লেভারেজ - পরের পয়সায় পোদ্দারি

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি
লিখেছেন সুবিনয় মুস্তফী (তারিখ: সোম, ১৫/১২/২০০৮ - ৭:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মাহবুব মুর্শেদ জানালেন যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী বাঙ্গালিদের দুর্দশার কথা। বৃটেনেও অবস্থা দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। গত দুই সপ্তাহে আমার দুজন বন্ধু চাকুরি হারিয়েছে। একজন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকে কাজ করতো, তার পুরো ডিপার্টমেন্টই বন্ধ করে দিয়েছে। আরেকজন রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিতে - সে বেচারা গত এক-দুই মাসে কাউকে কোন চাকুরি খুঁজে দিতে পারেনি। তাই চাকরি নট। এই বাজারে একমাত্র স্কুলটিচার বা ডাক্তাররাই হয়তো হলফ করে বলতে পারবে যে তাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না বা হবে না। বেশির ভাগ পেশা আর বেশির ভাগ ইন্ডাস্ট্রিই কোন না কোন ভাবে ঝুঁকির সম্মুখীন। নিজের চাকরিও যে থাকবে আজ থেকে তিন মাস বা ছয় মাস পরে তার কোন গ্যারান্টি দিতে পারছি না।

কিন্তু এইসব নিয়ে টেনশন করলে তো জীবনের চাকাই বন্ধ হয়ে যাবে। মাহবুব আজকে যা দেখছেন, সেটা আমাদের দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছিল ২০০১-০২-এর ডটকম ক্র্যাশের সময়। ডিগ্রি শেষ করে মাত্র বেরুবো, এমন সময় টেক্সাস তথা পুরো দেশের চাকরির বাজার চুরমার। বন্ধুবান্ধবরা দলে দলে আবার নতুন কোর্সে ভর্তি হয়ে গেল - কেউ কেউ দ্বিতীয় এমন কি তৃতীয় মাস্টার্স-ও করতে বাধ্য হন! আমি চলে আসি ইউকে'তে। তবে সেই দেড়টা বছর - ২০০২-এর মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ২০০৩-এর শেষ অব্দি যেই পরিমান টেনশন করেছিলাম, যেই পরিমান হতাশা আর দুশ্চিন্তায় কাবু হয়েছিলাম - তাতে আমার আয়ুস্কাল যে বছর দশেক কমে গেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

এইবেলা তাই আর তেমন টেনশন করছি না। যা হবার হবে। ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডন। মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, every cloud has a silver lining। ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব ভেবে নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছি আর তুলনামূলকভাবে কিছুটা রিল্যাক্সড ফিল করছি, বা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

* * *

এই দুর্যোগের একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো - যারা কোনদিনও অর্থনীতির মারপ্যাঁচ নিয়ে বিশেষ কোন আগ্রহ বোধ করতেন না, তাদেরও অর্থনীতি সম্পর্কে ধারনা, জ্ঞান (economic literacy) আগের তুলনায় অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। আমার প্রায়ই মনে হয় যে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সকল ছাত্রকেই বেসিক ইকনমিক্স পড়ানো উচিত। শুধু টেক্সটবইয়ের প্রথাগত পুঁজিবাদ নয়, অর্থনীতির অন্যান্য ধারাও থাকা উচিত, যারা আগ্রহী তাদের জন্যে। আদৌ কোনদিন হবে কি না কে জানে, তবে আমার স্থির বিশ্বাস যে এই ধরনের জ্ঞান একটা উন্নয়নশীল দেশের নাগরিকদের জন্যে আরো বেশী জরুরী।

সে যাই হোক। শিরোনামে লেভারেজ-এর কথা উল্লেখ করেছিলাম। এইবারের মন্দা নিয়ে যারা পেপার পত্রিকা নাড়াচাড়া করছেন, তারা এই শব্দটা যত্রতত্র দেখে থাকবেন। আজকের লেখার বিষয়বস্তু এই 'লেভারেজ'।

লেভারেজ মানে কি? তেমন কঠিন কিছু না - লেভারেজ (leverage) মানে ধার-দেনা। অনেক কিছুকেই দোষ দেয়া যায় আজকের মন্দার জন্যে, তবে কাঠগড়ায় লেভারেজ-এর জন্যে একটা বিশেষ স্থান দিতেই হবে। অল্প কথায় লেভারেজ নিয়ে কিছু বলেই বিদায় নেবো।

বাস্তবে পুঁজিবাদের তিন-চার রকম মডেল নিয়ে খেলা চলছে আজকে। একদিকে আছে আমেরিকা-বৃটেনের Anglo-Saxon model - বা ইংরেজীভাষী দেশগুলোর পুঁজিবাদ। আরেকদিকে ইউরোপীয় পুঁজিবাদ - জার্মানি বা ফ্রান্স যেটা বেশী পছন্দ করে - সেখানে অর্থনীতিতে রাষ্ট্র বা সরকারের ভূমিকা অনেক বড়। আবার অন্যদিকে এশীয় ধারার চর্চাও আছে - সেটা একটু ভিন্ন ধাঁচের। রপ্তানীভিত্তিক অর্থনীতি, তাই পরের কাছে জিনিস বেঁচে নিজের দেশের উন্নয়ন হচ্ছে এর মূল কথা। (এঙ্গলো বনাম ইউরোপীয় চর্চা নিয়ে ইকনমিস্ট পত্রিকার একটি সুন্দর আর্টিকেল।)

ফিরে আসি প্রথম ধারায় - এঙ্গলো-স্যাক্সন মডেলে। এখানেই লেভারেজের চর্চা সবচেয়ে বেশী হয়েছে, এখানেই ধার-দেনা নিয়ে বেয়ারা রকমের বিশৃংখলা একটা হোলি খেলার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। প্রশ্ন আসে আমেরিকা বৃটেনের পুঁজিবাদে লেভারেজ এতো বড় স্থান কিভাবে পেলো?

এর উত্তর খুঁজতে শেয়ার বাজার এবং কর্পোরেটদের একটা বড় ভূমিকা আছে - সেটা একটু দেখা যাক।

লেভারেজ-এর আকর্ষণ - রিটার্ন বাড়ানোই মূল কথা
একটা সহজ উদাহরন দেই। ধরেন আমি ব্যবসা করতে চাই। ব্যবসা শুরু করার জন্যে পুঁজি আছে আমার ১০০ টাকা। এই ১০০ টাকা আমার মূলধন বা ইকুয়িটি (equity)। ব্যবসা আরম্ভ করলাম - ১০০ টাকা খাটিয়ে প্রথম বছর শেষে আ্মি মুনাফা করলাম ৪০ টাকা। তার মানে আমার লাভ হলো ৪০/১০০ - ঠিক ৪০% শতাংশ। এই চল্লিশ পার্সেন্ট হলো আমার রিটার্ন অন ইকুয়িটি (return on equity, সংক্ষেপে ROE)।

ধরেন আমার পাশের বাড়ির ছেলে জুয়েলও ব্যবসা করতে চায়। তার পুঁজি আছে আমার থেকে কম - ৫০ টাকা, কিন্তু তার প্রয়োজনও ১০০। জুয়েল বাকি ৫০ টাকা ব্যাংকের থেকে ধার করে ম্যানেজ করলো। এটা ওর লেভারেজ।

তাহলে জুয়েলের equity হলো ৫০ আর leverage(অথবা debt) হলো ৫০। মোট ১০০।

জুয়েল একই রকম ব্যবসা করে আমার মতোই লাভ করলো। ৪০ টাকা। ওর return on equity তাহলে কতো? সোজা হিসাব ৪০/৫০ = ৮০% শতাংশ। আমি আর ওই পোলা একই বাণিজ্য করলাম, একই মুনাফা করলাম কিন্তু ওর ROE আমার থেকে দ্বিগুণ!

আপনি হয়তো জিজ্ঞেস করবেন - কিন্তু ব্যাংকের টাকা তো ওর টাকা না - সেটা তো ফেরত দিতে হবে। ঠিক, হয়তো দীর্ঘ মেয়াদে গিয়ে তা দিতে হবে, কিন্তু এই বছর বা সামনের বছর ব্যাংক-কে শুধু সূদটা দিলেই চলবে, আসলের চিন্তা পরে করা যাবে। এমন কি চাইলে ব্যাংকের সাথে আলোচনা করে আসলটা রিনিউ বা rollover-ও করা যেতে পারে। মানে জুয়েল শুধু সূদটা সময়মত দিতে পারলেই কেল্লা ফতে।

ইনভেস্টর বা শেয়ার কারবারীরা শুধু ঐ রিটার্ন অন ইকুয়িটি-টাই দেখবে। ওরা দেখবে আমার ROE ৪০% আর জুয়েল দিচ্ছে ৮০%। তাই ওর ব্যবসা আরো বেশী বিনিয়োগকারী পাবে, আরো বেশী শেয়ার বিক্রি করবে। জুয়েলের কম্পানীর শেয়ারের দামও বাড়বে আমার থেকে দ্রুত। আর আমি, আমার শেয়ার, আমার বিনিয়োগ পড়ে থাকবে তিমিরে।

এই যে লেভারেজ-এর উদাহরণ দিলাম, সেটাকেই আরো বহুগুণে ব্যবহার করে আমাদের বাবাধন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এবং হেজ ফান্ড (hedge fund) রা ব্যবসা করেছিল। ১ টাকা মূলধন তো ৩০ টাকা লেভারেজ বা ধার করা। ROE সেই রকম ফাটাফাটি, শেয়ারের দাম আকাশচুম্বী, আর বছর শেষে বোনাস - তার তো কোন কথাই নাই!

সেই লেভারেজ-এর বুদবুদই ফেটে গেলো ২০০৮ সালে। বছরের শুরুতে একটা সিরিজ লিখেছিলাম এই সস্তা ঋণের উৎস নিয়ে। পুরান পাঠকরা হয়তো পড়ে থাকবেন। বছরের শেষে আমরা দাঁড়িয়ে আছি ধ্বংসস্তুপের উপরে। এখন শুরু হয়েছে deleveraging-এর যুগ। নিজের মাকেও এখন আর কেউ ৫ টাকা ধার দিতে রাজী না, এমন অবস্থা প্রায়!

এই বছর যা কিছু ঘটে গেছে, তা নিয়ে শত শত বই পুস্তক লেখা হবে আগামীতে। ১০০ বছর পরে অর্থনীতির পাঠ্যবইয়ের পাতায় এই আশ্চর্য বছর ২০০৮-কে নিয়ে পোলাপান পড়াশোনা করবে। কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য/দুর্ভাগ্য হলো।

আরেকটা জিনিস যেটা শিখেছি এই বছর, তা হলো - বাজারের গতিবিধি নিয়ে আসলেই কেউ কিছু জানে না। No one knows a f**king thing। চেষ্টা করবো এই নিয়ে আরেকটু নিয়মিত লেখার। দেখা যাক কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়।

অবশেষে একটা লিংক - গার্ডিয়ান পত্রিকায় উইল হাটোন-এর সাম্প্রতিক একটি লেখা - জার্মান মডেল ভালো না বৃটেনের-টা ভালো? ঝরঝরে আলাপ, পড়ে মজা পাবেন।

P.S. এই শব্দগুলো সমার্থক - leverage, debt বা gearing। যদি শুনেন কোন মানুষ বা কম্পানী highly leveraged বা highly geared, বুঝবেন ব্যাটা পরের পয়সা নিয়ে মাস্তানী করতেছে।


মন্তব্য

স্নিগ্ধা এর ছবি

১০০ বছর পরে অর্থনীতির পাঠ্যবইয়ের পাতায় এই আশ্চর্য বছর ২০০৮ কে নিয়ে পোলাপান পড়া শোনা করবেন। কাছে থেকে দেখা - আরেকটা জিনিস যেটা শিখেছি এই বছর, তা হলো - বাজারের গতিবিধি নিয়ে আস লেই কেউ কিছু জানে না।

একদম ঠিক!

সৌরভ এর ছবি

No one knows a f**king thing

এইটাই মোদ্দাকথা মনেহয়।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

এপ্রিল মে-র দিকে তেলের দাম যখন ১০০ পার করলো, তখন ওপেকের হুজুর থেকে শুরু করে গোল্ডম্যান স্যাক্সের জাঁদরেল অর্থনীতিবিদ পর্যন্ত বললো তেলের দাম ২০০ ডলার হয়ে যাবে। ঐ গোল্ডম্যান মিয়ার বাৎসরিক বেতন লাখো ডলারের কম না। জানতে চাই হালার চাকরি কি এখনো আছে, না নাই? তেলের দাম মাটিতে আইসা ঠেকার অবস্থা এখন, অথচ মোটে ছয় মাস আগের ভবিষ্যদবানী!

-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

সুবিনয় মুস্তফী লিখেছেন:
একজন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকে কাজ করতো, তার পুরো ডিপার্টমেন্টই বন্ধ করে দিয়েছে।

একই ব্যাপার ঘটল গত সপ্তাহে। পিটসবার্গে মেলোন ব্যাংকের আইটি ডিপার্টমেন্টে চাকরী করত এক বাংলাদেশী ছেলে। খুব ভালোও করছিল। এখন পুরো আইটি ডিপার্টমেন্ট ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দিচ্ছে খরচ বাঁচাতে। হঠাৎ করে পানিতে পড়ে গেল বাঙ্গালী ছেলেটি।

সুবিনয় মুস্তফী লিখেছেন:
এই বাজারে একমাত্র স্কুলটিচার বা ডাক্তাররাই হয়তো হলফ করে বলতে পারবে যে তাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না বা হবে না।

এখানকার ডাক্তারদের সাথে কথা হল। তাদের সাফ কথা, 'মানুষ থাকলে ডাক্তার থাকবে'। তাদের চিন্তামুক্ত জীবন দেখে ভাবছি আবার ডাক্তারী পড়া শুরু করব নাকি!

আপনার লেভারেজে বর্ণনা পড়ে ঘটনাটা আরেকটু করে বুঝলাম। কিন্তু আসলে ঠিক কিভাবে এটা ভেঙ্গে পড়ল সেটা নাকি ফেডের চেয়ারম্যানও বুঝতে পারছে না। দূর্যোগটা চিন্তা করেন! কারো কোন ক্লু নাই কি ঘটল, কি ঘটতে পারে এবং উদ্ধারের উপায় কি। আমার তো মনে হয় এভাবে একের পর এক বাবল ফাটতেই থাকবে যতক্ষণ না পশ্চিমা দেশ গুলি মুখ থুবড়ে পড়ে।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

ক্লু কিছু কিছু আছে, মূলত সাবপ্রাইম হাউজিং মর্টগেজ এবং তার securitization থেকে এর শুরু। সেই কাহিনী আরেকটু লম্বা, সময় নিয়ে আরেকদিন লিখবো। আর গ্রীনস্প্যানের সম্পর্কে নতুন কিছু বলার নাই। ও কি একটা শুওরের বাচ্চা না একটা বোকাচো**, নাকি উভয়ের অদ্ভূত শংকর, সেটাই জানার বিষয়। তবে স্বান্ত্বনা একটাই - বাজারে ওর যা সুনাম ছিল, সেইটা মোটামুটি ভূলুন্ঠিত। বাজারে 'গ্রীন্সপ্যান' এখন একটা গালির মতো।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

এই ঘটনাটা দেখেন। কানাডায় ৬১ বছর বয়স্ক কার্কপ্যাট্রিক নামের ভদ্রলোক চাকরী চলে যাবার পর অফিসের ক্রিসমাস পার্টিতে এসে গুলি করে সিইওকে মেরে ফেলেছে।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

দিগন্ত এর ছবি

এই ঘটনা কদিন আগেও একবার দেখেছি।


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

হুম, বুঝলাম। এবার কন চাকরি দিবেন নাকি?

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

এই ফ্রডের ঘটনাটা দেখেন। আপনি যে কায়দাটা বর্ননা করলেন সেটাই ম্যাস স্কেলে এক্সারসাইজ করেছে ব্যাটা।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

যুধিষ্ঠির এর ছবি

যদি শুনেন কোন মানুষ বা কম্পানী highly leveraged বা highly geared, বুঝবেন ব্যাটা পরের পয়সা নিয়ে মাস্তানী করতেছে।

দারুণ সত্যি কথা। মাত্র ছ'মাস আগেও CNBC খুললে এই কথাগুলোই অনেক শোনা যেত!

s-s এর ছবি

আ্যালান গ্রীনস্প্যান একটা গর্ভস্রাব, আগেও বলেছি, আবারও বললাম।

জীবন জীবন্ত হোক, তুচ্ছ অমরতা

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রিয় সুবিনয়, অনেকদিন পর লিখলেন। যা অবস্থা চলছে আরো আগেই আপনার লেখা আশা করেছিলাম। যাই হোক, অসংখ্য ধন্যবাদ। এই বিপদে দয়া করে চুপ করে না থেকে যা বোঝেন তা তাড়াতাড়ি লিখে ফেলুন। তাতে আমার মত অর্থনীতি-মূর্খদের অনেক উপকার হবে।

১। মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে আমাদের মত দেশে কেন বাধ্যতামূলক অর্থনীতি পড়ানো হয় না তা আমার বোধগম্য নয়। হয়তো এতে ছেলে-মেয়েদের উপর চাপ বাড়ে। তা ধর্মশিক্ষার মত "অতীব জরুরী" বিষয় বাদ দিলে অনায়াসেই অর্থনীতি সিলেবাসে ঢোকানো যায়। কিন্তু তাতে তো কর্তাদের ভোট কমে যাবে। তাই অর্থনীতি বাদ।

২। আমার সামান্য পদার্থবিদ্যার জ্ঞানে বুঝি একটা লম্বা "সহায়কের" একপ্রান্তে থাকে "ভার" আর আরেক প্রান্তে থাকে "প্রচেষ্টা"। "সাম্যবিন্দু" যদি "ভারের" কাছাকাছি থাকে তাহলে অল্প "প্রচেষ্টায়" অধিক "ভার" উত্তোলন করা সম্ভব। অর্থনীতির হিসাবে অল্প ব্যক্তিগত/প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের বিপরীতে বিপুল পরিমান বাজার বিনিয়োগ লাভ তথা তার মাধ্যমে বিপুল পরিমান মুনাফা অর্জনই হচ্ছে লিভারেজ। কিন্তু এই হিসাবে সহায়কের ভূমিকা কে পালন করে? নিঃসন্দেহে বাজার তথা ম্যাঙ্গো পাবলিক। হয় তারা অধিক দামে শেয়ার কেনে, অথবা নানা প্রকার আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত রাখে বা বিনিয়োগ করে। শুধু সুদ বা ডিভিডেণ্ড দেবার কড়ারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবে তাদের পেয়ারের লোক/প্রতিষ্ঠানদের গৌরীসেনের টাকা পাইয়ে দেয়। তারপর কী হয় তা আমরা দেশে-বিদেশে হাজারোবার দেখেছি। সমস্যা হচ্ছে সবার টাকা মেরে দেয়া এই ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানগুলোর বা তাদের হর্তা-কর্তাদের (আসলে বলা উচিত চোরগুলোর) কোন বিচার বা শাস্তি হয়না। মাঝে-মধ্যে কারো কারো সামান্য বিচার/শাস্তি হলে সরকারের কর্তা আর কর্তাভজা মিডিয়ার লাফ-ঝাঁপের আর শেষ থাকেনা। একক বা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা এক ধাক্কায় পথের ফকির হয়ে যান। এনিয়ে সম্ভবতঃ কারো কোন মাথাব্যথা থাকেনা। আমরা বোধহয় ধরেই নিয়েছি এভাবেই আমরা কিছুদিন পর পর প্রতারিত হব বা লুন্ঠিত হব।

৩। সরকার নিয়ন্ত্রিত জুয়া বা লুটের যন্ত্র হচ্ছে শেয়ার বাজার। যে কোম্পানী গত দশ বৎসরে ১০% ডিভিডেণ্ডও দেয়নি, যাদের প্রডাকশন ধুঁকছে তাদের ১০০ টাকার শেয়ারের দাম ৩,০০০ টাকা। এই কোম্পানী লাটে উঠলে ৩,০০০ টাকায় কেনা শেয়ারহোল্ডারেরা পাবেন ১০০ টাকা (তাও বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে, আইন-আদালত করে)। বাজারে নানা রকম গুজব ছড়িয়ে শেয়ারের দাম পাতালে নামিয়ে আনা নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। এসময় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ভয়ে (অথবা দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ রাখতে পারবেন না বলে) যেকোন প্রকারে কমদামে শেয়ার বিক্রি করে দেন। এসময় বড় বিনিয়োগকারীরা বা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকগুলো শেয়ারগুলো কিনে নেন। সপ্তাহশেষে গুজব মিথ্যা প্রমাণিত হয় আর শেয়ার বাজার আবার চাঙ্গা হয়। এদফা বড়রা আবার চড়াদামে (আগে সস্তায় কেনা) ছোটদের কাছে শেয়ারগুলো বিক্রি করে বিরাট মুনাফা পকেটে ভরেন। লিভারেজের এই আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক হলেও এই কথাগুলো বললাম শুধু এই ভেবে যে, মানুষ যখন আর্থিক দুর্গতিতে পড়ে তখন তার মধ্যে জুয়া বা ঝুঁকি প্রবণতা বেড়ে যায়। রাঘব-বোয়ালেরা এই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। এই সময় দ্রুত লাভসহ বিনিয়োগ ফেরত, পাঁচে-চল্লিশ (স্নোবল ইফেক্ট), চাঙ্গা শেয়ার বাজার, চাঙ্গা মুদ্রা বাজার ইত্যাদি স্কিমগুলো বাজারে ছাড়া হয়। বিপন্ন মানুষেরা তখন একটু লাভের আশায় সেগুলোতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অচিরেই তারা আরো বেশী পুঁজি হারিয়ে অথৈ সাগরে পড়েন। জীবনে কোন কিছুই বিনামূল্যে বা প্রায় বিনামূল্যে পাওয়া যায় না। যথেষ্ঠ দাম দিয়েই সব কিছু পেতে হয়। যখন কোন কিছু কেনেন তখন তাতে বিক্রেতার লাভ থেকেই যায়। তাই সবকিছুই বেশি দামে কেনা কমদামী জিনিষ। তাই প্রিয় বন্ধুরা, এই বিপদে একটু সাবধানী হোন। আশাহত হবেন না।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

পান্ডব, মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমার মনে হয় আপনার বিশ্লেষণটা কিছুটা এক-পেশে হয়েছে, এই বিধায় যে আপনি বলতে চাইছেন যে শেয়ার বাজার, মানুষের সেভিংস এইসবকে বাণিজ্য-শিল্প-কারখানার দিকে পাঠিয়ে আসলে কোন লাভ নেই, কারন সবই জোচ্চুরি। এটাই মানতে পারলাম না, কারন দেশের উন্নয়নে properly-functioning financial markets-এর কি ভূমিকা আছে তা বুঝতে চাইলে যে কোন একটা উন্নত দেশের দিকে চোখ ফেরালেই পরিষ্কার হবে। ছুরি দিয়ে আপনি আলু কেটে মজাদার ভাজি রান্না করতে পারেন। আর একই ছুরি দিয়ে মানুষের গলা কাটতে পারেন। শেয়ার বাজার আর সেভিংস-এর সুচারু প্রয়োগ - এইসবই মানুষের নিয়ন্ত্রনে। নীতি-নির্ধারকদের মেধা-বুদ্ধি, সততা আর দক্ষতার অভাব পুরোটাই বাজারের ঘাড়ে চাপাতে পারছি না।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রিয় সুবিনয়, আপনার প্রতি-মন্তব্যর সাথে বহুলাংশে একমত। আমার বিশ্লেষণ খুব অল্প কিছু উন্নত দেশ ছাড়া আর বাকী প্রায় সব দেশের জন্য প্রযোজ্য হবার কথা। সুষম, নিয়মতান্ত্রিক শেয়ার বাজারের জন্য প্রয়োজনীয় Efficient Market Hypothesis-এর মৌলিক দু'টি অনুকল্পের দু'টিই এসব দেশে অনুপস্থিত। তাই এই শেয়ার বাজারকে আমার কাছে জুয়া এবং লুট ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না। উন্নত বিশ্বে হিসেবটা অন্য রকম সত্যি, তবে হঠাৎ করে বাজারে ধ্বস যখন নামে তখন নানা রকম তত্ত্ব কপচিয়ে Mass Level-এ লুটকেই জায়েজ করার চেষ্টা করা হয় বলেই মনে হয়।

একটু বিভ্রান্ত হয়েছি আপনার এই কথায়ঃ

"নীতি-নির্ধারকদের মেধা-বুদ্ধি, সততা আর দক্ষতার অভাব পুরোটাই বাজারের ঘাড়ে চাপাতে পারছি না"

আমি কিন্তু বাজার বলতে ম্যাঙ্গো পাবলিকের কথাই বলেছিলাম। এবং আমি তাদের সীমাবদ্ধতা ও অজ্ঞানতার কথা বলেছিলাম। দায় অতি অবশ্যই নীতি-নির্ধারকদের। তা তাদের সীমাবদ্ধতাই বলুন বা নষ্টামীই বলুন।

আমার আশংকা এই দুর্দিনে উন্নয়নশীল (আসলে অনুন্নত) দুনিয়ার নষ্ট বুদ্ধিগুলির বিচ্ছিন্ন বা সামগ্রিক প্রয়োগ না আবার উন্নত দুনিয়ায় শুরু হয়।

অপ্রাসঙ্গিক হলেও যেসব বিষয় নিয়ে আমার আশংকা ছিল (শেয়ার বাজারসহ) সেগুলো সম্পর্কে আমার না-দেখা প্রিয়জনদের আমি একটু সাবধান করতে চেয়েছিলাম। যেহেতু এই টপিকগুলো আপনার মূল পোস্টের সাথে প্রাসঙ্গিক নয় তাই এই আলোচনা আপনি চাইলে আমরা আপাততঃ মুলতুবী রাখতে পারি। পরে কখনো আপনার, আমার বা অন্য কারো এসংক্রান্ত পোস্টে আমারা আবার আলোচনা করতে পারি।

এই দুর্দিনে ভালো থাকুন। ভালো কিছুর আশায় থাকুন।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

পান্ডব, মন্তব্য়র জ্নয় ধন্য়বাদ। অনেকগুলো ঠিক কথাই বলেছেন। এই নিরন্তর asset bubble তৈরী আর তার ভাঙ্গন নিয়ে একটা আর্টিকেল এসেছে আটলান্টিক পত্রিকায়। এক্সপেরিমেন্টাল ইকনমিক্স বলে অর্থনীতির যে শাখাটা আছে - অর্থনীতি আর মনস্তত্ত্ব যেখানে এসে এক হয় - সেই শাখাটা ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ভার্নন স্মিথ সেই শাখার একজন গুরু - নোবেল পেয়েছেন কয়েক বছর আগে। তিনি এক্সপেরিমেন্ট করে বুঝতে চাইছেন যে বাবল কি সব সময়, সব জায়গাতেই অবধারিত? নাকি এর কোন অন্য়থাও হতে পারে?

একটু ঘোলাটে লেখা, সব বুঝিনি। কিন্তু এক্সপেরিমেন্ট-টা খুব ইন্টারেস্টিং। আর চরম অবস্থায় ইনভেস্টররা নিজেদের সাথে কি রকম আত্মপ্ররোচনা করতে পারে, বার্নার্ড ম্যাডোফ নামের পুকুরচোরই তার বড় প্রমাণ। বিবিসির চমতকার নিবন্ধ।

-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

শামীম এর ছবি

জ্ঞান আহরণের সুযোগ দেয়াতে চুপচাপ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেলাম।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।