সীমান্তরেখা-৬

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: সোম, ০৩/০৩/২০১৪ - ৬:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সীমান্তরেখা-১, সীমান্তরেখা-২, সীমান্তরেখা-৩, সীমান্তরেখা-৪ সীমান্তরেখা-৫

ষষ্ঠ অধ্যায়

সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে দেড়ের বিশাল উঠোনে। কাদা অবশ্য তেমন জমেনি। তবু ভেজা মাটির রস যাতে অভ্যাগতদের কাপড় নোংরা না করতে পারে সেজন্য পাতা হয়েছে বড় একটা চট। একে একে শ’ দুয়েক লোকের জমায়েত তো হয়েছেই। নেংটা ছেলেপুলের হিসাব করলে সংখ্যাটা চার শ’ ছাড়িয়ে যাবে সন্দেহ নেই। অন্যদের হিসবে না থাকলেও মোজাম দেড়েকে হিসেব কষতেই হয়েছে, তবারকের ঘাটতি যাতে না পড়ে। ঘাটতি অবশ্য পড়বে না। মুক্তার ময়রাকে ডেকে এনে রান্নাঘরেই বসানো হয়েছে তবারকের জিলাপি বানানোর সরঞ্জাম। সব মিলিয়ে শ’ পাঁচেক লোকের হাতে যাতে তবারক তুলে দেয়া যায় তেমন নির্দেশ দেয়া আছে মুক্তার ময়রার। পয়সাটা যখন ঘর থেকে যাচ্ছে না--সংখ্যাটা একটু কম-বেশি হলে দোষ কী।
ছ’বস্তা চিনি চার হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। ব্ল্যাকের চিনি তো আর মোজাম দেড়ে হজম করতে পারেন না--আল্লাহ টাকা-কড়ি তাঁর কম দেননি। কিন্তু টাকাগুলোর তো একটা সদগতি করা চাই। তখনি মনে আসে বটতলার ফকির বাবার কথা। বড্ড রুষ্ট হয়েছেন তিনি। তার স্যাঙাতরা যে জ্বালাতন করছে একটা মিলাদ মহাফিল না করলেই নয়। তাই এই আয়োজন। ডেকে এনেছেন এলাকার সবচে কামেল ইমাম মাইলবাড়িয়ার কেরামত হুজুরকে। উনি খাস দিলে দোয়া করলে যদি ফকিরবাবার রোষ প্রাশমন হয়।
লোক সমাগম বাড়তে শুরু করেছে। হুজুর এতক্ষণ হামদ-নাত গাইছিলেন। যথেষ্ট জন-সমাগম হয়েছে বুঝতে পেরে হুজুর গলার স্বরটাও বাড়ালেন। মাইক অপারেটরও বাড়িয়ে দিল মাইকের ভলিউম। হুজুর বয়ান করছেন আর মাঝে মাঝে শ্রোতাদের উদ্দেশে বলছেন--‘জোরে বলুন সোবানাল্লাহ।’
শ্রোতারাও সমস্বরে বলে উঠছে--‘সোবানাল্লাহ।’
তেমিন হুজুর কখনো বলছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, তখনও মুসুল্লিদের বলতে হচ্ছে সোবানাল্লাহ। মাঝে-মাঝে হুজুর শ্রোতাদের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন, ‘জোরে বলুন ঠিক কি না।’
ঠিক নয় এ কথা বলার ধৃষ্টতা বা বিদ্যা-বুদ্ধি কারো নেই। হুজুরের কথাটাকে শিরোধার্য মেনে তারা বলছে, ঠিক, ঠিক। কিন্তু হুজুর আওয়াজটা পছন্দ করলেন না। তাঁর ধারণা, মুসিল্লিরা আরো জোরে আওয়াজ দিতে পারে, কেউ কেউ হয়তো আওয়াজ করছেই না। তিবি আবার হাঁকলেন, ‘শুনিনি, আবার বলুন ঠিক কি না?’
এবার আওয়াজটা অনেক জোরালো হল। হুজুর বোধহয় এমন আওয়াজই চাইছিলেন।
এরপর হুজুর নাস্তিকদের নরক-গুলজার, ইহুদি-নাচারাদের শাপ-শাপান্ত, আমেরিকা-ভারতের গালিগালাজ আর হিন্দুদের চোদ্দগুষ্ঠির শ্রাদ্ধ করে মুসুল্লিদের আহবান করলেন তিনবার সুরা এখলাস, তিনবার দরুদ শরীফ আর এগারো বার সুরা ফাতেহা পড়ার জন্য। তারপর ধরলেন মোনাজাত।

হাবুডাগা মজলিশে এসেছিল একটু দেরি করেই। হুজুর তখন বয়ানের মাঝপর্যায়ে। হুজুরের সুর চাপা দিয়ে বেজে ওঠে মোজাম দেড়ের গমগমে গলা, ‘হাবু, এইছিস?’
‘জ্বী, চাচাজি।’ হাবুর নির্ভক উত্তর।
‘না আলি আইজ তোর কপালে কষ্ট ছেল রে হারামজাদা! যাক, বইস। দেখা না কইরে ফুস কুইরে চলে যাসনে যেন, তবারকের ব্যবস্থা আছে।’
হাবু অন্ধকারে মুখ ডুবিয়ে মোজাম দেড়েকে আড়াল করে মুচকি হাসে। নিঃশব্দ এই হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে ধৃষ্টতা, প্রভাবশালীকে বোকা বানাতে পারার আত্মতৃপ্তি।

হুজুর মোনাজাত ধরেছেন, ‘ইয়া আল্লাহ তোমার কতিপয় গোনাহগার বান্দা তোমার দরবারে হাত উঠিয়েছে, ইয়া আল্লা তুমি খাস করে তাদের দোয়া কবুল করো। ইয়া মাবুদ, আমরা তিনবার সুরা এখলাস পড়েছি মাবুদ, তিনবার দরুদ শরীফ আর এগারো বার সুরা ফাতেহা পাঠ করেছি, এই দোয়া তুমি মদীনায় মুহাম্মদ (সঃ)-এর রওজা মোবারকে পৌঁছে দাও। ইয়া আল্লাহ, এই দোয়া-কালামের ওছিলায় তুমি আমাদের সমস্ত গোনাহ-গাথা মা-আ-ফ করে দাও। ইয়া আল্লা, তুমি আমদের আসমানি বালা জমিনি বালা থেকে দূরে রাখোওও... হে আল্লাহ, আমাদের অনেকের বাবা-মা কবরে শুয়ে আছে, তাঁরা বেঁচে থাকতে সজ্ঞানে, অজ্ঞানে কত গোনাহ ক-রে-ছে...’ খোঁৎ খোঁৎ উঠল হুজুরের কণ্ঠস্বর। কিছুক্ষণ চোখের পানি ঝরালেন। মজিলিশিদের বেশিরভাগের মন আর্দ্র হয়ে উঠল। হুজুরের মতো কেউ কেউ মৃত-বাবা মায়ের কথা মনে করে হাউ-হাউ করে কেঁদ উঠল। ‘ আল্লা, তাঁরা অনেক নেক আমলও করেছে,’ কান্না চেপে ফোঁপাতে ফোঁপাতে আবার শুরু করলেন হুজুর। ‘ইয়া মাবুদ, তাঁদের সেই নেক আমেলের উছিলায় তাদের সমস্ত গোনা-গাথা মাফ করে দা-ওও...’ এবার ডুকরে কেঁদে উঠন হুজুর। কান্নার একটা রোল পড়ে গেল গোটা মজলিশে। ঠিক তখনই হুজুরের গলাটা চেপে ধরল ভয় নামের দানবটা। পিনপতন নীরবতায় আচ্ছন্ন হল গোটা সভাস্থল। খুব কাছে--মোজাম দেড়ের সারগাদার পাশে যে বড় বাতাবীলেবু গাছটা, সেখান থেকে ভেসে এলো বটতলার সেই ভূতশিশুর করুণ কান্না। মিনিটখানেক পর মৃদু একটা গুঞ্জন উঠল মজলিস থেকে। কিন্তু সাথে তুমুল হুটোপুটির শব্দ ত্রাস হয়ে ধেয়ে এলো আবরো। নীরব হল জনতা। বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে পালাবার উপক্রম করল সবাই।
ও দিকে হুজুর--যাকে ডাকাই হয়েছে মূলত এই বজ্জাৎ জ্বীনগুলো এলাকা ছাড়া করতে--তিনিই এবার পালাবার পথ খুঁজছিলেন। কিন্তু বেইজ্জতি হতে হবে ভেবে নিজেকে নিবৃত করলেন। দোয়া ইউনিস পড়ে যাচ্ছিলেন সমানে। তাতেও যখন কাজ হলো না, সূরা ইয়াসিন পড়লেন, মজলিসিদের পড়তে অনুরোধ করলেন। কিন্তু মজলিস তখন ভণ্ডুলপ্রায়। হাবুডাগা উঠে গিয়ে হুজুরের কাছ থেকে মাইক্রোফনটা চেয়ে নিল। ‘কেউ যাবেন না আপনারা, বটতলার জ্বেন-ফকির আমি ধইরে এনিছি। কেউ যাবেন না।’
থমকে দাঁড়াল পলায়নরত মজলিস। ডাকাবুকো মোজাম দেঁড়ে পর্যন্ত ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তোতলাতে তোতলাতে বললেন, ‘কী বলছিস তুই, হাবু। বটতলার ফকিরবাবাকে ধইরে এনিচিস মানে?’
‘জ্বী চাচা। আমার সাথে নিমতলায় আসলিই দেখতি পাবেন।’
হাবুডাগার সাথে নিমতলায় যাবার মত সাহসটুকুও তখন অবশিষ্ট নেই মোজাল দেড়ের। হাবুডাগা জোসনার প্লাবন সাঁতরে একাই চলল নিমতলার দিকে। গাছের মগডাল থেকে পেড়ে আনল একটা পাখির খাঁচা আর একটা শিকলে বাঁধা গুইসাপ। গুইসাপটা ইয়াবড়, রীতিমত একটা কমাডো ড্রাগন।
‘হুজুর দেখেন-এই যে চাচাজী, এই হইল আপনার বটগাছের ফকিরবাবা।’
‘কী আশ্চর্য,’ চোখ কপালে তুলে বলেন মোজামদেড়ে। হতভম্ভের মত চেয়ে থাকেন কিছুক্ষণ হাবুডাগার দিকে।
‘হুজুরের চেহারা থেকেও ঝরে গেছে ভয়ের আস্তরণ। তবে ফুটে উঠেছে অস্বস্তির বলিরেখা। মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।’
‘এই গুইহ্যাঙ্গেড়ডা বটগাছে ঝাঁপট মারে, আবার মুখ খোলে হাবুডাগা। আর শগুনির বাইচ্চাডা কান্দে মানষির মতন।’
হাবুডাগাকে সমর্থন করতেই যেন সেইসময় কেঁদে ওঠে শকুনছানাটা। রক্ত হীম করা তীক্ষ্ণস্বরে। আরেকবার শীতল শিহরণ বয়ে যায় মজলিশে। মোজাম দেড়ে কটমট করে তাকায় হুজুরের দিকে।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

তরু-লতা-গুল্মের বাইরে আসার সময় হলো তাহলে?

---ইমরান ওয়াহিদ

মহিউদ্দিন ডালিম এর ছবি

বুঝতে পারিনি, পুরো সিরিজ পড়তে হবে মনে হয় ।

মেঘলা মানুষ এর ছবি

রনি ভাই, লেখাগুলো একটু তাড়াতাড়ি দিন।
তা না হলে মন থেকে আগের রেখা টা ঝাপসা হতে হতে মুছেই যাচ্ছে।
আপনার আগের লেখাটা (পর্ব ৫) দিয়েছিলেন ০৭/০৮/২০১৩
মাঝখানের ৯ মাসে সব ভুলে গিয়েছি কি কি পড়েছিলাম।

ভালো থাকুন, শুভেচ্ছা হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।