-তোমরা বেবাকে যে আইছ এতে আমি বড়ই খুশি হইছি। আল্লার রহমতে আমার অনেক আছে। গেল বছর হজ্ব করতে যাইয়া নিজের চোখে মক্কা মদীনা দেইখা আহার পরে আমার দেলে দুনিয়াদারীর চিন্তা ফিকির আর নাই। তাই ভাবলাম মানুষের জন্য কিছু একটা করি। এজন্যই তোমাগরে ডাকলাম যাতে তোমাগর সমস্যার কথা শুইনা কিছু একটা করতে পারি।
মন্ডলের কথা শেষ করে তাকায়, সামনে বসা লোকগুলির কাছ থেকে মন্তব্য আশা করে। সে আশাহত হয়না, ফজলু বলে উঠে,
-আক্কাসের কাছ থিকা একটু আধতু শুনছি। এবার আপনে গাঙ্গের বিষয়ডা একটু খোলাসা কইরা কন মন্ডল সাব।
মানুষের আগ্রহ দেখে রশীদের ভাল লাগে। মনে মনে ভাবে, জীবন আর কয় দিনের, কিছু মানুষের ভাল কইরা যাইতে পারলে কব্বরে যাইয়াও শান্তি। পকেট থেকে বাক্সটা বের করে আরো একটা পান মুখে পুড়ে রশীদ আসল কথায় আসে,
-তোমরা সবাই জান আমাগো গাঙ্গটা বানের সময় ছাড়া বাকী সময় শুকনা থাকে। শীতকালে সেই শুকনা গাঙ্গে শুকুর মিয়া লোকজন দিয়া ইরি ধান বুনে। কিন্তু গাঙ্গ হইল সরকারের, শুকুর মিয়ার না। এইহানে সবারই অধিকার আছে। আমি গত সপ্তাহে শহরে গিয়া উকিলের সাথে কথা কতা কইয়া আইছি। শুকুর মিয়ার নামে একটা কেস কইরা দিলেই এই গাঙ্গ গ্রামের ভুমিহীনগো নামে ডিক্রি হইব।
মন্ডলের কথায় সামনে বসা মানুষগুলো মাথা নাড়ে, ভরসা পায়, কিন্তু ভুমিহীন কথাটা ঠিক মাথায় ঢুকেনা। মন্ডল বুঝতে পেরে খোলাসা করে,
-ভুমিহীন হইল যাগোর জমি এক্কেবারেই নাই বা আছে যৎসামান্য। তোমরা সক্কলে মিলা মিশা যদি কিছু টাকা সংগ্রহ কর তাইলে কেস চালানোর বাদবাকী খরচ আমি দিমু।
এবার সকলের মাথায় জিনিসটা ঢুকে, সেই সাথে মন্ডলের প্রতি আলাদা একটা শ্রদ্ধাবোধ আসে। পরিস্থিতি বুঝে মন্ডল নতুন কথা পাড়ে,
-তয় কথা হইল গিয়া কেস কাহিনী সুরাহা হইতেত সময় লাগে, এইবার গাঙ্গে ফলন ভাল হইছে, তোমরা চাইলে শুকুর মিয়ার দলবল ধান কাটার আগেই জমি দখল করতে পার, তাইলে জমিও আইব লগে পাকা ধান। জমিতো আর শুকুরের বাপের না, তার কি কোন হক আছে ঐ ফসলে? থানার ওসির লগে আমার খুব খাতির, তারে আগে থিকা কইয়া রাখলে কোন গ্যাঞ্জাম হইবনা। আর তোমরাতো জোর জবর করতাছনা, এইডা হইল গিয়া তোমাগর হক।
রশীদ মন্ডলের কথায় সবার চোখে পাকা ফসলের ছবি ভাসে আবার ভয়ও লাগে। ফজলু ইতস্তত করে বলে,
-মন্ডল সাব আমরার হাতে কি আর লাঠি মানাবো ?
এই কথায় খ্যাক খ্যাক করে উঠে মন্ডল,
-পেডে ভাত না থাকলে হাতে খালি লাঠি কেন, দরকার হইছে ফালা সুরকীও নিবা। তোমরা কি মাইয়া মানুষ নাকি মিয়ারা, বুকে জোর নাই?
এইবার সকলের রক্ত গরম হয়, সত্যিতো শুকুর মিয়া জোর জবর করে গরীবের হক নিজে নিতেছে, এর প্রতিবাদ এহনই করন দরকার। পরের শুক্রবার বাদ জুমা সবাই ফসল কাটতে যাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা বাড়িতে ফিরে আসে।
এক কান দুই কান ঘুরে শুকুর মিয়ার কানে কথাটা আসে, কাজটা যে রশীদ মন্ডলের তা বুঝতে অবশ্য দেরী হয়না তার। এই গ্রামে বিত্ত, সম্মান বা সামাজিক অবস্থানে তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দী হচ্ছে এই রশীদ মন্ডল। গাঙ্গের জমি ভোগদখল করে সে খায় একথা সত্যি কিন্তু রশীদ মন্ডল যে মহাজনী ব্যবসা করে কাড়ি কাড়ি টাকা বানাইছে সে কথাতো কারো অজানা নয়। কাছারী ঘরে বসে সে চোখ বন্ধ করে চিন্তা করে,
থানায় রশীদ মন্ডলের জানা শোনা আছে ভাল তবে ওসি সাবের বড্ড টাকার লোভ আর বড় বড় মাছের। শুকুর মিয়া ফন্দি আঁটে, কাল সকালেই থানায় যাইতে হইব পুকুরের বড় মাছ আর নগদ মালপানি নিয়া, আর ফকিরনীর পুত গুলারে শিক্ষা দিতে হইব জব্বার আর তার সাঙ্গ পাঙ্গ দিয়া। হারামজাদা গুলানের কত্ত বড় সাহস, বিপদে আপদে তার পায়ের কাছে আইসা পড়ে আর এখন তারই ঘাড়ে উইঠা মাথা ভাঙ্গনের ধান্ধায় আছে।
জুমার দিন সকালে ফজলু মিয়া গোসল অজু সেরে মসজিদের দিকে রওনা দেয়, সাথে তার সাত বছরের ছেলে খোকন।নামাজ শেষ করে মসজিদের কোণে ফজলু, গেদু, আক্কাস, মনির, আব্বাস সহ বাকীরা একত্র হয়। সবাই মিলে একসাথে গাঙ্গের দিকে রওনা হয়। আগে থেকে রশীদ মন্ডলের লোকজনেরা কাচি আর বাঁশের লাঠির বন্দোবস্ত করে রেখেছিল। হঠাৎ ফজলু থেমে যায়,
-খোকন তুই বাড়িত যা
-না বাবা আমি তোমার লগে যামু
-না রে বাপ এইহানে ঝামেলা হইতে পারে তুই বাড়িত যা
এইবারে আক্কাস ক্ষেপে উঠে,
-আরে মিয়া পোলারে কি ঘরের মধ্যে রাখবার লিগা পয়দা করছ নাকি? যারে কয় ব্যাডাছেলে, হেরে দিয়া কি তুমি হেশেল ঠেলার ধান্ধায় আছি নাকি ?
-না মানে ছোড পোলা , যদি বাড়ি মাড়ি খায়!
-আরে মিয়া মন্ডলে কইলনা থানায় কতা কইয়া রাখছে, তুমি মিয়া আসলেই মাইয়া মানুষ, বুকে সাহস আন।
ফজলু আর কথা বাড়ায়না, তারা হাঁটতে হাঁটতে গাঙ্গের ধারে চলে আসে। শুকিয়ে যাওয়া গাঙ্গে সোনালী ফসল দেখে তাদের চোখে স্বপ্নের ঝিলিক লাগে। দুপুরের রোদে তারা নেমে পড়ে ফসল কাটতে। প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে ধান কাটার পরে বড় রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখে জব্বার আর তার সাঙ্গ পাঙ্গরা ফলা সুরকী নিয়ে তাদের দিকে আসছে।অবস্থা বুঝে ফজলু আক্কাসরে মন্ডলের বাড়িতে যেতে বলে। যেই ফুসরত পায়না আক্কাস, জব্বারের দলের লাঠির বাড়িতে তার মাথাই সবার আগে ফাঁটে। একে একে গেদু, মনির আব্বাস সবাই যখন আহত হয় তখন তারা দৌড়ে পালানোর চিন্তা করে। জব্বারের দলবলেরা দূরে থেকে এলোপাথারি ফলা ছুড়ে মারে, একটা ফলা যেয়ে লাগে ফজুলুর পায়ে, সে পড়ে যায় মাটিতে। খোকন দৌড়ে বাবার কাছে আসে ঠিক তখনি আরেকটা ফলা এসে খোকনের পেটে লাগে। ও বাবা গো বলে খোকন শোয়ে পড়ে মাটিতে, তার পেট দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়তে থাকে। পাগলের মত ফজলু ছেলেকে কোলে নিয়ে দৌড়াতে চেষ্টা করে কিন্তু আহত পা নিয়ে খুব বেশিদূর যেতে পারেনা। এর মধ্যে খোকন নেতিয়ে পড়ে, পানি পানি বলতে বলতে একসময় থেমে যায় সে।
খুন, খুন, খুন হইছে বলে গ্রামের সবাই আস্তে আস্তে জড়ো হয় গাঙ্গের ধারে। ফজলু যেন একেবারে বাকশুন্য, ছেলেরে দুই হাতে ধরে কোলে করে আস্তে আস্তে উঠে আসে সে। মানুষের আহাজারিতে বিকেলের বাতাস ভারী হয়ে উঠে, কিন্তু সেই কান্নার শব্দ মন্ডল কিংবা শুকুরের কানে পৌঁছায়না।একটা দুইটা মৃত্যু শুকুরকে জেল হাজতে নিলেও টাকার গরম তাদেরকে আবার বাইরে নিয়ে আসে, মাঝখান দিয়ে ছেলের বিচারের জন্য কেইস চালাতে গিয়ে মন্ডলদের কাছ থেকে সুদী করে টাকা নিয়ে ফজলুরা আরো সর্বসান্ত হয়। গাঙ্গের জমি নিয়ে বছরের পর বছর কেইস চলে, কিন্তু ভূমিহীনদের ডিক্রি আর পাওয়া হয়ে উঠেনা। কেইস চালানোর জন্যও মন্ডল টাকা ধার দেয় চড়া সুদে আর তা শোধাতে কারো কারো বসত বাড়ি পর্যন্ত তুলে দিতে হয় মন্ডলের কাছে। মন্ডল , শুকুরদের অবস্থার পরিবর্তন হয় সময়ের সাথে কিন্তু ফজলু, আক্কাসদের হয়না। শীতে শুকিয়ে যাওয়া গাঙ্গের দিকে তাকিরে সবুজ ইরি ধানের ক্ষেত দেখে তাদের দীর্ঘশ্বাষ আরো প্রলম্বিত হয়।
মন্তব্য
গল্পের মূল বক্তব্য টা ভালো লেগেছে ।
তবে গ্রামীন লোকদের মুখে 'গ্রাম্য ভাষা' শুনে ভালো লাগলেও লেখকের নিজস্ব বক্তব্যে 'গ্রাম্য ভাষা' কিছুটা বেমানান লেগেছে । যেমন - "রশীদ মন্ডলের কথায় সবার চোখে পাকা ফসলের ছবি ভাসে আবার ডরও লাগে। " - এই বাক্যে "ডরও লাগে" এবং "জুমার দিন সকালে শুকুর মিয়া গোসল অজু সাইরা মসজিদের দিকে রওনা দেয়" - এই বাক্যে "সাইরা" শব্দ !
"মুক্ত বিহঙ্গ" [অতিথি লেখক]
মোঃ জিয়াউর রহমান ববি
ববি অবশেষে সচলে আগমন, শুভেচ্ছা রইল। তোমার নিকটা ভাল লেগেছে, মন্তব্য বা লেখার শেষে তোমার নিবন্ধন করা ইমেইল দিতে ভুলোনা।
লেখার প্রসংগে আসি, তোমার ধারনা ঠিক, আমি একমত। কিছু অসংগতি রয়ে গেছে এক্ষেত্রে। সম্পাদনা করে দেব অতিসত্তর। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ রইল।
----------------------------------------------------------------------------
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
এক কথায় অসাধারন লেগেছে আমার কাছে।
ট্যাগে গল্প থাকলেও আমাদের দেশের নদী ভাঙ্গা গ্রামাঞ্চলের চিত্র অনেকখানি উঠে এসেছে।
ধন্যবাদ আপনাকে। নিজের গ্রামে অনেক কাছে থেকে এই ধরনের ঘটনা দেখেছি তারই চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি এই গল্পে।
----------------------------------------------------------------------------
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
জাহিদ ভাই, দারুন লাগল গল্পটা। আপনার প্রতিটা গল্পের বিষয়বস্তু আমার পছন্দ হয়েছে। আপনি সুন্দর ভাবে গ্রাম বাংলার অসহায় মানুষের কষ্ট তুলে আনছেন।
===অনন্ত ===
ধন্যবাদ অনন্ত।
----------------------------------------------------------------------------
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
আপনার গল্পের বিষয়টা খুব ভাল লাগে। তাড়াহুড়া কম করলে বা লিখে সপ্তাহ খানেক পরে আবার পড়ে দেখলে অনেক টাইপো বা বর্ণনার অসঙ্গতি কমে যায়। কিন্তু আমি নিজেই লেখা শেষ হলে আর দেরি সহ্য না করে পোস্ট করে দেই। অনেক উপদেশ দিয়ে ফেললাম ভাই, কিছু মনে করবেন না।
গল্পের বিষয়টা একেবারে নিজের চোখে দেখা। এমনও দেখেছি, ইচ্ছে করে নিজের দলের কোন শিশুকেই হত্যা করে নিজেরাই। শুধু মামলায় বা প্রতি মামলায় অবস্থানটা একটু ভাল করতে। কি জঘন্য! ব্যাপারটা নিয়ে গল্প লেখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জাহিদ ভাই।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
মিথুন ভাই একদম ঠিক ধরেছেন, তাড়াহুড়ো করা। গল্পটির প্লট চিন্তা করেছি কয়েকদিন ধরে, লিখেছি দুই দিন ধরে কিন্তু পোষ্ট করার আগে খুব বেশিবার পড়ে দেখা হয়নাই। যাই হোক প্রথম প্রথম গল্প লেখায় হয়ত উত্তেজনা বেশি, কিছুদিন পরে এটি কমে যাবে তখন বেশি বেশি অসংগতি চোখে পড়বে। আপনাকে মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
----------------------------------------------------------------------------
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
ধারাবাহিক গল্পকার হয়ে যাচ্ছো তো হে। চালিয়ে যাও।
ধন্যবাদ বস।
----------------------------------------------------------------------------
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
নতুন মন্তব্য করুন