মরার বাড়ি - মৃত্যু নিয়ে কিছু আদিম বিশ্বাস : প্রথম পর্ব

সোহেল ইমাম এর ছবি
লিখেছেন সোহেল ইমাম [অতিথি] (তারিখ: শনি, ১০/০৬/২০১৭ - ১০:৪৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

যে বাড়িতে মানুষ মারা যায় সে বাড়িকে সেই মৃত্যুরদিন বা ঠিক তার পরের দিন পর্যন্ত আমাদের এলাকায় মরার বাড়ি বলে । অন্য অঞ্চলেও সম্ভবত তাই বলে, অথবা অন্য কোন শব্দবন্ধে এই ভাবটাই হয়তো প্রকাশ করা হয়। বলার কথাটা হলো এই মরার বাড়ির অভিধাটা থাকা পর্যন্ত সে বাড়িতে রান্না নিষেধ। প্রথাটা এখনও অনেক জায়গাতেই পালিত হয়। আমার আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে এই প্রথাটা বরাবরই পালিত হতে দেখেছি। আমার বাবা মারা গেলে আমাদের বাড়িতে দেখলাম আত্মীয়রা তাদের বাড়ি থেকে খাবার তৈরী করে আনলেন, আমাদের বাড়িতেও রান্না হলোনা। অনেকবারই এ ব্যাপারটা নিয়ে আমার আশেপাশের কয়েকজনকে প্রশ্ন করাতে উত্তরটা সব সময় এই ছিলো শোকাকুল পরিবার খাওয়া দাওয়ার কথা ভাবতে পারেনা, রান্না যে হবেনা তাতে আশ্চর্য কি। কিন্তু এ উত্তরটা যথেষ্ট বলে মনে হয়নি। কেননা বাবা মারা যাবার দিন আমাদের বাড়িতে আমাদের সঙ্গ দিতে যে আত্মীয়রা ছিলেন তাদেরই একটা পরিবার তাদের নিজেদের বাড়ি থেকে আমাদের জন্য ভাতটাত রেঁধে আনলেন। তারা আমাদের বাড়ির চুলোয় কিন্তু দিব্যি সেই ভাতটা চড়িয়ে দিতে পারতেন, ‍কিন্তু তারা তা করেননি। আমার আসলে প্রশ্নটা ছিলো মরার বাড়িতে মৃত্যুর দিনটায় চুলো জ্বলেনা কেন। যারা শোকের কথা বলে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেন তারা এ প্রশ্নে নীরব হয়ে যান। প্রথাটা আছে পালিত হচ্ছে এবং একটা আধুনিক ব্যাখ্যাও (শোক ইত্যাদি) দাঁড় করানো হয়েছে কিন্তু প্রথাটা কেন পালিত হয় তা কেউ যেন জানেন না।

এই প্রথাটার ব্যাপারে আরো অনেককে অনেক সময়ই জিজ্ঞেস করেছি। কিভাবে পালিত হয় প্রথাটা, বিশেষ করে আমার পরিচিত বলয়ের বাইরে। একবার দুই মহিলার উপস্থিতিতে প্রশ্নটা করলে একজন বললেন তাদের এলাকায় মৃত্যুর পর মরার বাড়িতে তিন দিন যাবত চুলো ধরানো হয়না। অন্যজন বলে উঠলেন মৃত্যুর দিনই যদি কবর দেবার জন্য মৃতদেহ সেদিনই সন্ধ্যার আগে বের করে নিয়ে যাওয়া হয় তবে সেই দিনই সন্ধ্যায় কিছুক্ষণের জন্য চুলা জ্বালতে হয়, এটা করলে পরদিন থেকেই সে বাড়িতে চুলো জ্বালানো যাবে, রান্নাবাড়াও স্বাভাবিক ভাবেই শুরু হয়ে যায়। কিন্তু কোন কারণে যদি মৃত্যুর দিন সন্ধ্যায় চুলো জ্বালানো না যায় তবে তিন দিন আর চুলোয় আগুন দেওয়া যাবেনা। একটা ব্যাপার পরিস্কার মৃতদেহ বাড়িতে থাকা অবস্থায় চুলোটা ধরানো যায়না, এটাই প্রথা। হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও মৃত্যুর দিন মরার বাড়িতে কিছুই রাঁধা যাবেনা। এসময় মৃত্যুর ঠিক আগে রান্না করা খাবার থাকলে সে খাবার অন্য কাউকে (বাড়ির বাইরে) দিয়ে দিতে হয়ে অথবা ফেলে দিতে হয়, কিছুতেই খাওয়া চলবেনা। পরদিন থেকে চুলো জ্বালালেও মৃতের নিকটতম আত্মীয় স্বজনের খাবার দাবারের ব্যাপারেও বিশেষ কিছু নিষেধাজ্ঞা থাকে। অশৌচ পালনের মেয়াদ এক একটা বর্ণের জন্য এক এক রকম আবার বাড়ির কোন সদস্য যদি দূরে বা বাইরে থাকে তাদের ক্ষেত্রে ভিন্ন রকম। এই অশৌচ পালনের সময় যে বিশেষ বিধি সম্মত খাবার অশৌচ পালনকারী খাবে তা সে নিজের বাড়ি থেকে নিতে পারবেনা বা বাজার থেকেও কিনতে পারেনা এটা আত্মীয়দের কেউ তাদের নিজেদের বাড়ি থেকেই সরবরাহ করবে।

কিন্তু কেন এই প্রথাটা প্রচলিত হলো আর পালিতই বা হয়ে আসছে কেন। এসব প্রশ্নের উত্তর কারোরই জানা নেই। কেন মৃতদেহকে শেষ গোসল দেবার পানিটা চুলোয় গরম করার সময় নয়টা বড়ই গাছের পাতা সেই পানিতে ছেড়ে দেওয়া হয়? অনেকে বলেন এতে নাকি পানিটা বিশুদ্ধ হয়ে ওঠে, হয়তো বড়ই পাতার ভেষজ গুণের কল্যাণে। কিন্তু অন্য কোন সময় পানি বিশুদ্ধ করার জন্য আমরা বড়ই পাতা পানিতে সেদ্ধ করিনা। কবর দেওয়া সম্পন্ন হলে সেই নতুন কবরের মাটির ওপর কিছু মসুরের ডাল ছড়িয়ে দিয়ে আসা হয়। অনেকবার অনেককে এ প্রশ্ন করে উত্তর পেয়েছি রাতের অন্ধকারে এই মসুরের ডাল গুলো নাকি জ্বল জ্বল করে জ্বলতে থাকে, অন্তত শেয়ালের চোখে। নতুন কবর পেলেই শেয়াল এসে যাতে কবর খুঁড়ে লাশে কামড় না বসাতে পারে তাই শেয়াল তাড়ানোর এটা একটা পদ্ধতি। এসব ব্যাখ্যার মধ্যে একটা দায়সারা ভাব আছে, যেন কেউ সঠিক উত্তরটা জানেনা বলেই গোঁজামিল দিয়ে কাজটা সারতে চাইছে।

যখন অনেক দিন ধরে কিছু প্রথা পালিত হতেই থাকে তখন একটা সময় আসে যখন এই সব প্রথার ভেতরের আসল কারণ, উদ্দেশ্য জনমানসের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। বিশেষ করে এই সব প্রথা গুলোর উদ্ভব যদি বহু বহু বছর আগে হয়। বিশেষ করে যখন হয়তো লেখারই উদ্ভব হয়নি। বিশেষ বিশেষ আচার গুলো প্রজন্ম পরম্পরায় বহু বছর ধরে মুখে মুখে প্রবাহিত হতে থাকে। একটা সময় দেখা যায় বিশেষ বিশেষ সামাজিক আচারের পেছনের কারণ গুলো যারা জানতো তাদের থেকে স্মৃতিটা আর সর্বাংশে পরের প্রজন্মের কাছে অখণ্ড ভাবে পৌঁছায়না। শ্রেফ বাহ্যিক আচারটা পালিত হতে থাকে বলে হয়তো হারিয়ে যায়না কিন্তু মূলকথা গুলো আর পরের প্রজন্মের কারো জানা নেই। তবে এই না জানাটা অবশ্য নতুন প্রজন্ম নিজেই পূরণ করে নেয় নিজেদের তৈরী করা ব্যাখ্যা দিয়েই কিন্তু মোটের ওপর কাজটার ভেতর ফাঁক থেকেই যায়, জোড়ায় জোড়ায় মেলেনা। কিন্তু এই যান্ত্রিক ভাবে পালিত হতে হতে প্রথা গুলো একটা শক্তি পেয়ে যায়, এরা বিভিন্ন সামাজিক ও ব্যক্তিমানসের পরিবর্তন সত্ত্বেও শ্রদ্ধার, পবিত্রতার একটা আবরনে অক্ষয় হয়ে ওঠে।

একেবারে আদিম কালে এসব প্রথার উদ্ভব বলেই এখন আর কেউ এসব প্রথার সত্যিকারের তাৎপর্যটা বুঝে উঠতে পারেননা। কিন্তু আদিম কালেতো ফেরার উপায় নেই। আমাদের আদিম পূর্বপুরুষরা কি উদ্দেশ্যে, কি ভেবে এই সব প্রথা পালন করতেন তা জানবার উপায় নেই। প্রত্নতত্ত্ব হয়তো এ ব্যাপারে কিছুটা সাহায্য করতে পারে কিন্তু সেও আর কতখানি। বিশেষত ভারতবর্ষের মত দেশে যেখানে কয়েকশো বছর আগের মধ্যযুগের সময়কালটা সম্পর্কেই তথ্য পাওয়া দুস্কর সেখানে তারও আগের প্রাচীন কালটার তত্ত্ব তালাশ প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। তালপাতার পুঁথিপত্রেই সাধারণত বিভিন্ন ধর্মীয় উপদেশ আচার সম্পর্কিত বিষয় গুলো এক সময় লিপিবদ্ধ করা হতো যা এদেশের আর্দ্র আবহাওয়ায় খুব বেশিদিন টিকে থাকতোনা। আর আমরা যে সময়কালের কথা বলছি তা এই লেখার যুগেরও আগের আদিম পূর্বপুরুষদের সময়টা। সে সময়ের টুকরো টাকরা পাথরের গায়ে ছবি, সংকেত ইত্যাদি পাওয়া গেলেও সে সময়ের আচার বিশ্বাসের প্রকৃতি জানার ব্যাপারে তা আর কতখানিই বা কাজে আসবে।

এতো প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও কিন্তু সেই আদিমকালের তত্ত্বতালাশের একটা উপায় আছেই। নৃতত্বের আর ফোকলোরের গবেষক স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজারের মতে মানুষ খুব নিচু একটা সংস্কৃতি থেকে তার যাত্রা শুরু করে ক্রমশ ধীরে ধীরে আজকের অবস্থানে উঠে এসেছে। অবশ্য এই যাত্রার গতির হার আর সময়টা সব মানব সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে একই ছিলোনা। কোন সম্প্রদায় কিছুটা দ্রুত এগিয়েছে, আবার কোন সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে এই গতিটা ছিলো যথেষ্টই ধীরে। ফলে চিন্তায়, সংস্কৃতিতে উন্নত হবার পথে বিভিন্ন মানব সম্প্রদায় বিভিন্ন স্তরে অবস্থান করছে। আর এখানেই আমরা পেয়ে যাচ্ছি আদিমকালটাকে এক পলক দেখার একটা সুযোগ। ফ্রেজার বলছেন,

… the various stages of savagery and barbarism on which many tribes and peoples now stand represent, broadly speaking, so many degrees of retarded social and intellectual development, they correspond to similar stages which the ancestors of civilized races may be supposed to have passed through at more or less remote period of history. Thus when we arrange all the known peoples of the world according to the degree of savagery or civilization in a graduated scale of culture, we obtain not merely a comparative view of their relative positions in the scale, but also in some measure an historical record of genetic development of culture from a very early time down to the present day. (ফ্রেজার-ক: ৬)

অর্থাৎ আমরা এই আধুনিক যুগেও যে কিছু আদিবাসী পেয়ে গিয়েছি যাদের সংস্কৃতি, চিন্তা-চেতনা আমাদের আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শ থেকে বিভিন্ন কারণে বিচ্ছিন্ন থাকায় আদিমই থেকে গেছে তাদের মধ্যেই আমাদের আদিম পূর্বপুরুষদের জীবন্ত ছবি আমরা পেয়ে যাচ্ছি। ফ্রেজার ঠিক এই দিকটার দিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। নৃতত্ত্ববিদ হেনরী লুইস মর্গ্যানও ঠিক একই কথা বলতে চেয়েছেন। তার এনশিয়েন্ট সোসাইটি বইটিতে বলছেন,

“আর্য জাতিগুলির অতি দূরের পূর্বপুরুষেরা নিঃসন্দেহে এখনকার বন্য জাতি আর বর্বরদের অবস্থার মধ্যে দিয়ে কাটিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। সেইসব আর্যদের অভিজ্ঞতার ইতিহাস খুঁজলে আমরা তাদের অতীত ও বর্তমান সভ্যতার এবং সেই সঙ্গে বর্বর অবস্থার শেষ দিককার একটা ছবি পেতে পারি। তাদের আরও অগেকার ইতিহাস জানার জন্য যদি সেই সময়কার অন্য বন্য জাতিদের বিধি নিয়ম বা রীতিনীতি গুলো এবং তাদের আবিস্কারের ইতিহাস যে গুলো তারা এখনও ধরে রেখেছে, সেগুলোর সঙ্গে তখনকার আর্যদের ওইসব ব্যাপার গুলোর সঙ্গতি সাধন করা যায়, তাহলে অনেক খবরাখবরই পরিস্কার ভাবে পাওয়া সম্ভবপর হবে বলে মনে হয়।” (মর্গ্যান: ৫-৬)

কিন্তু আমরা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী, উত্তর আর দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী বা আফ্রিকার আদিবাসীদের দিকে তাকালে কিভাবে ভারতবর্ষের বাংলাদেশের আদিম পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে বা তাদের সে সময়কার আদিম সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারবো। এ সম্পর্কেই মর্গ্যান বলছেন,

“মানবজাতির সভ্যতার পথে এগিয়ে চলার অভিজ্ঞতার ধারাটা সমস্ত মানবগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই একইভাবে একই ধারাতে হয়েছে। আর যদি একই অবস্থার মধ্যে দিয়ে তাদের চলতে হয়ে থাকে, তাহলে তাদের ব্যবহারিক প্রয়োজনও একই রকমের ছিল। বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর প্রতিটি মানুষের মস্তিস্কের গঠন একরকম হওয়ার জন্য তাদের চিন্তাধারার বিকাশও একরকমের হওয়াটাই স্বাভাবিক আর সর্বক্ষেত্রে হয়েছিলও তাই। তবে সর্বত্র অনুরূপ ফল হবার কারণ সমূহের মধ্যে এটা অন্যতম কারণ মাত্র। বন্য অবস্থায় থাকাকালীনই মানুষের মধ্যে আচরণবিধি তৈরি করার প্রবণতা এবং শিল্প সংক্রান্ত জ্ঞানের অঙ্কুরোদ্গম হয়েছিল। বর্বর অবস্থার শেষের দিকে এবং সভ্য অবস্থায় থাকাকালীন নানান অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে এইসব গুণগুলো আরও বিকাশ লাভ করে। যদি আমরা ভালোভাবে লক্ষ করি তাহলে দেখব, বর্বর অবস্থায় থাকাকালীন পৃথিবীর প্রতিটি মহাদেশের মানব সমাজের রীতিনীতি গুলোর মধ্যে কি অসম্ভব মিল এবং তার একমাত্র কারণ হচ্ছে এই যে আসলে তারা একই মানব-পরিবার থেকে এসেছে।” (মর্গ্যান: ৫-৬)

আসলে আদিমকালটা সব জায়গাতেই প্রায় একই ধরণের ছিলো। প্রাকৃতিক বা আবহাওয়া গত বৈচিত্র্য এক একটা জায়গায় এক এক ধরণের হলেও আদিম কালে মানুষের জীবন ধারণের হাতিয়ার গুলো প্রায় একই ধরণের বা প্রায় একই মাত্রার সুবিধাই তাদের এনে দিতো। জ্ঞানের অগ্রগতি তখনও হয়নি, উদ্ভাবনও বিশেষ হয়নি সুতরাং জীবনধারার যে সরল বৈশিষ্ট্য আদিমকালের মানব জীবনটাকে বৈশিষ্ট্য মন্ডিত করেছে তাই পৃথিবীর প্রায় সব আদিম মানুষ সম্পর্কেই সত্য। আর সেজন্যই এই আদিবাসীদের জীবন, বিশ্বাস আর আচারের খুঁটিনাটি খুব ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা আমাদের সময় পর্যন্ত চলে আসা সেই প্রাচীন সব প্রথার আসল চেহারাটা পেয়ে যাই। বহু নৃতত্ত্ববিদ এই আদিবাসীদের জীবন আর আচার সংক্রান্ত তথ্য গুলো সরেজমিনে সংগ্রহ করেছেন। এদের অনেকেই বহু দিন এইসব আদিবাসীদের সঙ্গে থেকে এদের আচার, সংস্কৃতির খুঁটিনাটি লক্ষ্য করেছেন আর তা লিপিবদ্ধও করে গেছেন। স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজারের দ্যা বিলিফ অব ইমর্টালিটি এ্যাণ্ড দ্যা ওরশিপ অব দ্যা ডেড এবং দ্যা ফিয়ার অব ডেড ইন প্রিমিটিভ রিলিজিওন বই দুটি এরকম তথ্যেরই সংকলন। এ লেখার টুকরো তথ্য গুলো মূলত এই বই দুটো থেকেই নেওয়া।

খুবই আদিম ধরণের জীবনাচার আমরা পাচ্ছি অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের সম্পর্কে। এই আদিবাসীরা মূলতঃ পশুপাখি শিকার আর বিভিন্ন বন্য ফলমূল সংগ্রহ করেই বেঁচে ছিলো। এদের মধ্যে তখনও কৃষির প্রচলন পর্যন্ত হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার কিছুটা উত্তর-পূর্বের অসংখ্য ছোট বড় দ্বীপ পুঞ্জের আদিবাসীরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কৃষি, মাছধরা, কিছুটা কুটির শিল্পের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করলেও সভ্য সমাজের তুলনায় অনেকখানি আদিম ধরণেই জীবন কাটাতো। সভ্যতার সংস্পর্শে সম্প্রতি এই আদিমতা অনেক খানিই বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু নৃতত্ত্ববিদদের সংগৃহীত তথ্য গুলো যে সময়ের তখন এই পরিবর্তন ব্যাপক হারে তাদের পাল্টে দেয়নি। আর এই তথ্য গুলোয় আমাদের সুযোগ করে দেয় আদিমকালের মানুষের জীবনে চুপিসারে এই উঁকি দেবার।

মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে ধারণাটা একেবারে আদিম কালেও মানুষের মধ্যে ছিলো। নিয়াণ্ডারথাল মানুষদের কবরের মধ্যে মৃতদেহের সঙ্গেই ফুলপাতা আর বলির পশুর হাড়ের অস্তিত্ব জানান দেয় সেই সময়েও মানুষ ভাবতো মৃত্যুর পরও একটা জীবন থাকে আর তার জন্যই এই আয়োজন। নিয়াণ্ডারথাল মানুষদের জীবন আর মৃত্যু সম্পর্কিত বিশ্বাসের খুব বেশি কিছু আমরা আর জানতে পারিনা। কিন্তু আমাদের এই আধুনিক যুগে আবিস্কৃত আদিবাসীদের বিশ্বাস সম্পর্কে নৃতত্ত্ববিদদের কল্যাণে আমরা অনেক তথ্যই পেয়েছি। আমাদের এই আদিবাসীরাও বিশ্বাস করে মৃত্যুর পরও মানুষের অস্তিত্ব থেকে যায়। এই ধারণা সৃষ্টির পেছনে মূল ভূমিকা ছিলো স্বপ্নের। আদিবাসী এই আদিম মানুষ গুলো জাগ্রত অবস্থার ঘটনা আর স্বপ্নে দেখা ঘটনার ফারাক দেখতে পায়না। একটা মানুষ মারা যাবার পরও তাকে কেউ যদি স্বপ্নে দেখে তবে সে নিশ্চিত হয়ে যায় মানুষটা মারা গেলেও কোথাও না কোথাও মানুষটা বেঁচেই আছে। স্বপ্ন দৃশ্যকে বাস্তব প্রত্যক্ষ জ্ঞানে গ্রহণ করাটা প্রায় সব আদিবাসী সম্প্রদায়েই দেখা যায়। শুধু মৃত মানুষের সাথে যোগাযোগই নয় স্বপ্ন জীবিত মানুষের বৈদেহী ভ্রমণেরও একটা উপায়। স্বপ্নে একটা মানুষ বহু দূরের জায়গাও ঘুরে আসতে পারে।

ব্রিটিশ নিউগিনির কোইটা বা কোইটাপুদের বিশ্বাস ঘুমন্ত অবস্থায় জীবিত মানুষের আত্মা দেহ ছেড়ে দূরে ভ্রমণ করে আসতে পারে। স্বপ্ন ব্যাপারটাকে তারা এই বৈদেহী ভ্রমণেরই প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করে। এজন্য তারা বলে কোন মানুষকেই হুট করে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতে নেই, তাতে করে বাইরে পরিভ্রমণকারী আত্মাটা যথাযথভাবে দেহে ফিরে আসতে পারেনা আর এর ফলেই শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। অনেক অসুস্থতাকেই এরা আত্মা হারিয়ে ফেলা বা আত্মা চুরির ফল বলে মনে করে। এই ভাবে বৈদেহী ভ্রমণকালে কোন অসৎ শামান বা ওঝা মন্ত্র তন্ত্র পড়ে সেই আত্মাকে বন্দি করে নিজের কাছে রেখে দিতে পারে আর এর ফলেই আত্মাবিহীন দেহধারী ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। হাঁচি দেওয়াকে কোইটারা আত্মার শরীরে ফেরৎ আসার সংকেত বলে বিশ্বাস করে। কেউ অনেকদিন যাবত হাঁচি না দিলে এরা তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকায় ভাবে নিশ্চয়ই কোন বদলোক তার আত্মাকে কোথাও আঁটকে রেখেছে এবং অবধারিত ভাবে হাঁচিহীন লোকটা অসুখে পড়বে (ফ্রেজার-ক: ১৯৩-১৯৪)।

ব্রিটিশ নিউগিনির পূর্ব অংশে কিওয়াই দ্বীপের আদিবাসীদের বিশ্বাস মৃতব্যক্তির আত্মারা জীবিতদের সাথে দেখা করে স্বপ্নের মাধ্যমে। স্বপ্নের মাধ্যমেই তারা আসন্ন কোন বিপদের পূর্বাভাস দিয়ে সতর্ক করে দেয় কখনও কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় উপদেশও দিয়ে যায়। অনেকেই কোন বিশেষ বিপদে উপদেশ পাবার আশায় পিতার কবর খুঁড়ে তার করোটি তুলে এনে সেই করোটি মাথার কাছে রেখে ঘুমায় যাতে স্বপ্নে তার পিতা তাকে আসন্ন দুর্বিপাক থেকে উদ্ধারের কোন পথ দেখান (ফ্রেজার-ক: ২১৩)। অনেক সময় দেখা যায় মৃত পূর্বপুরুষরা স্বপ্নেই কোন আদিবাসীকে দেখা দিয়ে বিপদ থেকে পরিত্রাণের মন্ত্র-তন্ত্র শিখিয়ে দিচ্ছে, যুদ্ধে বা কৃষিকাজে বিভিন্ন সমস্যা কিভাবে যাদুশক্তির সাহায্যে মোকাবিলা করতে হয়ে সেই সবকটাও দিয়ে দিচ্ছে। আমাদের ট্রেন-বাসে টোটকা ওষুধ-তাবিজের ফেরিওয়ালাদের “স্বপ্নে পাওয়া” বলে দাবী করা ওষুধের জড়টা এখানেই। এখনও অনেকে মৃত পিতা-মাতা বা আত্মীয়স্বজনকে স্বপ্নে দেখলে সেই স্বপ্নটা নিছক স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেননা। তারা ভাবেন মৃত আত্মা তাদের কিছু বলতে চাইছে। আমার এক মামা একবার তার দাদাকে স্বপ্নে দেখলেন আর এই স্বপ্নে দেখার সূত্রেই তাকে একটা মিলাদ বা দোওয়া মাহফিলের আয়োজন করতে হলো। এই দোয়া মাহফিলের খরচে অন্য আত্মীয়দেরও সাহায্য করতে হলো এবং তাতে তারা খুব খুশি ছিলেননা, কিন্তু স্বপ্নে মৃত আত্মীয়কে দেখা নিয়ে যে সামাজিক বিশ্বাস সেটার শক্তিটা কম নেই বলেই তারা নিছক স্বপ্ন বলে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে পারেননি।

(চলবে)

তথ্যসূত্র ও সহায়ক গ্রন্থাবলি:

১। মর্গ্যান : এনসিয়েন্ট সোসাইটি - লুইস হেনরী মর্গ্যান
ভাষান্তর : অসীম চট্টোপাধ্যায়, অসিত চৌধুরি। ৪র্থ সংস্করণ অগ্রহায়ণ ১৪০৯।
দীপায়ন। ২০ কেশব সেন স্ট্রীট।। কলিকাতা-৭০০ ০০৯
২। ফ্রেজার-ক : The Belief in Immortality and the Worship of the Dead : J. G. Frazer
The Gifford Lectures, St Andrews (1911-1912)
Macmillan & Co., Limited, St Martin’s Street, London, 1913


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

বাঙালী মুসলিম পরিবারে অরন্ধনের ব্যাপারটি এসেছে বাঙালী হিন্দুর সংস্কৃতি থেকে। চিতাগ্নি না নেভা পর্যন্ত উনুনে আগুন না দেবার মাধ্যমে শোক প্রকাশের রীতি থেকে। কবরের উপরে মসুর ডাল ছড়িয়ে দেবার ব্যাপারটি আঞ্চলিক সংস্কৃতি, তাই এসম্পর্কে কিছু আঁচ করতে পারছি না। বাংলাদেশের বেশিরভাগ জায়গায় মসুর ডালের ব্যাপারটি নেই। শেষ স্নানের গরম জলে ৯টি বড়ই পাতা দেবার সংস্কৃতিটি সম্ভবত সারা দেশেজুড়ে পালিত হয়। এটা নিয়ে গানও আছে -

"বড়ই পাতা গরম জলে
শোয়াইয়া মশারির তলে
সাজিয়ে গুজিয়ে দে মোরে সজনী তোরা
সাজিয়ে গুজিয়ে দে মোরে"

বড়ই গাছ আরব দেশে সুলভ নয়। সুতরাং বাঙালী মুসলিমের এই সংস্কৃতিটি আমদানিকৃত নয়। তাছাড়া সংখ্যা হিসেবে '৯' ইসলামী সংস্কৃতিতে জনপ্রিয় নয়। সেখানে ৩, ৭, ১১, ২১, ৭০, ৭২ ইত্যাদি সংখ্যাগুলো অধিকতর ব্যবহৃত হয়।

সোহেল ইমাম এর ছবি

মসুরের ডাল ছড়িয়ে দেবার প্রথাটা রাজশাহীতে অনেকবারই দেখেছি, অনেক জায়গায় এই প্রথাটা নেই এটাও একটা মূল্যবান তথ্য। হ্যাঁ আমার মনে হয় বেশিরভাগ প্রথা আচারই বাঙ্লী হিন্দুর সংস্কৃতি থেকেই এসেছে। যারা প্রথম প্রথম ইসলাম প্রচার করেছিলেন তারা হয়তো ইসলামের মৌলিক কিছু উপাদান অনুসরণের ওপরই জোর দিতেন জীবনের সাথে আরো যে বহু পরিস্থিতিতে বহু আচার প্রথা থেকে গেলো সে সম্পর্কে অতটা গুরুত্ব দেননি। ফলে নও মুসলিমরা সেই প্রথা গুলো পুরনো সংস্কৃতির অনুসরনেই চালিয়ে গিয়েছিলো। লেখাটা পড়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। মন্তব্যে আপনার নাম দিতে ভুলে গেছেন।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

Moloy Adhikary এর ছবি

পুরোটা লেখা-ই বেশ মন দিয়ে পড়লাম। সাধারণত এধরনের লেখার শেষটা পর্যন্ত পড়া খুব ধৈর্য্যের ব্যাপার যা আমার একদমই নেই। তারপরও, মনে হলো লেখার গুণেই পড়ে ফেললাম। খুব সুন্দর লিখেছেন এবং তথ্যবহুল। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

সোহেল ইমাম এর ছবি

লেখাটা সময় নিয়ে পড়বার জন্য আর আপনার উৎসাহের জন্য অশেষ ধন্যবাদ।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

মেঘলা মানুষ এর ছবি

এবিষয়ে বাংলায় আগে কোন লেখা চোখে পড়েনি।
অনেক খেটে একটা তথ‌্যব‌হুল লেখা দাঁড় কড়িয়েছেন।

শুভেচ্ছা হাসি

সোহেল ইমাম এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। এই দিক গুলো নিয়ে আরো আলোচনা-গবেষণা হওয়া উচিত। আমি শুধু ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে অবতারণা করলাম মাত্র, আশা আছে নৃতত্ত্ব সম্পর্কে ভালো যারা জানেন তারা আরো বিশদ করে আমাদের জানাবেন।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেকদিন পর সচলায়তনে এসে আপনার লেখাটা দিয়েই শুরু করলাম। খুব মন খারাপের একটা বিষয় নিয়ে লিখছেন সোহেল ইমাম। বাবা-মা এবং অপরাপর মুরুব্বিদের বয়স হয়েছে। আমাদের বাড়িটা কে জানে কবে মরার বাড়ি হয়! যাই হোক, আপনার লেখা ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে। এখন যাই পরের পর্বটি পড়ি গিয়ে।

---মোখলেস হোসেন।

সোহেল ইমাম এর ছবি

সম্প্রতি আমিও অনেক গুলো আপন মানুষের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে পার হলাম। সবচেয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে ছোটবেলার এক প্রাণপ্রিয় বন্ধুর আকস্মিক মৃত্যু। এখনও সে শোকটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। মৃত্যুটাই তাই মাথায় ঘুরছে। মনখারাপের বিষয়টার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী মোখলেস ভাই।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।