দুনিয়া কাঁপানো ছয় দল

সুহান রিজওয়ান এর ছবি
লিখেছেন সুহান রিজওয়ান (তারিখ: মঙ্গল, ০২/০৮/২০১১ - ৯:৫৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কালো মাণিক পেলে বেশি ভালো খেলতেন, নাকি ফুটবল ঈশ্বর ম্যারাডোনা ?? মিশেল প্লাতিনি তুলনামূলক কতটা এগিয়ে জিনেদিন জিদানের চাইতে, অথবা পিছিয়ে ?? ১৯৭০ এর ব্রাজিল বেশি ভালো, না ১৯৫৪ এর হাঙ্গেরী ?? স্বপ্নের দল হিসেবে ক্রুইফের বার্সেলোনা না সাচ্চির মিলান- কোন দলটি এগিয়ে ?? ... ভিন্ন সময়ের- ভিন্ন প্রজন্মের খেলোয়াড় বা দলগুলোর মাঝে তুলনা করা যে তুলনা করা যে শুধু খুব কঠিন, তা নয়। বরং বলা যায়, এটি প্রায় অসম্ভব।

তারপরেও সমর্থকেরা তুলনা করে, প্রাক্তন খেলোয়াড় বা ধারাভাষ্যকারেরা তুলনা করেন- সাংবাদিকেরা দিস্তা দিস্তা কাগজ উড়ান। সর্বকালের সেরা ফুটবল দল কোনটি ?? আরেকটু স্পষ্ট করে প্রশ্নটা করলে, ক্লাব পর্যায়ে সর্বকালের সেরা দল কোনটি ?? প্রশ্নটা এইভাবে করায় ভুরু কুঁচকাতে পারে অনেকে- পালটা প্রশ্ন আসতে পারে; কেন কেবল ক্লাব দল- জাতীয় দল নয় কেন ?? সবিনয়ে জানাই, এই প্রশ্নের কোন যথোপযুক্ত উত্তর দেবার মতো ধৃষ্টতা আমি রাখি না। আন্তর্জাতিক ফুটবলে যেখানে সারা বছর জুড়ে ক্লাব পর্যায়ের ফুটবল ক্যালেন্ডার ব্যস্ত থাকে- সেই সময়ের ফুটবল দর্শক হিসেবে ‘সেরা দল’ শব্দদ্বয়ের সাথে আমার প্রতি বছর হাতে গোণা কয়েকটা ম্যাচ খেলা জাতীয় দলগুলোকে রাখা মানানসই বলে মনে হয় না।

নানা মত যাচাই বাছাই করে ফুটবল বোদ্ধারা সর্বকালের সেরা দলের ক্ষুদ্রতম তালিকায় তুলে এনেছেন ছয়টি দলকে। এদের মাঝেও পার্থক্য অনেক। কেউ হয়তো সময়ের বিস্তারে অপেক্ষাকৃত বেশি দিন সফল, কেউ হয়তো ট্রফির সংখ্যায় এগিয়ে, কারো আবার প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথের ব্যবধানটুকু বিস্তর। তবে এইটুকু নিশ্চিত, এখনো পর্যন্ত সর্বকালের সেরা ক্লাব দল নির্ধারণ করতে হলে প্রতিযোগীদের তালিকায় রাখতে হবে এই ষষ্ঠককেই। এই লেখার আলোচনা তাই সীমাবদ্ধ থাকলো এদের মাঝেই।

রিয়াল মাদ্রিদ (১৯৫৫-৬১)- অপরাজেয় ফুটবল দল

সর্বকালের সেরা ক্লাবদলগুলোর মাঝে যেটি সবচেয়ে প্রাচীনতম, সেটি গঠনের কাজ শুরু হয়েছিলো ১৯৫৩-৫৪ মৌসুমে। ক্ষুরধার ফুটবল মস্তিষ্কের যে লোকটি শুরু করেছিলেন এই দুনিয়া কাঁপানো দল গঠনের কাজ, দুনিয়াজোড়া ফুটবল ভক্তদের প্রায় প্রত্যেকেই জানেন তার নাম- হয়তো একটু ভিন্নভাবে। হ্যাঁ, রিয়াল মাদ্রিদের বর্তমান হোমগ্রাউন্ড স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে সেই সান্তিয়াগো বার্নাব্যু ইয়াস্তের নামেই। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের পর জৌলুস হারিয়ে ফেলে ধুঁকতে থাকা রিয়াল মাদ্রিদের জন্যে এই ম্যানেজার ঠিক করলেন নয়া কৌশল- প্রায় আধাশতাব্দী পরে ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ যে পথ আবারো অনুসরণ করেছিলেন। অর্থাৎ, রিয়াল মাদ্রিদকে ‘নক্ষত্রপুঞ্জ’ করে গড়ে তোলা।

সেই লক্ষ্যেই কলম্বিয়ান ক্লাব মিলানোরিস থেকে উড়িয়ে আনা হলো জাদুর কাঠি (নাকি পা ??)ওয়ালা এক আর্জেন্টাইনকে- যার নাম আলফ্রেড ডি স্টেফানো। স্টেফানো এলেন। এলেন ফুটবল ইতিহাসের আরেক মাস্টার ম্যাজেশিয়ান, ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্সের হাঙ্গেরীর প্রণেতা- ফেরেঞ্চ পুসকাস। আরো আছেন ইতিমধ্যেই স্প্যনিশ সংবাদমাধ্যমে ‘কান্টাব্রিয়ান সাগরের ঝড়’ উপাধি লাভ করা স্ট্রাইকার ফ্রান্সিসকো জেন্টো। বড় নামের মাঝে আরো ছিলেন রক্ষণের মিগুয়েল মুনোজ আর মাঝমাঠের হেক্টর রিয়াল। দল প্রস্তুত, যাদের অস্ত্র- আশ্চর্য সুন্দর ফুটবল; যাদের লক্ষ্য- বিশ্বজয়।

সে এক এমনই বিজয় অভিযান, যার সামনে রীতিমতো উড়ে গেলো বিশ্বের বাকি ফুটবল দলগুলো। ১৯৫৫ থেকে শুরু করে পরের ১১ বছরে ৮ বার স্প্যানিশ লীগের শিরোপা ঘরে তুললো রিয়াল মাদ্রিদ। থেমে রইলো না এখানেই। এখনকার উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের পূর্বরুপ ইউরোপিয়ান কাপের প্রথম পাঁচ আসরের পাঁচটিই (১৯৫৬- ১৯৬০) টানা গেলো মাদ্রিদের ট্রফির তাকে। এই দলের স্বর্ণযুগের হাইলাইটস চাইলে ১৯৬০ সালের হ্যাম্পডেন পার্কের ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালের কোন দর্শককে খুঁজে বের করুন। ৭-৩ ব্যবধানে এইন্ট্রাক্ট ফ্র্যাঙ্কফুর্টকে রীতিমতো কাঁদিয়ে ছেড়েছিলো মাদ্রিদ। চার গোল করে পুসকাস হারিয়ে দিয়েছিলেন তিন গোল করা ডি স্টেফানোকে।

ফুটবলীয় সৌন্দর্য বাদ দিয়ে তাই কেবল ট্রফি সংখ্যার হিসাব করলেও, স্টেফানোর রিয়াল মাদ্রিদ বলতে গেলে অনতিক্রম্য।

আয়াক্স (১৯৭০-৭৩)- টোটাল ফুটবলের যাদুকরেরা

‘ব্যাটা হয় জিনিয়াস, নয় তো বদ্ধ উন্মাদ !! ’- রাইনাস মিশেলের সম্পর্কে এই ধরণের মনোভাব পোষণ করা লোকের সংখ্যা নেহাত কম ছিলো না। ফুটবলের তো নিয়মকানুন কিছু আছে, নাকি ?? ডিফেন্ডার রক্ষণের কাজ করবে, মিডফিল্ডার আক্রমণের বল যোগাবে আর স্ট্রাইকার গোল দেবে- এই তো ফুটবল খেলা। মিলিটারী কায়দায় কোচিং করানো রাইনাস মিশেল এই ধারণাটা পালটে দিলেন, চালু করলেন ‘টোটাল ফুটবল’ নামের এক কায়দা। সেই কায়দাতেই ভর করে কি না, কে জানে- ১৯৬৯-৭০ এর ডাচ লীগ জিততে কোন সমস্যা হলো না আয়াক্সের। এমনকি, সেই মৌসুমেই ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে অভিজ্ঞ এসি মিলানের মুখোমুখি হলো আয়াক্স। ৪-১ গোলে আয়াক্সকে মোটামুটি অনায়াসে পরাজিত করে দিলো মিলান।

রাইনাস মিশেল ভুল থেকে দ্রুত শিক্ষা নিলেন। নতুন করে ঢেলে সাজালেন আয়াক্সকে। সেই লক্ষ্যেই ডিফেন্ডার রুদ ক্রল আর মিডফিল্ডার গ্যারি মুরেন আয়াক্সের যুব ফুটবল একাডেমী থেকে মূল দলে এলেন। তবুও মিলানের সাথে পরাজিত আয়াক্সের একজন স্ট্রাইকারকে ঘিরেই আবর্তিত হলো দলের যাবতীয় ছক কাটা। তার নাম ইয়োহান ক্রুইফ। পরের তিন বছরে যথাক্রমে প্যান্থিনাইকোস, ইন্টার মিলান আর জুভেন্টাসকে হারিয়ে টানা তিনবার ইউরোপ সেরার মুকুট পড়লো আয়াক্সেরা। এই সময়ে তাদের ট্রফিকেসে আরো উঠলো তিনটা ডাচ লীগ, তিনটা ডাচ কাপ, একটা করে ইউরোপিয়ান সুপার কাপ, ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ ও উয়েফা সুপার কাপ। বিশ্ব ফুটবল তখন অবাক বিস্ময়ে দেখছে নতুন এক ফুটবল দর্শনের এই ভয়াল সুন্দর রুপ।

কি ছিলো এই ‘টোটাল ফুটবল’ ?? ছিলো অফুরন্ত প্রাণশক্তি আর পারষ্পরিক সমঝোতার এক দারুণ মিশ্রণ। প্রজাপতির মতো মাঠময় ছুটে বেড়াতেন আয়াক্সের ফুটবলারেরা, কারো কোন নির্দিষ্ট জায়গা নেই। স্ট্রাইকার যেমন দলের প্র্য়োজনে রক্ষণে নেমে আসছেন- দরকারে আক্রমণে উঠে যাবেন তেমনি ডিফেন্ডার, তার জায়গা দখল করে নেবে কোন মিডফিল্ডার।

রাইনাস মিশেল ১৯৭১এ বার্সেলোনার উদ্দেশ্যে ব্যাগ গোছানোর পরে ক্রুইফেরও বিদায় ঘটলো আয়াক্স থেকে। নতুন কোচ সরে আসলেন এই ‘টোটাল ফুটবল’ নামের নিয়ম ভাঙ্গা ফুটবল থেকে। ৭৩-৭৪ মৌসুমে ক্রুইফের বার্সেলোনায় চলে যাবার পরেই তাই কার্যত ভেঙ্গে পড়লো আয়াক্সের এই দুর্দমনীয় দলটি. রাইনাস মিশেলকে গত শতাব্দীর সেরা ফুটবল কোচ নির্বাচন করে, ফিফা তাই যেন বিনীত শ্রদ্ধা জানিয়েছিলো এই দলটির প্রতিই।

লিভারপুল (১৯৭৬-৮২)- আক্রমণাত্বক ফুটবলের শেষ কথা

সারা ক্যারিয়ার “ইউ উইল নেভার ওয়াক এলোন!!” গাইবার পরেও একদিন বিল শ্যাঙ্কলি ওয়াক করলেন, নিজেই। ক্লাব ইতিহাসের তখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল এবং জনপ্রিয় ম্যানেজারের পদত্যাগে হতাশ এনফিল্ডপ্রেমীদের সামনে বিল শ্যাঙ্কলির চাপাচাপিতেই ক্লাবকর্তারা ক্লাবের ভার তুলে দিলেন রবার্ট পেইসলির হাতে। কেউ জানতো না, লিভারপুলের ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশটুকু লিখতে চলেছেন এই বব পেইসলিই।

প্রথমে কেভিন কিগান, রে কেনেডিদের নিয়ে; এবং পরে টেরি ম্যাকডারমট, কেনি ডালগ্লিস আর ইয়ান রাশদের মতো তরুণদের নিয়ে বব পেইসলি গড়ে তুললেন এক অজেয় দল। সেই সময়টায় বেকেনবাওয়ার আর জার্ড মুলারের সৌজন্যে ইউরোপ কাঁপাচ্ছে বায়ার্ন মিউনিখ। বব পেইসলির লিভারপুল ১৯৭৭ সালের ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে হারিয়ে দিলো সেই বায়ার্ণকেই। পেইসলি সেই রাতেই বলেছিলেন ফুটবল ইতিহাসে ঢুঁকে পড়া তার সেই বিখ্যাত উক্তিটি, “ এই নিয়ে দ্বিতীয়বার ওদের হারালাম আমরা। প্রথমবার হারিয়েছিলাম ১৯৪৪- এ !!”

বিস্ময়করভাবে এফ-এ কাপ কখনোই জিততে পারেনি পেইসলি যুগের লিভারপুল। এই সামান্য আক্ষেপটুকু বাদ দিলে প্রাপ্তির ভাঁড়ার প্রায় পূর্ণ বব পেইসলির। তারা জিতেছিলো চারটা ইংলিশ লীগ শিরোপা, তিনবারের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ানশিপ, তিনবারের ইউরোপিয়ান কাপ, একটা করে উয়েফা কাপ ও উয়েফা সুপার কাপ। [ সমসাময়িক ব্রায়ান হাওয়ার্ড ক্লফ নামের আরেক জিনিয়াস ম্যানেজারের জন্ম না হলে হয়তো প্রাপ্তির খাতাটা আরো বড় হতো বব পেইসলির, কিন্তু সে গল্প আরেকদিন করা যাবে।]

আক্রমণাত্বক ফুটবলের সাথে কখনো আপোস না করা বব পেইসলি বিখ্যাত ছিলেন তার ঠোঁটকাটা স্বভাবের জন্যেও। সবসময়েই তিনি বলতেন, “Football is a beautiful game & should be played in a beautiful way .”। লোকে বলে, পেইসলি কথা রাখতে জানতেন !!

এসি মিলান (১৯৮৮-৯১)- ডাচ ত্রিভুজে বিশ্বজয়ী

সিলভিও বার্লুসকোনি লোকটা টাকার কুমীর, জানেন সবাই। কিন্তু আরিগো সাচ্চি কোচ হিসেবে কেমন ?? ‘মিলানকে সাফল্য এনে দেবার মতো হাই-প্রোফাইল কোচ নয়’, এই মতটাই শোনা গেলো জোরেশোরে।
টাকা থাকলেই চলে না, দল হয়ে উঠতে হলে দরকার একটা পরিণত ফুটবল মস্তিষ্ক। আরিগো সাচ্চি সাইন করালেন স্পোর্টিং লিসবনের ডিফেন্ডার ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ডকে, সাচ্চির হাতের ছোঁয়ায় যিনি জন্ম দিলেন কালজয়ী এক হোল্ডিং মিডফিল্ডারের। প্রজন্মের সেরা কল্পনাশক্তি সম্পন্ন মিডফিল্ডার রুড খুলিতও এই দলের অংশ। সেই সাথে আরো একজন, ইতালিয়ান টিভিতে যার ড্রিবলিংয়ের সাথে তুলনা করে নাকি একবার দেখানো হয়েছিলো ব্যালে নর্তকীদের নাচ; ফন বাস্তেন। বিশ্বজয়ের জন্যে মিলানের এই ডাচ ত্রিভুজ ছিলো যথেষ্টর চাইতেও বেশি। সাথে যোগ করুন রক্ষনভাগের ফ্রাঙ্কো বারেসি, পাওলো মালদিনি আর আলেসান্দ্রো কোস্ত্রাকুর্তার নাম। মিলান রক্ষণ ভাঙ্গার চেয়ে চীনের প্রাচীর গুঁড়ানো স্ট্রাইকারদের জন্যে সহজ।

এই দল নিয়ে সাচ্চির প্রথম বড় সাফল্য এলো প্রথম মৌসুমেই। ম্যারাডোনা যাদুতে বলীয়ান নাপোলিকে পিছনে ফেলে ইতালিয়ান সিরি-আ হলো তাদের। সেই বছরেই ইউরোপিয়ান কাপের সবচেয়ে একতরফা ফাইনালগুলোর একটির জন্ম দিয়ে ৪-০ গোলে স্টুয়া বুখারেস্টকে উড়িয়ে দিলো মিলান। এমনকি পরের বছরেও বেনফিকাকে হারিয়ে টানা দ্বিতীয় ইউরোপিয়ান কাপ জয় করলো রোজেনারিরা। এই বছরেই ইতিহাসে প্রথম বারের মতো ফিফা ব্যালন ডি’অর পুরষ্কারের জন্যে মনোনীতদের শীর্ষ তিন ফুটবলার নির্বাচিত হলেন একই ক্লাব থেকে। ক্লাবটি এসি মিলান, খেলোয়াড় তিনজন সেই বাস্তেন-খুলিত-রাইকার্ড।

সাচ্চির প্রস্থানের পরেও মিলানের সাফল্যধারা রইলো অক্ষুণ্ণ। ফ্যাবিও কাপেলোর হাত ধরে মিলান ৯১-৯২ মৌসুমে তারা অপরাজিত রইলো টানা ৫৮ ম্যাচ, ফুটবল ইতিহাসে পরিচিত হলো ‘দা ইনভিন্সিবল’ নামে। টানা তৃতীয় বারের মতো ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে উঠে মিলান হেরে গেলো অলিম্পিক মার্সেইয়ের কাছে। এসি মিলানের সুসময় ফুটবল বিশ্ব দেখেছে এরপরেও অনেকবারই, কিন্তু সাচ্চির সেই ডাচ ত্রিভুজের কল্যাণে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়া ঔজ্জ্বল্য আসেনি আর এরপরের কোন ট্রফিতে।

বার্সেলোনা (১৯৯১-৯৪)- ক্রুইফের স্বপ্নের দল

নিজে খেলেছেন শতাব্দী সেরা কোচ রাইনাস মিশেলের অধীনে, টোটাল ফুটবলের আয়াক্স দলের কান্ডারী হয়ে ছিলেন, ১৯৭৪ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডের ‘ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ’ দলের হয়ে বিশ্বের অগণিত ফুটবল সমর্থকের হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ইয়োহান ক্রুইফের নিজের হৃদয়টা বাঁধা পড়ে গেলো স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনার কাছেই। নিজে খেলোয়াড় থাকাকালীন সময়েই এই ক্লাবের জন্যে তরুণ ফুটবলার গড়ে তুলতে ১৯৭৯ সালে সভাপতি জোসেপ নুনেজের কানে তোলেন যুব ফুটবল একাডেমী স্থাপনের প্রস্তাব। গড়ে উঠলো ‘লা মেসিয়া’- আজকের দিনের বার্সার খেলোয়াড় তৈরীর কারখানা।

১৯৮৯-৯০ মৌসুমে বার্সার ম্যানেজারের দায়িত্ব নিলেন ক্রুইফ। টানা পাঁচবার লা লীগা জয় করে তখন চিরকালের প্রতিপক্ষ রিয়াল মাদ্রিদ যোজন যোজন এগিয়ে। ইউরোপের মুকুট তখন সাচ্চির মিলানের মাথায়। ক্রুইফ ডেনমার্ক থেকে উড়িয়ে আনলেন মাইকেল লাউড্রপ নামের স্ট্রাইকারটিকে, নিজের হাতে গড়া একাডেমী থেকে মূল দলে আনলেন জোসেপ গার্ডিওলাকে, প্রজন্মের সবচেয়ে সেরা ডিফেন্ডারদের একজন- রোনাল্ড কোম্যানকে আনলেন বার্সা রক্ষণে। সালিনাস আগেই ছিলেন, পরে এসে যোগ দিলেন রিস্টো স্টয়চকভ। ‘স্বপ্নের দল’ প্রস্তুত।

টানা চার মৌসুমের লা লীগা শিরোপা এলো এই দলের ট্রফি কেসে। তারা জিতলো উয়েফা কাপ। ক্লাব ইতিহাসের সেরা তখন পর্যন্ত সেরা দিনটি এলো এই দলের হাত ধরেই। ১৯৯২, ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে, ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে। তখন পর্যন্ত অধরা হয়ে থাকা এই শিরোপা আর বার্সেলোনার মাঝে বাঁধা হয়ে ছিলো ইতালির সাম্পাদোরিয়া। রোনাল্ড কোম্যানের বহুদিন মনে রাখার মতো এক ফ্রি-কিকে প্রথমবারের মতো ইউরোপ সেরা হলো বার্সেলোনা।

এছাড়াও, তিনটি স্প্যানিশ কাপ সহ মোট এগারোটি শিরোপা চার বছরে ঘরে তুলেছিলো ক্রুইফের বার্সেলোনা। ফলশ্রুতিতে, ক্রুইফ বনে গেলেন ক্লাব ইতিহাসের সেরা ম্যানেজার। ইয়োহান ক্রুইফ তখনো জানতেন না ভবিষ্যতে সর্বকালের শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নে তাকে চ্যালেঞ্জ করে বসবেন তারই শিষ্য জোসেপ গার্ডিওলা!!

বার্সেলোনা (২০০৮-??)- পাসিং ফুটবলের আগ্রাসন

বিশ্বফুটবলে ২০০৬ সালে শেষ হলো রোনালদিনহো রাজত্ব। বলতে গেলে একক চেষ্টায় বার্সাকে লা লীগা ও উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ এনে দেয়া রোনির বিদায়ের পর লা লীগার মুকুট চলে গেলো রিয়াল মাদ্রিদের হাতে। বিদায় নিলেন ম্যানেজার ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড, যার রেখে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণ করতে ইয়োহান ক্রুইফের পরামর্শে ক্লাব কর্তৃপক্ষ নিয়োগ দিলেন সাবেক বার্সা মিডফিল্ডার পেপ গার্ডিওলাকে।

নিজেদের একাডেমী লা-মেসিয়া থেকে মূল দলে ততদিনে সদ্য নিয়মিত হয়েছেন মিডফিল্ডার আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা আর লিওনেল মেসি। পেপ গার্ডিওলা একাদশে নয়া সংযোজন হলেন পেদ্রো রড্রিগুয়েজ আর সার্জিও বুস্কেটস। জেরার্ড পিকে আর দানি আলভেজকেও ন্যু ক্যাম্পে আনলেন পেপ। দলে আগে থেকেই রয়েছেন বহু যুদ্ধের যোদ্ধা কার্লোস পুয়োল আর জাভি হার্নান্দেজ। দাঁড়িয়ে গেলো পেপ গার্ডিওলার দল।

প্রথম মৌসুমে মাঠে নেমেই ইতিহাস গড়লেন পেপ। এক মৌসুমে সম্ভাব্য যে ছয়টি শিরোপা জেতা সম্ভব, সে ছয়টিই (লা লীগা, কোপা ডেল রে, স্প্যানিশ সুপার কাপ, উয়েফা সুপার কাপ, ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ এবং উয়েফা চ্যাম্পিয়স লীগ) জিতে নিলো বার্সেলোনা। এর আগে এই কীর্তি করে দেখাতে পারেনি কোন ক্লাবই। পরের দুই মৌসুমে আরো দুইবার লা লীগা, একবার করে স্প্যানিশ সুপার কাপ ও চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জিতে নেয়ায় গার্ডিওলার অর্জিত ট্রফি সংখ্যা এখনো পর্যন্ত দশ।

গার্ডিওলার বার্সেলোনার খেলবার ধরণটা নেহাতই সরল। পাস, পাস এবং পাস। বল পায়ে রেখেই প্রতিপক্ষকে আক্রমণে ব্যস্ত করে গোলমুখ খুলে দেয়া। ক্লাব ফুটবলের কিংবদন্তী ম্যানেজার স্যার এলেক্স ফার্গুসন তো ২০১১ ফাইনালে বার্সেলোনার কাছে পরাজয়ের পর বলেই বসলেন, তার ২৫ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি এই দলের চেয়ে ভালো কোন দলের বিপক্ষে খেলেন নি।

তারমানে সাচ্চির মিলান কি ক্রুইফের বার্সেলোনার চেয়ে এই বার্সা এগিয়ে ?? মৃদুভাষী ম্যানেজার পেপ বলেন, ‘আমরা জানি না আমরাই সর্বকালের সেরা দল কি না। তবে আজ থেকে ১০-১৫ বছর লোকে যদি আমাদের মনে রাখে; তবে সেটাই আমাদের বড় প্রাপ্তি।’

***** ******* ********
সর্বকালের সেরা ছয়টি ক্লাব দলের সম্পর্কে এই হলো অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনা। সন্দেহাতীত ভাবেই, কে সেরা তা নির্ণয় বলতে গেলে অসাধ্য।

এর বাইরেও কথা থাকে। ফুটবল দর্শকের নিজস্ব পছন্দ-ধরণ-দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী আরো অনেক দলই হতে পারে সেরা। সেটি হতে পারে ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের নক্ষত্রপুঞ্জ রিয়াল মাদ্রিদ, অথবা ১৯৯৯ চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জয়ী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, অথবা থিয়েরে অঁরি যুগের আর্সেনাল। কিংবা ব্যক্তিগত পছন্দের আরো অন্য যে কোন দল।

তবে একটি বিষয় নিশ্চিত। আক্রমণাত্বক ফুটবলের সাথে সাফল্যের কোন বিরোধ নেই। বর্ণিত ছয়টি দলের কেউই আক্রমণাত্বক-দৃষ্টিনন্দন ফুটবলের সাথে আপোষ করেনি। তারা সফল হয়েছে কি না, এর জবাব ইতিহাসই দেবে, দিচ্ছে। তারপরেও পেশাদারিত্বের এই যুগে আর্সেন ওয়েঙ্গারদের মতো ম্যানেজারেরা কমে যাচ্ছেন- আক্ষেপ এইটাই।


মন্তব্য

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

লেখাটির প্রাথমিক ধারণা এবং প্রয়োজনীয় প্রচুর তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন কামরুল হাসান ভাইয়া। তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না, বরং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

কৌস্তুভ এর ছবি

হায়, কী গবেষণামূলক প্রবন্ধের আশা করে ছিলাম, আর কী দিলেন! দিক্কার! খাইছে

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

কেনো, ফুটবল তো শিশুদেরই বিষয়, নাকি ?? দেঁতো হাসি

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

ওই ছ্যাঁরা, তুই চিট কইচ্চস! বার্সার কতা দুইবার কইছস! রেগে টং

খেলা (বিশেষত ফুটবল) বিষয়ে তুমি সর্বকালের সেরা ব্লগারদের একজন।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

দূরে গিয়া মুড়ি খান- আপনে নিশ্চয়ই রিয়াল সাপোর্টার। কথায় তো আপনাগো লগে পারুম না, ন্যান তালগাছটা আপনাকে দিলাম

... পরের অংশে খাইসে আমারে ইমো...

মৌনকুহর এর ছবি

চলুক

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

হাসি

guest_writer এর ছবি

চমৎকার লিখেছেন ! সবগুলোয় সেরা দলগুলোর শীর্ষ কাতারে! আপনার লেখা পড়ে ভাবছি বিশ্বকাপের খেলা দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা পোষ্ট করব নাকি। শুভেচ্ছা- অণু

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

অবশ্যই লিখবেন, আগ্রহ নিয়ে পড়বো।

কামরুল হাসান এর ছবি

খুব ভালো হয়েছে সুহান।

তবে এই ছয়টা দলের সঙ্গে যদি অন্য কারো কথা বলতে চাও তাহলে ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের রিয়াল, ১৯৯৯ ম্যান ইউ বা থিয়েরি অঁরি যুগের আর্সেনালেরও আগে আসবে ইউসেবিওর বেনফিকা বা বেকেনবাওয়ার-জার্ড মুলারের বায়ার্ন মিউনিখের নাম। বিশেষ করে ইউসেবিওর বেনফিকা তো নাকি অসাধারণ দল ছিল। ডি স্টেফানো-পুসকাসদের একতরফা আধিপত্য প্রথম ভেঙ্গেছিল তারা।

পুসকাসের নামটা বোধহয় ফেরেংক পুসকাস উচ্চারিত হয়। মানে সেরকমই শুনেছি। ভুলও হতে পারে আমার।

শুধু খেলা নিয়ে নয়, তোমার সব লেখাই পড়তে ভালো লাগে আমার। অনেক ভালো থেকো।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

আসলেই এই ছয়টা দলের বাইরে আরো অনেক দলের নাম এই তালিকায় আসতে পারে। বেনফিকা বা বায়ার্নের দলের নামও বিবেচনায় ছিলো। ম্যারাডোনার নাপোলিও কম কি !!

তবে খেয়াল করবেন

ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের রিয়াল, ১৯৯৯ ম্যান ইউ বা থিয়েরি অঁরি যুগের আর্সেনালের

- এই দলগুলার প্রত্যেকটাই মোটামুটি কাছাকাছি সময়ের। এখনকার দর্শকেরা এদের যে কাউকে পছন্দ করতে পারে ভেবেই এদের নাম লেখা।

আর পুসকাসের নাম নিয়ে কোন দ্বিধা নেই, ওটা ফেরেংক- ই হবে। তবে শিকাগো যেমন "চিকাগো", তেমনি এইটাও ছোট থেকে পড়ে পড়ে অভ্যাস হয়ে গেছে বলে ফেরেঞ্চ-ই লিখে ফেলেছি হাসি

... আবারো আরেকটা ধন্যবাদ।

আশফাক এর ছবি

দারুণ। স্পোর্টস মর্টেমে ঐ আলোচনাটার পর থেকেই আশায় আশায় ছিলাম, এই নিয়া তুই কিছু লিখবি।
স্টেফানো আর পুস্কাস একই দলে খলতেন, জানতাম না।
এনিওয়ে, ম্যানইউ কে বাতিলের খাতায় ফেলায় তোকে দিক্কার হাসি
আরো কথাবার্তা আছে তোর সাথে। কালকে পরীক্ষা দিয়া নিই। তারপর কমেন্টের পরিধি ব্‌দ্ধি পাবে ইনশাআল্লাহ

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

ইয়ে, ম্যানইউকে বা অন্য কোন দলকে আমি আসলে বাতিলের খাতায় ফেলিনি। এই লেখার মূল কাঠামোটা এসেছে দৈনিক কালের কন্ঠে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত কামরুল ভাইয়ার এই সিরিজটা থেকে।

... দল বাছাইয়ে আমার নিজের পছন্দ-অপছন্দের কোন সুযোগ নেয়া হয় নাই আর কি। হাসি

আশফাক আহমেদ এর ছবি

ইংলিশ লীগের দলগুলো প্রথম কয়েক বছর মনে হয় চ্যাম্পিয়ন্স লীগ খেলতে পারেনি। সঠিক ইতিহাস জানিস কিছু?

-------------------------------------------------

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

তানিম এহসান এর ছবি

চলুক

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

হাসি

ধৈবত(অতিথি) এর ছবি

হুম। আলু অফিসে ফোন করতেছি, শুভ্ররে সরাইয়া যাতে তোরে চাকরি দেয়।

ফেরেঞ্চ নাকি ফেরেঙ্ক পুসকাস? হাঙ্গেরিয়ান উচ্চারণে ফেরেন্স হবার কথা।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

পুসকাস কাহন উপরে তো বললাম...

আর এতো শুভ্র শুভ্র করস ক্যান ?? ব্যাটা কৃষ্ণ কাঁহিকা... দেঁতো হাসি

মুস্তাফিজ এর ছবি

লেখায় উত্তম জাঝা!

...........................
Every Picture Tells a Story

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

ধন্যবাদ মুস্তাফিজ ভাই !!

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

এই দুর্দান্ত দলগুলার মধ্যে ৯০-এর দশকের মিলান দিয়েই খেলা দেখা শুরু। সেই থেকে আজও পছন্দের শীর্ষের দুই দলের একটা মিলান। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে প্রিয়তম দুই দলের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ফাইনাল (লিভারপুল, মিলান) ছিলো দুর্দান্ত রকম স্পেশাল অনুভূতি। হার-জিতের পাল্লা দুই দল ভাগাভাগি করে নেওয়ায় খুশি তাই। পছন্দের আরেক দলের কাছে (বার্সেলোনা) অপছন্দের দল (ম্যানইউ) দুই বছরের ব্যবধানে দুই বার হারতে দেখাও সমান আনন্দের!

খুব আবছা করে মনে পড়ে বিটিভিতে লিভারপুলের খেলা দেখার কথাও। নানার বাসায় দেখতাম খেলা। নানা ছিলো এভার্টন, সম্ভবত। এখন বয়স হওয়ার পর বুঝি কি বেমক্কা ব্যাপার ছিলো এটা! ইউরোপিয়ান টুর্নামেন্ট থেকে ইংলিশ দলগুলো ৬ বছরের জন্য নিষিদ্ধ থাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে লিভারপুলের ঐ দলটারই। নয়তো ৯০ পর্যন্ত চলেছিলো লিভারপুলের একচ্ছত্র আধিপত্য। পেইজলির পর প্লেয়ার-ম্যানেজার হিসাবে দায়িত্ব নেওয়া কেনি ডাগলিশ কী জিনিস, তা দেখার জন্য এই যুগে ম্যানেজার হিসাবে দ্বিতীয় দফার কাজটুকুই যথেষ্ট মনে হয়। ইপিএল অনুসারী যে-কেউ নিজ চোখেই দেখেছে লিভারপুলের উত্তরণ।

শুধু সমর্থনের দল বলে লিভারপুলের প্রসঙ্গ টানছি না। দুর্দান্ত একটা ফিলোসফি ছিলো ঐ দলটারও। আয়াক্স যেমন টোটাল ফুটবল প্রচলন করে, লিভারপুল তেমনি ইংলিশ লীগে চালু করে পাস-অ্যান্ড-মুভ ফুটবল। কোচিং-এর একটা ড্রিল ছিলো (এখন পুনঃপ্রবর্তিত), বল 'পাস' করার পর 'মুভ' করতেই হবে, নয়তো ফাউল এবং প্রতিপক্ষের পায়ে বল যাবে। এটার ফলাফল ছিলো অদ্ভুত সুন্দর, ফ্লুইড ফুটবল। ইয়ান রাশ এবং মাইকেল ওয়েন এই প্রজন্মের কাছে পরিচিত বেশি, কিন্তু সেই যুগে প্রজন্মের সেরা সব ফুটবলারের সম্মিলন ছিলো ৭০-৮০র দশকের লিভারপুল দলে।

মিলান নিয়ে বলতে গেলে প্রায় সবাই থেমে যায় ডাচ ত্রয়ীতেই। সেই দশকে (৯২-৯৮) আরেকজন অসামান্য খেলোয়াড় ছিলো মিলান দলে -- ডেজান সাভিসেভিচ। দুর্ভাগা যুগোস্লাভিয়ার এক অসামান্য খেলোয়াড়, যিনি লিওনেল মেসি-র দেড় দশক আগে থেকেই একই ধাঁচের খেলা দিয়ে মাঠ মাতিয়েছেন। বাম পায়ের খেলোয়াড়, অসামান্য ড্রিবলিং এবং ক্লোজ কন্ট্রোল, ডান প্রান্তের ইনভার্টের উইঙ্গার পজিশন দিয়ে শুরু করে "ফলস-নাম্বার-টেন" হয়ে খেলা... সবই মেসির মতো। বার্সার খেলা অনুসরণ করা যে-কেউ অবাক হয়ে যাবেন দুই খেলোয়াড়ের মিল দেখে। আফসোস, আন্তর্জাতিক ফুটবলে তেমন দেখা না যাওয়ায় তার কথা জানে কম লোকেই। ওদিকে ক্লাবে ফাবিও কাপেলোর অতি-রক্ষণাত্মক খেলার জন্য আটকে যায় প্রতিভার বিকাশ।

ফুটবল এখন অনেক বদলে গেছে... কিন্তু তবু রিয়াল মাদ্রিদ বাদে এই তালিকার প্রতিটা দলের প্রতি অন্য রকম অনুরাগ কাজ করে। বিশেষ করে আয়াক্স, বার্সা, এবং লিভারপুল এত বছর পরও নিজ অ্যাকাডেমি থেকে খেলোয়াড় তুলে আনার প্রতি একনিষ্ঠ আছে। সাথে অবশ্যই যোগ করতে হবে আর্সেনালের কথা। বহু রকম কারণে মেজাজ খারাপ হয় আর্সেন ওয়েঙ্গারের উপর, কিন্তু তাই বলে শ্রদ্ধায় ঘাটতি হবে না কোনোদিন।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

দেখলেন, দেখে দেখে জানা দর্শক আর পড়ে পড়ে জানা দর্শকের মাঝে পার্থক্য বিস্তর দেঁতো হাসি

ফুটবল অনেক বদলেছে তো বটেই। টাকার ছড়াছড়ি বেড়েছে, ট্রান্সফার ফি-ইন্সুরেন্স বাহাস নিয়ে মাতামাতি অনেক বেশি। যে কোন মূল্যে জিততে চাওয়া ম্যানেজারের সংখ্যা অনেক বেশি। আর্সেন ওয়েঙ্গারের মতো লোকেরা আজকাল বড় দূর্লভ।

... আর আপনি ফুটবল নিয়ে স্মৃতিচারণ লেখেন, প্লিজ। মন্তব্যটা পড়েই বোঝা যাচ্ছে, আপনার অনেক কিছু বলবার আছে।

স্বাধীন এর ছবি

চলুক

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- ভাইয়া।

অমিত এর ছবি

ধুর, লেখা পড়ে মনে হচ্ছে বল নিয়ে মাঠে নেমে যাই মন খারাপ

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

ডাক দিয়েন কর্ণেল দেঁতো হাসি

আয়নামতি1 এর ছবি

টো টাল খেলেও এবং টোটাল ফুটবল জিনিসটা কী সেটা তেমন না বুঝলেও লেখাটা মন দিয়ে পড়েছি দেঁতো হাসি
এসির প্রতি আমার দুবর্লতা আছে। কী কিউট খেলওয়ারগুলো খাইছে বার্সাও ভালু। পছন্দের দুটো নাম তালিকায় দেখে লেখাটাকে জটিল না বলি কেম্নে! বেশ পরিশ্রমী লেখা। অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।

অ:ট: গত লেখায় আপনি কিন্তু বেশ একটা চাপা দিয়েছিলেন। শিমুল ভাইয়ার বিয়ের ছবিতে আপনাকে দেখে ওটা যে চাপা ছিলো তেমনটাই মনে হয়েছে। আপনি তো মাশাল্লাহ দশাসই মানুষ , আপনাকে পাঁজরে কিক্ দিয়ে অদ্রোহ কিভাবে বিছানা থেকে ফেলতে পারেন অ্যাঁ চিন্তিত খাইছে

অদ্রোহ এর ছবি

আয়নামতিদি আমাকে দেখলে ওই কিক দেওয়ার ব্যাপারটা যে কতটা গাঁজাখুরি সেটা না বলে দিলেও চলত দেঁতো হাসি

--------------------------------------------
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।

অদ্রোহ এর ছবি

সর্বকালের সেরা দলগুলোর যেই তালিকাই করা হোক না কেন, মজা এই যে প্রত্যেকটা দলের নিজস্ব একটা ফুটবলদর্শন আছে, খেলার একটা অনন্য তরিকা আছে। শুধু সাফল্যবুভুক্ষু হওয়াটাই এই এলিটক্লাসভুক্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট নিশ্চয় না। আর হ্যাঁ, এর মধ্যে ম্যানইউর শিরোপাজয়ি মৌসুমগুলোর রিভিউ দেখে শেষ করলাম। ৯৯ বা ২০০৮ এর শিরোপাজয়ী দলটা একেবারে ফেলনা নয়। আর অঁরিমন্ডিত আর্সেনালের অপরাজেয় দলের কথাও বলতে হবে।

তবে একটা ব্যপারে বাহাস নেই, এই বার্সার খেলা দেখতে পারাটা যেকোন ফুটবলভক্তদের জন্য পরম সৌভাগ্য। আর বাকিগুলর মধ্যে আমার ব্যক্তিগত পক্ষপাত মিলানের দলটাকে। খেলত বটে তারা...

--------------------------------------------
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

আয়নামতির মন্তব্যের এই অংশ পড়ে আসলেই দীর্ঘক্ষণ হাহা করে হাসলাম-

বিয়ের ছবিতে আপনাকে দেখে ওটা যে চাপা ছিলো তেমনটাই মনে হয়েছে। আপনি তো মাশাল্লাহ দশাসই মানুষ

নাহ, আপনার ধারণা এদ্দমই ভুল। শিমুল ভাইয়ার বিয়েতে ব্যস্ততাবশতঃ আমার যাওয়াই হয়নি !!

আর ইয়ে, আমি এসির খেলোয়াড়দের মতোই কিউট- এদ্দম দশাসই নই দেঁতো হাসি

রেড ডেভিল  এর ছবি

মানিনা । বাসবি বেবস'দের এভাবে হেলাফেলা করলেন? বেস্ট, চার্লটন, ডাংকান এডয়ার্ডস ,ডেনিস ল'দের অভিশাপ পড়ুক আপনার উপর খাইছে

অদ্রোহ এর ছবি

৫৮ তে মিউনিখের ওই ভয়াবহ দুর্ঘটনার জন্য রেড ডেভিলদের ভক্ত হিসেবে আজীবন হাপিত্যেশ করে যেতে হবে মন খারাপ

--------------------------------------------
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।

স্বপ্নহারা এর ছবি

চলুক

কিন্তু ছয় কেন? ছয় একটা অশুভ সংখ্যা...দশ হইলে ভাল হইতো... খাইছে

একসময় রিয়াল আর ম্যান-ইউ'র সাপোর্টার ছিলাম। এখন অতটা খবর রাখতে পারি না, তবে খেলা দেখে এখন এটা বুঝি, বার্সেলোনা ফুটবল খেলে আর অন্যরা খেলার চেষ্টা করে। আমার ফুটবলে সাপোর্ট ঘুরাঘুরি করে...যে দল সুন্দর খেলে সেই দল সাপোর্ট করি...দেঁতো হাসি হার্ডকোর সাপোর্টার ছিলাম আবাহনীর...দেঁতো হাসি
বিশ্ব ফুটবলে মাঝে মাঝে খেলা চলাকালীন সময়েও সাপোর্ট বদল হয়! খাইছে

কেন জানিনা স্প্যানিশ লীগ আর ইটালিয়ান লীগ ভাল লাগতো ছোটবেলা থেকেই...এসি মিলানেরও ফ্যান ছিলাম। আর ছিলাম ডেল পিয়েরোর...পরে ইংলিশ লীগের গতিময় খেলা ভাল লাগতো।

২০০০ এর দিকে রিয়ালের টিমটা ছিল সেইরকম...কিন্তু পরে একসময় মনে হলঃ টিম কম্বিনেশনের চেয়ে ওরা ব্যবসাটাকেই প্রাধাণ্য দেয়। সব সুপার প্লেয়ার মিলেও টিমটাকে গ্রেট বানাইতে পারলো না!

আমার ছোটকালের হিরো, ম্যারাডোনা আর তিন ডাচ! (পেলের সময়ে খেলা- গোল করা অনেক সহজ ছিল মনে হয়, ডিফেন্ডাররা হাফ-লাইন ক্রস করতো না...৫ জন স্ট্রাইকার পর্যন্ত খেলতো!) আর ফন বাস্তেনের অমানবিক কিছু খেলা এখনও চোখে লেগে আছে! আর বড় হয়ে রুড গুলিত হতে চাইতাম!

এখন বিশ্বফুটবলের খেলাগুলো অনেক বিরক্তিকর...কোনভাবেই গোল খাবনা এই মনোভাব খেলায় আর সৌন্দর্য বলে কিছু রাখছেনা! তাই ক্লাব ফুটবলই ভাল!

উপরের সবগুলান টিমই ইউরোপিয়ান...সাউথ আমেরিকার কোন টিম সেইরকম কিছু করতে পারে নাই?

-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

ফুটবলে সাপোর্ট করি বার্সেলোনা, কারণ জিজ্ঞেস করলে এক রোনালদিনহো ছাড়া আর কিছু বলবার নাই। একমাত্র তার কারণেই কাতালানদের কিছু না বুঝে সাপোর্ট করসিলাম...

হিরো বলতে সে ছাড়াও আছে মালদিনি। মিলানের খেলা আমার দারুণ লাগতো একটা সময়। এখনো লাগে। তবে ইপিএলে আমার আগমন অনেক পরে, তখন অঁরি যুগ শেষ হয়ে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো যুগ শুরু হবে হবে। আর্সেনাল আর ম্যানইউকে বেশ লাগে আমার। ...

নাহ, সাউথ আমেরিকান কোন দলেরই পাতা নাই লিস্টে। তালিকায় থাকলেও থাকতে পারতো বরং বেনফিকা, বায়ার্ন, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বা আর্সেনাল।

ওসিরিস এর ছবি

লেখাটা ভালো হইসে। (গুড়)

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

ধন্যবাদ দোস্তো।

sas এর ছবি

গুরু গুরু

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

লইজ্জা লাগে

ধুসর গোধূলি এর ছবি

যাক, সুহান দুনিয়া কাঁপানো (তিন) তিরিশ (নব্বুই) মিনিটের কথা কয় নাই!

লেখা ভাল্লাগছে। ফাঁকতালে আমার ধারণার একটা কথা কয়া দেই। ক্যান জানি মনেহয় পেলে-ম্যারাডোনা আলোচনায় ফুটবলের সত্যিকারের নায়ক গ্যারিঞ্চার কথা অন্তরালে থাইকা যায়। শারীরিক নানান অসম্পূর্ণতা নিয়াও গ্যারিঞ্চা যা দেখাইছে, সেইটা কোনো অংশেই সুস্থ, শক্ত-সামর্থ ম্যারাডোনা বা পেলের চেয়ে কম না। অথচ তাঁদের তুলনায় ফুটবল বিশ্ব ৫৮ আর ৬২ সালের বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল দলের অন্যতম সেরা এই ফুটবল লিজেন্ডের কথা স্মরণই করে না!

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

গারিঞ্চা অনেক আন্ডাররেটেড ছিলেন, সত্য। একটা পা ছোট হওয়া সত্বেও সমসাময়িকেরা তাকে অনেক সময়েই পেলের সাথে তুলনা দিতেন। এই একটা বিষয়ই তার গ্রেটনেস বুঝিয়ে দেয়। কী আর করা। ওয়ার্নের সময়ে জন্মে ম্যাকগিলও তো ম্লান হয়ে গেলেন।

ঢাকাইয়্যা যাদুকর () এর ছবি

জটিল হইছে সুহান ভাই

বার্সা'র কথা মাত্র ২বার!? কমসেকম ৫বার দরকার ছিল দেঁতো হাসি

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

এতো পার্শিয়াল্টি ভালা নারে যাদুকর- ভালা না...

মৃত্যুময়-ঈষৎ এর ছবি

চলুক চলুক

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

rishad এর ছবি

চমৎকার সুহান।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

লইজ্জা লাগে

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

জট্টিল।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

ধন্যবাদ বস।

ফাহিম হাসান এর ছবি

ফুটবল খেলা নিয়মিত দেখা হয় না। তবে ক্লাব পর্যায়ের খেলা বিশ্বকাপের থেকেও ভাল জমে-এমনটাই মনে হয়েছে প্রতিবার। লেখা উত্তম জাঝা!

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

বিশ্বকাপের ক্ষেত্রে অবশ্য গণমানুষের একটা আবেগ কাজ করে, সেটা ক্লাব ফুটবলে দেখা যায় না। এছাড়া ক্লাব ফুটবলের জবাব নেই কিন্তু।

অনিকেত এর ছবি

খেলা নিয়ে এই ব্লগ দুনিয়ায় (মতান্তরে সারা দুনিয়ায়) সুহানের চেয়ে ভাল কেউ লিখে না....পিরিয়ড!
তার উপর তার মত আমিও আবার বার্সার সাপুর্টার কি না, ওর লেখা তাই এম্নিতেই আমার খুব ভাল লাগে--
হে হে হে

লেখা ভালৈসে বস, লেখা জটিলৈসে--

শুভেচ্ছা নিরন্তর

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

ধন্যবাদ অনিকেতদা- ম্যালা ধন্যাবাদ।

পাঠক এর ছবি

ভালো তথ্যবহুল লেখা।

তবে ফুটবল দর্শনের কথাই যদি বলুন, তবে ম্যানইউ এর Never Say Die মানসিকতার কোন তুলনা নেই। এমন কোন দল আছে যারা শেষ ১০ মিনিট ম্যানইউ এর বিপক্ষে নার্ভাস থাকে না? কতগুলো ম্যাচ ম্যানইউ ইনজুরি টাইমের গোলে জিতেছে? অসংখ্যবার।

অন্য ছয় দলের প্রতি পুর্ন শ্রদ্ধা রেখে বলছি, ম্যানইউ (ম্যাট বুসবি অথবা স্যার এ্যালেক্স ফার্গুসন) এদের কারো চাইতে কম নয়, অন্তত শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে।

চিত্রাঙ্গদা এর ছবি

এখনকার ফুটবল যতো টা না সুন্দর তার থেকে বেশি ফল প্রত্যাশী । এখনকার ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিই সম্ভবত এর জন্য দায়ী । ফলাফলে আজকের যুগে সুন্দর ফুটবল কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে... আরসেন ওয়েঙ্গারের উত্তরসুরীরা এমনকি ওয়েঙ্গার নিজেও তাই সুন্দর ফুটবল সরিয়ে আজ ফল প্রত্যাশী ফুটবল খেলে।

লেখা যথারীতি অসাধারন।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।