বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-২৬ : স্বর্ণলতা / আলোকলতা

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: রবি, ১৬/০২/২০১৪ - ৮:৪০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সীমান্তরেখা ইছামতী। নদীর গতিপথকে অনুসরণ করে সাপের মত হেলেদুলে বয়ে গেছে প্রশ্বস্ত মেঠো পথ। দু’পাশে সোনালি, শিরিষ আর বাবলা ঝোপের আচ্ছাদন। ছোট ছোট বাবলা গাছের মাথায় যেন কাঁচা সোনার প্রলেপ দেয়া। গ্রিষ্মের হাহাকার ম্লান করে ঝিকিয়ে ওঠে সেই সোনার প্রলেপ। চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। প্রশান্তি দেয় মনকে। কিন্তু প্রদ্বীপের নীচের যেমন অন্ধকারের রাজত্ব, প্রকৃতির সেই সুবর্ণ প্রলেপের নীচেয় গুমরে মরে প্রকৃতির কন্যারা।


হ্যাঁ, পাঠক সোনার প্রলেপ বলতে আমি স্বর্ণলতা বা আলোক লতাকে বুঝিয়েছি। গ্রিষ্মের আগুন ঝরা দুপুরে গনগনে সূর্যালোক থেকে সবটুকু রং শুষে নিয়ে যেন স্বর্ণলতা নিজের গায়ে মাখে। স্বর্ণলতার এই সুবর্ণ রূপকে কাঁচা সোনা ছাড়া আর কার সাথেই তুলনা করবেন?


স্বর্ণলতা লতা জাতীয় বহুর্ষজীবি উদ্ভিত। পরজীবি। অন্য উদ্ভিদের গায়েই এর বসবাস। জীবন-ধারণের জন্যও নির্ভর করতে হয় অন্য উদ্ভিদের ওপর। বাংলার প্রায় সর্বোত্র এদের দেখা মেলে। সারা বছরই দেখা যায়। তবে গ্রীষ্ম কালে এদের সৌন্দর্য্যরে শতভাগ প্রস্ফুটন ঘটে।
স্বর্ণলতা আর দশটা পরজীবি উদ্ভিদের চেয়ে আলাদা। আলাদা আর দশটা লতার চেয়েও। স্বর্ণলতার পাতা-ফল হয় না। তবে শাখা প্রশাখা গজায় অবিশ্বাস্য দ্রুততায় অবিশ্বাস্য সংখ্যায়।


বলার অপেক্ষা রাখে না, স্বর্ণলতা রং সোনালি। লতা বা শাখা-প্রশাখা অত্যান্ত নরম ও রসালো। মসৃণ। খুবই চিকন। লতার বেড় ২-৩ মিলিটার হয় মাত্র।


আগেই বলেছি, স্বর্ণলতায় ফল পাতা হয় না। তবে ফুল হয়। লতার গায়ে ২-৩ ইঞ্চি দূরে দূরে গিঁট থাকে। সেই গিঁট থেকে স্বর্ণলতার ফুল বের হয়। খুব ছোট ছোট। কলসাকৃতির। ফুলের রং সাদা, কলসের মাঝখানে হলুদ রঙের কিশোর থাকে।


প্রতিটা গিঁট থেকে একটা করে পুষ্প মঞ্জরি বের হয়। মঞ্জরি বহুপষ্পক।


স্বর্ণলতার ফল বা বীজ হয় না তাই এদের বংশবৃদ্ধি ঘটে অঙ্গজ প্রজননের মাধ্যমে। আমার কাছে পাথরকুচি আর লজ্জাবতীর মত স্বর্ণলতাও আশ্চর্য উদ্ভিদ। সেটা এর বংশবিস্তার পদ্ধতির কারণেই। কোনো গাছের মাথা থেকে স্বর্ণলতার একটু অংশ ছিঁড়ে অন্য কোনো গাছের মাথায় ফেলে দিলেই কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সেই গাছের জেঁকে বসে স্বর্ণলতা।

সাধারণত রাখাল আর শিশু-কিশোরদের মাধ্যমেই স্বর্ণলতার বংশ বিস্তার ছড়িয়ে পড়ে দূর দূরান্তে। এক গাছ থেকে স্বর্ণলতা ছিঁড়ে ছড়িয়ে দেয় দূর-দূরান্তের কোনো ঝোপ কিংবা গাছের ওপর। ওরা এটাকে মজার খেলা হিসেবেই নেয়। ছোটবেলায় আমিও খেলেছি এই মজার খেলা।
ঠিক শিকড় বলতে যা বোঝায় স্বর্ণলতার তেমন শিকড় থাকে না। তবে এক গাছ থেকে আরেক গাছে ফেলার পর এর গায়ে একধরনের তন্তু গজায়। সেই তন্তুই আঠার মত গেথে দেয় আক্রান্ত গাছের গায়ে। স্বর্ণলতা যে গাছের মাথায় নিজের আধিপত্য বিস্তার করে সেই গাছের ওপরই খাদ্যনির্ভর হয়ে বেঁচে থাকে। পোষক গাছ থেকে রস শোষণ করে জীবন ধারণ করে। স্বররণলতার খাদ্য যোগাতে গিয়ে ধীওে ধীওে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যায় আক্রান্ত গাছ। আশ্রয়দাতাকে তীলে তীলে শেষ কওে দেয় বলে এর ইংরেজি নাম Devis Hair বা শয়তানের চুল।
স্বর্ণলতা বা আলোকলতার বৈজ্ঞানিক নাম : Cuscuta Reflexa

আগের পর্ব : বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-২৫ : কার্পাস তুলা


মন্তব্য

দীনহিন এর ছবি

আপনার এই সিরিজের কোন লেখা মিস করি না, যদি মিস হয়েই যায়, তবে পড়ে নেই পুরনো পাতায় যেয়ে!
খুব পুচকে হয়ে গেছে এবারের পর্বটা, তবে শেষের যে ছবিটা দিয়েছেন, তা অনবদ্য! আর আশ্রয় গাছ সত্যি সত্যি মরে যায় নাকি?? 'শয়তানের চুল' মোটেই ভাল নামকরন হয় নাই! ইংরেজরা দিয়েছে এই নাম? তো তারা এত্ত সুন্দর-সভ্য হয়েছে কি করে? তারা শুষলে দোষ নাই? স্বর্নলতা শুষলেই সে হয়ে যায় ডেভিলস হেয়ার?

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

অতিথি লেখক এর ছবি

ঠিক ই বলেছেন ।

আশালতা এর ছবি

এইটা একটা খুবই পাজি টাইপ গাছ এটুকু জানি, কিন্তু কোন কাজে টাজে লাগে কি?

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

এক লহমা এর ছবি

দেখতে সুন্দর, নাম-ও পেয়েছে বাহারী, কাজে একেবারে পুরাই শয়তান! হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

স্পর্শ এর ছবি

উত্তম জাঝা!
রসাল ও স্বর্ণলতিকা কবিতাটার কথা মনে পড়ে গেল।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

সেইম।

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

গ্রিষ্মের> গ্রীষ্মের
সর্বোত্র > সর্বত্র
সৌন্দর্য্যরে> সৌন্দর্যের
এমন কিছু টাইপো আছে, ঠিক করে দিলে পড়তে আরাম লাগবে।
আমারও মাঝে মাঝে টাইপো হয় তো তাই আজকাল সতর্ক থাকার চেষ্টা করছি। হাসি

এবারের লেখাটা আসলেই ছোট হয়ে গেছে।
স্বর্ণলতার নাম যে সত্যি সত্যি ইংলিশে শয়তানের চুল জানতাম না, আমাদের এলাকায় ছোটতে এমনি আমরা দুষ্টুমি করে স্বর্ণলতাকে ভুতের চুল নামে ডাকতাম। ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়ে গেল।

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

আপনার এই সিরিজের সব লেখাগুলো পড়া হয়ে ওঠেনি । সিরিজের শুরুর দিকে একবার বলেছিলাম, আবারও বলি, আপনার এই সিরিজটি সচলায়তনে একটি মুল্যবান সংযোজন । চলুক

তারেক অণু এর ছবি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।