টুকটুকির বঙ্গবন্ধু

সোহেল ইমাম এর ছবি
লিখেছেন সোহেল ইমাম [অতিথি] (তারিখ: রবি, ১৬/০৮/২০২০ - ১:২০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


রাস্তায় রাস্তায় কালো পতাকা টাঙানো। টুকটুকি পতাকা জিনিসটা চেনে। সে প্রথমটা পতাকা পতাকা করে চেঁচায় তারপরই বলে তার ঐ কালো পাতাকা একটা চাই। তারপরই জিজ্ঞেস করে কালো পতাকা কেন? সে লালসবুজ পতাকাটা চেনে, ভালোই চেনে। জানে এই পতাকা উড়লে “আমার সোনার বাংলা” গাইতে হয়। তার কাছে এই লালসবুজ পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, দেশ নিয়ে গান সবই বাংলাদেশ। তিন বছর পুরো হয়নি এখনও তবু আমরা ওর সব প্রশ্নের জবাব দিতে চেষ্টা করি, বুঝুক না বুঝুক, হয়তো একদিন বুঝবে। তাই বলি ওই কালো পাতাকা নেওয়া যায়না। আজ বঙ্গবন্ধু মারা গিয়েছিলেন তাই আজ শোক দিবস। শোক দিবসে কালো পতাকা টাঙায়। এখন বঙ্গবন্ধু কে এটা টুকটুকিকে বলে দেবার দরকার নেই কেননা সে বঙ্গবন্ধুকে ভালোমত চেনে। সারাদিন দুরন্তটিভির সামনে কার্টুন দেখার জন্য বসে থাকতে থাকতে সে দেখেছে বঙ্গবন্ধুর ছবি,বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। মাঝে মাঝে টুকটুকি চেঁচিয়ে বলতে থাকে এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। শব্দগুলো ঠিকমত উচ্চারণ করতে পারেনা তবে বেশ বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধু মারা যাবার ব্যাপারটা এর আগে সে শোনেনি তাই অবাক চোখে আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে “আমার বঙ্গবন্ধু?” আমি বলি হ্যাঁ বাবা। আমার ঘাড়ে মুখ লুকায় সে বলে বাবা আমার মন খারাপ।
করোনাকাল শুরু হবার সময় থেকে টুকটুকিকে নিয়ে বাইরে বের হওয়া হয়না। বিকেলে ছাদে খোলা আকাশের নিচে কিছুক্ষণের খেলা বাদে টুকটুকির সময় কাটে ঘরেই। কিন্তু রাতের বেলা যখন গেটে তালা লাগাতে বের হই তখন টুকটুকি সঙ্গে সঙ্গে তার স্যাণ্ডেল পায়ে দিয়ে বাইরে যাবার জন্য তৈরী। তখন ওকে নিয়ে বাড়ির সামনের ফুটপাথে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি চলে আমাদের। হাঁটতে হাঁটতে দেয়ালের পোস্টারে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখলেই ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে চিৎকার করে উঠে সে। সে শেখ মুজিবুর রহমানকে চেনেনা। বলেছি কিন্তু নামটা ওর মনে থাকেনা। তাই শেখ মুজিবুর রহমান ওর কাছে শুধুই বঙ্গবন্ধু। আমাদের ছোটবেলাটা কেটেছে বিএনপি সরকারের আমলে। সে সময় টিভিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখা যেতোনা। আমরা অবশ্য জানতাম এই লোকটার নেতৃত্বেই সংগ্রাম করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি কিন্তু খুব বেশি কিছু জানার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। অনেকটা বড় হয়ে বই পড়ে তবে জানতে পেরেছি তার সম্বন্ধে। এখন ছোটবেলা থেকেই বাচ্চারা বঙ্গবন্ধুকে চিনে নিচ্ছে, তার জীবনের ঘটনাগুলো, সংগ্রামের কাহিনীগুলো জেনে যাচ্ছে দেখে ভালো লাগে। তো আমাদের টুকটুকির ধারণা হয়েছে আজই বঙ্গবন্ধু মারা গিয়েছেন। এতোদিন তিনি বেঁচেই ছিলেন আজই কোনভাবে তার মৃত্যু হয়েছে। তাই প্রশ্নও করে “কিভাবে মারা গেলো বঙ্গবন্ধু?” দুষ্টু লোকরা গুলি করেছিলো বাবা। আমি টুকটুকিকে অবশ্য বোঝাতে চেষ্টা করি আজ নয় অনেক আগে ঘটনাটা ঘটেছে। টুকটুকি অতীত-বর্তমান কালের ঘোর প্যাঁচ কতখানি আয়ত্ব করতে পেরেছে জানিনা। সে যে এই সময়ের তফাৎটা বোঝেনি এর প্রমাণ পাওয়া গেলো যখন দুপুর বেলা জোহরের নামাজের বিরতির পর আবার চারদিকে লাউডস্পিকারে ৭ই মার্চের ভাষণ শুরু হয়ে গেলো। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে লাফিয়ে ওঠে টুকটুকি “মা, বঙ্গবন্ধু ঠিক হয়ে গেছে।” ওর মা বুঝে উঠতে পারেনা। আমি বুঝি। টুকটুকিকে আনন্দে লাফাতে দেখে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয় আমার। বঙ্গবন্ধু জীবিত আছেন তাতে টুকটুকির কোন সন্দেহই আর নেই। মারা গেছে বা মারা যাওয়াটা তার কাছে যেন একটা সাময়িক অসুখের মত। এটা ঠিক হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু ঠিক হয়ে গেছেন। তাঁর ভাষণ আবার শোনা যাচ্ছে। রাতে টিভিতে ভাষণদানরত বঙ্গবন্ধুকে দেখে আমার মেয়েটা আবার বলে “বাবা বঙ্গবন্ধু ঠিক হয়ে গেছে”। হ্যাঁ বাবা, আমি বলি।


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

বাঃ! খুব ভালো লাগল। ৫ তারা।
এ গল্প একটা অন্য রকম চিন্তার খোরাক যোগাল। শিশুর চিন্তায় যেমন কালের বোধ সেভাবে দানা বাঁধে না, সেইভাবে কোন পরিণত মানুষের মানুষের চিন্তায় যদি এটা ঘটে, সে তাহলে জগতটাকে কি ভাবে দেখে। আরো এক ধাপ এগিয়ে, জাদুবাস্তবতার জগতে ঢুকে গেলে, কালের পরিচিত গমনটা যদি উল্টে পাল্টে যায়, তা হলে কি হতে পারে। এই সব ভাবনা ঘুরপাক খেয়ে গেলো।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সোহেল ইমাম এর ছবি

সময় নিয়ে পড়েছেন বলে অনেক ধন্যবাদ এক লহমা।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

যদি রাত পোহালে শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই! আশ্চর্য মিল!

সোহেল ইমাম এর ছবি

হ্যাঁ তাই। তিনবছরের শিশুর কাছে মনে হয়নি বঙ্গবন্ধু অনুপস্থিত, তার কাছে মনে হয়েছে বঙ্গবন্ধুতো বিপুল ভাবেই উপস্থিত তবে কেন বলা হচ্ছে তিনি মারা গেছেন।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে লাফিয়ে ওঠে টুকটুকি “মা, বঙ্গবন্ধু ঠিক হয়ে গেছে।”

আহা! কি সুন্দর অনুভূতি!

১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি আমাদের অনুভূতিও অনেকটা তেমনই ছিল বোধহয়!

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সোহেল ইমাম এর ছবি

সত্যিই এই অনুভূতিতেই আলোড়িত হয়ে ছিলাম সেই মুহূর্তে।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।