“মায়ের দোয়া”র শিকড় সন্ধানে : দ্বিতীয় পর্ব

সোহেল ইমাম এর ছবি
লিখেছেন সোহেল ইমাম [অতিথি] (তারিখ: রবি, ২০/০৫/২০১৮ - ১২:৩৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মায়েরদোয়া সংক্রান্ত এই বিশ্বাসটির জন্ম ঠিক কবে, কিভাবে? আমরা একপা একপা করে ইতিহাসের পেছনে সরে গিয়ে যদি খুঁজতে শুরু করি তবে মনে রাখতে হবে এক একটা যুগ পর্যায়ে একই বিশ্বাস ভিন্ন ভিন্ন চেহারা নেয়। তাই আমরা মায়েরদোয়া নামের যে বিশ্বাসটির মূল অনুসন্ধানে নেমেছি সেই বিশ্বাসটাকে এখনকার পোষাক ছাড়িয়ে তার বিশিষ্ট কঙ্কালটা মাত্র নিয়ে অতীতে যাত্রা করতে হবে। অর্থাৎ আমাদের খুঁজতে হবে ঠিক কোন কোন সময়কালে মানুষের জীবিকা অনেকাংশেই সন্তান জন্মদায়িনী নারীর সঙ্গেই যুক্ত এই বিশ্বাসটা বর্তমান ছিলো।

মানুষের ইতিহাসেরও আগের একটি পর্যায় রয়েছে। যে পর্যায়টার কোন লিখিত ইতিহাস নেই আর সে কারণেই এ পর্বটার নাম প্রাক-ইতিহাস। কিন্তু যে সময়টা থেকে লিখিত ইতিহাস শুরু হচ্ছে বলে আমরা ধারণা করি তাকেও গড়ে তুলেছে এই প্রাগৈতিহাসিক পর্বটিই। অর্থাৎ যাকে আমরা ঠিক ইতিহাস বলি তার অনেক আগে থেকেই মানুষের সত্যিকার ইতিহাসটা শুরু হয়ে গেছে। এ ইতিহাসটা কেউ লিখে রাখেনি, এ ইতিহাসটাকে খুঁড়ে তুলতে হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে হয়তো এ পর্বটা সম্পর্কে কিছুটা তথ্য পাওয়া সম্ভব কিন্তু সেটাও পূর্ণাঙ্গ ছবি নয়। কিছু পোড়া মাটির হাড়ি, পাথরের কিছু অস্ত্র, পাথুরে গুহার গায়ে কিছু ছবি, কিছু দুর্বোধ্য চিহ্ন এসব থেকে একটা মানব সম্প্রদায়ের কতখানিই বা উদ্ধার করা সম্ভব। তাদের দৈনন্দিন জীবনটা কিভাবে কাটতো, তাদের উৎসবের নাচ গুলো কেমন হতো, কেউ অসুস্থ হলে বা মারা গেলে অন্তেষ্টিক্রিয়াটাই বা কেমন ছিলো এসব চলমান মুহূর্ত গুলোকে তো কেউ ধরে রাখেনি। কিন্তু প্রগৈতিহাসিক মানুষের সেই আদিম জীবন যাত্রা, তাদের সে সময়ের আচার অনুষ্ঠান, পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা, জীবন বোধ এসবই তো কালপরম্পরায় পাল্টাতে পাল্টাতে আমাদের সংস্কৃতি আমাদের বিশ্বাসের কাঠামো গড়ে তুলেছে। তাই আজকের ধর্মীয় বা লৌকিক বিশ্বাসের স্বরূপ অন্বেষণে এই আদিম পর্বে বিশ্বাস গুলো কি চেহারায় ছিলো সে খবরটা নেওয়া জরুরি।

নৃতত্ত্ব কিন্তু সেই খবরটাই আমাদের দিতে চায়। সারা পৃথিবী জুড়েই কিছু কিছু মানব সম্প্রদায়, গুচ্ছ গুচ্ছ মানব গোষ্ঠী থেকেই গেছে যাদের আমাদের এই চলমান সভ্যতার সাথে কোন যোগ ছিলোনা অথবা সুদূর অতীতের কোন এক সময় এই যোগাযোগটা গেছে ছিঁড়ে। ফলে তাদের সাংস্কৃতিক অগ্রগতি আমাদের সভ্যতার সমান তালে এগোয়নি। তারা অনেকটাই সেই আদিম কালেই আঁটকে আছে। সভ্যতার সাথে যখন এই মানব গোষ্ঠীর যোগযোগ হয় তখন নৃতত্ত্ববিদরা এই পিছিয়ে পড়া সংস্কৃতির মানুষগুলো আর তাদের জীবন যাপন সম্পর্কে, তাদের বিশ্বাস আর ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কে যতবেশি সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করে রাখতে শুরু করেন। এই তথ্য গুলো আমাদের আদিম পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া নানান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন গুলোকেও বুঝতে সাহায্য করেছে। আমাদের আদিম পূর্বপুরুষ আর এই আদিবাসী গোষ্ঠীর জীবন ধারা কতকটা একই ছন্দে চলেছিল। যে মানুষের জীবন সভ্যতা আর বিজ্ঞানের আবিস্কারের সম্ভারে ভরে ওঠেনি তখনও, অর্থাৎ এক রকম নিরস্ত্র, নগ্ন মানুষ যখন প্রকৃতির মুখোমুখি হয়ে তার সাথে লড়াই করে বাঁচতে চায় তখন গল্পটা পৃথিবীর সর্বত্রই একই রকম হবার কথা এবং হয়েওছিলো তাই। এ সম্পর্কেই স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজার বলছেন, … the various stages of savagery and barbarism on which many tribes and peoples now stand represent, broadly speaking, so many degrees of retarded social and intellectual development, they correspond to similar stages which the ancestors of the civilized races may be supposed to have passed through at more or less remote periods of their history. (Frazer,1913; p6)

দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ও এদিকটায় দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন, সারা পৃথিবীর বুক জুড়ে সমস্ত মানুষের উন্নতিই সমান তালে হয়নি। কোথাওবা মানুষ এগিয়ে গিয়েছে অনেক দূরে, কোথাওবা মানুষ পড়ে রয়েছে অনেকখানি পিছনে। ওই পিছিয়ে পড়া মানুষদের বাস্তব অবস্থাকে পরীক্ষা করলে এগিয়ে যাওয়া মানুষদের অতীত ইতিহাসটিকেও দেখতে পাওয়া যাবে (দেবীপ্রসাদ : ১৩৬৩; পৃ:১৭০)। মানুষের এই আদিম অবস্থাটাকে আবার কয়েকটা পর্বে ভাগ করেছিলেন হেনরি লুইস মর্গান। মাটির বাসন পত্র তৈরী, আগুন আবিস্কার, তীর-ধনুক আবিস্কার প্রভৃতি বিচার করে এই ভাগ গুলো করা হয়েছিলো। মর্গানের পরিভাষা অনুসারে সভ্যতার স্তরে পৌঁছবার আগে পর্যন্ত মানুষের অবস্থাকে মোটের উপর দুটি অংশে ভাগ করা যায়: বন্যদশা (savagery) ও বর্বরদশা (barbarism)। এই দুটি দশারই আবার স্তরবিভাগ রয়েছে: নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ। মানুষশুরু করেছে নিম্ন-বন্যদশা থেকে, তারপর এগিয়ে এসেছে মধ্য-বন্যদশায়, তারপর উচ্চ-বন্যদশায়। তারপর মানুষ বন্য-দশা ছেড়ে বর্বরদশায় উঠে এসেছে : প্রথমে নিম্ন-বর্বরদশা, তারপর মধ্য-বর্বরদশা, তারপর উচ্চ-বর্বরদশা। আর, তারপর মানুষ বর্বরদশা ছেড়ে সভ্যতার আওতায় এসে পৌঁছেছে (দেবীপ্রসাদ,১৩৬৩;পৃ:১৭০)। মর্গানের মতে এখন এই আধুনিক যুগে আমরা যে আদিবাসীদের আবিস্কার করেছি সে তালিকায় একেবারে নিম্নবন্যদশায় আঁটকে আছে এমন কোন মানব গোষ্ঠী পাওয়া যায়না। তবে আবিস্কৃত হবার সময় পলিনেসিয়া আর অস্ট্রেলিয়ার উপজাতিরা ছিলো মধ্য-বন্যদশায়। আমেরিকার ‘হাডসন-বে-টেরিটরি’ ও ‘কলম্বিয়া উপত্যকা’র নানা উপজাতিরা ছিলো উচ্চ-বন্যদশায়। মিসিসিপি নদীর পুব-কিনারায় রেড-ইণ্ডিয়ানরা ছিলো নিম্ন-বর্বরদশায়। নিউ মেক্সিকো, মেক্সিকো, মধ্য-আমেরিকা ও পেরুর নানান উপজাতিদের দেখা গেলো মধ্য-বর্বরদশায়। এরপর উচ্চ-বর্বরদশার কথা। মর্গান বলছেন, সে দশার পরিচয় পাওয়া যায় হোমারের যুগের গ্রীকদের মধ্যে, রোম স্থাপিত হবার মুখোমুখি সময়কার লাতিন জাতিগুলির মধ্যে এবং সিজারের সময়কার জার্মানদের মধ্যে। এই উচ্চ-বর্বরদশার আওতা পেরিয়েই সভ্যতার শুরু (দেবীপ্রসাদ, ১৩৬৩;পৃ:১৭০)।

আদিম যুগের সমাজ সংগঠনটা পিতৃতান্ত্রিক না মাতৃতান্ত্রিক ছিলো এ নিয়েও একটা বিতর্ক আছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ মানে যে সমাজে পুরুষ বা পিতাই প্রধান বা নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকে। আর মাতৃতান্ত্রিক সমাজে মা বা নারীরাই থাকবে নেতৃত্বে। আমরা অবশ্য এ বিতর্কে ঠিক এই মুহূর্তে জড়াতে চাইনা। এ পর্যন্ত সংগৃহীত নৃতাত্ত্বিক তথ্য প্রমাণে যেটুকু গ্রাহ্য বলে গৃহীত হয়েছে আমাদের আলোচনা তাতেই আমরা সীমিত রাখবো। আধুনিক কালে যে আদিম ধরনের মানব গোষ্ঠী আবিস্কৃত হয়েছে তার প্রায় সব গুলোর নেতৃত্বেই রয়েছে পুরুষেরা। অবশ্য কিছু কিছু এমন মানব গোষ্ঠীও পাওয়া গেছে যেখানে নারীদের ভূমিকায় পুরুষদের তুলনায় বেশি সক্রিয়। মোটের উপর সমাজের নেতৃত্ব, বংশাধারা নির্ণয়, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের নিয়ম নারী বা পুরুষ যে ধারাতে চলে সে অনুসারেই নির্ণয় করা হয় সমাজটা মাতৃতান্ত্রিক না পিতৃতান্ত্রিক।

যে সময়টা কথা বলা হচ্ছে এখানে তা ছিলো মানুষের শিকার আর সংগ্রহের যুগ। প্রধানত গাছের ফল-পাকুড়, মূল-কন্দ সংগ্রহ করেই রোজকার খাদ্য আহরণ করতো মানুষ। এছাড়াও ছিলো পশু শিকার, কিন্তু শিকারের হাতিয়ার তখন এতোটাই অনুন্নত পর্যায়ে ছিলো যে শিকার করাটা কঠিনই ছিলো। খুব স্বাভাবিক কারণেই এসময়ে সম্পত্তির দেখা দেওয়ার কথা না, কেননা সেই সময়ে যে খাদ্য জোগাড় করা হতো তা ছিলো অত্যন্ত কম, জমা করে রাখবার মত উদ্বৃত্তের সুযোগই ছিলোনা। কৃষির আবিস্কার তখনও অনেক দূরের ব্যাপার। এ সময়টায় আমরা ধরে নিয়েছি পুরুষরাই সমাজের প্রায় সব কিছুতেই নেতৃত্ব দিতো। সমাজের নেতৃত্বের বিষয়টা গড়ে ওঠে প্রধানত জীবিকার ক্ষেত্রে সামাজিক সহযোগিতা আর অংশ গ্রহণের ভেতর থেকেই। এই ক্ষেত্রটাই পুরুষ যেমন নিরবচ্ছিন্ন ভাবে আত্মনিয়োগ করতে পারতো নারীদের সেটা সম্ভব ছিলোনা। কেননা নারীদের সন্তান গর্ভে ধারণ থেকে শুরু করে সন্তান লালন পালনে একটা দীর্ঘ সময় দূর পাল্লার ছোটাছুটি বা বিপজ্জনক কাজে জড়ানো চলতোনা। এটা ধরে নেবার কোন কারণ নেই যে আদিম নারীরা এখনকার মত কৃশদেহী, লজ্জাশীলা, একান্ত বাধ্যগত, অসূর্যম্পশ্যা ছিলো যারা কখনওই শিকার বা লড়াইয়ে অংশ না নিয়ে ঘরে বসে থাকতো। সে সময়ে নারীরাও অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষদের সঙ্গে শিকারে অংশ নিতো, লড়াইয়ে ঝাপিয়ে পড়তেও দ্বিধা করতোনা। ঋগ্বেদে বিশপলা নামে এক নারী যোদ্ধার খবর পাওয়া যায় যে কিনা যুদ্ধে একটা পা হারিয়েছিলো। এই পা হারানো বিশপলা একটা কাঠের পা নিয়েছিলো সে খবরও আমরা পেয়েছি। তো যুদ্ধের মত ভয়ঙ্কর কাণ্ডে অংশ নিতে পারলে অনুমান করাটা যথেষ্ট যুক্তি সঙ্গত যে সেকালের শিকার দলে মেয়েরাও থাকতো। তবে অনেক কম হারে, কেননা আগেই বলেছি গর্ভধারণ ও সন্তান লালনের ভারটার জন্যই জীবিকার এই প্রধান ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ খুব বেশি হতে পারতোনা। আর এসুত্রেই পুরুষরাই সামাজিক নেতৃত্বের জয়গাটা নিয়ে ফেলে।

কিন্তু সে সমাজে মেয়েদের বা নারীদের গুরুত্ব কম ছিলোনা। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে সামাজিক নেতৃত্ব থেকে নারীরা পিছিয়ে এলেও এই সন্তান জন্মদানের ঘটনা থেকেই তারা নিজেদের একটা অনন্য ভূমিকায় সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছিলো। এখন যেমন স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে পরিবার, সেই আদিম কালটাতে পরিবারের চেহারাটা ঠিক এমন ছিলোনা। তখন পরিবার বলতে আরো বড় একটা গোত্র বোঝাতো যার সদস্যরা সবাই রক্ত সম্পর্কে আত্মীয়তায় আবদ্ধ। অনেকটা আমাদের একান্নবর্তী পরিবার গুলোর মত। কিন্তু এই আত্মীয়তার সূত্রটা ছিলো মায়ের দিক থেকেই। মা সন্তানের জন্ম দিচ্ছে আর এই সাথেই একেবারে প্রাথমিক যে আত্মীয়তার সম্পর্কের সৃষ্টি হচ্ছে তা মাতা আর সন্তানের মধ্যে। আর এখান থেকেই সম্পর্কের শাখাটা যখন বিস্তারিত হচ্ছে তখন গর্ভধারিণী মাতাই কেন্দ্রে চলে আসছে যাকে আবর্তন করে গোষ্ঠীর সবাই একে অপরের সাথে সম্পর্কিত হচ্ছে। সে সময়টায় জন্মদানের বিষয়টাতে পুরুষের অবদান সম্পর্কে মানুষ অজ্ঞাত ছিলো। জন্মদানের সাথে মৈথুন বা পুরুষের কোন ভূমিকা থাকতে পারে এই ভাবনাটারই তখন জন্ম হয়নি।

অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ধরা হয় মধ্যবন্য-পর্বে আটকে থাকা মানব গোষ্ঠী। আমরা সেই অস্ট্রেলিয়ার অরুন্টা আদিবাসীদের সন্তান জন্ম সংক্রান্ত ধারণার যে পরিচয় পাই তাতে দেখি তারাও সন্তান জন্মের সাথে পুরুষদের ভূমিকা সম্পর্কে সত্যটা তখনও জেনে উঠতে পারেনি। অস্ট্রেলিয়ার অরুন্টা আদিবাসীদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে তা হলো চুরিঙ্গা। এই চুরিঙ্গা জিনিসটা একটুকরো পাথর হতে পারে অথবা গাছের ডালের ছোট একটা অংশ যা প্রত্যেকেই সব সময় নিজের সঙ্গে রাখে। অনেকটা আমাদের তাবিজের মত। এই চুরিঙ্গা প্রত্যেকেরই জন্মের সঙ্গে সম্পর্কিত। কোন অরুন্টা নারী সন্তানের জন্ম দেবার পরই পরিবারের কর্তা বা পুরুষদের জানায় ঠিক কোন জায়গায় তার ধারণা বিদেহী আত্মা শিশু হয়ে জন্ম নেবার জন্য তার গর্ভে প্রবেশ করেছে। সেই জায়গাটা হতে পারে একটা জলাশয়ের ধারে বা অন্য কোথাও। পরিবারের পুরুষরা তখন সেই জায়গায় গিয়ে খুঁজতে থাকে। যদি কোন ছোট পাথর পড়ে থাকতে দেখে তবে ভেবে নেয় গর্ভে প্রবেশ করার সময় আত্মাটিই এই পাথর এখানে ফেলে গেছে। তারা সেই পাথরটা কুড়িয়ে নিয়ে আসে আর সেটাই নবজাতকের চুরিঙ্গা হয়ে দাঁড়ায়। কোন পাথর না পাওয়া গেলে কাছের কোন একটা গাছের ডাল কেটে তা থেকেই নবজাতকের জন্য একটা চুরিঙ্গা তৈরী করে ফেলা হয়। এই গাছটি তখন সেই নবজাতকের নানজা-বৃক্ষ হয়ে দাঁড়ায়, যা নবজাতকের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এই গাছটি যাতে সহসা কেউ কেটে না ফেলে এটাও তাকে দেখে রাখতে হয়। অরুন্টা গোষ্ঠীর লোকেদের মৃত্যুর পর মৃতের চুরিঙ্গাটি একটা বিশেষ স্থানে ফেলে বা রেখে আসা হয়। সে জায়গায় অনেক ছোট পাথর বা গাছের ডালের চুরিঙ্গা জমতে জমতে একটা স্তুপের মত হয়ে যায়। অরুন্টারা বিশ্বাস করে এই স্তুপ যাকে তারা ওকনানিকিলা বলে তা বিদেহী পূর্বপুরুষদের আত্মার একটা পবিত্র আবাস। এর আশপাশ দিয়ে কোন নারী গেলে আত্মারা তার গর্ভে শিশু হয়ে ঢুকে পড়তে চায়, আর এভাবেই সন্তানের জন্ম হয়। অরুন্টারা অবশ্য খেয়াল করেছে এই আত্মারা কেবল স্বাস্থ্যবতী তরুণীদেরই জন্মের জন্য বেছে নেয়, বৃদ্ধাদের বা অধিক বয়স্কদের গর্ভে ঢুকতে চায়না (Spencer & Gillen,1899;p128-132)। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ও বলছেন, আদিম মানুষের পক্ষে প্রজননের প্রকৃত রহস্য অনুমান করা সম্ভব নয়। তারা মৈথুনের সঙ্গে প্রজননের সম্পর্ক দেখতে শেখেনি। আধুনিক পণ্ডিতেরা আদিম মানুষের এই অজ্ঞতার নানা রকম স্বাভাবিক কারণ অনুমান করে থাকেন। মৈথুনের অনুপাতে গর্ভসঞ্চারের দৃষ্টান্ত অবশ্যই দুর্লভ; তাই প্রাচীন মানুষদের পক্ষে মৈথুনকেই গর্ভসঞ্চারের কারণ মনে করা স্বাভাবিক নয়। ফলে গর্ভসঞ্চার সংক্রান্ত নানা রকম অবাস্তব ধারণা প্রশ্রয় পাওয়াই স্বাভাবিক। বস্তুত পৃথিবীর পিছিয়ে পড়া মানুষদের মধ্যে এ জাতীয় নানা ধারণা দেখতে পাওয়া যায় এবং রূপকথা ও লোককথায় তার স্মারক খুঁজে পাওয়া কঠিন নয় (দেবীপ্রসাদ,১৩৬৩;পৃ:৩৯১-৩৯২)।

(চলবে)

তথ্যসূত্রঃ

১. The Belief in Immortality and the Worship of the Dead : J.G. Frazer, 1913. Macmillan and Co. Limited. London.
২. The Native Tribes of Central Australia : Baldwin Spencer & F.G. Gillen, 1899. Macmillan and Co. Limited. London.
৩. লোকায়ত দর্শন : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ১৩৬৩ ব.। নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।

“মায়ের দোয়া”র শিকড় সন্ধানে : প্রথম পর্ব


মন্তব্য

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

বেশতো, চলুক তাহলে।

সোহেল ইমাম এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ আব্দুল্লাহ ভাই।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

কর্ণজয় এর ছবি

পড়লাম। দুটোই।।। ভাল লেগেছে। কাজেও।।।

সোহেল ইমাম এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ কর্ণজয়, পড়ার জন্যতো বটেই উৎসাহিত করার জন্যও একরাশ কৃতজ্ঞতা। হাসি

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সোহেল ইমাম এর ছবি

ধন্যবাদ মোখলেস ভাই। হ্যাঁ, বেশ কয়েকটা পর্ব আরো আছে।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রথম পর্বের চেয়েও ভালো। আরও বেশ কয়েকটা পর্ব আশা করছি।

--মোখলেস হোসেন

সোহেল ইমাম এর ছবি

ধন্যবাদ মোখলেস ভাই। হ্যাঁ, বেশ কয়েকটা পর্ব আরো আছে।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

আয়নামতি এর ছবি

এ পর্বটাও পড়ে গেলেম। হাসি

সোহেল ইমাম এর ছবি

ধৈর্য নিয়ে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ আয়নামতি। আপনার লেখা পাইনা অনেক দিন।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

এক লহমা এর ছবি

ভাল লাগছে। পড়ে চলেছি।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সোহেল ইমাম এর ছবি

ধন্যবাদ এক লহমা।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।