ধর্মঘট

তাপস শর্মা এর ছবি
লিখেছেন তাপস শর্মা [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১৬/০১/২০১২ - ১২:৩৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রাত্রি বোধ হয় শেষ হবার পথে। ঠিক কটা বাজে তা বোঝা না গেলেও টিনের চালের ফাঁক দিয়ে পৌষের হিমেল হাওয়া সাংঘাতিক ভাবে ঢুকছিল। দু দিন ধরেই ঘুম নাই অসিতের। নিজের ঘর থেকে এত দূরের এই চিলেকোঠায় গত দশ বছরের সবচেয়ে অস্থির রাত্রি আজ। কারণ বলতে দুইটা আছে, এক পায়ের ঘা’টাতে প্রচণ্ড ব্যাথা করছে। আর দ্বিতীয়র প্রচণ্ড মানসিক দোটানায় আছে সে। দুদিন আগের সেই ঘটনা তার সমাজ দেখার ভূগোল পাল্টে দিয়েছে। সে ভাবে রঙ নিয়ে। কোনটা দেশের আসল রঙ...


প্রথম শেষ

দাঙ্গা উন্মত্ত গুজরাটের গুলবার্গ সোসাইটি এলাকায় বীভৎস পরিস্থিতি। ঘরে নিরাপত্তা রক্ষীদের ছত্রছায়ায় নিশ্চিত আশ্রয়ে থাকতে পারেননি এহসান জাফরিন। অসহায়দের বাঁচাতে নিরস্ত্র অবস্থায় ছুটে গেলেন গুলবার্গ এলাকায়। তারপর তার আর ঘরে ফেরা হয়নি। নিরীহ মানুষকে বাঁচাতে গেলে সাংসদ এহসান জাফরিনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারল দুর্বৃত্তরা।

দুই বছর বাদে সেই ঘটনাকে স্মরণ করে আজকের ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে এক শ্রেণীর রাজনৈতিক পুঙ্গব। আর সরকার পক্ষ কেনইবা মানবে সেই ডাক। ঘটনার স্রোত সেই দিকেই ধাবমান।


মধ্যের শেষ

স্তব্ধ, শুনশান, আজকের সকালটায় আহমেদাবাদ যেন থমকে আছে। সবে মাত্র সকাল দশটা। রোজ এই সময়টায় রাস্তায় এত ব্যাস্ততা থাকে। কিন্তু আজ অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। বিল্লাল এবং আমজাদ কিছুই বুঝতে পারলো না। এই সময়টা ওদের ইনকামের সময়। ট্রাফিক পয়েন্টে ভীর জমে গেলে বাবুদের হাতে পায়ে ধরে দু পয়সা কামানোটাই ওদের নিত্য দিনের রুটিন। কিন্তু আজকের এই অবস্থা দেখে কিছুটা দমে গেলো দুজন। করিম চাচার ব্যাস্ত চা স্টলটাও আজ বন্ধ। সামনের চাতালের নিচে গিয়ে দাঁড়াল দু’জন। দু বছর আগে শহরে ঘটে যাওয়া সেই নারকীয় ঘটনা আজও স্মরণে আছে ওদের। কুন্দন বাওয়াজের ঠেলা গাড়িটার নীচে সাত দিন না খেয়ে শুয়েছিল দুজনেই। সাত দিন সাত রাত। আজও এমন কিছু ঘটেনি তো। একজন অপর জনের দিকে তাকায়।

এমন সময় পাশের গলির নিন্দিয়া ছুটতে ছুটতে আসে – বিল্লাল ভাইয়া, আমজাদ ভাইয়া তোমরা এখানে কি করছ?

সে কথার উত্তর না দিয়ে বিল্লাল বলে – কি রে সবাই আজ কোথায় গেলো?

নিন্দিয়া বলে – জানিস না আজ ধর্মঘট।

ভ্রু কুঁচকে বিল্লাল বলে উঠে- ধর্মঘট? ওটা কী?

এবার নিন্দিয়া বলে- এত কিছু জানিনা। তবে অনেক লোক একসাথে কি সব বলে, একসাথে চিৎকার দেয়, গলাবাজি করে, আর...... । বলতে হলনা। শুধু বিকট শব্দ হল। আর বুটের ঠকঠক শব্দ।

এখন সকাল গড়িয়ে বিকেল। বাতাসটা আরও আলুথালু এবং জটিল। ট্রাফিক পোষ্টের উল্টো দিকের চাতালটার সামনের গলিটা দিয়ে দু একজন লোক হেঁটে যাচ্ছে। ধর্মঘট থামাতে আজ সকালে সরকার সেনা নামিয়েছেন। এবং আজ সকালে তারা গুলি চালিয়েছেন। সম্ভবত ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।


শেষের শেষ

আজ দুদিন পর সব শান্ত। রাস্তায় আবার সেই নিত্য দিনের ব্যাস্ততা। অসিত আবার অফিসে গেছে। তবুও ফেরার পথে একটা অদ্ভুত নিরবতার মতো লাগল। বাসস্টপ আজ প্রায় জনশূন্য। সন্ধ্যা হবে হবে। নানা জাতের কয়েকটা কুকুর আশেপাশে আঁচড় কাটছে। বোধ হয় এইবেলা খেতে পায়নি। ওরাইতো অভুক্ত পেটে মাটির উর্বরতা বাড়াবে। আবিজাবি চিন্তা সেই যে ঢুকেছে তা এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে অসিতকে। নিজের ভেতর অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতাকে নিয়ে বারবার প্রতিঘাতের বিষবাস্প গিলছে সে। হথাৎ গোমট পাথরের ভারী ক্লান্তিকে ঘুচিয়ে দিতে বৃষ্টি নামল। ভরা শীতের মধ্যে বৃষ্টি। একটু ধাতস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি সামনের ভাঙা দোকানটার নীচে গিয়ে দাঁড়াল সে।

এটাই বোধ হয় আত্মরক্ষা। দৌড়ে যেতে গিয়ে হাল্কা মোচড় লাগল পা’টাতে। ঝলসে যাওয়া অংশটাতে আবারও ব্যাথা। অসিত মনে করার চেষ্টা করল দুদিন আগের সকাল। আগের দিন ফিরে আসার সময় কিছু নিয়ে আসা হয়নি। রোজ অফিস ফেরার পথে ও পরের দিনের জন্য খাবার নিয়েই আসে, কিন্তু সেদিন আগের দিনের খাবার অবশিষ্ট থাকায় নিয়ে আসা হয়নি। কিন্তু রাতে জানতে পারল পরের দিন ধর্মঘট। অফিসে যাবার তাড়া নেই তাই একটু দেরি হয়েছিল ঘুম থেকে উঠতে। তারপর সাতপাঁচ না ভেবেই ব্রেকফাস্ট কিনে আনার জন্য রাস্তায় নেমে আসতেই গুলির শব্দ। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল জলপাই রঙের পোশাক পড়নে লোক গুলি আগুনের মতো গুলি চালাচ্ছে। কিছু ভেবে উঠার আগের একটা গুলি তার পা ছুঁয়ে গেলো। সংজ্ঞা হারানোর আগে সে দেখল মাটিতে লুটিয়ে আছে তিনটি ছোট্ট লাশ।

বাসস্টপের ঠিক পেছনটাতেই রেল স্টেশন। একটা ট্রেন হুইসেল দিতে দিতে এইমাত্র বেড়িয়ে গেলো। ট্রেনটা চলে যেতেই শরীরটা কাঁপতে থাকে অসিতের। ঠিক কয়েক সেকেন্ড। তারপর সম্বিৎ ফিরল তার। বারবার ভেসে উঠল মায়ের মুখ। ভেসে উঠল তিনটি বেওয়ারিশ লাশ, পায়ের ঘা। সেদিন গুলিটা যদি পা ছুঁয়ে না গিয়ে বুকটা ছুঁয়ে যেতো...। বৃষ্টি ঝরছে অবিরাম। কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। শুধু ঝাপসা এক ধূসর চাদর। এইবার বাড়ি থেকে ফেরার আগে মা ইলিশ মাছ রেঁধেছিলেন, অসিতের খুব প্রিয়। এই নির্জন বাসস্টপে দাঁড়িয়ে অসিত মা, গ্রামের সবুজ গাছ আর সেই অসাধারণ মাছভাজার গন্ধ পেলো। তারপর একা দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকল বৃষ্টিতে।

======================

আমার শহর

জানুয়ারি। ১৫। ২০১২


মন্তব্য

ফাহিম হাসান এর ছবি

কতদিন বৃষ্টিতে ভিজি না!

Atithi lekhak এর ছবি

দাদা সেরা হয়েছে।:)

তাপস শর্মা এর ছবি

ফাহিম ভাই বৃষ্টিতে ভেজার সুখ............... সত্যিই...

উচ্ছলা এর ছবি

"সংজ্ঞা হারানোর আগে সে দেখল মাটিতে লুটিয়ে আছে তিনটি ছোট্ট লাশ।"
আহা রে...কী নিদারুন বাস্তব ছবি...

তাপস শর্মা এর ছবি

বাস্তব কে অতিক্রান্ত করে যায় এই বাস্তব...

Atithi lekhak এর ছবি

দাদা ট্রেন থেকে মনে হল এখন অব্দি আমার ট্রেন চলা হয়নি।

Atithi lekhak এর ছবি

দাদা ট্রেন থেকে মনে হল এখন অব্দি আমার ট্রেন চলা হয়নি।

Atithi lekhak এর ছবি

দাদা ট্রেন থেকে মনে হল এখন অব্দি আমার ট্রেন চলা হয়নি।

Atithi lekhak এর ছবি

দাদা ট্রেন থেকে মনে হল এখন অব্দি আমার ট্রেন চলা হয়নি।

Atithi lekhak এর ছবি

দাদা ট্রেন থেকে মনে হল এখন অব্দি আমার ট্রেন চলা হয়নি।

Atithi lekhak এর ছবি

দাদা ট্রেন থেকে মনে হল এখন অব্দি আমার ট্রেন চলা হয়নি।

Atithi lekhak এর ছবি

দাদা ট্রেন থেকে মনে হল এখন অব্দি আমার ট্রেন চলা হয়নি।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

আহা! বৃষ্টিতে ভেজা, কি মজা! বয়সের কারনে এখন বৃষ্টিতে ভেজার সাধ হলেও সাহস হয়না।
চলুক। চলুক

তাপস শর্মা এর ছবি

ধন্যবাদ কবির দা...

Atithi lekhak এর ছবি

দাদা আমরা তো জানতাম ই না, যে ধরমঘটের এত করুন ফল থাকতে পারে। ধরমঘটের ফল স্বরুপ বেচারা বিল্লাল ও আমজাদকে সাত দিন ধরে উপোস করতে হয়েছিল কুন্দন বাওয়াজের ঠেলা গাড়িটার নীচে।

আহা রে কি নিদারুন বাস্তব ছবি।

তাপস শর্মা এর ছবি

Atithi lekhak - আপনার এক মন্তব্য কতবার এলো ভাই!!!!!

যাই হোক এত খুঁটিয়ে পড়েছেন , আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

তদানিন্তন পাঁঠা এর ছবি

অণুগল্প লেখার হাত বেশ আপনার। এতো অল্প কথায় কী ভাবে ফুঁটিয়ে তোলেন সব? মন খারাপ করা লেখা। ভালো থাকুন।

তাপস শর্মা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।

Samiran Ray, KOLKATA এর ছবি

কঠোর বাস্তবের চালচিত্র ০০০০০০০ যাপিত জীবনের রোজ-নামচা, লেখকের হাতের যাদুকাঠিতে, অব্যক্ত যন্ত্রনার এ্যসিড হয়ে পাঠকহৃদয়ে স্থায়ী দাগ রেখে যায়।।
গল্পের অন্তিম অংশতে, অবিরত বারিধারায় সব ধূসর হয়ে আসা ধরনী, ইলিশ ভাজার গন্ধে, দিশাহীন অতীতের করুণা-মাখা এক দিগভ্রষ্ট হাতছানি আছে।। যথারীতি ভালো লাগলো।।

Samiran Ray, KOLKATA এর ছবি

কঠোর বাস্তবের চালচিত্র ০০০০০০০ যাপিত জীবনের রোজ-নামচা, লেখকের হাতের যাদুকাঠিতে, অব্যক্ত যন্ত্রনার এ্যসিড হয়ে পাঠকহৃদয়ে স্থায়ী দাগ রেখে যায়।।
গল্পের অন্তিম অংশতে, অবিরত বারিধারায় সব ধূসর হয়ে আসা ধরনী, ইলিশ ভাজার গন্ধে, দিশাহীন অতীতের করুণা-মাখা এক দিগভ্রষ্ট হাতছানি আছে।। যথারীতি ভালো লাগলো।।

তাপস শর্মা এর ছবি

আপনি সবসময় আমাকে উৎসাহ দেন দাদা। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকুন সবসময়...

রোখশানা রফিক এর ছবি

বাস্তবতার কঠিন প্রতিচ্ছবি আছে গল্পটিতে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কাছে আমরা যে কত অসহায় তা আবার মনে করিয়ে দিল গল্পটি। অনুগল্প হিসেবে চমৎকার।

তাপস শর্মা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।

দ্যা রিডার এর ছবি

নিদারুন মন খারাপ ( লেখা মর্মস্পর্শী )

তাপস শর্মা এর ছবি

হুম।

পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, দ্যা রিডার।

শামীমা রিমা এর ছবি

তাপস দা , আপনার লেখায় গভীর জীবন বোধের উপলব্ধি সব সময়ই স্পষ্ট ভাবে ফুটে ওঠে । এটাও তার ব্যতিক্রম না ।

নোংরা রাজনীতি এসব নিরীহ মানুষদের আর কত ভোগাবে ?
চলুক

তাপস শর্মা এর ছবি

হয়তো কোন দিনও নয় । এই জিনিষ শেষ হবার নয়......

তাপস শর্মা এর ছবি

আমার তো মনে হয় রাজনীতি কোন দিনই সুস্থ ছিলো না...

শামীমা রিমা এর ছবি

ঠিক ই বলছেন তাপস দা ।

অতিথি লেখক  এর ছবি

খুব মন খারাপ হলো .....সুস্থ রাজনীতি আর নেই .........

মাসুম এর ছবি

লেখাটা টাচি, এরকম লেখা মন খারাপ করে দেয়

তাপস শর্মা এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ মাসুম।

কল্যাণ এর ছবি

চলুক

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

তাপস শর্মা এর ছবি

ধন্যবাদ কল্যাণ ভাই।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

চলুক

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

তাপস শর্মা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ রাতঃ দাদা...

তাপস শর্মা এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ নক্ষত্র-নীরবতা...

নক্ষত্র-নীরবতা এর ছবি

ধন্যবাদ, ভাল হয়েছে চলুক চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।