একজন নিভৃতচারী মানুষের গল্প

সচল জাহিদ এর ছবি
লিখেছেন সচল জাহিদ (তারিখ: বিষ্যুদ, ১২/০২/২০০৯ - ১:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

উৎসর্গঃ জাহিদুল ইসলাম গনী


'আমার এই দু’টি চোখ পাথরতো নয় তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়
কখনো নদীর মত তোমার পথের পানে বয়ে বয়ে যায়.................'

সুবীরনন্দীর গাওয়া এই অসম্ভব সুন্দর গানটি শোনেননি অথবা পছন্দ করেননা এমন বাংলা গানের শ্রোতা পাওয়া দুস্কর।বাংলা গানের একজন নেশাছন্ন শ্রোতা হিসেবে গানটি আমারো পছন্দের তালিকায় বেশ উপরের দিকে।এই গানটিকে আমরা চিনি সুবীরনন্দীর গান হিসেবে কিন্তু এটির রচয়িতার কোন খাবর কি আমরা কখনো রেখেছি? কেউ কি জানি কি অবহেলা আর অনাদরে গান রচনা থেকে নিজেকে বিরত রেখে আজ এক নিবিড় পল্লীতে একেবারে সাধারন মানুষের মত জীবন যাপন করছেন অসম্ভব মেধাবী এই কবি? আমার আজকের লেখনীর প্রয়াস সেই মানুষটিকে নিয়ে।

আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগের কথা।গনী ভাই এর সাথে আমার পরিচয় আমার বড়বোনার বিয়ের সময়।পুরো নাম আমার নামের মতই জাহিদুল ইসলাম গনী।আমার দুলাভাই এর দূর সম্পর্কের দুলাভাই, সেই হিসেবে ভাই সম্মোধন করেই আলাপ শুরু। গ্রামের আর দশটা সাধারন মানুষের মতই জীবন যাপনে অভ্যস্থ এই মানুষটিকে প্রথম দর্শনে আমার বিশেষ কিছু মনে হয়নি তাই স্বাভাবিক ভাবে কেমন আছেন কি করছেন এই ধরনের সৌজন্যমূলক আলাপচারিতার বেশি আর কিছু গড়ায়নি।যাই হোক যেদিনের কথা বলছিলাম সেটা বিয়ের দিন। গনি ভাই আমার বোনের সাথে পরিচয় হলেন, কথা বললেন, দুলাভাই সুলভ ঠাট্টা মশকরা করলেন এবং যথারীতি অনুষ্ঠান শেষে চলে গেলেন।পরের দিন বৌভাত উপলক্ষ্যে আমরা সবাই মিলে মজা করতে করতে গেলাম ভুঞাপুর থানার গোলাবাড়ী নামক স্থানে আমার আপূর শশুরবাড়ীতে।আপুর পাশে বসে গল্প করছি এমন সময়ে সেখানে গনী ভাই এর আবির্ভাব। হাতে ছোট্ট একটি কাগজ আমার আপুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ঝর্না তোমার আর মনি(আমার দুলাভাই এর নাম)কে নিয়ে শুভকামনা জানিয়ে একটা কবিতে লেখেছি পড়ে দেখ। চলে যাবার পড়ে আমি আপুর কাছ থেকে কাগজটা নিয়ে দেখলাম, লম্বা সাইজের কাগজে পুরো দুই পৃষ্ঠা জুড়ে রচনা এবং এককথায় অসাধারন। মুহুর্তের মধ্যে আমি মানুষটির সম্মন্ধে বেশ উৎসাহ বোধ করলাম এবং বেশ আলাপ জমিয়ে ফেললাম। থাকেন পাশের গ্রামেই, একটি বেসরকারী স্বাস্থসেবা কেন্দ্রে চাকুরী করেন, বিয়ে করেছেন বেশ আগে, একটি ছেলে আছে গ্রামের স্কুলেই পড়াশুনা করে।কিছু আলাপচারিতা হলোঃ

লেখালেখি করে থেকে করছেন ?
‘সে প্রায় অনেক দিন থেকে, ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি করি’
মূলতঃ কি কি লেখেন?
‘কবিতা কখনো গান’
বই বের করেছেন ?
‘সে সূযোগ কখনো পাইনি, নিজের আনন্দে লিখি’
আর গান নিয়ে ?
‘নিজেই লিখি, অনেক সময় সুর দেই, মাঝে মাঝে গাইতে চেষ্টা করি’
কখনো রেডিও বা টিভি তে পাঠান নাই?

এই পর্যায়ে গনী ভাই একেবারে চুপ। আমি বিব্রত হই, ভাবি জিজ্ঞেস করা কি ঠিক হল? কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন, ‘কষ্টের কথা মনে করিয়ে দিলে ভাই’। আমি বলি কিসের কষ্ট? আরো কিছুক্ষন মিয়ম্রান থেকে গনী ভাই বলে ‘অনেক গান রেডিওতে বা টিভিতে পাঠাইছি, কিন্তু ওরা আমাকে তেমন কিছু জানাইনাই।হঠাৎ একদিন শুনি আমারি লেখা একটি গান রেডিও তে বাজতেছে। আমি অপেক্ষা করলাম কানটি কার লেখা শুনার জন্য, দেখি অন্য একজনের নাম।এত কষ্ট পেয়েছিলাম সেই দিন তা আর বলার মত না। তার পর থেকে আর পাঠাইনা। নিজের জন্য লিখি। তবে দু’একটা গান আমার নামেও দিছে এবং তার জন্য কিছু টাকাও পাইছি নামে মাত্র’

আমি বলি আপনার লেখা কোন গানের নাম মনে আছে?

‘একটা গান খুব বিখ্যাত হইছিল ওই যে সুবীরনন্দী গায় গানটা, আমার এই দু’টি চোখ পাথরতো নয় তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায় কখনো নদীর মত তোমার পথের পানে বয়ে বয়ে যায়’

আমি আমার নিজের কানকে বিশ্বাষ করতে পারছিনা।এরকম একটি অসম্ভব জনপ্রিয় আর শাশ্বত গানের স্রষ্টার পাশে আমি বসে আছি? সময়টা ১৯৯২ আমি তখন নবম শ্রেনীর ছাত্র, তারুন্যের উম্মাদনায় তখনকার ব্যান্ড সংগীতের স্বর্নযুগের মানুষ আমি, কিন্তু এইসব গানত তার আগেই আমার রক্তে, মজ্জায় ঢুকে গেছে। বাসায় আপু গান শুনত আর গুন গুন করে গাইত সেই সাথে আমিও। সেই সব গানের একটিত এটাও আর সেই গানের গীতিকার পড়ে আছেন এই অজপাড়াগায়ে? কতৃপক্ষের অবহেলায়, অনাদরে, শঠকারীতায় নিজেকে আড়াল করে রেখেছে এই ভাবে? আমি আমার মনকে মানাতে পারিনা বড্ড বেশী আবেগ তাড়িত হয়ে যাই। বিয়ে বাড়ীর আনন্দ আমার কাছে ম্লান হয়ে যায়।আমি গনী ভাইকে বলি আর কখনো লিখবেননা? ঝটপট উত্তর ‘না’

সেদিন অনেক রাতে বাসায় আসি।মনটা আশান্ত থেকেই যায়। মধ্যবিত্ত পরিবারে ভাই বোনের মাটির ব্যাংকে জমানো টাকা দিয়ে কেনা ক্যাসেট প্লেয়ারে গানটা ছেড়ে দিয়ে আমি বাতি নিভিয়ে বসে থাকি………

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA


মন্তব্য

যুধিষ্ঠির এর ছবি

আমার অনেক প্রিয় গান। জানতাম যে এটার স্রষ্টা সুবীর নন্দী নন, কিন্তু কে সেটা জানতাম না। এই গুনী গীতিকারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ। ওনার সাথে আবার দেখা হলে অনুগ্রহ করে তাকে আমার হয়ে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাবেন।

আমাদের দেশের গানের সিস্টেমটাই কেন যেন এরকম, যেখানে গীতিকারের কোন সরব উপস্থিতি থাকে না। ব্যাণ্ড সঙ্গীতের ক্ষেত্রে কিছুটা এরকম হয়েছে যে শিল্পী নিজেই গীতিকার, কিন্তু এর বাইরে পুরোটাই প্রায় গায়ক-প্রাধান্য পূর্ণ। আমি জানি না বাংলাদেশে কেন এটা ঘটে না। পাশ্চাত্যে দেখবেন একজন ভালো শিল্পী প্রায় সবসময়ই নিজের লেখা গান গাইবেন - তার গানের গলা ভালো হোক বা না হোক। বব ডীলানের গানের গলা বেশ ভালো, এই কথা সম্ভবত: খুব কম লোকই বলবেন। এখানে আমি প্রকৃত সঙ্গীতশিল্পীদের কথা বলছি, ব্রিটনী স্পীয়ার্সের মত ম্যানুফ্যাকচার্ড বাণিজ্যিক পন্যের কথা এই যুক্তির বাইরে।

সচল জাহিদ এর ছবি

যুধিষ্ঠির ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।আমার নিজস্ব মতামত হচ্ছে একটি গানের সৃষ্টির পেছনে অবদান তিন জনেরই অর্থ্যাত গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পী। আমরা মুলত শিল্পীকে দিয়েই গানটাকে চিনি কারন তিনি গানটা মানুষের সামনে নিয়ে আসে বলে। আবার কিছু গানকে আমরা চিনি গীতিকারের নামেই যেমনটা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন কিংবা হাসন রাজার লেখা গানগুলি। এই গানগুলি যেই গাননা কেন আমরা কিন্তু বলবো ওটা রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, লালনগীতি, বা হাসন রাজার গান।যদিও কিছু কিছু নজরুল গীতি বাদ দিলে তাদের লেখা প্রায় সব গানেরই সুরকার এবং মুল গায়ক তারা নিজেরাই। তাই আপনি বব দিলানের যে উদাহরন টানলেন সেট আমাদের সংস্কৃতিতেও বর্তমান। আমার মতে মূল সমস্যা হচ্ছে আমাদের লোকগীতি আর আধুনিক গান এর ক্ষেত্রে।

লোকগীতি যেহেতু সংগায়নের দিক থেকে ' লোক মুখের সংগীত' বলে অনেকে মনে করেন তাই অনেক ক্ষেত্রেই এসব গানের মূল গীতিকার বা সুরকার এর তথ্য জানা যায়না। অনেক গীতিকার আবার গানের মধ্যেই তাদের নিজেদের নাম প্রকাশ করেছেন। যেমন ' ভ্রমর কইও গিয়া ...' জনপ্রিয় এই গানটির গীতিকার অনেকেই জানেননা কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে এই গানের একটা অন্তরার লাইন এরকম ' ভাইবে রাধারমন বলে শোন রে কালিয়া ...' সুতরাং গানটি যে রাধারমন দত্তের তা বলাই বাহুল্য। একই রকম দেখা যায় 'গাড়ি চলেনা চলেনা ...' কিংবা 'কুহু সুরে মনের আগুন আর জ্বালাইওনা ...' এর ক্ষেত্রে (আব্দুল করিম)।

আধুনিক গানের ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরও প্রকট। আমরা খুব কম ক্ষেত্রেই জানতে পারি গানিটির রচয়িতা বা সুরকার কে। এই বিষয়ে আমার ব্যাক্তিগত মত হলো প্রত্যেকটা শিল্পী তার গাওয়া যেকোন গান দর্শকের সামনে উপস্থাপনের পূর্বে যদি উল্লেখ করেন তাদের কথা তাহলে অন্তত মানুষ জানবে গানটি সৃষ্টির ইতিহাস। এই কাজটি আমি অনেক শিল্পীকে করতে দেখি তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটি অনুপস্থিত থাকায় আসল মানুষগুলো রয়ে যায় লোক চক্ষুর অন্তরালে কিছুটা আমাদের গনীভাই এর মত।

_____________________
জাহিদুল ইসলাম
এডমনটন, আলবার্টা, কানাডা


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

যুধিষ্ঠির এর ছবি

ঠিক। যদি শিল্পীরা এই কাজটি নিয়মিত করতেন তাহলে তো কোন সমস্যাই ছিলো না। ক'বছর আগে খুব খারাপ লেগেছিলো মাহমুদুজ্জামান বাবু'র মত শিল্পীকে দেখে যখন "আমি বাংলায় গান গাই" এর সকল কৃতিত্ব এবং প্রশংসা নির্দ্বিধায় নি:শব্দে মেনে নিচ্ছিলেন। উনার সিডি'র কভারে গীতিকার প্রতুল ব্যানার্জীর নাম ছোট করে লেখা ছিলো যদিও, কিন্তু কখনো কোন কনসার্টে বা সাক্ষাৎকারে উনাকে আগ বাড়িয়ে বলতে শুনিনি যে এই গানটা প্রতুলবাবু আনেক আগেই লিখেছেন, গেয়েছেন, প্রকাশ করেছেন তার যেতে হবে অ্যালবামে। এই "ক্ষুদ্র" শিল্পীকে হয়তো সম্মানী দেয়া হয়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু দিলে বাবু'র বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের কোন ক্ষতিও হত না, তবুও তিনি সেটা দেন নি।

আশা করি আপনার লেখার মাধ্যমে অন্তত: ব্লগভূবণে এই সচেতনতাটা তৈরী হবে, আর প্রচারবিমুখ গণীভাই, প্রতুলবাবুরা কিছুটা হলেও স্বীকৃতি পাবেন।

রানা মেহের এর ছবি

মন খারাপ হয়ে গেল পড়ে
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

তানবীরা এর ছবি

মন খারাপ হয়ে গেলো। এরশাদ যুগে যুগে

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।