টোপ দিলেই যে কেঁচো মাছ খেয়ে ফেলবে তার গ্যারান্টি কি? ২

সুমন চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন সুমন চৌধুরী (তারিখ: শনি, ১৭/১১/২০০৭ - ৫:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৯৯৭। ক্যাম্পাসে ঢুকেছি বেশীদিন হয়নি। কাঁধের উপর ২০ মাসের সেশন জট নিয়ে কি কি যেন ভেবেছিলাম ক্যাম্পাসে পা দেবার আগে। পাদিবামাত্র সব উবে গেল। প্রথম দুই তিনদিন একটু ভ্যাক ধইরা ছিলাম। পোলাপানরে দেখতাম আর মনে করতাম কি ব্যাপার সবাই এরকম পোলাপানের মতো করে ক্যান?তৃতীয় কি চতুর্থ দিনে একবার ধুন্ধুমার ঝড়ের মুখে কারেন্ট গেলগা। বিষাদ সিন্ধু (মীর মশাররফ হোসেন হল) এমনিতেই পাগলাগারদ হিসাবে পরিচিত। কারেন্ট গেলে শুরু হলো মৌখিক প্রতিভা জাহিরের প্রতিযোগীতা। ফার্স্ট ইয়ারের পোলাপানরা তখনো র‌্যাগীং এর ভয়ে একতলায় ঘোট পাকিয়ে থাকে। আমি কিছুক্ষণ হাসিমুখে সবার গালাগালি শুনলাম। বরিশালের সোহাগ বললো , এহানে থাকতে হৈলে গালি দেতে হৈবে। আমি জিগাইলাম, দেতেই হইবে? কয় , হয়। শুরু করলাম। পাশা উল্টে গেল। আগের তিনদিনে পোলাপানের ধারণা হইছিল আমি বুঝি সুশীল (তখন আমি ছায়ানটের ছাত্র আর ক্যাডার)। গালিতে চিনে নিল মাটির গন্ধ। মজলিসের একক মধ্যমণি না হলেও অন্তত মজলিসে সুরুয়ায় দৃশ্যমান ভেসে ছিলাম।

সবাই খুশী। তবে সমস্যা হলো অন্যখানে। ক্যাম্পাসে নথিপত্র মোতাবেক দাখিল হবার কদিন আগে থেকেই বামপন্থীদের সাথে একটু একটু আলাপ পরিচয়। আসলে তখন জয়ের (আমাদের লেখক কর্ণজয়) সাথে ঘুরতাম। ওর মাধ্যমেই লালঝান্ডাধারীদের সাথে আলাপ পরিচয়ের শুরু। ইঁচড়ে পাকা ছিলাম। তাই তাদের সাথে শুরু থেকেই হুহুবাবা ভাব নিয়ে কথা বলতাম। তারাও বুঝতেন আমিও বুঝতাম। কিন্তু ভাবটা থাকতো কেউই বুঝে নাই টাইপ। তো সেইখানে এক সিনিয়র নেতার নজরে পড়লাম প্রথম থেকেই। তিনি থাকতেন অন্য হলে। একদিন অডিটোরিয়ামের সমানে ধরলেন। ধরে ধমকের সুরে, " কি ব্যাপার! তুমি নাকি খালি হালকা হালকা কথা বলো? এগুলা শুইনা পোলাপানের জীবন সম্পর্কে ভুল ধারনা হইতেছে। ওদের মনে হইতেছে যে জীবনটা খুব মজার জায়গা। তুমি নিজে এরকম ভাবো সেইটাও ঠিক নাই তবে তোমারে দেইখা আরো লোকের ক্ষতি হোক এইটাতো আরো খারাপ "!
টাস্কি খাইলাম।
কইলাম, "ঠিকাছে দাদা। কাইলকা থিকা ভারী ভারী কথা বলবো। একেকটা শব্দ কমপক্ষে ৫ ছটাক। মুখ থিকা বাইর হইয়াই ধুমধাম মাটিতে পড়বো"।
তিনি আরো খাপ্পা হয়ে উঠলেন। "তোমাগো মতো পোলাপানের জন্যই অনেকে শেষ পর্যন্ত উপলব্ধিই করতে পারে না যে জীবনে তাগো একটা কর্তব্য আছে। দায়বদ্ধতা আছে।" তারপর বেশ বিরক্তি নিয়ে চলে গেলেন।
আমি ভাবলাম খাইছে! এইরম তো ভাবিই নাই ভাবার চেষ্টার কথাও ভাবি নাই!
এর আরো কিছুদিন পরে কবিদের সাথে খাতির জমা শুরু করলো। কবিতা পড়তাম গাবরের মতো। লিখতে পারি এরম একটা ভুল ধারনা নিয়া লিখতামও। সেইটা প্রথম প্রথম দেখাইতাম দুইএকজনরে। বেশীরভাগই ভুরু কুচকাইয়া কিছুক্ষন দেইখা জিগাইতো, এগুলা কি? একজন বললেন, খালি তো নানারকম চালিয়াতি আর ফাইজলামি। কবিতাটা কই? আমি ঢোঁক গিলা বললাম, কবিতা কোথায় কতদূর গেলে হৈবো? কয় কবিতায় গভীরতা লাগে। অনেক গভীরে গেলে তারপর সেইটা কবিতা হয়। অনেকে সারাজীবনেও সেই গভীরতা পায় না। এরপর কথায় কথায় খালি ডেপথ। প্রতি তিনটা বাক্যে একবার কইরা ডেপথ। মাথা ভোঁ ভোঁ করতে থাকলো। টিএসসির দোতলায় কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান শুনতে গেছিলাম। প্যাচানো সিড়ি দিয়া নিচে নাইমা কানে ধরলাম আর যামু না। গভীরতা খুঁজতে কুয়ায় নাইমা দমবন্ধ হৈয়া মরা যাইবো না। কিন্তু কবিতা গুতায়। কোন চান্সে একলা হইলেই কাগজে ধুমধাম কয়েক লাইন লিখি। লেইখা একলা একলা হাসি।
তো সেইদিন টিএসসির দোতলা থিকা নাইমা থিয়েটারের হলরুম পার হইতেই দেখি চিপায় বইসা আছে বান্নাভাই। কই যাছ? কইলাম হলে। কয় সন্ধ্যা ছয়টায় কেউ হলে যায়? হাগা ধরছে নাকি? কইলাম, না। তাইলে বয়। বইলাম। তমাকের ধোঁয়া ধূসরতর হতে থাকলো। তুই ল্যাখোস নাকি? কইলাম হ। তারপর খাতা খুইলা শুরু হইলো। বান্নার হাসি আর আমার দুইটাই ট্রেডমার্ক। সেইদিন হলে গেলাম দশটায়। গিয়াই খাতা খুইলা বসলাম। সেদিনকার বিষয় "গভীরতা"। সেখানেই মোক্ষ।

মোক্ষ

গভীর হতে হতে
পাছায় সামুদ্রিক ঝাপটা খেয়ে বুঝলাম
চিলির কাছাকাছি এসে গেছি,
সাঁতরে কুলোবে না।
হুলোবেড়ালের সরস হাঁচি
পাঁচিলজোড়া কুলোর বাতাস শুঁকে।

বুকে ছিল
গঙ্গামাসীর ঠোঙ্গাভরা শামুক,
তুলসীমোড়া যতই বল,
মাসী আমার ত্রিকাল জোড়া কামুক

আমায় বাপু উড়তে হবে
ফুস করে সেই ভেল্কি সাধুর টানে,
কল্কি ভাঙ্গার হুজ্জোতে যে শুধিয়েছিল
গভীর হবার মানে !

১২.০৩.১৯৯৭


মন্তব্য

এরশাদ আলমগীর এর ছবি

যথারীতি চমৎকার- স্মৃতিকথন এবং কবিতা- দুটোই।

ধ্রুব হাসান এর ছবি

দারুন...! আপনিও দেখি আমাদের সময়কার তরুন...হা হা হা...ভালৈছে...

সুমন চৌধুরী এর ছবি

শুক্রিয়া...



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

যথারীতি ভালো লাগল।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

তো 'গভীরতা'পাওয়া গেলো শেষে?
-----------------------------------------
'জলপ্রিয় হে যুবক, তোমার ভিতরে এত
ভাঙনের পতনের শব্দ শুনি কেন!'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

দেঁতো হাসি



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

ধুসর গোধূলি এর ছবি
কালোবিড়াল এর ছবি

বদ্দার বয়স তো মনে হয় তিরিশের নিচে মাগার নিজের লিখা রেটিং দিছেন ৩০ বছর বা তদুর্ধ!

??? এর ছবি

"পাদিবামাত্র সব কিছু উবে গেল" হো হো হো
হুহুবাবা, বান্না তো মনে হয় চিরকালের জন্য রিহ্যাবের চক্করে আটকায়া গেল!
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

সুমন চৌধুরী এর ছবি

বান্নার স্মৃতি কিছুদিন পরপরই খোঁচায়। ২০০১ এর পর সব মিলিয়ে মনে হয় দুই তিনবারের বেশী দেখা হয় নি। প্রবাসে প্রায়ই মাথায় ইকো হয় সেই হাসি....



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

পিপুল বৃক্ষের সাধু, সাধু! সাধু!

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

শেখ জলিল এর ছবি

বেশ জমেছে..চলুক আরও..

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

জুয়েল বিন জহির এর ছবি

ভালো লাগছে...

সবুজ বাঘ এর ছবি

উরে সব্বোনাশ..উরে সব্বোনাশ-এত ফাইন আর কুনদিনো নাগে নাই।
পুনশ্চ: আমাগো সিনে আর কত দেরি?

সুমন চৌধুরী এর ছবি

তিষ্ঠ



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

খুবই বদ্দাফুল।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

মন্তব্যের জন্য সবাইরে শুক্রিয়া.................



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।