অনুবাদ কারখানা ||| ৪ |||

শুভাশীষ দাশ এর ছবি
লিখেছেন শুভাশীষ দাশ (তারিখ: সোম, ১৯/০৭/২০১০ - ১০:১৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হোয়াট ইজ আ নভেলিস্ট?
মিলান কুন্ডেরা


বুঝতে পারা মানেই তুলনা

হারম্যান ব্রচ কোনো চরিত্র নির্মাণ করতে গেলে প্রথমে সেই চরিত্রের আবশ্যিক দিকগুলো কল্পনা করে নিতেন, পরে আস্তে আস্তে সেখানে ব্যক্তিত্ব জুড়ে যেত। যেন বিমূর্ত থেকে মূর্তিমানের দিকে আগানো। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দা স্লিপ ওয়াকার্স’-এর প্রোটাগনিস্ট ইশ্চ্। নির্যাসে ব্রচ বলতে চেয়েছেন সে একজন বিপ্লবী। বিপ্লবী মানে কী? এই জিনিস বোঝাতে গিয়ে ব্রচ তুলনার আশ্রয় নিয়েছেন। ব্রচ বিপ্লবীর সাথে তুলনা করেছেন অপরাধীর। এখন অপরাধী বলতে আমাদের ধারণা কী? একজন রক্ষণশীল ব্যক্তি যে বর্তমান ধারার বিরুদ্ধে না বরং সেখানে খাপ খাইয়ে নিতে চায় সাথে নিজের চুরি জোচ্চুরিকে পেশাগতভাবে স্বাভাবিক মনে করে একজন নাগরিক হওয়ার খায়েশ জারি রাখে। অন্যদিকে বিপ্লবী চায় প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে জেহাদে নেমে সেগুলোকে নিজের পথে নিয়ে আসতে। ইশ্চ্ তাই অপরাধী নয় বরং বিপ্লবী, অনেকটা মার্টিন লুথারের মতো। ব্রচের কথাকে এমনকি ইশ্চ্‌কে নিয়ে আমি এতো কথা বলছি কারণ ব্রচ ঔপন্যাসিক হিসেবে আমাকে আকৃষ্ট করেন। তাঁর সাথে ঔপন্যাসিকের তুলনা করা চলে।

কবি ও ঔপন্যাসিক

ঔপন্যাসিকের সাথে কাকে তুলনা করা যায়? একজন কবিকে। একটা পদ্যের উপাত্ত, হেগেলের মতে, কবি নিজে। তাঁর ভেতরের জগতকে তিনি শব্দ দিয়ে স্থাপন করেন, পাঠক সেই জগতের সন্ধান পায়, তাঁর অভিজ্ঞতার সাথে পরিচিত হয়। এমনকি কবি যদি তাঁর জীবনের বাইরের কোনো কিছু নিয়ে পদ্য লেখেন, প্রকৃত কবি সেসব থেকে সরে এসে ঢুকে পড়বেন তাঁর নিজের জগতে আর সেখানে আত্মপ্রতিকৃতি ফোটাবেন।

সংগীত আর কবিতা, হেগেলের মতে, চিত্রকলা থেকে এক জায়গায় এগিয়ে আছে: তার ছন্দে। হেগেল আরো খোলাসা করেছেন, ছন্দ নিয়ে ভাবতে গেলে কবিতার চেয়ে সংগীত এগিয়ে আছে- ভেতরের জগতের কিছু গভীরতর নাড়াচাড়া শব্দে ধারণ অসম্ভব; ছন্দ বা তান সেটা নিজে করে নেয়। ফলে সংগীত কবিতার ছন্দ থেকে স্বাচ্ছন্দ্য। যুক্তি দিয়ে তাই বলা যায়- ছন্দ কেবল সাহিত্যের একটা শাখায় মানে কবিতায় সীমাবদ্ধ থাকছে তা নয়, তার অন্য জায়গায় ও অবস্থান আছে; কবিকে আমরা ধরে নেই একজন মানুষ যে নিজের আত্মগত রূপ বাইরে শব্দে আর ছন্দে পরিষ্কার করেন।

ছন্দের জগতে যৌবনকে আমি প্রকৃত সময় বলে মনে করি। সেই সময়ে ব্যক্তিমানুষ নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে, আশপাশের সাথে জড়ানো ঠিকঠাক হয়ে ওঠে না। এই স্বতসিদ্ধকে মানলে (আমি অবশ্য একে সূত্র বলে মানি) বোঝা যাবে অপরিপক্বতা কমে আসলে ছন্দ আর কাব্য আস্তে আস্তে দূরে সরে পড়ে।

ঔপন্যাসিকের সূচনা হয় একটা মিথ থেকে, একটা পরিবর্তনকামী গল্প থেকে। ছন্দের জগতের ক্ষয় থেকে জন্ম নেয় একজন ঔপন্যাসিক।

পরিবর্তনের গল্প

আমার বইয়ের সেলফ থেকে ‘মাদাম বোভারি’র একটা কপি হাতে নেই। ১৯৭২ সালের পকেট এডিশন। সেখানে প্রাককথন দুজনের; একটি লেখক হেনরি মন্থারলেন্টের; অন্যটি সাহিত্য সমালোচক মরিস বারদেসের। মজার ব্যাপার দুইজনেই এই বইটির কাছ থেকে নিরাপদ দূরে বসে থাকাকে সমস্যা বলে মনে করেননি; মন্থারলেন্টের মতে- রসবোধ, চিন্তার নতুনত্ব, লেখনীর ক্ষিপ্রতা, মানুষের হৃদয়মথিত অব্যক্ত কথামালা, কিছু আবিষ্কার, মহানুভবতা; লেখক ফ্লবেয়ারের মধ্যে এর কোনোটির দেখা মিলে না। অবশ্য এটা না বলে থাকেননি- ফ্লবেয়ারের কাছ থেকে কিছু শেখা যাবে না তা ঠিক নয়। কিন্তু এটা মেনে নিতে হবে ফ্লবেয়ারের মধ্যে একজন র‌্যাচিন, একজন সেইন্ট সিমন, একজন শ্যাটুব্রিয়োন, একজন মিসেলেটের মতো জিনিস পাওয়া যাবে না।

বারদেসে ও রায় দিয়েছেন; ফ্লবেয়ারের ঔপন্যাসিক হবার জেনেসিস কি সূচনালগ্নের কথা টেনেছেন: ১৮৪৮ সালে সাতাশ বছর বয়েসে তিনি তাঁর কয়েক বন্ধুকে ‘দা টেম্পটেশান অফ সেইন্ট অন্থোনি’ পড়ে শোনান। এটা একটা অসামান্য গদ্য(আমি বারদেসে’র কথা কোট করছি খেয়াল করবেন)। এই লেখার মধ্যে তিনি তার সমস্ত সত্তা, আশা, হৃদয় সমর্পণ করেছিলেন। ফ্লবেয়ারের বন্ধুরা তাঁকে এসব রোমান্টিক ভাবধারা ত্যাগের পরামর্শ দেয়। তিনি সেটা মেনে বছর তিনেক পরে ১৯৫১ সালের সেপ্টেম্বরে ‘মাদাম বোভারি’ লেখা আরম্ভ করেন। বারদেসের মতে- এই কাজটা করতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন না। ক্রমাগত অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। চিঠিপত্রে জানিয়েছেন- বোভারি আমাকে ক্লান্ত করছে। বিষয়টার ইতর উপস্থাপন তীব্র বিবমিষা দিচ্ছে।

আমার মনে হয় না ফ্লবেয়ার তার সকল ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কেবল বন্ধুদের অনুরোধ রাখতে গেছেন। বারদেসের ব্যাখ্যা ফ্লবেয়ার যা করেছেন তা নিজেকে ধ্বংস করার জন্য। আসলে ঘটনা ছিল আমূল পরিবর্তনের। ফ্লবেয়ার বয়স তখন ছিল তিরিশের কোঠায়- কাব্যলক্ষ্ণীকে পায়ে ঠেলার সময়। পরে অভিযোগ এসেছিল ফ্লবেয়ারের চরিত্রগুলো মিডিওকার- কিন্তু তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করার এর চেয়ে ভাল উপায় ছিল না। উপন্যাসের প্রকৃতিই এইরকম-এর শরীরে জীবনের গদ্য।

কৌতুকের মৃদু আলোক

ফ্লবেয়ারের ‘সেন্টিমেন্টাল এডুকেশান’ উপন্যাস। প্রিয়তমা মাদাম আরনক্সের সান্নিধ্যে একটা উষ্ণ সন্ধ্যা কাটানোর পর নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা মদোম্মত্ত ছিলেন ফ্রেডেরিক। বাসায় ফিরে আয়নার দিকে তাকানো। নিজেকে সুপুরুষ মনে হওয়া। নিজের রূপে কিছুক্ষণ সম্মোহিত হয়ে থাকা।

একটা পুরো মিনিট। এই ক্ষুদ্র মুহূর্তের মধ্যে একটা বিশালতা আটকে পড়ে আছে। সে ধীর থাকে, একদম স্থিরদৃষ্টিতে নিজেকে সুপুরুষ ভাবা শুরু করে। পুরো একটা মিনিট। কোনো ছন্দপতন ছাড়া। সে এক মেয়েকে ভালোবাসে, কিন্তু তখন সেই মেয়ের কথা মাথায় আসে না, বরং নিজের প্রতি সম্মোহনে ছেদ পড়ে না। কিন্তু আয়নার দিকে তাকিয়ে সে নিজের প্রকৃত চেহারা দেখতে পায় না( যেটা স্পষ্ট দেখতে পান লেখক ফ্লবেয়ার)। নিজের লিরিক সত্তার কাছাকাছি চলে যেতে হয় তাকে, এটা ও খেয়াল করার সময় থাকে তার ও তার ভালোবাসার ওপর একটা কৌতুকের আছর পড়েছে।

ছন্দের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকার পরিবর্তন অর্জন করা একজন ঔপন্যাসিকের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। নিজেকে নিজের কাছ থেকে পৃথক রেখে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ করে নিজেকে দেখলে পুরো অপরিচিত মনে হয়। এই অভিজ্ঞতার পরে সে বুঝতে পারে পৃথিবীতে কেউই নিজের ধারণামতো ব্যক্তি নন, আর এই কথা একদমই ধ্রুব আর প্রাথমিক একটা ব্যাপার। ফ্রেডেরিক যেমন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এটা নিয়ে ভাবে তেমনি অন্যদের বেলায় ও এই ঠাহর করা একটা কৌতুকের মৃদু আছর দেয়।( এই আবিষ্কার হঠাৎ করে করলে নীরবে সেটা ঘটে, আর লেখকের জন্য হয়ে পড়ে বেশ মূল্যবান)।

গল্পের শেষে এমা বোভারি (ব্যাংকারদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য না পেয়ে আর লিয়নের কাছে পরিত্যক্ত হয়ে) একটা কোচে চেপে বসে। সেই সময় একটা ভিক্ষুক শোর করে ভেতরে ঢোকে। সাথে সাথে এমা একটা পাঁচ ফ্রা-র কয়েন ঘাড়ের ওপর দিয়ে ভিক্ষুককে দিয়ে দেয়। এটা ছিল তার শেষ সম্বল। কিন্তু সে ভাবে-ঠিকাছে; এটা এক ধরণের টস।

সত্যিই এটা ছিল তার শেষ সম্বল। একেবারে শেষ পর্যায়ে তার চলে আসা। শেষ বাক্য (ইটালিকসে) ফ্লবেয়ার এমাকে ঠিকমতো দেখতে পান, কিন্তু সে নিজেকে দেখে এক অদ্ভুত ইশারায়- কয়েনটা দিয়ে সে সুখ পায়। চরম হতাশাজনক সেই সময়ে ও ইঙ্গিতটা ধরা যায়। এই বক্রাঘাত তাকে শেষ পর্যন্ত এমনকি তার মৃত্যু (যেটা খুব সন্নিকট) পর্যন্ত তাকে ছাড়ে না।

ছেঁড়া পর্দা

লৌকিক উপাখ্যানে বোনা একটা জাদু পর্দা পৃথিবীর সামনে ঝুলে আছে। সারভেন্তেস ডন কিহাতোকে ভ্রমণে বের করান আর সেই পর্দা দিয়ে তাকে দেখান। নাইটের কাছে পৃথিবীর ভ্রান্ত রূপ খুলে যাওয়া একটা রসঘন উম্মুক্ত গদ্যে প্রকাশ পেয়েছে।

মেয়েরা তার মেকাপ দেয়ার আগে প্রথম লেয়ার দেয়ার সময় যেই তাড়া করে ঠিক তেমনি জন্মের সময়ে হুড়াহুড়ি করে পৃথিবীতে এসে দেখি এখানে সবকিছুই তৈরি করা, মুখোশে ঢাকা আর আগে থেকেই অনেক কিছুর ব্যাখ্যা সারা হয়ে গেছে। গতানুগতিক সবাই একাকী বোকা বনে তা কিন্তু নয়- কিছু বিপ্লবী এইসব প্রথাগত সবকিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়ায় অথচ তারা এটা মাথায় রাখে না তারা স্বাভাবিকভাবে খুব অনুগত- কেবল বিপ্লবের কিছু জিনিস তৈরি করে তারা বিদ্রোহ উৎপাদন করে।

দেলাক্রোয়ার তাঁর বিখ্যাত ‘লিবার্টি লিডিং দা পিউপল’ পেইন্টিং-এ পর্দার প্রি-ইন্টারপ্রিটেশান দেখান: বেরিক্যাডের ওপর একজন যুবতি, তার কঠোর মুখ, খোলা বুকে ভয়ের চিহ্ন, তার পাশে আছে পিস্তল হাতে এক পেটমোটা লোক। বিখ্যাত পেইন্টিং হবার জন্য কোনো এবসার্ড কিছু এখান থেকে সরালে ঠিক হতো না বলে আমি মনে করি।

উপন্যাস এর চিত্রায়ণ কিভাবে সম্ভব? এই ধরণের সিম্বোলিজম উপন্যাসের ইতিহাসে ঠিকমতো ফোটেনি। প্রি-ইন্টারপ্রিটেইশানের পর্দা ছিঁড়ে সারভেন্তেস নতুন ঘরানা সৃষ্টি করেন- তাঁর ধ্বংসাত্মক শিল্পে প্রতিটা উপন্যাস নিজেকে চেনায়: উপন্যাসের প্রকৃতি সনাক্তকরণের কাজ সারে।

খ্যাতি

১৯৩৫ সালের ভিক্টর হুগোর বিপক্ষে একটা পুস্তিকা ‘দা হুগোলেইড’ এ নাট্যকার ইউজিন ইউনেস্কো (তখন তাঁর বয়স ছিল ২৬, রুমানিয়ায় থাকতেন) লিখেছেন- বিখ্যাত লোকদের জীবনী পড়লে বোঝা যায় তাঁরা বিখ্যাত হবার জন্য বেড়ে উঠেছেন। সাধারণ মানুষের জীবনী দেখলে উপলব্দি করা যায় তারা বিখ্যাত হবার চিন্তা মাথায় কখনো আনে নি। … এক কথায় বিখ্যাত মানুষ মাত্রেই বিরক্তিকর।

বিখ্যাত কথাটাকে আরো বিস্তার করি- একজন লোক বিখ্যাত তখনই বলা যায় যখন তিনি যতজনকে চেনেন তার চেয়ে অনেক বেশি লোক যখন তাঁকে চেনে। একজন চিকিৎসক তাঁর খ্যাতি ঠিক করে উপভোগ করেন না, বরং চান কাজের স্বীকৃতি-রোগী কিংবা সহকর্মীদের কাছ থেকে। অন্যদিকে কিছু পেশার লোক মাত্রা ছাড়া খ্যাতি পেয়ে যান- রাজনীতিক, সুপারমডেল, ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, শিল্পী।

শিল্পীর খ্যাতি সবচেয়ে ভয়ানক- সেখানে অমরত্বের খোয়াব ও আছে। এই অদ্ভুত তরিকার মধ্যে অনেক কিছু জড়িত- শিল্পীর সততা সাথে মৃত্যুর পরে জিইয়ে থাকার উচ্চাসা। প্রতিটা উপন্যাস গড়ে ওঠে যেন সেটার একটা সর্বকালীন নির্যাস থাকে- লেখককে সেই উপন্যাস টিকিয়ে রাখে। তাই উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছাড়া লেখালেখিতে আসা হতাশার- একজন মধ্যম সারির মিস্ত্রি লোকের কাজে আসবে কিন্তু একজন মধ্যম মানের ঔপন্যাসিক যিনি ক্রমাগত বই উৎপাদন করছেন (সাধারণ মানের, চটুল সব বই) তিনি কাজের কাজ কিছু করছেন না, বরং তাঁর সব কাজ এক ধরণের বোঝা, বিরক্তিকর। ঔপন্যাসিকের জন্য এটা একটা অভিশাপ- আত্মকেন্দ্রিকতার নির্লজ্জ প্রদর্শনীতে সততা আটকা পড়ে যাওয়া।

সূত্র
What is a Novelist?
The Curtain: An Essay in Seven Parts
Milan Kundera
Translated from the French by Linda Asher
Harper Collins Publishers
New York
2005

(পরের কিস্তিতে শেষ হবে)

অনুবাদ কারখানা ||| ৩ |||


মন্তব্য

মাসকাওয়াথ আহসান এর ছবি

এখনকার সাহিত্যের ছেলেদের আর সাহিত্যের ক্লাসে না গিয়ে ব্লগএ আসাই যথেষ্ট, খুব ভালো ক্লাস লেকচার, দারুণ।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখনি,নইলে কোন দিন নয়।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ, বস্‌।

-------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

সিরাত এর ছবি

ক্লাস। লেখার 'আমেজ'-টা, বা ফিলিংটা, জোস।

তবে আপনি কমার ব্যবহার কম করেন মনে হয়। আর আপনার প্যারাগুলোতে কেমন ছাড়া ছাড়া বাক্য থাকে। যাহোক এটা আপনার স্টাইলই। হাসি

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

হ। ঠিকই ধরছেন। কমা একটু কমই দেই। চোখ টিপি

--------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কুন্ডেরার লেখা মূল ভাষায় (চেক ও ফরাসী) পড়া হবেনা কোনদিন। তাই কুন্ডেরার আসল ভাষা জানা হবেনা। তবে ইংরেজীতে (এক বা দুই হাত ফেরতা) কুন্ডেরা পড়ে বুঝেছি এর বাংলা করা (দুই বা তিন হাত ফেরতা) অসম্ভবের কাছাকাছি একটা কিছু। কুন্ডেরার বাংলা অনুবাদ তাই একটু ছাড়া ছাড়া লাগতে পারে।

এই লেখাটা এমন যেখানে পড়তে গেলে পাঠকের পূর্ব প্রস্তুতি থাকতে হবে। নতুবা কুন্ডেরা কী বোঝাতে চাইলেন তার অনেকটাই অস্পষ্ট থেকে যাবে। নিঃসন্দেহে এটা আম-জনতার জন্য কোন made-easy নয়।

আমার নিজস্ব মতামতঃ

০১. ব্রচের প্রকল্পটি আমার কাছে যান্ত্রিক সরলীকরণের মত লাগে। কিছুটা ভ্রান্ত অনুপপত্তির মত। এভাবে ঔপনাসিক নিজের চরিত্রের প্রতি পাঠকের এক ধরণের সমবেদনা টানতে পারেন হয়তো তবে তাতে সত্য চাপা পড়তে পারে।

০২. হেগেল যাই বলুন না কেন কাব্য ও সঙ্গীতের একটা ব্যাপন ক্ষমতা আছে যা ঔপন্যাসিককে আক্রান্ত করে। এই আক্রমণ ক্ষয়জাত নয়। উপন্যাসের শুরুতে তার একটা ভূমিকা, বা উপন্যাসের অগ্রগতিতে তার একটা বৃদ্ধি থাকতে পারে। ঔপন্যাসিকের শুরুটা তাই সর্বাংশে মিথ বা পরিবর্তনকামী গল্প থেকে নাও হতে পারে।

০৩. উপন্যাসের কাহিনী বা চরিত্রের বিকাশ কি সর্বাংশে ঔপন্যাসিকের হাতে থাকে? সম্ভবতঃ না। অন্ততঃ একজন সৎ লেখকের কাছেতো নয়ই। ঔপন্যাসিকের ব্যক্তি চরিত্র, ভালো লাগা-মন্দ লাগা এখানে বেশ কিছু জায়গায় কোন প্রভাব ফেলতে পারেনা। এটা অনেকটা সৃষ্টি কর্তৃক স্রষ্টাকে চ্যালেঞ্জ করার মত। মাদাম বোভারি তাই ব্যক্তি ফ্লবেয়ারকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে।

০৪. ‘সেন্টিমেন্টাল এডুকেশান’ থেকে উপলদ্ধিটাকে কী বলতে পারি? একই সাথে "Doppelgänger Effect" আর "Clairvoyance"? আমি নিশ্চিত না। নিজেকে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেয়ে নিজের পাশে দাঁড়িয়ে তৃতীয় কোন জন হয়ে উপলদ্ধিটা আবিষ্কার অভিনব নয়, কঠিন। ঔপন্যাসিক যখন স্রষ্টার ভূমিকায় তখন ভবিষ্যতের পরিণতিকে জাস্টিফাই করার জন্য বর্তমানের রূপরেখা নির্মাণ করবেন সেটাও স্বাভাবিক।

০৫. ইউজিন দেলাক্রোয়ার ছবিটি আমার কাছে আরোপিত মনে হয়। সিম্বোলিক মনে হয়। রোমান্টিক ঘরাণার দেলাক্রোয়ার কাজে সেটা স্বাভাবিক। সারভেন্তেসের 'দন কিহোতে' অমন রোমান্টিক কোন কাজ নয়। প্রথা ভাঙার আর ইল্যুশনের এক জগত থেকে উপন্যাসকে বের করে আনার এক তীব্র প্রয়াস সেটা। উপন্যাসকে এমনই আরেক ধাপ আগাতে দেখতে পাই হেমিংওয়ের 'ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী'তে। যেখানে ইচ্ছাশক্তিতে বলীয়ান মানুষ ঈশ্বরের রাজ্যকে চ্যালেঞ্জ করে। ইতিহাসে ধ্বংসের পাশাপাশি নির্মাণের চেষ্টা, বিপ্লবীর প্রথা বিরুদ্ধতার পাশাপাশি নেতা-নেতৃত্ব-আদর্শের প্রতি এক ধরণের আনুগত্য এগুলো আমরা দেখতে পাই আরো পরে। দুই ধাপের মধ্যবর্তী অংশে নতুন যুগের সৃষ্টি যন্ত্রণাকে দেখতে পাই তুর্গনেভের উপন্যাসে।

০৬. অমরত্বের পেয়ালা কেবল ঔপন্যাসিকই ঠোঁটে ছোঁয়াতে চান তা নয়। সে আকাঙ্খা সাহিত্যের অন্য ধারাতেও আছে। উপন্যাসের কাহিনী বা চরিত্র ইউনিক হলেই অমরত্ব পাবে তা নয়। যে পটুয়া শিব গড়েছেন তার দেখা দেখি বাকিরা বাঁদর গড়লে তার শিব বাঁদরের পর্যায়ে নামেনা। শিবের শিবত্ব বহু ব্যবহারে ইউনিকনেস হারায়, কিন্তু অমরত্ব তারও নির্বন্ধ। ঔপন্যাসিকের লক্ষ্য যদি এই থাকে যে তিনি কেবল শিবই গড়বেন তাহলে নিজের বিকাশের পথটা রুদ্ধ হয়ে যায়। ক্রমাগত হোমওয়ার্কের মাধ্যমে যে নতুন নতুন শিব গড়ে উঠবে তার মাঝখানে মাঝখানে কিছু বাঁদরও গড়ে উঠেবেনা একথা বলা যায়না। সেই বাঁদরগুলো আসলেই বাঁদর হলেও তারাই জম্বুদ্বীপ আর সুবর্ণপুরীর মাঝখানের সেতুবন্ধটা বাঁধে।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

০১. হারম্যান ব্রচের ‘দা স্লিপওয়াকার্স’ কুন্ডেরার বেশ প্রিয় উপন্যাস। তাঁর ‘দা আর্ট অফ দা নভেল’ প্রবন্ধগ্রন্থে Not inspired by “The Sleepwakers” নামে একটা অধ্যায় আছে। ব্রচের থিয়োরি কিছু ব্যাখ্যা সেখানে আছে। আরো ডিটেইলে।

০২. কুন্ডেরার ব্যাখ্যা অনুসারে কাব্যদেবী তাঁর ভাঁড়ার শূন্য করলে সেখানে ঔপন্যাসিকের যাত্রা শুরু হয়। ব্যাখ্যাটা অভিনব। লিটারেরি থিয়োরির সাথে পরিচিতি থাকলে কথাটা বেশি নতুন মনে হয় না। তবে পাঠকের অভিজ্ঞতা কী বলে? সেই অনুসারে কুন্ডেরার কথা পুরো মানা যায় না।

০৩. আর এই বিপর্য অবস্থা সাহিত্য সমালোচক অন্য মানে করে বসে আছেন।

০৪. কুন্ডেরার এই ব্যাখ্যাগুলো ঠিক লিটারেরি ক্রিটিকদের মতো না এই জায়গাতেই। ‘সেন্টিমেন্টাল এডুকেশান’ এর জায়গাটা ক্রিটিকরা ঠিক ঠাহর করতে পারেন না। ঔপন্যাসিক বলে কুন্ডেরার অভিজ্ঞতা এখানে পাঠককে ভাবায়। আয়নায় ভালো করে তাকালে আমরা নিজেদের প্রায়শ চিনে নিতে পারি না।

০৫. ইউজিন দেলাক্রোয়ার ছবিটা আসলেই সিম্বোলিক।

eugene-delacroix-liberty-leading-the-people-t15553

সারভেন্তেসের ‘ডন কিহাতো’ উপন্যাস সাহিত্যের একটা প্রধান সংযোজন। কুন্ডেরা নানান সাক্ষাৎকারে প্রুস্ত আর সারভেন্তেসের নাম নিয়েছেন। তাঁদের ফর্মের ব্যাখ্যা করেছেন। তুর্গেনেভ কেবল একটা উপন্যাসের জন্য দীর্ঘকাল টিকে থাকবেন। ‘ফাদারস এন্ড সনস্’, বাজারভ, নায়িলিজম। এর প্যারালেলে আছেন কেবল আরেকজন রাশিয়ান। মিখাইল লেরমেন্তভ। আ হিরো অফ আওয়ার টাইম, পেচোরিন, নায়িলিজম।

০৬. এত বই এত বাঁদর ঠেলে ঠিক লোকের কাছে পৌঁছানোই মুশকিল। মন খারাপ

---------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আমি ভাবলাম গল্প অনুবাদ করছেন। এ তো দেখি একেবারে কঠিন জিনিস...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

এটা সাহিত্যের কেলাস। হাসি

---------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

লুকাচ করবেন নাকি ...
_________________________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ই. ভি. লুকাসের কথা কন। নাকী?

--------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

না ... এই লোক
____________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

মার্ক্সকে পড়তে না ভয় পেলেও লুই আলথুসার ছাড়া বাকি মার্ক্সিস্টদের কিছুটা ডরাই। আপাতত উনার হিস্টরি এন্ড ক্লাস কনশাসনেস নেটে পেলাম। পড়ে দেখি।

---------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

একটা বিস্মৃতপ্রায় নাম আছে গিওর্গি কারাস্‌লাভোভ (উচ্চারণ ঠিক লিখলাম তো?), বুলগেরিয়ার। উনার লেখা আজকাল খুঁজে পাওয়াই ভার। পাওয়া গেলে অনুবাদ বা সমালোচনার জন্য আপনাদের ধরিয়ে দেয়া যেত।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ইনার কিছুই পাইলাম না।

---------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ইনার একটা বই Tango, একটা বই কাম মুভি Snaha টরেন্ট-ফরেন্ট ঘাঁটলে পাওয়া যাওয়ার কথা। আমার আবার ঘাঁটাঘাঁটির এলেম নাই। Tango'র একটা কপি বুয়েটের সোহরাওয়ার্দী হলের লাইব্রেরীতে ছিল। মসিউদ্দিন শাকের যখন ঐ লাইব্রেরীটার সম্পাদক ছিলেন তখন এমনতর অনেক বই কিনেছিলেন। ইউজিন ও'নীল, কনর‌্যাড রিখটার এমন আরো অনেকের বই পড়তে পাবার জন্য এই অগ্রজের প্রতি কৃতজ্ঞতা।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।