ম্লান মনোরম মনোটোনাস শহর

শুভাশীষ দাশ এর ছবি
লিখেছেন শুভাশীষ দাশ (তারিখ: শুক্র, ২০/১১/২০০৯ - ১১:২৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কেউ নেই বাসায় আজ। আব্বা আম্মা চট্টগ্রাম গেছে দাদার কবর জিয়ারত করতে। আনিকা আজ বান্ধবীর বাসায় থাকবে। আমার কাছে ছোটবোনকে রেখে যেতে আম্মা শান্তি পায় না। মাস তিনেক আগে কি যেন করতে গিয়ে আমার টেবিলের ড্রয়ার থেকে কিছু বাজে সিডি পেয়েছিল আম্মা। আমি শুয়ে মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’ পড়ছিলাম। হঠাৎ এসে সব সিডি আমার মুখে ছুঁড়ে মারলো। আম্মার মুখে বাজে এক দুটো গাল আগে শুনেছি। এতো গাল আম্মা জানে জানতাম না। এরপর অনেক দিন আমার সাথে কথা বলে নি। আমি কেমনে তাকে বুঝাই আসলে এগুলা কিছু না। এই বয়েসে সবাই এসব করে। আজ যাবার সময় বলে গেল- একা থাকবা যা ইচ্ছা কইরো। আব্বা অবাক হয়ে গেছিল এ কথা শুনে। কি বলো এসব- যা ইচ্ছা করো। ছেলের সাথে এভাবে কথা বলো কেন? আম্মা কথা না বাড়িয়ে লিফটে ঢুকে গেল।

আমাদের বাসা ইন্দিরা রোডের শেষ মাথায়। মানিক মিয়া এভিন্যুর উল্টোদিকে। ষোলতলা বিল্ডিং। আমরা থাকি পনের তলায়। উপর থেকে ঢাকা শহরকে দেখলে এত কদর্য লাগে না। আমি লিখি। মানে ব্লগার আর কি। বাসায় কেউ জানে না। ছদ্মনামে ব্লগ পোস্ট করি। উড়োখই নাম। নানান ভারসাম্যহীন ব্লগ পোস্ট করে দিই। এমন বিষয়ের উপর লিখি যার বিন্দুবিসর্গ জানি না। এদিক ওদিক ঘেঁটে মেটে লিখে ফেলি। জ্ঞানের কালোয়াতি চর্চার মজা ব্যাপক। উড়াধুড়া টপিকের অভাব নেই এই ব্লগজগতে। জাতির চেহারা বনাম জাতির স্বরূপ আকা জাতীয়তাবাদ-উহু-আহা। ইভটিজীং বনাম নারীর মনোজগৎ কি পুরুষের অপর। গণতন্ত্র অথবা গণস্বৈরতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্র । ছাগুভক্ষণজীবি বিপরীতে পাতাজীবি। কথার তোড়ে কথা চাপা পড়ে। মাঝে মাঝে ভাবি আমার কথা আমি নিজে কতটুকু বিশ্বাস করি! কাল এক ব্লগে একজনের কমেন্ট পড়ে বেদম হাসি পেয়েছিল। আম্মা লাফিয়ে রুমে ঢুকবে বলে গিলে গিলে হাসলাম। একজন লিখেছে- হাগার পরাণ আছে। হাগলে হাগা ব্যথা পায়।

আগে মডুবাবাদের দিকে পিত্যেশ করে থাকতাম। আমি আপ করে দিতাম। ওয়েট করতাম কখন উনারা আপ করেন। এখন নিজেই আপ করতে পারি ছাই পাশ সব।তবে ব্লগের টান কমে গেছে। দুই তিন দিনে একবার হয়তো ঢুঁ মারি। অন্যদের লেখা না পড়ে অনেকসময় কেবল মন্তব্য পড়ে লিখে দিই দু চার কথা। ভাল্লাইছে। চ্রম। হ। র। ক। ল। প্রথম প্রথম নিজের ছাপানো লেখায় রিফ্রেশ মেরে মেরে দেখতাম কি কমেন্ট আসছে।কমেন্টে কেউ ভাব নিলে আমি পাঠ নিতাম। এখন লেখা আপ করে দুইদিন পরে ঢুকি। এক দুইটায় কমেন্টের জবাব দেই। এই ভার্চুয়ালে আবার দু চারজনের মধ্যে বড় মানুষের ছায়াও দেখি।কারো কারো লেখায় রক্তবেগতরঙ্গিত হই।

নিজের একান্ত এই বিকেলসন্ধ্যায় বারান্দায় যাই। হাতছোঁয়া আকাশের আলো ফিকে হয়ে গেছে। বাড়ির মধ্যের আলো আলো খেলা বিবর্ণ ভোঁতা লাগে। গাছ। তার পাতা তার শরীরকে ধূসর বলে মনে হয়। হলদে হ্যালোজেনে নগরীর গাড়িগুলো সাঁতার কেটে বেড়ায়। পিঁপড়ে মানুষগুলা সারি বেধেঁ অনর্থক হেঁটে চলে । এক ফালি চাঁদ আলো দিতে না পেরে কুঁচকে এতটুকুন হয়ে আসে। বাতাস উবু হয়ে আমায় ছুঁতে গিয়ে ফসকে দূরে সরে যায়। হাতের সিগারেট একা একা জ্বলে ছাই ভস্ম হয়।

এই ম্লান মনোরম মনোটোনাস শহরে আমার কিছু করার নেই। আমার কথার বমি চুপে ব্লগে আপ করে শুয়ে পড়ি। বাতি নিভিয়ে।

ফিরেঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াছের অন্য ঘরে অন্য স্বর গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প নিরুদ্দেশ যাত্রা শুরু হয়েছিল এভাবে- এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো।


মন্তব্য

কনফুসিয়াস এর ছবি

মনোরম মনোটোনাসের সামনে একটা ম্লান বসিয়ে ইলিয়াসের সৃষ্ট সৌন্দর্যটা বেশ খানিকটা ম্লান করে দিয়েছেন আপনি।
ঐ দুটা শব্দকে, আমার কাছে মনে হয়, এই শহরটার ঘাড়ে চাপিয়ে তাদের মত করেই থাকতে দেয়া ভালো।

-----------------------------------
আমার জানলা দিয়ে একটু খানি আকাশ দেখা যায়-

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

সবজান্তা এর ছবি

কী আশ্চর্য ! মনোরম মনোটোনাস শব্দটা শুনলে যেমন ইলিয়াসের কথা মনে পড়ে, তেমনি মনে পড়লো জুবায়ের ভাইয়ের কথা।

জুবায়ের ভাইও এমন একটা ব্লগ লিখেছিলেন, ইলিয়াসকে নিয়ে, প্রায় একই শিরোনামে ( ম্লানটুকু ছাড়া)।

হায় সময় !


অলমিতি বিস্তারেণ

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ধন্যবাদ সবজান্তা। জুবায়ের ভাইয়ের ‘এই মনোরম মনোটোনাস শহরে…’ আর কনফুসিয়াসের লাট্টু - ২ পড়লাম। দুটো লেখাই অসাধারণ।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ভালো কথা। আচ্ছা, হায় সময় ! ক্যান চিন্তিত

সংসপ্তক এর ছবি

শুভাশীষ দাশ লিখেছেন:

নিজের একান্ত এই বিকেলসন্ধ্যায় বারান্দায় যাই। হাতছোঁয়া আকাশের আলো ফিকে হয়ে গেছে। বাড়ির মধ্যের আলো আলো খেলা বিবর্ণ ভোঁতা লাগে। গাছ। তার পাতা তার শরীরকে ধূসর বলে মনে হয়। হলদে হ্যালোজেনে নগরীর গাড়িগুলো সাঁতার কেটে বেড়ায়। পিঁপড়ে মানুষগুলা সারি বেধেঁ অনর্থক হেঁটে চলে । এক ফালি চাঁদ আলো দিতে না পেরে কুঁচকে এতটুকুন হয়ে আসে। বাতাস উবু হয়ে আমায় ছুঁতে গিয়ে ফসকে দূরে সরে যায়। হাতের সিগারেট একা একা জ্বলে ছাই ভস্ম হয়।

এই ম্লান মনোরম মনোটোনাস শহরে আমার কিছু করার নেই। আমার কথার বমি চুপে ব্লগে আপ করে শুয়ে পড়ি। বাতি নিভিয়ে।

এইটুকু অসাধারণ লেগেছে। চলুক
.........
আমাদের দূর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা

.........
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

হাসি

ঐশী এর ছবি

গুরু গুরু

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

কি করলাম !!!!

রনি  [অতিথি] এর ছবি

আপনার লেখায় অন্যরকম একটা ভাব আছে। কারো প্রভাবমুক্ত হয়ে লেখা কিন্তু কঠিন ব্যাপার। আপনার প্রতিটা গল্পের মনোযোগী পাঠক হিসেবে আপনার কাছ থেকে আরো আরো গল্পের প্রত্যাশায় .............চলুক

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

"নিজের একান্ত এই বিকেলসন্ধ্যায় বারান্দায় যাই। হাতছোঁয়া আকাশের আলো ফিকে হয়ে গেছে। বাড়ির মধ্যের আলো আলো খেলা বিবর্ণ ভোঁতা লাগে। গাছ। তার পাতা তার শরীরকে ধূসর বলে মনে হয়। হলদে হ্যালোজেনে নগরীর গাড়িগুলো সাঁতার কেটে বেড়ায়। পিঁপড়ে মানুষগুলা সারি বেধেঁ অনর্থক হেঁটে চলে ।"
অসাধারণ।
.........*তিথীডোর

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

হাসি

জুয়েইরিযাহ মউ এর ছবি

ভালো লাগলো লেখাটি।

--------------------------------------------------------
জানতে হলে পথেই এসো, গৃহী হয়ে কে কবে কি পেয়েছে বলো....


-----------------------------------------------------------------------------------------------------

" ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজেকে শুধু নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি, উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা, এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

থ্যাংকু

বইখাতা এর ছবি

এইবার পাঠক হিসাবে একটা চাহিদার কথা জানাই | আপনার পরপর চারটি গল্প পড়লাম উত্তমপুরুষে। এবার একটু অন্যভাবে লিখবেন কি ? অবশ্য কীভাবে লিখবেন সেটা সম্পূর্ণই আপনার ব্যাপার। তারপরও আপনার লেখা বেশ ভালো লাগে তাই কী পেলে আরো ভালো লাগবে, সেটাও জানিয়ে গেলাম।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

দেখি।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

"এমন বিষয়ের উপর লিখি যার বিন্দুবিসর্গ জানি না। এদিক ওদিক ঘেঁটে মেটে লিখে ফেলি। জ্ঞানের কালোয়াতি চর্চার মজা ব্যাপক। উড়াধুড়া টপিকের অভাব নেই এই ব্লগজগতে। জাতির চেহারা বনাম জাতির স্বরূপ আকা জাতীয়তাবাদ-উহু-আহা। ইভটিজীং বনাম নারীর মনোজগৎ কি পুরুষের অপর। গণতন্ত্র অথবা গণস্বৈরতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্র । ছাগুভক্ষণজীবি বিপরীতে পাতাজীবি। কথার তোড়ে কথা চাপা পড়ে।"

- ব্লগিং, বিশেষতঃ বাংলা ব্লগিং, এখনো শৈশব পর্যায়ে আছে। এই পর্যায়ে এমনটা চলবে। প্রফেশনাল ব্লগিং করার সুযোগ তৈরি হলে এইসব চাপা পড়ে যাবে। অবশ্য প্রফেশনাল ব্লগিং-এর চাহিদাও এখান থেকেই তৈরি হবে। তবু "এদিক ওদিক ঘেঁটে মেটে" লেখার প্রচেষ্টাটাই শুভ। আর কিছু না হোক নতুন কিছু বিষয়তো পড়া হয়, নতুন কিছু জানা তো হয়। কে জানে এখান থেকেই হয়তো কারো কারো জ্ঞানচর্চার স্পৃহা বা সিরিয়াসলি লেখার স্পৃহা তৈরি হয়ে যেতে পারে।

"মাঝে মাঝে ভাবি আমার কথা আমি নিজে কতটুকু বিশ্বাস করি!"

-প্রশ্নটা ব্যক্তিগত সততার। এখানে ব্লগিং-এর কিছু করার নেই। এখানে প্রত্যেকের ব্যাকগ্রাউন্ড আর সার্বিক শিক্ষার ভূমিকা ব্যাপক। তবু একটু ক্ষীণ, দুর্বল আশা করি এই যে, অন্যের সততার চর্চা দেখে লজ্জায় পড়েও আমি না হয় একটু সৎ হই। সঙ্ঘবদ্ধতার অনেকগুলো উপকারিতার এটাও একটা।

পুনশ্চঃ লেখাটার কোন ট্যাগ দেখতে পাচ্ছিনা। এটাকে কোন ক্যাটেগরীতে ফেলা হবে?



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

পাণ্ডবদা,

এটা অণুগল্প।আর স্যাটায়ার মিশেছে সাথে। সরি, ট্যাগ লাগাতে ভুলে গেছি।

বাংলা ব্লগে আমার যাতায়াত দীর্ঘদিনের না। এর মধ্যেই যোগাযোগের এই ক্ষেত্রটা ভালোবেসে ফেলেছি। বাংলাব্লগ পরিণত মানসিকতার দিকে এগোচ্ছে বলে আমিও মনে করি। আমাদের আরো সহনশীল হতে হবে, ভুল করলে সেটাকে মেনে নেয়া শিখতে হবে। আমাদের খাঁটি হতে হবে। আর সাথে সাথে হতে হবে অবশ্যই সৎ।

বাংলা ব্লগে সুস্থতার জয় হোক। সত্যের জয় হোক।

অতিথি লেখক এর ছবি

কেমন জানি লাগলো... ভালো, কিন্তু ভালো অনুভুতিটার সাথে একটু যেনো মন খারাপ করা।। কেমনই জেনো বলে বোঝাতে পারবো না।

নীল ভুত।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

চিন্তিত

অতিথি লেখক এর ছবি

অদ্ভুত তো এই ম্লান মনোটোনাস শহরটায় ফিরতে আমার তবুও এত ইচ্ছে করে!!

ত্রেয়া।।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

আপনি কি ইনি?

অতিথি লেখক এর ছবি

জ্বি আমিই ত্রেয়া।।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

আপনার নামের মানে কী জানতে গুগলে সার্চ দিয়ে ব্লগটা পেলাম। সচলে লিখুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার নামের অর্থটা বোধহয় তৃতীয়।যতদূর জানি শব্দটি দিয়ে শক্তিও বোঝানো হয়।
সচলের নিয়মকানুন এখনো ঠিক বুঝে উঠিনি আসলে।কিন্তু লেখাগুলো পড়তে খুব ভালো লাগছে সত্যি।
আপনি দাওয়াত দেয়ায় ভালো লাগল।
ধন্যবাদ।।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

আসলে দাওয়াত দেয়ার কিছু নাই। অতিথি লেখক হিসেবে যে কেউ ব্লগ লিখে পোস্টাতে পারে। প্রকাশযোগ্য হলে মডারেশন পার হয়ে সেটা ছাপানো হবে। নিয়মকানুন আর কিভাবে পোস্টাবেন তা বোঝার জন্য হিমুর লিংক দুটো পড়ে দেখেন।

হিমু এর ছবি

নিচের লিঙ্ক দু'টিতে গিয়ে মনোযোগ দিয়ে একবার পড়ে দেখতে পারেন।

http://www.sachalayatan.com/sachalayatan/17756
http://www.sachalayatan.com/sachalayatan/16572



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়লাম।ধন্যবাদ হিমু আপনাকে।
আপনাদের দুজনের জন্যেই ঈদের শভেচ্ছা রইলো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।