ব্রাহ্মণ্য পুরান ইতিহাসে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে সমস্ত ভারতবর্ষই তাদের পদানত ছিলো তা সম্ভবত কখনওই ছিলোনা। কেবল শাস্ত্র রচনার ক্ষমতা ছিলো বলেই তারা নিজেদের কৃতিত্বকে বহুগুণে বাড়িয়ে বর্ণনা করলেও আসল সত্যটি ছিলো তাদের শাসন সীমার বাইরেও বহু আদিবাসী গোষ্ঠী স্বাধীন ভাবেই নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছিলো। ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রগুলোর বাগাড়ম্বর পূর্ণ ইতিহাসে বলা হয়নি ভারতবর্ষের খুব সীমিত কিছু অংশেই তাদের আধিপত্য ছিলো। আদিবাসী এই গোষ্ঠী গুলোয় শিক্ষার আলো ছিলোনা বলেই তারা ইতিহাসটা রচনা করে যেতে পারেনি ফলে ব্রাহ্মণ্য ইতিহাসই একমাত্র ইতিহাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছিলো।
যখনই কোন রাজা সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের খেলায় মেতেছেন, দিগ্বিজয়ের নামে একের পর এক রাজ্য দখল করে চলেছেন তখনই সেই সম্প্রসারিত সাম্রাজ্যের খরচ যোগাতে তাকে অনাবাদি জমি গুলো চাষের আওতায় এনে কৃষক নিয়োগ করতে হয়েছে। সে সময়ে রাজা বা সম্রাটের আয় বা খাজনা বলতে ছিলো প্রধানত কৃষি থেকে পাওয়া কর। এটার বৃদ্ধি সম্ভব নয় যদি না নতুন ভাবে আরো বেশি অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় না আনা হয়। কিন্তু অনাবাদি জমি চষবে কে? তার জন্য আরো কৃষক প্রয়োজন, আর এই প্রয়োজন তারা মেটাতো আদিবাসীদের ধরে নিয়ে এসে। কখনও এই আদিবাসী গোষ্ঠী গুলোকে আক্রমন করে, কখনও প্রলোভন দেখিয়ে তারা কৃষিশ্রমিকের সরবরাহটা বজায় রাখতো। ভারতবর্ষের ইতিহাসে সাম্রাজ্য বিস্তারী প্রায় সকল রাজাই এই প্রক্রিয়াতেই কৃষির জন্য শ্রমিক সংগ্রহ করে গেছে। আর এর ফলেই ব্রাহ্মণ্য সমাজের ভেতর শূদ্র হয়ে, বিভিন্ন অন্ত্যজ শ্রেণির নাম নিয়ে আদিবাসীদের অন্তর্ভূক্তি চলতেই থেকেছে যুগের পর যুগ। কৃষক ছাড়াও সৈন্যদল বাড়াতেও এই আদিবাসীদের ব্যবহার করা হতো। আদিবাসীদের আদিম সামাজিক ঐক্য আর সরলতার জন্যই সৈনিক হিসেবে, কৃষক হিসেবে এদেরকেই পদানত করে রাজ্যের সম্পদবৃদ্ধিতে কাজে লাগানো হতো।
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর লোকায়ত দর্শন বইতে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে দীর্ঘ একটি উদ্ধৃতি তুলে দিয়ে দেখাবার চেষ্টা করেছেন কৌটিল্য রাজ্যের আশেপাশের আদিবাসী সমাজ সংগঠন গুলো কিভাবে ভেঙ্গে দিতে হবে সে বিষয়ে রাজাকে পরামর্শ দিচ্ছেন। আমরা দেখি কৌটিল্য বলছেন :
… সংঘের আসন্নবর্তী হইয়া (বিজিগীষুর) সত্রিনামক গূঢ় পুরুষগণ সংঘগুলির পরস্পরের মধ্যে দোষ, দ্বেষ বা রোষ, অপকারাদি-নিমিত্তিক বৈর বা দ্রোহ ও কলহের কারণ উপলব্ধি করিয়া তাহাদিগের মধ্যে ক্রমশ অনুপ্রবেশিত ভেদ ঘটাইবে এবং বলিবে, ‘অমুক সংঘ তোমাদিগের সংঘের এইরূপ অপবাদ করে। (অন্য সংঘের প্রতিও এইরূপ বলিয়া) তাহারা উভয়পক্ষ মধ্যে ভেদ আনয়ন করিবে। পরস্পরের প্রতি রুষ্টভাবাপন্ন সংঘীদিগের মধ্যে আচার্যব্যঞ্জন গূঢ় পুরুষগণ বিদ্যা, শিল্প, দ্যূত ও বৈহারিক বিষয়ে বালকলহ উৎপাদন করাইবে। নারী, মাদকদ্রব্য ও আরো ভয়ানক সব ষড়যন্ত্রের নক্সা বর্ণনার পর কৌটিল্য রাজাকে উপদেশ দিচ্ছেন, … এই প্রকার কলহকারণ উপস্থিত হইলে, কিংবা, (উপজাপ ব্যতীত) আপনা হইতেই কলহ উৎপন্ন হইলে, অথবা, তীক্ষ্ণ পুরুষগণদ্বারা কলহ উৎপাদিত হইলে, (বিজিগীষু) রাজা অল্পশক্তি-বিশিষ্ট সংঘমুখ্যকে কোষ ও দণ্ডদ্বারা নিজ বশে আনিয়া তাঁহাকে প্রতিকূলচারী অন্যান্য সংঘমুখ্যের বিরুদ্ধে আক্রমণ করিতে নিয়োজিত করিবেন… (দেবীপ্রসাদ,১৩৬৩;পৃ:২৪৫-২৪৭)।
কিন্তু এই আদিবাসীদের এক একটা সমাজ ভাঙ্গা কেন জরুরি ছিলো? দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, কৌটিল্য বলছেন, রাজা এই মানুষগুলিকে নিজের সৈন্যদলে ভর্তি করবার চেষ্টা করবেন। ‘সর্বপ্রকার কলহ-বিষয়েই রাজা হীনপক্ষকে কোষ ও দণ্ডদ্বারা স্বপক্ষে আনিয়া তাহাকে নিজ-প্রতিপক্ষ বা শত্রুর বধে নিযুক্তি করিবেন। … অষ্টম ও নবম শতাব্দীর ধর্মপাল ও দেবপালের শিলালিপিতে তাঁদের সৈন্যবাহিনীর যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা থেকে স্পষ্টই অনুমান করা সম্ভব যে, নানা রকম ট্র্যাইব্যাল মানুষ নিয়েই এই সৈন্যদল গঠিত হয়েছিলো। কেননা, এই সৈন্যদলের বর্ণনায় যে-সব মানুষদের নাম পাওয়া যায় সেই নামগুলি প্রায়ই সরাসরি ট্র্যাইব্যাল নাম (দেবীপ্রসাদ,১৩৬৩;পৃ:২৪৮)। শুধু সৈন্যবাহিনী গঠনই নয় কৌটিল্য আরো উপদেশ দিচ্ছেন, গণ-সমাজ থেকে উৎপাটিত ওই মানুষ গুলিকে পাঁচঘর বা দশঘর এই রকম ছোটো-ছোটো দলে বিভক্ত করে আলাদা আলাদা ছোটো-ছোটো গ্রামে বসিয়ে কৃষিকার্যে নিযুক্ত করতে হবে: দশকুলিং পঞ্চকুলিং বা কৃষ্যাং নিবেশয়েৎ - ‘ভূমিতে কৃষিকর্ম করিতে যোগ্য ইহাদের কুলপঞ্চক বা কুলদশক লইয়া (ভিন্ন ভিন্ন) গ্রামনিবেশ করাইবেন’। মনে রাখতে হবে, কৌটিল্য বিশেষ করে উপদেশ দিচ্ছেন, এই গ্রামগুলি যেন স্বতন্ত্র ও পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়। কেননা, গণ-সমাজের প্রধান শক্তি – এবং, অতএব রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে গণসমাজ সম্পর্কে আতঙ্কের প্রধান কারণ হলো – গণবন্ধন বা মানুষগুলির মধ্যে একতা। ইংরেজিতে group bond । তাই কৌটিল্যের কাছে গণসমাজকে ভাঙবার প্রধানতম কৌশল হলো এর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। অতএব, গণসমাজকে ভাঙবার পর যে সতর্কতা অবলম্বন করবার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো ওই মানুষগুলি যাতে আবার না এক হতে পারে। ওরা আবার এক হতে পারলেই রাজার বিরুদ্ধে আয়ূধ ধারণ করবে। তাই এরা আবার এক হবার উপক্রম করছে দেখলে প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে হবে।কৌটিল্য বলছেন, ইহাদিগকে একত্র হইয়া থাকিতে দিলে, ইহারা (বিজিগীষু রাজার বিরুদ্ধে) শস্ত্রগ্রহণে সমর্থ হইয়া উঠিতে পারে। এবং ইহারা সমবেত হইয়া অবস্থান করিলে, (তিনি) ইহাদের উপর দণ্ড বিধান করিবেন’ (দেবীপ্রসাদ,১৩৬৩;পৃ:২৪৮-২৪৯)।
সব সময় যে আদিবাসী গোষ্ঠী গুলোকে জোর করে ধরে আনতে হতো তাও নয়। কখনও কখনও জীবিকার আশাতেই কিছু কিছু আদিবাসী গোষ্ঠী স্বেচ্ছায় এসে এই ব্রাহ্মণ্য শাসনের দাসত্ব গ্রহণ করতো। আবার কেউবা নিস্কর জমি পাবার প্রলোভনে এসে বন কেটে আবাদি জমি প্রস্তুত করতো আর তার পর রাজ্যের উচ্চবর্গের হাতেই সে সব আবাদি জমি চলে যেতো। ঠিক সেই একই পদ্ধতিতে ইংরেজদের শাসনামলেও এই ব্যাপারটা চলেছে। ১৭৮৯ সালে ইংরেজরা জমিদারদের হাতে জমির মালিকানা অর্পণ করে আর এর চার বছর পরই তা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত হয়। আর তখন থেকেই বন কেটে আবাদি জমি বাড়াতে জমিদাররা সাঁওতালদের চড়া মজুরী আর খাজনাহীন জমির প্রলোভন দেখিয়ে কাজে নিয়োগ করে নিজেদের আবাদি জমি বাড়িয়ে নিতে থাকে (দেবীপ্রসাদ,১৩৬৩;পৃ: ২৫১-২৫২)। আর এভাবেই আদিবাসীরা আর তাদের আদিম সংস্কৃতি ব্রাহ্মণ্য সমাজে যুগের পর যুগ ধরে প্রবেশ করেছে। কায়িক শ্রমের জন্য, রাজ্য বিস্তারের প্রয়োজন বা রাজ্য রক্ষার জন্য সৈন্যদল হিসেবে এই আদিবাসীদের রাষ্ট্রের মধ্যে স্থান দিতেই হয়েছে আর এদের সংস্কৃতিকেও অনেকখানি ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়েও নিতে হয়েছে। যা মেলানো যায়নি সে উপাদান গুলোকেও ব্রাহ্মণ্য সমাজের শাসকদের সহ্য করে নিতে হয়েছে। আবার সময়ের সাথে সাথে এই কায়িকশ্রমে নিয়োজিত মানুষ গুলোও কখনও কখনও প্রজন্ম পরম্পরায় সম্পদ সঞ্চয় করে সমাজের উপর তলায় উঠে যেতেও সক্ষম হয়েছে এবং তাদের আচার বিশ্বাস আর সাংস্কৃতিক উপাদান গুলোও কোন কোন সময় ব্রাহ্মণ্য শাসকদের স্বীকৃতিও অর্জন করে নিতে পেরেছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ভারতবর্ষের মানুষ গুলোকে ভালো করে গুনে দেখবার ও তাদের প্রকৃতি-বিশ্লেষণ করবার প্রয়াস নেওয়া হয়। তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক কালের হলেও এই রিপোর্টের থেকে কয়েকটি বড় চিত্তাকর্ষক তথ্য পাওয়া যায়। প্রথমতঃ, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাশেষি পর্যন্ত (এবং আধুনিকতম রিপোর্ট অনুসারে নিশ্চয়ই আজও, অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর মাঝমাঝি পর্যন্ত) আমাদের দেশ থেকে ট্রাইবাল সমাজ বিলুপ্ত হয়নি - ১৮৭১-৭২ সালের রিপোর্ট অনুসারে ১৮৬০ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১৮০ লক্ষ তখনো ট্রাইবাল সমাজেই জীবন যাপন করছে। ব্রিটিশ কলোনিয়াল অফিস থেকে এদের নাম দেওয়া হয়েছে জংলী লোক বা এ্যবরিজিন। এবং জনৈক সুদক্ষ ইংরেজ আমলা এদেরই প্রসঙ্গে বলছেন : আর্য-আক্রমণের দরুন সমতল দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে এরা পর্বতে গিয়ে আত্মগোপন করে রয়েছে – বিলুপ্ত জীবজন্তুবিষয়ক বৈজ্ঞানিকেরা পাহাড়ের গুহায় যেরকম বিলুপ্ত জানোয়ারের অস্থি আবিস্কার করেন এদের অবস্থাও খানিকটা তার মতন। তাই ভারতবর্ষের অবস্থাটা যেন জাতিতত্ত্বের এক বিরাট যাদুঘরের মতো – এখানে আমরা মানুষকে তার সংস্কৃতির সবচেয়ে নিচুস্তর থেকে শুরু করে সবচেয়ে উঁচুস্তর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করতে পারি (দেবীপ্রসাদ,১৩৬৩;পৃ: ২৫০)। লেখক অন্যত্র এই ট্রাইবাল-সমাজের মানুষগুলির বর্ণনায় বলেছেন, the fragments of pre-historic world, - প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীর টুকরোর মতো। ইংরেজ আমলের ভারতবর্ষের চেহারাটাই যদি এই হয় তাহলে হিন্দু-আমলের ভারতবর্ষের ছবিটা নিশ্চয়ই অনুমান করা কঠিন নয়। কিন্তু ১৮৭১-৭২ সালের ওই রিপোর্টটির আরো বিস্ময়কর তথ্য হলো, বাকি ১৬৪০ লক্ষ মানুষদের মধ্যে প্রায় ১৫২০ লক্ষ মানুষ যে কোথা থেকে এলো তার সঠিক হদিস দিতে পারা যাচ্ছেনা। কেননা, এই রিপোর্টে দেশের মাত্র ১৬০ লক্ষ মানুষকে উঁচু-জাতের বলে – অর্থাৎ বর্ণনাদাতাদের ভাষায়, বিশুদ্ধ আর্যসন্তান হিসেবে – সনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে, এই ১৫২০ লক্ষ মানুষদের ব্যাখ্যা হিসেবে শুধু এইটুকুই বলা হচ্ছে যে, এরা আদিতে ছিলো স্থানীয় অসভ্য ও অনার্য মানুষ (দেবীপ্রসাদ,১৩৬৩;পৃ: ২৫০)।
কিন্তু এই আদিবাসী আদিম প্রথার মানুষ গুলোর সমাজ ব্রাহ্মণ্য সমাজ থেকে অনেক খানিই আলাদা গোত্রের ছিলো। এদের পরিচয় দিতে গিয়ে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, মানুষের অগ্রগতির প্রাকৃত পর্যায়ের সমাজ-সংগঠন বলতে ওই ট্রাইব্যাল সমাজের সংগঠনই। কিন্তু আজকের দিনে আমাদের পক্ষে এই ট্রাইব্যাল সমাজের মূল লক্ষণটিকে সম্যকভাবে বুঝতে পারা সহজসাধ্য নয়। কেননা, আমাদের সমাজ জীবনের সঙ্গে এর একেবারে গুনগত পার্থক্য আছে। আমরা বাস করি শ্রেণীবিভক্ত সমাজে, আমাদের চিন্তার কাঠামোটি শ্রেণীবিভক্ত সমাজের বৈশিষ্ট্য দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। ট্রাইব্যাল সমাজের আদি ও অকৃত্রিম রূপটির মধ্যে শ্রেণীবিভাগের চিহ্ন ফুটে ওঠেনি; সে সমাজের মানবজীবন একান্তভাবেই যৌথজীবন। তাই রাষ্ট্রব্যবস্থা নেই, শাসক-শাসিত তফাত নেই, ব্যক্তিগত সম্পত্তি নেই, আধুনিক একবিবাহমূলক নরনারী সম্পর্ক বা পরিবার জীবন নেই। ফলে, শ্রেণীসমাজে লালিত আমাদের চিন্তা-চেতনার সাহায্যে আমরা ওই প্রাকবিভক্ত সমাজের বৈশিষ্ট্যকে সহজে উপলব্ধি করতে পারিনা (দেবীপ্রসাদ,১৩৬৩;পৃ: ২৮৯)।
কিন্তু এই আদিবাসীরা যখন ব্রাহ্মণ্য সমাজে বাস করতে শুরু করলো তখন তাদের সংস্কৃতি ঠিক সেই আদিম চরিত্রটি আর বজায় রাখতে পারেনি। তারা যে আদিম ধরণের সমাজ কাঠামোর মধ্যে বাস করতো আর ব্রাহ্মণ্য সমাজ কাঠামো এক ছিলোনা। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় আরো সুন্দর করে বলছেন, বাংলাদেশে কৃষকদের গ্রামগুলি ট্রাইব্যাল সমাজ নয়। কিন্তু ট্রাইব্যাল সমাজ না থাকলেও এই গ্রাম-জীবন থেকে ট্রাইব্যাল সমাজের সমস্ত চিহ্নই নিঃশেষে বিলুপ্ত হতে পারেনি। কেননা, উৎপাদন কৌশলে কোন মৌলিক পরিবর্তন দেখা দেয়নি। ট্রাইব্যাল সমাজ ভেঙে সে-সমাজের মানুষগুলিকে নিয়ে পুরোনো উৎপাদন কৌশলের ভিত্তিতেই যদি ছোটো ছোটো আর নতুন গ্রাম নিবেশ হয়ে থাকে তাহলে এই গ্রামগুলির মধ্যে থেকে ট্রাইব্যাল সমাজের সমস্ত চিহ্ন নিঃশেষে মুছে যাবার কথা নয় (দেবীপ্রসাদ,১৩৬৩;পৃ: ২৫৪)। আর একারণেই সেই আদিম সমাজের নারীর উর্বরতা কেন্দ্রিক যাদুবিশ্বাস মূলক আচার অনুষ্ঠান অবিকৃত ভাবে ফিরে এলোনা। ফিরে এলোনা সেই আদিম মাতৃকা মূর্তি গুলোও। যা রূপ পরিগ্রহ করলো তা হলো লৌকিক দেব দেবী। যাদের নিয়ে মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে, পাঁচালি রচিত হয়েছে।
এই আদিবাসীদের লৌকিক দেব-দেবীরা ব্রাহ্মণ্য সমাজে একরকম অপাংক্তেয়ই ছিলো বহুকাল। কিন্তু ভারতবর্ষে মুসলমানদের আক্রমন ও শাসন প্রতিষ্ঠার সময় রাষ্ট্রশক্তি যখন হিন্দু ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের উচ্চবর্গের হাত থেকে বিদেশী মুসলিম শাসকদের করায়ত্ত হলো তখন এই ব্রাহ্মণ্য সমাজ শঙ্কিত হয়েছে। শঙ্কাটা আরো বেশি তীব্র হয়েছে মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মান্তরের প্রকোপ দেখে। যে আদিবাসীদের তারা তাদের সমাজে শূদ্র ও অন্ত্যজ শ্রেণির অভিধা দিয়ে তাদের উপর ধর্মীয় সংস্কার চাপিয়ে দাসানুদাস করে রেখেছিলো তারাই যদি তাদের হাত ফস্কে বেরিয়ে যায় তবে তাদের জমি চষবে কে। আর তাছাড়া মুসলিম শাসকরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেও ব্রাহ্মণ্য উচ্চবর্গের ভূস্বামীরা সবাই যে তাদের জমিজিরাতও হারিয়ে বসেছিলেন তা নয়। মুসলিম শাসকদের অধীনে তখনও প্রচুর হিন্দু ভূস্বামী, জমিদাররা ছিলো। যে বিপুল মানুষকে তারা একান্ত বাধ্যগত শ্রমশক্তি বানিয়ে রেখে দিয়েছিলো, এতোদিন ধরে যাদের দ্বারা সম্পদ সৃষ্টি করেই তারা সাচ্ছন্দ্য আর সম্ভোগের জীবন কাটিয়ে এসেছে তাই যেন তাদের হাত ছাড়া হবার উপক্রম হলো। এই আতঙ্কেই তারা নিম্নবর্গের লৌকিক দেবদেবীদের ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের গণ্ডীর মধ্যে টেনে নিতে কিছুটা বেশি স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হলো। রাষ্ট্রক্ষমতা তারা হারিয়েছিলো কিন্তু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিটাও হারিয়ে বসলে চলবে কেন। এই যে নিম্নবর্গের মানুষেরা মুসলমান হয়ে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করছে এতে ধর্মরক্ষার চেয়ে ব্রাহ্মণ্য ভূস্বামীদের কাছে বড় হয়েছিলো সস্তায় এবং সহজ শ্রমশক্তির ভাণ্ডার হারিয়ে ফেলার ভয়।শ্রম ছাড়া সম্পদ সৃষ্টি হয়না এটা তাদের কাছে মোক্ষ ও নির্বাণের চেয়েও পরমসত্য ছিলো। এরই প্রতিক্রিয়ায় নিম্নবর্গের চণ্ডী, মনসা প্রভৃতি দেবীরা ব্রাহ্মণ্য গণ্ডীর ভেতরে প্রবেশের ছাড়পত্র লাভ করে। এই মানুষ গুলোকে ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের সাথে আঁটকে রাখার তাগিদে মঙ্গলকাব্যে এই সব লৌকিক দেবদেবীর কাহিনির সঙ্গেই ব্রাহ্মণ্য পৌরাণিক কাহিনিও উপক্রমণিকার মত জুড়ে দেওয়া হতো ।
হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় একটু অন্য বিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও তার বর্ণনায় সে সময়ের ছবিটা যথেষ্টই স্বচ্ছ। তিনি বলছেন, হিন্দুরাজত্বের অবসান ঘটিয়াছে। বিদেশী তুর্কী আসিয়া বঙ্গালার নানা স্থান অধিকার করিয়াছে। লোহার খয়রা ভল্ল ডোম বাগদি মল্ল প্রভৃতি জাতি যাহারা সৈন্যবিভাগে কার্য করিত, তাহারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছে। রাজা নাই, রাজ্যরক্ষার প্রয়োজন নাই, সৈন্য রাখিবে কে? তাহাদের জীবিকার্জনের পন্থায় বিঘ্ন উপস্থিত হইল। সমাজ তাহাদের নূতনতর বৃত্তির উপায় খুঁজিতে লাগিলেন, সুতরাং নূতন করিয়া জাতি গঠনের, পরস্পর ঐক্যবন্ধনের প্রয়োজন অনুভূত হইল। তাহাদিগকে বুঝাইতে হইল, তাহারা দেবনুগৃহীত জাতি, কালুবীর ডোম ধর্মের পরম ভক্ত, লোহাটা বজর জাতিতে লোহার – দেবী ভবানীর প্রিয় সাধক। ইছাইঘোষ গোয়ালা। ধনপতি ও চাঁদ জাতিতে বণিক। কালকেতু ব্যাধ। ইহাদিগকে বুঝাইতে হইল, স্বয়ং ভগবতী বাগদিনীর বেশে মাছ ধরিয়াছেন। দেবাদিদেব মহাদেব স্বয়ং কৃষিকার্য করিয়াছেন। জীবিকার্জনে বংশানুগত বৃত্তি অবলম্বনে কোন লজ্জা নাই। বুঝাইতে হইল, দৈহিক বল অপেক্ষা নৈতিক বল কোন অংশে হীন নহে, পার্থিব সম্পদ অপেক্ষা চরিত্রসম্পদের মূল্য অনেক বেশী। মঙ্গলকাব্যের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইল। মনুষ্যত্ব দেবত্বেরই রূপান্তর রূপে পূজা লাভ করিল। ধর্মরাজ মনসা চণ্ডী মহাদেব প্রভৃতি দেবতাকে কেন্দ্র করিয়া জাতির ঐক্যবন্ধন সুদৃঢ় হইল, গ্রামদেবতার আশ্রয়প্রাঙ্গণে উচ্চনীচ ভেদ বহুল পরিমাণে তিরোহিত হইয়া আসিল। মঙ্গলকাব্য গুলি ধর্মমূলক সাহিত্য হইলেও কবিগণ রসভাবের সাধনায় কিয়দংশ সাফল্য লাভ করিলেন (হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, ১৯৯৯; পৃ: ১৪৫)। এই যে “জাতির ঐক্যবন্ধনের” কথা এতে কিন্তু এই নিম্নবর্গের মানুষের কোন লাভ হয়নি। তারা যে তিমিরে ছিলো সেই তিমিরেই থেকে গেছে। হরেকৃষ্ণ যেমন বললেন, “উচ্চনীচ ভেদ বহুল পরিমাণে তিরোহিত হইয়া আসিল” এর কিন্তু কোন প্রমাণ চোখে পড়েনা। কিন্তু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে বেহাত হবার উপক্রম করছিলো যে সস্তা শ্রমশক্তি তাকে আঁটকে এবং আগের ধরনেই খাটিয়ে মুসলিম শাসনের মধ্যেই নিজেদের অর্থনৈতিক সাচ্ছন্দ্যকে তারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। গোটা হিন্দু জাতির উন্নতির চিন্তা তাদের ছিলোনা। অতখানি স্পষ্ট করে না হলেও অতুল সুরও বলছেন, মুসলমানরাজগণের আমলে ব্রাহ্মণ শাসিত সমাজের মধ্যে শৈথিল্য ঘটায় নিম্নশ্রেণী কর্তৃক পূজিত বহু দেবদেবী প্রাধান্য লাভ করতে থাকেন। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন শীতলা, বাশুলী, মনসা, চণ্ডী ইত্যাদি। হিন্দু দেবতামণ্ডলে স্থান দেবার জন্য তাঁদের অধিকাংশকে শিবজায়া উমার সহিত অভিন্ন করা হয়। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, এ যুগের হিন্দুসমাজে গৃহীত এই সকল দেবদেবী বাঙলাদেশে সুপ্রাচীন কাল থেকেই পূজিত হয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সমাজের নিম্নশ্রেণী কর্তৃক পূজিত এই সকল দেবদেবী ব্রাহ্মণ্যধর্মের মধ্যে স্বীকৃতিলাভ করতে পারেনি। তার প্রধান কারণ ছিল এই যে, আর্যসমাজের প্রধান দেবতাসমূহ ছিল পুরুষদেবতা, আর আর্যেতর সমাজের প্রধান দেবতাসমূহ ছিলেন নারীদেবতা। আর্যদেবতাসমূহ যতই প্রাধান্য লাভ করতে লাগলেন, আর্যেতর এই সকল নারীদেবতাসমূহ ততই পর্বতকন্দরে, ঝোপজঙ্গলে বা গাছতলায় আশ্রয়লাভ করলেন। কিন্তু মধ্যযুগে যখন ব্রাহ্মণ্যধর্মের ভিত্তি টলমল করে উঠল, তখন এই সকল নারীদেবতা তাঁদের পর্বতকন্দর, ঝোপজঙ্গল ও গাছতলার আশ্রয় পরিহার করে ক্রমশ হিন্দুর আনুষ্ঠানিক ধর্মসংস্কারের মধ্যে প্রবেশ লাভ করতে লাগলেন। এই অনুপ্রবেশকে সহজ করবার জন্য তাঁদের পৌরাণিক মাতৃদেবীর সঙ্গে অভিন্ন প্রতিপন্ন করা হল (অতুল সুর:২০০৮;পৃ:২২১)। এখানেও সমাজের “শৈথিল্যের” কথা বলে ব্রাহ্মণ্য শ্রেণির সুবিধাবাদী চরিত্রটাকে আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে কিন্তু মোটের ওপর মুসলিম শাসনের প্রভাবই যে মঙ্গলকাব্য গুলো রচনার পেছনে কাজ করেছিলো এটা অস্বীকার করবার জো নেই। ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের পালিশ দিয়ে রচিত হলেও তাই এদের মধ্যের আদিবাসী চারিত্র্যই প্রকট ছিলো, কেননা এগুলো যাদের জন্য রচিত হতো তারা আদিম সমাজ থেকেই এসেছিলো।
এই মনসা, চণ্ডী, ষষ্ঠী, শীতলা দেবীরা কিন্তু ব্রাহ্মণ্য সমাজের দেবতাদের মত উচ্চমার্গের আধ্যাত্মিক পর্যায়ের মোক্ষ, মুক্তি, নির্বাণের বরদান নিয়ে হাজির হলোনা হাজির হলো একান্ত পার্থিব, বৈষয়িক উন্নতির বরদান নিয়ে, রোগবালাই থেকে, সদ্যজাত সন্তানের অকাল মৃত্যু থেকে পরিত্রাণের বরদান নিয়ে। রাখাল বালকদের মধ্যে নিজের পূজা প্রচারের জন্য উৎসাহিত করতে বৃদ্ধার ছদ্মবেশে দেবী মনসা তাদের আশ্বাস দেয়,
বুড়ী বলে শুন বাপা যত শিশুগণ
আমার করহ পূজা পাইবে গোধন।। (সনৎকুমার,২০১৫; পৃ: ৮০)
আবার চাঁদবেনে জালু মালুকে শতভার মাছ ধরে দেবার আদেশ দিলে তারা বিপদে পড়ে কেননা এতো মাছ একদিনে ধরা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। কিন্তু বিপদ আরো চরমে ওঠে যখন জালু মালু শত চেষ্টাতেও একটি মাছও ধরে উঠতে পারেনা। তখন জালু মালুর মা মনসার কাছে প্রার্থনা জানায়,
নিছনি জালুর মায় পূজা করে মনসায় এবার উদ্ধার বিষহরি।
এবার করহ পার মৎস্য দিয়া শতভার বিপদ-সাগর তবে তরি।।
রক্ষ রক্ষ ঊর ঝি আমি ত বলিব কি কি জানি তোমার স্তুতিবাণী।
আপনার গুণে মাআ দিবে চরণের ছায়া দয়াময় গিরিশ-নন্দিনী।।
মনসাকুমারী মনে জ্ঞাত হৈলা ততক্ষণে সখীরে কহিলা বিশ্বমাতা।
নিছনি জালুর মায় জপে মনে মনসায় তাহারে হইব বরদাতা।। (সনৎকুমার,২০১৫; পৃ: ১১৪)
মনসাও এই প্রার্থনায় বর দিতে দেরি করেনা,
তোরা মোর দুই দাস চিরকাল দুঃখ পাস দয়া-মনে দিতে আইনু বর
এই কথা শুন সার দুঃখ না পাইবে আর আর না ধরিতে যাহ মীন।
মনের মানস যত পুরাইব মনোমত আজি হৈতে সম্পদের চিন।। (সনৎকুমার,২০১৫; পৃ: ১২১)
দেবী মনসা বর দিলে জালু-মালুর ঘরবাড়ির চেহারাই পাল্টে যায়,
মনসা দিলেন বর আওয়াস প্রাচীর ঘর হৈল বেড়্যা ভাঙ্গা কুড়েখানি।
হেনই দেবীর মায়্যা অকিঞ্চন জনে দয়া সদয় হৃদয় সুধাবাণী।।
নিছনি জালুর মা জাঁতে তাঁর হাথ পা আসরে বাসরে দেই ফুল।
জালু মালু দুই ভাই দাণ্ডায়্যা দেবীর ঠাঁই চামর ঢুলাই সমতুল।।
মনসা বিদায় করে সোনার কুস্মাণ্ড ঘরে দেখিয়া জালুর চমৎকার। (সনৎকুমার,২০১৫; পৃ: ১২২)
জালু মালুর বাড়িঘরের উন্নতি দেখে অবাক হওয়া চাঁদবেনের স্ত্রী সনকা জালুর মাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে,
জালুর জননী বলে সনকার তরে।
মনসার পূজা আজি করিলাঙ ঘরে।।
নেত কেত দুটি বারা উঠ্যাছিল জালে।
করিল দেবীর পূজা পূর্ব্ব কর্ম্মফলে।।
মনসার পূজা কৈল তিঁহ দিল বর।
আওয়াস প্রাচীর হৈল বেড়্যা ভাঙ্গা ঘর।।
যার সনে বাদ করে চাঁদ সদাগর।
তার বরে হৈল মোর সুবর্ণের ঘর।। (সনৎকুমার,২০১৫; পৃ: ১২৩)
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে ঠিক এভাবেই দেখি দেবী কালকেতুর কাছেও এরকম পার্থিব সমৃদ্ধির বরদান নিয়ে হাজির হয়েছে,
কি আর জিজ্ঞাসা কর আইনু তোমার ঘর বীরের দেখিতে নারি দুখ।
দিয়া আপনার ধন তুষিব বীরের মন আজি হৈতে পাবে বড় সুখ।।
…
খাও পর যত তুমি সকল যোগাব আমি মোরে তুমি না ভাবিহ ভিন।
সমরে কানন-ভাগে থাকিব বীরের আগে আজি হৈতে সম্পদের চিন।।
শতেক রাজার ধন অঙ্গে মোর আভরণ ভুবন কিনিতে পারি ধনে।
সম্পদ অনেক দিব ভকতি কেবল নিব শ্রীকবিকঙ্কণ রস ভনে।। (সৌম্যেন্দ্রনাথ, ২০০০; পৃ:৭৬)
কালকেতু আর তার স্ত্রী যখন এই অযাচিত সৌভাগ্যকে ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারেনা তখন দেবী আবারও তাদের আশ্বাস দিয়ে বলে,
শুন শুন মোর বাক্য বীর কালকেতু।
খণ্ডাব তোমার দুঃখ আইনু তার হেতু।।
আইনু পার্বতী আমি তোরে দিতে বর।
বর মাগ কালকেতু ত্যজ ধনুশর।।
মাণিক অঙ্গুরী লহ সপ্ত রাজার ধন।
ভাঙ্গায়্যা বসাহ রাজ্য গুজরাট বন।। (সৌম্যেন্দ্রনাথ, ২০০০; পৃ:৮৪)
মোক্ষ, নির্বাণ, সংসারের জন্মচক্র থেকে চিরমুক্তির সেই উচ্চমার্গের আধ্যাত্মিক বর নয় এই দেবীরা সাধারণ মানুষের কাছে এলো সম্পদ সমৃদ্ধির বর নিয়ে যাতে চিরদারিদ্র্যের কষাঘাতে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া মানুষ গুলো একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারে, দৈনন্দিন গ্রাসাচ্ছদনের নাছোড়বান্দা দুশ্চিন্তার হাত থেকে মুক্তি পায়, যাতে তাদের নবজাত সন্তান জন্মমাত্র মৃত্যুর মুখে না পড়ে, বসন্ত বা ওলাওঠা রোগে মানুষ গুলো গ্রামকে গ্রাম সাবাড় না হয়ে যায়। দেবীদের বরদান বাস্তবায়িত হতো কতখানি সে প্রমাণ নেই, কিন্তু যুগ যুগ ধরে এই বিশ্বাস জীবিত ছিলো এবং প্রজন্ম পরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে এসেছে আমাদের এই আধুনিক কাল পর্যন্ত। এই সাধারণ মানুষ গুলো ব্রাহ্মণ্য দেবমণ্ডলীর নয় এরকম লৌকিক দেব-দেবীর কাছেই বরাবর আশ্রয় চেয়েছে, এদের উপরই ভরসা করেছে। আদিবাসী সমাজ থেকে উৎপাটিত হয়ে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি ও শাসনের গণ্ডীর মধ্যে এই সাধারণ মানুষ গুলো যারা সমাজের একটা বৃহৎ অংশে পরিণত হয়েছিলো তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে একটা অন্য জগত রচনা করে নিয়েছিলো। এই জগতটা ব্রাহ্মণ্য বলয়ের মধ্যে অবস্থান করেও একটা স্বতন্ত্র ধারা বজায় রেখে চলেছিলো। সাধারণ মানুষের এই সমাজটা আর আদিবাসী সমাজ ছিলোনা আবার ব্রাহ্মণ্য শাসনের চাপে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থারও বিশেষ কোন উন্নতির সুযোগ ছিলোনা তাই এরা ত্রিশঙ্কুর মতোই একটা অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে ঝুলে থেকেছে যুগের পর যুগ। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বোধহয় এ অবস্থাটাকেই বলেছেন ট্রাইবাল পর্বের অসম্পূর্ণ বিলোপ।
(চলবে)
তথ্যসূত্রঃ
১. লোকায়ত দর্শন : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ১৩৬৩ ব.। নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।
২. কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল : সম্পাদনা- সনৎ কুমার নস্কর,২০১৫। প্রজ্ঞা বিকাশ; ২য় সংস্করণ, কলকাতা।
৩. কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল : সৌম্যেন্দ্রনাথ সরকার,২০০০। গ্রন্থবিকাশ, কলকাতা।
৪. গৌড়বঙ্গ সংস্কৃতি : হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, ১৯৯৯। পুস্তক বিপনি; রজতজয়ন্তী বর্ষ প্রকাশন। কলকাতা।
৫. বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন : ড. অতুল সুর, ২০০৮। সাহিত্যলোক, কলকাতা; ৪র্থ সংস্করণ ।
আগের পর্বের লেখার লিংক:
“মায়ের দোয়া”র শিকড় সন্ধানে : প্রথম পর্ব
“মায়ের দোয়া”র শিকড় সন্ধানে : দ্বিতীয় পর্ব
“মায়ের দোয়া”র শিকড় সন্ধানে : তৃতীয় পর্ব
“মায়ের দোয়া”র শিকড় সন্ধানে : চতুর্থ পর্ব
মন্তব্য
কৌটিল্য সার্থক নামকরণ বটে। ডিভাইড এণ্ড রুল পেটেন্টের দাবীদার তো একা ইংরেজ নহে দেখা যায়। এক্ষেত্রে পাপীষ্ঠ ইতিহাস, কৌটিল্যকে পুরোপুরি বঞ্চিত করেছে নাকি কোথাও স্বীকার টিকার করেছে এহেন প্রতিভার কথা? সঠিক জানিনা। জানা থাকলে বলবেন।
সেই কোন প্রাচীন সময় থেকে ধর্মীয় সংস্কারের খুঁটিতে অর্থনীতির দুধেল গাই বাঁধবার তোড়জোড় শুরু হইছে। আজও সেটা নানান চেহারায় বর্তমান।
আপনার এই সিরিজ দারুণ হচ্ছে ভাই। শ্রমসাধ্য লেখাটির জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানবে।
সময় নিয়ে পড়ার জন্য আর মন্তব্য করে উৎসাহ দেবার জন্য আয়নামতি, অশেষ কৃতজ্ঞতা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন