ক্ষমতা, বিত্ত, ভাষা ও শিক্ষা

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি
লিখেছেন সুবিনয় মুস্তফী (তারিখ: রবি, ১৬/০৩/২০০৮ - ৩:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রাকিব হাসনাত সুমনের একটা অতি মূল্যবান কমেন্ট দিয়েই শুরু করি -
"শিক্ষা ব্যবস্থাটারে জগাখিচুড়ী বানায়া ফালাইছে। বড়োলোকগো ইংলিশ মিডিয়াম.... মধ্যবিত্তের জন্য ইংলিশ ও বাংলা মিডিয়াম মিক্সড.... আমগো মতো নিন্ম মধ্যবিত্তের ছোট লোকগো জন্য সরকারি স্কুল.... আর গরীব এবং গ্রামের সাধারন মানুষের সন্তানদের জন্য জেএমবি নেতাদের মাদ্রাসা"

এই কমেন্টটা পড়ে ঠাশ করে থাপ্পড় খাওয়ার মত মনে হইছিলো। কঠিন সত্যটা এত সহজ়েই বলে দিল সুমন। আগের পোস্টে আরো অনেক দরকারী কমেন্টই ছিল - তাদের কারো কারো জবাব দিতে চেষ্টা করছি। পুরানটা আর না টেনে নতুন করে একটা পোস্ট দেওয়াই সমীচীন মনে করলাম।

*

একটু অন্যখান থেকে আগাই আজকে। বিবিএ পড়াকালীন সময়ে একটা অর্থনীতি ক্লাসে প্রথম আমি Gini coefficient-এর নাম শুনি। একটা দেশের ভিতরে বিত্তের বন্টনের যেই অসমতা, সেই income inequality মাপার জন্যে সবচেয়ে বহুল প্রচলিত সূচক সম্ভবত এই জিনি সূচক। ধরেন দুইটা ভিন্ন দেশ - একটা দেশে ১০% মানুষের হাতে ৩০% সম্পদ কুক্ষিগত, আরেকটা দেশে ১০%-এর হাতে ৬০% সম্পদ বন্দী। অসমতা তাইলে দ্বিতীয় দেশেই বেশী।

জিনি নাম্বার দিয়ে এই সবই মাপে। টেকনিক্যাল আলাপে বেশী না গিয়ে এতোটুকু বলা যায় যে জিনি নাম্বার যত কম, একটা দেশে আয়ের অসমতা তত কম। আর জিনি নাম্বার বেশী হলে inequality-ও বেশী। এখন দেখি যে এই হিসাবে পৃথিবীর কোন কোন সমাজে সমতা বেশী আর কোথায় সেটা কম। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলার - নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক ও আইসল্যান্ড - এইদিক থেকে অনেক সুনাম আছে যে এরা ঐতিহাসিক ভাবেই সমাজে ধনী-গরীবের অতিরিক্ত ব্যাস-কম অপছন্দ করে।

উইকিপিডিয়া থেকে তার সত্যতা মিলে - সবচেয়ে সুষম ৮টা দেশের মধ্যে ৪টাই স্ক্যান্ডিনেভিয়ার। এবং আরো ইন্টারেস্টিং হলো যে প্রথম যেই বিশটা সুষম দেশ, তাদের সবগুলাই ইউরোপের। স্ক্যান্ডিনেভিয়া ছাড়াও উত্তর ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলাতে অসমতা কম রাখার চেষ্টা করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় পলিসি হিসাবেই।

জিনি সূচক কম মানে এই না যে সেই দেশে ধনী গরীব বলে কিছু নাই। অবশ্যই এদের ধনীও আছে আর গরীবও আছে। পৃথিবীর হেন কোন দেশ নাই যেখানে ধনী গরীবের তফাত নাই। কিন্তু পয়েন্টটা হইলো এই যে এই ব্যবধান উগ্র না। এই ব্যবধান দৃষ্টিকটু পর্যায় পরে না। একই দেশের ভিতর প্রাসাদ আর বস্তি পাশাপাশি বসবাস করে না। অতিশয় ধনীর সংখ্যা কম, আবার একেবারে রাস্তার ফকিরের সংখ্যাও কম। মাঝখানে বেশীর ভাগ লোক, আর ওরা ঐখানে থাকতেই পছন্দ করে।

*

auto

এই সাম্য কিন্তু অটোমেটিক তৈরী হয় নাই। এদের মধ্যে অনেক দেশই এককালে ভয়ংকর রূপে অসম ছিল। সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থা এদের রগে রগে ছিল। সুইডেনের কথাই ধরি। এক যুগেরও বেশী আগে ঢাকায় আমি একটা ছায়াছবি দেখছিলাম - Pelle the Conqueror। ডেনমার্কের ছবি, ১৯৮৮ সালে শ্রেষ্ঠ বিদেশী চলচ্চিত্র হিসাবে অস্কার পুরস্কার পাইছিলো। মার্টিন নেক্সো নামে এক লেখকের লেখা বিখ্যাত ডেনিশ উপন্যাস থেকে এই সিনেমার সৃষ্টি।

পেলে একটা ছোট সুইডিশ ছেলে। তার মা নাই, তার বুড়া বাবা কাজের খোঁজে তারে নিয়া গেছে ডেনমার্কের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের এক ফার্মে। সেই ফার্মের বিত্তশালী মালিক কংস্ট্রুপ (Kongstrup)-এর ব্যবহার জানোয়ারের থেকেও খারাপ। উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের সামন্তবাদী সমাজে অবিচার আর দুর্ব্যবহারের যে ভয়ংকর সব দৃশ্য এই ছবিতে দেখছিলাম, সেই কথা ভাবলে এখনো মন ভারী হয়। আমার দেখা বিদেশী ভাষায় সেরা ছবিগুলার অন্যতম। পেলের বাবার ভূমিকায় ছিল বার্গম্যানের প্রিয় অভিনেতা, কিংবদন্তীতুল্য ম্যাক্স ভন সিডো

অনেক বছর পরে এই ছবির ঐতিহাসিক ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটির সময়ে আমি একটা লিংক খুঁজে পাই। যেই স্ক্যান্ডিনেভিয়া বর্তমান বিশ্বে social equality-র এতো বড় উদাহরণ, সেই স্ক্যান্ডিনেভিয়াতেই তো পেলে'র গল্প। সেখান থেকে এখানে এরা কেমনে আসলো? উত্তর পাই এইখানে

পড়তে পড়তে বুঝলাম যে সমাজের সর্বস্তরে অবিচারের ফলে সুইডেন থেকে ১৮৭০-এর পরে থেকেই অতি ব্যাপক হারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন শুরু হয়ে যায়। তখনও মার্কিন ভূখন্ড মোটামুটি খালি ছিল। রেড ইন্ডিয়ানদের মেরে কেটে পশ্চিমে তাদের জমিজমা কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হইছে কেবল। যাই হোক, প্রায় ৪০-৫০ বছর টানা ইমিগ্রেশানের পরে দেখা গেলো যে সুইডেনের জনসংখ্যার মোট ২০% দেশ ছেড়ে আমেরিকা চলে গেছে। মানে পাঁচ জনে একজন!

সামন্তবাদী সমাজের টনক নড়লো এতে। ১৯০৭ সালে বসলো সুইডিশ অভিবাসন কমিশন। এর উদ্দেশ্য কারন অনুসন্ধান করা আর সমস্যার সমাধান খোঁজা। উইকি আর্টিকেল থেকে কিছু উক্তি সরাসরি তুলে ধরলাম -

"The great majority were enthusiastic over their new homeland, and critical of conditions in Sweden. They describe particularly the grim poverty in the Swedish countryside, the hard work, pitiful wages, and discouraging prospects. One woman wrote from North Dakota of how in her Värmland home parish, she had had to go out and earn her living in peasant households from the age of eight, starting work at four in the morning and living on "rotten herring and potatoes, served out in small amounts so that I would not eat myself sick." She could see "no hope of saving anything in case of illness, but rather I could see the poorhouse waiting for me in the distance." When she was seventeen, her emigrated brothers sent her a prepaid ticket to America, and "the hour of freedom struck." The emigrants also strongly emphasized non-material considerations, such as the exclusion of the poor from the political process, through the restrictive Swedish franchise before 1907. Bitter experiences of Swedish class snobbery still rankled after sometimes 40–50 years in America. A man who'd emigrated in 1868 described the disparaging comments he had heard in his youth from the aristocrat in charge of the parish poor relief, which "gave rise to great bitterness and a large number, among them myself, emigrated to America, which I have never regretted. Here, you are treated like a human being, wherever you are."

*

সো।

দারিদ্র্য আর হতাশা। পচা হেরিং মাছ আর আলু। খাদ্য আর পুষ্টির অভাব। Non-material considerations পর্যন্ত ছিল - যেমন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে গরীবদের বের করে দেওয়া। Class snobbery ছিল - জাত্যাভিমান, উঁচু বর্ণের উন্নাসিকতা। ৪০-৫০ বছর পরেও সেই স্মৃতি একজন মানুষকে খোঁচায়, আঘাত করে। 'এইখানে আমাকে মানুষের মর্যাদা দেওয়া হয়।' নিজ দেশে সে যা পেতো না। হৃদয়স্পর্শী এই কথাগুলা। আমাদের দেশের সাথে কি মিল পাই কোন?

সুইডিশরা তাদের সমাজ সংশোধনের কথা চিন্তা করলো এরপরে। কমিশনের ৬ বছরের অনুসন্ধান থেকে অনেক অপ্রিয় সত্য বেরিয়ে এলো। উঁচু জাতের সুইডিশরা যে অবশ্য শুধু গরীবের ভালোর জন্যে তাদের নীতি সংশোধন করেছিলো তা কিন্তু না। নিজেদের স্বার্থই ছিল আগে। শ্রমিকের অভাব দেখা যাচ্ছিলো, কল-কারখানা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাতে ব্যাহত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে, কিন্তু সেনাবাহিনীতে নতুন সৈনিকের অভাব। যুবকরা সব ভিনদেশে চলে যাচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন আর সমাজবাদী আন্দোলনও দানা বেঁধে উঠছিলো। এদের মোকাবেলা করতে হলে ন্যায় বিচারের দিকে যাওয়া ছাড়া উপায় কি?

তাই সংশোধন দরকারী হয়ে পড়লো। "To discuss the emigration meant to discuss Sweden in its entirety.. First on the list of urgent reforms were universal male suffrage, better housing, general economic development, and a broader popular education which could counteract "class and caste differences."

সেই যে সমতার পেছনে একটা পুশ তৈরী হয়েছিল, সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে গিয়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে পরিপূর্ণ রূপ পায়। Scandinavian welfare model নিয়ে বিস্তর লেখালেখি ও গবেষনা হয়েছে গত ৫০ বছরে, কেন ও কিভাবে তারা সফল হলো। আজকাল ডেনমার্ক বা সুইডেনে বা হল্যান্ডে যে বিদেশী বা মুসলিম বিদ্বেষ দেখা যায়, তার অন্তত একটা কারন তাদের সেই সমাজের এত কষ্টার্জিত একতা আর সমতা ছারখার হয়ে যাচ্ছে বলে সাধারণ মানুষের অন্তরে যেই ভয়টা। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান মডেল নিয়ে বিখ্যাত উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ জেফরি স্যাক্সের একটি মূল্যায়ন পড়ুন এখানে। নেট ঘাটলে আরো অনেক ডিটেইলস মিলবে, তবে আজকে আর সেই গবেষণায় যাচ্ছি না।

*

বরং পুনরায় চোখ ফিরাই শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে। কি সমাধান ছিলো? "A broader popular education which could counteract "class and caste differences." আজকে স্ক্যান্ডিনেভিয়া তথা পশ্চিম ইউরোপে আর্থ-সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখার একটা মূল অস্ত্র হচ্ছে সুষম শিক্ষা-ব্যবস্থা। সব বাচ্চা-কাচ্চা এক সিস্টেমে পড়বে, এক জিনিস জানবে শিখবে। একটা বাচ্চার মনে egalitiarianism বা সাম্যের গান তো আর হাওয়া থেকে আসবে না। গোটা সমাজ আর রাষ্ট্র যদি এই জিনিসটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, তবেই সেই নীতিবোধটা প্রতিফলিত হবে বই পুস্তকে, স্কুল কলেজের ক্লাসরুমে, এমন কি বাবা-মার মাঝেও। বাচ্চারা এসব থেকেই শিখে।

এই সমতা ও ঐক্য প্রতিফলিত হয় অন্যত্র - রাজনীতি, মিডিয়া এবং সাহিত্য সংস্কৃতিতে। আরেক বিখ্যাত সুইডিশ-এর উদাহরণ দিয়ে শেষ করি আজকের মতো। ওলোফ পামে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৮৬ সালে চাঞ্চল্যকর ভাবে তিনি খুন হন। কিভাবে? তিনি তার বৌকে নিয়ে একটা সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন এক রাতে। এবং পায়ে হেঁটে ফিরছিলেন বাসায়। পামে বডিগার্ড জিনিসটা অপছন্দ করতেন। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সাম্যের মতবাদে তিনি এতটাই বিশ্বাসী ছিলেন যে তিনি সাধারণ মানুষের মত জীবনযাপন করতেই বেশী পছন্দ করতেন। এবং সেটাই তার কাল হয়। উন্মাদ ড্রাগ-খোর আততায়ীর গুলিতে মারা যান সেই রাতে, তার বৌয়ের সামনে।

তারপর থেকে সুইডেনের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের বডিগার্ড দেওয়া হয়।

*

ইংলিশ মিডিয়াম থেকে ওলোফ পামে। অনেক দূরে সরে আসলাম মনে হয় ভূল করে। আবার কে জানে, হয়তো ঠিক অতটা দূরেও না...?


মন্তব্য

কনফুসিয়াস এর ছবি

ঠিকাছে।
লাইনেই আছেন এখনো। হাসি
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

সুইডিশরা বৈষম্য ঘোচানোর (মূলত কর্মী মানুষগুলির বিদেশে চলে যাওয়া ঠেকাতে) চিন্তা করেছিলো নিজেদের স্বার্থ বুঝে। এইটকু স্বার্থ বোঝার মতো দরকারি ঘিলুও তো আমাদের দণ্ডমুণ্ডের বিধাতাদের আছে বলে মনে হয়নি কখনো।

পরের পর্বের জন্যে অপেক্ষা করি।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

জুবায়ের ভাই,

Demographic ব্যাপারটাও আমাদের অনুকূলে নয়। সুইডিশরা বৈষম্য ঘোচাতে বাধ্য হয়েছিলো শ্রমিকের অভাব দেখে। আমাদের অবস্থান তো তার ঠিক বিপরীত। আমাদের হলো শ্রমিকের আধিক্য। আমাদের এই labour surplus কবে কেমনে কিভাবে কমবে? সুইডিশ গরীবেরা পেয়েছিল আমেরিকার উন্মুক্ত স্থলভূমি। আমাদের চাষীদের সন্তানেরা ভিটা-জমি বিক্রি করে চলে যায় আরবের মরুভূমিতে। কিন্তু আরো কয়েক কোটি চাষা-ভূষার বোধ হয় চলে যেতে হবে আমাদের ভদ্রলোকদের সত্যি সত্যি ভদ্র হবার আগে।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আপনার যুক্তি না মেনে উপায় নেই। আমাদের বাড়তি শ্রমশক্তির বিষয়টি সবারই কমবেশি জানা। স্পষ্ট করে বলা হয়নি, কিন্তু আমি যা বলতে চেয়েছিলাম তা হলো এই শ্রমশক্তিকে নিজেদের কাজে লাগানো। বিতর্কসাপেক্ষ হলেও অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আপনিও জানেন, ব্যবহার করতে জানলে শ্রমশক্তি কখনো অতিরিক্ত হয় না, বোঝা হয়ে দাঁড়ায় না। তাকে সম্পদ করে তোলাও খুবই সম্ভব। আমাদের দেশের পরিস্থিতি মনে রেখেই বলি, এই কাজটি শুরু হওয়া উচিত ছিলো অনেক আগেই।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

রাকিব হাসনাত সুমন এর ছবি

ওদের তো ভাই বডিগার্ড দিয়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করার গেছে.... বাংলাদেশে কিন্তু জেলের ভিতরও মেরে ফেলার রেকর্ড আছে.........প্রকাশ্যে গ্রেনেড মারা তো সেদিনের ঘটনা........

দুর কি বলতে কি বললাম.. মাফ কইরা দিয়েন ভাই.............

তানভীর এর ছবি

সুইডেনের উদাহরণটা দারুণ। এভাবে আগে চিন্তা করি নাই।
আমার আগের বসের পূর্বপুরুষ মানে তার দাদা ছিল সুইডেন থেকে আসা ইমিগ্রান্ট। সে এখনো স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলির পত্রিকা পড়ে, সুইডেনে তাদের আত্মীয় খুঁজে বেড়ায়, অনেকের সাথে এখন যোগাযোগও হয়েছে। বসের কাছে তার দাদার গল্প শুনতাম মাঝে মাঝে- ২৪ ঘন্টাই নাকি ক্ষেতে কাজ করা লাগত, পুরা স্লেভের জীবন, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলে কিছু ছিল না। তখন আমেরিকায় নেটিভদের নিধন করে অভিবাসীরা আস্তানা গেড়েছে। বিশাল দেশ গড়ে তোলার জন্য অনেক লোক দরকার। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিতে দালালরা জাহাজ ভিড়িয়ে গরীবদের ফুঁসলাতো-'আসো আমেরিকায়, land of opportunities, এইরকম slave হয়ে থাকতে হবে না।' গরীবরা কোনমতে ভাড়া যোগাড় করে জাহাজে চেপে বসত। আমার বসের দাদাও এইভাবে আমেরিকায় আসছে। ইনফ্যাক্ট, আমেরিকার অধিকাংশ সাদার কাহিনীই এরকম। তাই, বোধহয় অন্য যে কোন দেশের চাইতে এরা ইমিগ্রান্টদের প্রতি বেশি সফট।

ঠিকই বলছেন, বাংলাদেশে এখন ইউরোপে ঘটা একশ-দেড়শ বছর আগের এই কাহিনীই চলতেছে। খালি আমেরিকার মত এখন কোন land of opportunities নাই। দেশ থেকে পালায়েও তাই বাঙ্গালী বেশি সুবিধা করতে পারতেছে না। এখন কথা হল, সুইডেন নিজ দেশে equality -র জন্য যে রিফর্ম করেছিল, আমরা আমাদের দেশে এটা কবে করব? দেশের সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতায় লালিত-পালিত হওয়া পলিটিশিয়ান-আমলাদের কাছ থেকে এই রিফর্ম আশা করা দুষ্কর। হয়ত কখনো প্রবাসীদের উল্লেখযোগ্য অংশ যখন দেশে ফিরে যাবে বা যেতে বাধ্য হবে (যেহেতু অভিবাসী হওয়ার রাস্তা দিনদিন সংকুচিত হয়ে আসছে), তাদের হাত দিয়েই হয়ত রিফর্ম শুরু হবে (কিছু কিছু ক্ষেত্রে সীমিত আকারে এখন হচ্ছেও)।

হিমু এর ছবি

সুইডেনে ২০% লোক দেশত্যাগী হওয়ার পর লোকজনের টনক নড়েছিলো, যদি ধরে নিই বাংলাদেশের ভদ্দরলোকদেরও টনক নড়ানোর জন্য ২০% লোককে দেশত্যাগ করতে হবে, তাহলে ৩ কোটি মানুষকে দেশত্যাগ করতে হবে।

আমার ধারণা, বাংলাদেশের ভাগ্য পাল্টানোর জন্য দরিদ্র লোকের দেশত্যাগ নয়, বরং ধান্দাবাজ পয়সাঅলাদের শূন্য হাতে দেশত্যাগ জরুরি।


হাঁটুপানির জলদস্যু

দিগন্ত এর ছবি

"আমার ধারণা, বাংলাদেশের ভাগ্য পাল্টানোর জন্য দরিদ্র লোকের দেশত্যাগ নয়, বরং ধান্দাবাজ পয়সাঅলাদের শূন্য হাতে দেশত্যাগ জরুরি।"

- উত্তম প্রস্তাব। সংসদে পেশ করেন দেখি ...


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

প্রসঙ্গটা মনে হয় অভাব তীব্র হবার। যেই সম্পদের অভাব, সেটাই আচমকা হারিয়ে যাওয়ার ফলেই টনক নড়েছিল। সেই দিক থেকে ভাবলে আমাদের সবচেয়ে বেশি অভাব কিসের?

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

হুমমম এই কমেন্টটা ঠিক বুঝলাম না মনে হয়। একটু খোলাসা করো।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

কানাডা বা স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় মানুষ খুব কম। তাদের জন্য জনশক্তি কমে যাওয়া একটি বিশাল ক্ষতি। আমাদের বেলায় জনসংখ্যা একটি বাহুল্য, সবচেয়ে বড় বোঝা। প্রশ্নটা তাই মানুষ কম-বেশি হবার নয়, বরং প্রগতি কম-বেশি হবার।

সুইডেনের জন্য মানুষ ও প্রগতি সমানুপাতিক ছিল। আমাদের দেশের বেলায় প্রগতির সাথে কিসের সম্পর্ক সমানুপাতিক? বুদ্ধিবৃত্তি, প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশ্ববাজারে প্রবেশাধিকার, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে মুক্তি, ধর্মীয় অনুভূতি? পৃথিবীর একেকটি জাতির moment of reckoning এসেছে এরকম একেকটি ক্ষেত্রে আচমকা খুব বড় পরিবর্তনের পর।

আমাদের দেশের বেলায় কী কী নিয়ামক কাজ করবে, তা নিয়ে আমি নিজেও এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নই। তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি যে বাঙালির জন্য বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতির ভূমিকা ব্যাপক। এই ক্ষেত্রগুলোয় অভাব অনেক বেশি অনুভব করি আমরা।

জাতি হিসেবে আমরা নিজেদের "অন্য যে-কারো চেয়ে বেশি রাজনীতি-সচেতন" বলে দাবি করতে পছন্দ করি, আবার আমরাই সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ভুলগুলো করি। এটা নিয়েও চিন্তা ও বিবেচনার অবকাশ আছে।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

আমাদের দেশের বেলায় কী কী নিয়ামক কাজ করবে, তা নিয়ে আমি নিজেও এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নই।

আমার লিস্ট - আইনের শাসন, শিক্ষা আর অবকাঠামোতে বিনিয়োগ, আর ভবিষ্যত নিয়ে খুব সুদূরপ্রসারী প্ল্যানিং। অন্যদের লিস্ট ভিন্ন হতে পারে।

তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি যে বাঙালির জন্য বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতির ভূমিকা ব্যাপক।

কিছুটা দ্বিমত। রাজনীতি নিয়ে আমাদের যেই অতিরিক্ত অহংবোধ, আমার মতে সংস্কৃতি নিয়েও সেইটার কাছাকাছি সিচুয়েশন। মধ্যবিত্তের আত্মতুষ্টির একটা সহজ রাস্তা তৈরী হইছে। এতে নিম্নবিত্তদের প্রতি বৈষম্যের কোন অবসান নাই, আর তাদের পেটে ভাত জুটানোরও কোন দিক নির্দেশনা নাই। (নিতান্তই ব্যক্তিগত মতামত।)
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আপনার দ্বিমতে সহমত। হাসি সমাজের আর সব স্তরের মত সংস্কৃতিও "সূর্যমুখী" রোগে আক্রান্ত। সবাই বিত্তবানের সংস্কৃতি ধারন করতে চায়। সত্যিকার সংস্কৃতিমনস্ক জাতির আচরণ বিপরীত হওয়া উচিত ছিল। হয়তো উপর তলা থেকে খুব বাজে ভাবে লাথি খাওয়াটাই দরকার। আমার অনেক পুরনো একটা ধারনা হল, ব্রিটিশরাজ যদি অযথা আইসিএস পদে নিয়োগ দিতে বর্ণবৈষম্য না করতো, তাহলে ভারতবর্ষ কম করে আরো দুই শতাব্দি উপনিবেশ থেকে যেত। আমাদের যত নেতৃত্ব, তার সবই উচ্চপদ থেকে লাথি খেয়ে গড়ে ওঠা। শুনতে খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু গান্ধী থেকে মুজিব পর্যন্ত কেউই enlightenment এর তাড়না থেকে রাজনীতি করেননি। সবারটাই "thrust-upon" বা "আরোপিত" মহত্ত্ব।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

পড়ছি - - -

গৌতম এর ছবি

আমিও পড়ছি। চলুক...
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।