পরিত্যক্ত জাতক

তাপস শর্মা এর ছবি
লিখেছেন তাপস শর্মা [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ০১/০৬/২০১২ - ৮:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গন্ধটা টের পায়, ভালো করেই টের পায় শম্ভু। এবং আজকাল এতটাই টের পায় যে নিজেকেই ঘৃণা করতে শুরু করেছে হয়তো মনে মনে। বিকেলের পরিত্যক্ত রোদ ওর রোদে পোড়া দেহটাকে আরেকবার স্নান করিয়ে দিয়ে যায়। ময়লা গামছাটা দিয়ে মুখ মুছে গত রাতের বাসি রুটি আর জীবন সরকারের দোকানের মটর তরকারী দিয়ে উদরপূর্তি করতে গিয়েও সে টের পায় সেই গন্ধটা। একটা মাছি তার রুটির আশেপাশে অনেকক্ষণ ধরেই ঘুরঘুর করছিল, কয়েকবার তাড়িয়ে দিয়েও কোন লাভ হয়নি, আবার ঘুরেঘুরে আসছে। গন্ধটা সেই মাছিটার নয়তো? না, মাছিটার নয়। শম্ভু জানে গন্ধটা মাছিটার নয়। তবুও সে মাছিটাকে ময়লা গামছাটা দিয়ে তাড়ানোর চেষ্টা করে। শেষে ব্যর্থ হয়ে জীবন সরকারকে গালাগাল দেয় - শালা তরকারী মে একটা আলু পর্যন্ত দিলিক না হারামজাদা, সব শক্ত মটর আর পেঁপে দিয়া চালাইছে শুয়োর কা বাচ্চা। তারপর অবশিষ্ট প্রায় টক হয়ে যাওয়া সকালে তৈরি মটরের ঝোলটা দিয়ে বাসি রুটি চেটেপুটে খায়।

বিকেলের দিকে তার কাজ শেষ হয়ে যায়। তাই এখন সে অবসর। খাওয়া শেষ করে মনের সুখে বিড়ি ধরায় সে। দুটো টান দিতেই বুকটায় একটা চাপ খায়। গত সপ্তাহে তাদের চেকআপের জন্য ডাক্তার সাহেব এসেছিল। ভালো জামা ও ধূতিটা পরে গিয়েছিল শম্ভু। প্রতিমাসে দুই মাসে বাবুদের ঠিক করা এই ডাক্তার এসে শ্রমিকদের দেখে যান। কখনো নিজের সাথে আনা কিছু ওষুধ ফ্রি-তে দিয়ে যান, কিন্তু বেশী ভাগ সময়ই কাগজে করে ওষুধের ফিরিস্তি লিখে দিয়ে বলে যান শহর থেকে গিয়ে ওষুধ আনিয়ে নিতে। শম্ভুকেও এই ডাক্তার সাহেব বহুবার অনেক ওষুধ লিখেছেন, বলেছিলেন শহরে গিয়ে বড় ডাক্তারকে দেখাতে। কিন্তু শম্ভু একবারও শহরে গিয়ে কোন ওষুধ আনেনি কিংবা বড় ডাক্তারকে দেখাতে যায়নি। সামর্থ্য ছিলনা এটা ঠিক, কিন্তু ইচ্ছেও ছিল না তার। গত সপ্তাহে ডাক্তার তার কানে লাগানো যন্ত্রটা দিয়ে তার বুকে টিপেটুপে তাকে বলেছে এইবার আর দেরী না করে শিগগির শহরে গিয়ে বড় ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে, নইলে ওর বুকের ব্যথা আরও বেশী বাড়বে। যদিও এইবার যেতে যেতে ডাক্তার বাবু দশটা বড়ি দিয়ে গেছেন। তাছাড়া ডাক্তার সাহেব তো প্রতি বারই বলেন শহরে গিয়ে ভালো ওষুধ আনতে, ডাক্তার দেখাতে। কিন্তু শম্ভু তা করেনা। কই এখনো তো তার কিছু হয়নি। শম্ভু ভাবে এতদিন যেহেতু কিছু হয়নি, এখনো কিছু হবেনা। মনে মনে নিজেকে সুস্থ ভেবে আরেকবার বিড়িটা টান দিতেই প্রায় দমবন্ধ কাশি শুরু হয় তার, শ্বাসটা যেমন প্রায় আটকে গেছে। একটা অস্পষ্ট গোঙানি শুরু হয়। চোখগুলি বড় হয়ে প্রায় ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায় যেন। মুখ দিয়ে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে সে। বিড়িটা ফেলে দেয়। তারপর কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। একটু সময় গেলে, ধীরেধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে । তারপরই টের পায়, টের পায় সেই বিশ্রী গন্ধটা। এইবার সে ময়লা গামছাটা দিয়ে নিজেই নিজের নাক ঢেকে ফেলে।

নূতন বাজারের এই ইট ভাট্টাটিতে ঠিক কবে কাজ করতে এসেছিল শম্ভুচরণ যাদব তা কেউ ঠিক বলতে পারেনা। এমন কি ভাট্টার ম্যানাজার অশোক সাহাও ভুলে গেছেন ঠিক কবে এসেছিল সে। কত বয়েস হবে তখন শম্ভুর পনের বা তারও কম। একদিন বিকেলে বিহার থেকে সোজা এখানে! কি করে যে কি করেছিল, কিভাবে এসেছিল শম্ভু এখন নিজেও ইয়াদ করতে পারেনা। শুধু মনে আছে বাপ মরার পর মা যখন গ্রামের আরেক জোয়ান মরদ এর সাথে মিলে কোন এক ভিন রাজ্যের ইট ভাট্টাতে কাজ করতে গেল শম্ভু তখন তার দুই ছোট ভাই এবং একটি কোলের শিশু বোনকে নিয়ে একা। তখনো বিহার ভেঙে ঝাড়খণ্ড হয়নি। যাওয়ার আগে মা বাড়িতে মাত্র আড়াইশ গ্রাম আটা রেখে গিয়েছিল। সেই যে মা গেল আর ফিরে আসেনি। দুইদিন পরেই ছোট ভাইবোনগুলি খাবার জন্য ছটফট করত। ওর নিজেরও খিদে পেতো ভয়ানক ভাবে, পেটে দাউদাউ করে আগুন জ্বলত। কিন্তু কোথায় পারে খাবার। ঘরে এমন কিছু নেই যে বিক্রি করে খাবার আনবে, তাছাড়া বুর-বদি গ্রামের এই ঝোপর-পট্টিতে আর কীইবা থাকবে। সে মধ্যে মাঝে রাত হলে দূরে মাহাঞ্জি গ্রাম থেকে সামান্য মূলা কিংবা আলু তুলে আনত। সে দিয়ে আর এই চারটি পেট এর আগুন নিভেনা। কোলের বোনটি মাত্র এক বছরের শিশু। সে দুধ চায়। খাবারের যন্ত্রণায় সবকটি প্রাণ ছটফট করে। এইভাবেই চার মাস গড়িয়ে যায়। সে ভাবে সিজন শেষ হলে তার মা অনেক টাকা এবং খাবার নিয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু মা আসেনা। গ্রামের অন্যরা ক্ষেপের কাজ সেরে ফিরে আসলেও তার মা আসেনা। এখানকার হত-দরিদ্র গ্রামবাসীদের এটাই রীতি। বলতে গেলে গোটা বিহারের প্রায় একই অবস্থা! বছরের পাঁচ ছয় মাস ভিন্ন রাজ্যে পাড়ি দেয় কাজের জন্য আবার সিজন শেষে ফিরে আসে বাকি কয়দিন গ্রামেই কোন রকমে কাটিয়ে দেয় পরবর্তী সিজনের অপেক্ষায়।

একে ওকে জিজ্ঞাসা করেও মায়ের হদিশ পেলো না শম্ভু। কোলের বোনটা তখন প্রায় অসার হয়ে গেছে। কাঁদেও না, বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে বোঝা যায়না। তারপর একদিন সে টের পেল সেই একহাত শরীরের আধা ইঞ্চি নাকটা দিয়ে আর শ্বাস বের হয়না এবং প্রায় জ্যোতি-হীন চোখগুলি বন্ধ হয়ে গেছে, তখন বুঝল তার বোনটা মরে গেছে। লাশটা গর্ত করে পুঁতে দিতে দিতে তার বাপের কথা খুব মনে হয়েছিল। মায়ের জন্য নয়, সেদিন সে তার বাপের জন্য খুব কেঁদেছিল। বাপটা মদ খেয়ে মাকে খুব মারত, ভীষণ মারত। মা’ও ছড়ে দিত না, মুখের উপর ঝগড়া করত। কিন্তু দিনের শেষে বাপ যখন ঘড়ে ফিরত তাদের জন্য কিছু না কিছু খাবার নিয়ে আসত। খেতে বসে কখনো কখনো বেওড়া বাপের লাথি খেয়েও রুটি খেয়েছে সে। বাপটা তার খেতে দিত অন্তত। কিন্তু এই প্রায় পাঁচ মাস খেতে না পেয়ে তার অবস্থা একবারেই কাহিল। শম্ভুর মনে হতো তার পেটে কেউ যেন আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেছে, খালি জ্বলে আর জ্বলে।

সময় চলে যায়। বেঁচে থাকার জন্য মৃত্যু কারও কাছে ঋণ প্রত্যাশা করেনা। ধূসর অমলিন ছাইপাঁশ বেয়ে দিগন্তের আঁকা সূর্যটা হা করে তাকিয়ে থাকে। সেই থেকেই রোদের সাথে লড়াই শুরু শম্ভুর। এবং সেই থেকেই গন্ধটা পেতে শুরু করে সে। খাবারের জন্য সে বর্জিত জিনিষ কুড়িয়ে সেগুলি শহরতলিতে বেচতে শুরু করে। কিন্তু পূতিগন্ধময় নালাগুলিও একেক দিন তাকে খাবারের সন্ধান দিতে ব্যর্থ হয়!

একটা বর্ষা পেরিয়ে আরেকটা শীতকাল চলে আসে। তবুও বেঁচে থাকে শম্ভু। তারপর একদিন সবকিছু ছেড়ে পাড়ি জমায় কোন এক অজানার উদ্দেশে। শীতের সময় গ্রামের কুলিরা যখন কোন এক রাজ্যে কাজের উদ্দেশে যাওয়ার তোড়ঝোড় করছিল, সেও তাদের সেই দলে ভিড়ে যায়। ছোট বলে কেউ তাকে নিতে চাইছিল না। কার খবর কে রাখে। তার কাছে ট্রেনের ভাড়াও ছিল না। তবুও সে বিনা টিকেটে ওদের সাথে ট্রেনে চড়ে গেলো, পেট পুরে রুটি খাওয়ার জন্য বুর-বদি গ্রাম থেকে তার শেষ যাত্রা। ছোট্ট দুটি ভাই পড়ে রইলো সেই তালপাতার ছাউনি দেয়া ঘড়ে। নিজের পেটের জন্য আরও দুটি পেটকে শেষবারের মতো প্রহসনের লাথি মারল শম্ভুচরণ।

সেই যে প্রায় ছয়দিনের যাত্রা শেষে কি করে ত্রিপুরা রাজ্যের এই অখ্যাত গ্রামটিতে এসে গেলো সে, আর কোনদিন এখান থেকে কোথাও যায়নি। প্রায় ত্রিশটি বছর কেটে গেছে এরপর। আজ শীতের বিকেলের শেষ প্রান্তে এসে সেই ত্রিশটি বছরকে সামনে থেকে দেখতে পায় শম্ভু। প্রথম প্রথম ভাট্টার জন্য ইট তৈরির জন্য যে মাটি গুলতে হত, সেই মাটি গুলবার কাজ পায় সে। দিনে দশ টাকা। সেটাই তার জন্য অনেক ছিল। খুব মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজটা করত। কাজ শেষ করেই ম্যানাজারের হাত থেকে টাকাটা নিয়ে এক ছুটে সামনের পুরি সবজির দোকানে গিয়ে পেট পুরে খেয়ে, কলের জলে পেয়াস মিটিয়ে ক্ষুধাকে জয় করত শম্ভুচরণ। এই করেই একদিন সে ইট শ্রমিক বনে গেলো। এখন তার দৈনিক হাজিরা দশ টাকা থেকে আশি টাকায় পৌঁছেছে। এই নিয়েই খুশি আছে সে। প্রতিবার সিজন শেষ হলে সবাই গ্রামের উদ্দেশে রওনা দিতো। শুধু যেত না শম্ভু। তার কোন ঠিকানা নেই। কুলিদের জন্য মালিক পক্ষের বেধে দেওয়া ছনের ছাউনির এক ফালি ঘরে বাকি সিজনটা কাটিয়ে দেয় সে একাএকা। কখনো কখনো বাজারে কোম্পানির অফিস কক্ষে যায়। সেখানে কোন সময় আশোক বাবুর সাথে তার আধা বিহারি, আধা বাংলার মিশেলে এক অদ্ভুত ভাষায় সে কথা বলত। কখনো কখনো অফিসে কেউ না থাকলে অশোক বাবুর প্রায় নিভে যাওয়া সিগারেটের শেষ অংশটা শম্ভুর ভাগে জুটত। ইটের পেমেন্টের হিসেব লিখতে লিখতে কোন কোন সময় তিনি তার সাথে গল্পও করতেন।

প্রায়ই বলতেন – এতগুলি বছর হইল, একবার গিয়া গ্রামে ঘুইরা আয় শম্ভু।

এর উত্তরে অদ্ভুত হাসি হেসে শম্ভু উত্তর দিত – হামার লাগি কে অপেক্ষা করিছে আর বাবু, এমনেই আমি ভালো আছে ঈশ্বরের দোয়ায়। আপনাদের মেহেরবানীতে দো বকত কি রোটি মিল জাঁতি হে, ওর কিছু চাইনা। কথাগুলি বলতে বলতে ওর চেহারাটা কেমন জানি অদ্ভুত বিরান ভূমির মতো হয়ে যেত। যেন সে কিছু খুঁজছে। যেন হাজার বছর ধরে খুঁজছে। কোথাও দিকভ্রান্ত অনার্য সমাজের পরিত্যক্ত এক জাতক যেন খুঁজে মরছে তার হারানো মশাল।

এই সিজনটাও দেখতে দেখতে চলে যায়। বর্ষার সময় এলে ভাট্টায় ইট উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। তখন যে যার মতো চলে যায় কুলিরা নিজেদের রাজ্যের দিকে। আমার বর্ষার মরশুম শেষ হলে ওরা কেউ কেউ আবার ফিরে আসবে, কেউবা চলে যাবে অন্য রাজ্যের উদ্দেশে। কিন্তু শম্ভুচরণ যাদব কোথাও যায়না। সারি সারি ইট এর স্তূপ এর মাঝে সে একা একাই এই ভাট্টার চত্বরে পড়ে থাকে। ইদানীং বুকের কষ্টটা খুব তীব্র হয়ে উঠেছে। আর সেই গন্ধটা, বিচ্ছিরি গন্ধটা। সে একটু পর পর টের পায়। দিনের বেলা মাল ডেলিভারি হয়, তখন ট্রাকগুলি যান্ত্রিক শব্দ সৃষ্টি করে ভাট্টার নীরবতা ভাঙায়। শম্ভু কখনো কখনো সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মজদুরদের কাজে হাতও লাগায় কখনো কখনো। কিন্তু ইদানীং সে যায় না। ছোট্ট ছনের ছাউনি দেওয়া, তার উপর অজস্ত্র পলিথিন এর তালি দেয়া ঘুপচি অন্ধকার ঘরটায় একা একা শুয়ে থাকে। কেউ খবর নিতে আসেনা। কখনো কখনো রাত হলে শরীরটা একটু ভালো লাগলে সে ভাট্টার মাঝ বরাবর হেঁটে যায়। তিনটি বিশাল চুল্লি দিয়ে এখন শুধু বাতাস বের হয় হু হু করে, ধোয়া বা আগুন নেই। সেই চুল্লির আশেপাশে সে ঘুরে বেড়ায় একটা যাযাবরের মত। আর সেই গন্ধটার থেকে পেছন ছাড়ানোর জন্য তার যাবতীয় চেষ্টা।

এখন রাত গভীর। সন্ধ্যার সময় খানিকটা বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখনো টুপটাপ কয়েক ফোঁটা ঝরছে। শূন্য দিগন্তে রাত পাখিরা গান করছে। আর এই বিরান ভূমিতে গত দুই ঘণ্টা ধরে নিজের বুক আর গলার সাথে লড়াই করে যাচ্ছে শম্ভুচরণ যাদব। মুখটা কেমন যেন গর্তে ঢুকে গেছে। সেই কোন সকালে দুইটা রুটি খেতে চেষ্টা করেও খেতে পারেনি। বিড়ি মুখে দিয়েও তাতে একটা টানও দিতে পারেনি। বুকটা যেন জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। এতটা কষ্ট যে মনে হচ্ছে এই বুঝি সে শ্বাস নিতে ভুলে গেছে। সে একটু জল খাওয়ার চেষ্টা করে। প্লাস্টিকের বোতলে কল থেকে সংগ্রহ করা জল দুই ঢোক গিলতেই সাথে সাথে একটা ওক উঠে। এবং বাঁশের মাচানটার উপরে সব কিছু উগড়ে দেয়। সাথে সাথেই সেই বিশ্রী গন্ধটা। ভয়ঙ্কর ভাবে উঠে আসছে। সে সহ্য করতে না পেরে আবার ওক করে। তার পাগুলি যেন কঠিন হয়ে গেছে। চোখ মেলে তাকাতে পারছে না, আর মাথার উপর যেন কেউ এতটা তাপমাত্রা ছড়িয়ে দিয়েছে যে এখুনি জ্বলে খাক হয়ে যাবে। বুকে হাত দিতেই টের পেল ভয়ানক ভাবে হাড়গুলি মোচর খাচ্ছে। টাল খেয়ে সে অন্ধকার মেঝেতে পড়ে গেলো। এইবার একটু চোখ মেলে তাকাতে চেষ্টা করল সে। উপরে ছাউনির ফাঁক দিয়ে সামান্য চাঁদ উকি দিয়েছে। চাঁদের মুখে নিজের মায়ের মুখটা সন্ধান করে শম্ভু। ছোট বোনটার হাড়গুলি কি এখনো মাটিতে মিশে আছে, না কবেই মাটির সাথে সমান্তরাল হয়ে গেছে। ছোট দুটি ভাই যাদের ফেলে সে চলে এসেছিল, যাদের খোজ সে আর কোনদিনও নেয়নি। তারা কি বেঁচে আছে। এই কথাগুলি সে রোজ এই ছাউনিতে বসে ভাবত। আর পেটের দিকে তাকিয়ে বলত – শালার পেট, শালার ক্ষুধা। তার মা কি এখনো বেঁচে আছে। আর ভাবতে পারেনা শম্ভু। তীব্র সেই দুর্গন্ধটা তীব্র ভাবে নাকে এসে ধাক্কা দেয়, পরক্ষনেই আবার ওক করে বাকি যত কিছু অবশিষ্ট আছে পেটের ভেতর লালা সমেত মেঝেতে ঢেলে দেয়। গন্ধ, সে অন্ধকারে নাক চাপা দেয়ার জন্য নিজের গামছাটা হাতড়ায়। কিন্তু খুঁজে পায়না। বুকটা তীব্র দাবা-দহে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। এইবার আবার কাশি উঠবে। শ্বাসের সাথে একটা হেঁচকি তুলতেই শম্ভুচরণ এর চোখদুটি স্থির হয়ে যায়। এইবার স্পষ্ট চাঁদ দেখা যাচ্ছে। পূর্ণ চাঁদ। মেঘ কেটে গেছে। দূরে পাখিরা ডাকছে থেমে থেমেই, স্পষ্ট। ছনের ছাউনির ফাঁক দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল শম্ভুর পেটের উপর, তারপর কিছুটা স্থির হওয়া চোখের পাতায়।

-----------------

জুন। ০১। ২০১২


মন্তব্য

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক পড়ে ফেলসি এক টানে। ভাল লাগসে!

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

তাপস শর্মা এর ছবি

পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ মরুদ্যান।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

কোথাও দিকভ্রান্ত এক অনার্য সমাজের পরিত্যক্ত এক জাতক যেন খুঁজে মরছে তার হারানো মশাল।

মনটা ভাল ছিল, ভাল নেই। চলুক

তাপস শর্মা এর ছবি

কবীর দাদা। হয়তো বাস্তবের কথা আমরা কম শুনতে চাই। আসলে বাস্তব অনেক কষ্ট দিয়ে যায়।

অনেক ভালো থাকুন দাদা। এবং এভাবেই আমাদের পাশে থাকুন। হাসি হাসি

এবিএম এর ছবি

দাদা, অনেকদিন পর একটা অসাধারন লেখা পড়লাম। চলুক ভীষণ ভালো লাগল গল্পটা। চলুক

তাপস শর্মা এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ।

ফাহিম হাসান এর ছবি
তাপস শর্মা এর ছবি

ভায়া কত দিন পর!! ঘটনা হল, জাহিদ ভাই এর সাথে তো ঘুরাঘুরি করে এলেন! এইবার পোস্ট দ্যান। হাসি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বড় সাইজের জিনিস চেপেচুপে ছোট ফ্রেমে ঢোকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এটা যদি নিদেন পক্ষে বড় গল্পের আকারে লেখা হতো তাহলে কাহিনী ও চরিত্রগুলোর প্রতি সুবিচার করা হতো। তাপস শর্মা এই পর্যায়েই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো এক বাক্যে বিশাল গল্প বলে ফেলতে পারবেন তা তো নয়। তার দরকারও নেই। তাপস শর্মার ভাঁড়ারে কাব্যিক ভাষা তো আছে। সেটা দিয়ে ঘটনা আর চরিত্রগুলোর বিস্তার ঘটানো যায়। দরকারী ইন্টারপ্রেটেশনগুলোও আনা যায়। তাতে পাঠকের চোখের সামনে ছত্তিশগড় থেকে ত্রিপুরা পর্যন্ত ক্যানভাসটা ঠিকমতো ফুটে ওঠে।

পাঠক হিসেবে চাওয়াটা কি একটু বেশি হয়ে গেল?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তাপস শর্মা এর ছবি

না, দাদা একটুও বেশী হয়নি। হাসি কম হয়েছে, আপনি আরও বলতে পারেন।

আপনার বলা কথাগুলি মনে রাখলাম। গল্পটা রি-ডেভলাপ করার সময় ঠিক করার চেষ্টা করব। এবং পরবর্তী কিছু গল্প এমন কিছু প্লট সামনে রেখে লেখার ইচ্ছে আছে। এবং সেক্ষেত্রে আরও ভালোভাবে ইলাবরেট করার চেষ্টা অবশ্যই করব।

অনেক অনেক ধন্যবাদ পাণ্ডব দা।

সুমিমা ইয়াসমিন এর ছবি

চলুক

তাপস শর্মা এর ছবি

থিঙ্কু। হাসি

তারেক অণু এর ছবি

চলুক ভাল লাগল, ভাষাটা আরেকটু তীক্ষ হতে পারত কিছু শব্দ ছেঁটে ফেললে।

তাপস শর্মা এর ছবি

ধন্যবাদ ভায়া। হাসি মাথায় রইলো কথাটা।

অরফিয়াস এর ছবি

তাপসদা, ভালো লিখেছো।

কিন্তু লেখাটাতে কি একটু তাড়াহুড়োর ছাপ পেলাম? নাকি আমার ভুল| আর ভাষাটা একটু যদি তীক্ষ্ণ হতো আরও দাগ কাটতো মনে|

বিহারী-বাংলাটা মনে হয় ঠিক হয়নি পুরোপুরি, ওদের টানটা অন্যরকম থাকে দেখেছি| "হামকো" শব্দটা ওরা কথায় কথায় বলে।

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

তাপস শর্মা এর ছবি

হুম। আসলে গল্পটা টানা লিখে শেষ করেছি। মাথায় এলো আর লিখে ফেললাম।

এটা আসলে ওরিজিন্যাল বিহারি টোনটা নয়। তুমি ঠিক ধরেছ। কিন্তু এমন কিছু মানুষকে সামনে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে যারা অনেকদিন এখানে থাকার ফলে বাংলা এবং বিহারি মিশিয়ে একটা অদ্ভুত মিশ্রণে কথা বলেন। গল্পে যে ভাষাটা বললাম সেটা ওখান থেকেই নেওয়া।

যদিও গল্পটা রি-ডেভলাপ করার সময় আরেকটু ঠিক করার চেষ্টা অবশ্যই করব।

তোমাকে ধন্যবাদ। হাসি

কাজি মামুন এর ছবি

গল্পটির ভেতর অনেক টুকরো গল্প রয়েছে; আর সেজন্যই হয়ত পান্ডবদা বড়গল্পকে চেপেচুপে ছোট ফ্রেমে ঢোকানোর কথা বলেছেন। কিন্তু তাই বলে চরিত্রগুলোর প্রতি সুবিচার করা হয়নি, তা মানতে পারছি না। বেওড়া বাপের লাথি খেয়েও রুটি খাওয়া, গ্রামের আরেক জোয়ান মরদের সাথে মায়ের চলে যাওয়া, মাহাঞ্জি গ্রাম থেকে মুলা-আলু তুলে এনে ছোট দুই ভাই ও কোলের বোনের ক্ষুধা নিবৃত্ত করার চেষ্টা, পুতিগন্ধময় নালা থেকে বর্জ্য তুলে শহরতলিতে বিক্রি, এক হাত শরীরের শিশু বোনটার আধা ইঞ্চি নাক দিয়ে আর শ্বাস বের না হওয়া, সব ছেড়েছুড়ে বিহার থেকে ত্রিপুরার ইট ভাটায় আসা, ম্যানেজার অশোক বাবুর সাথে কথোপকথন আর নিজের পলিথিনের জোড়াতালি দেয়া ছনের ঘরে শুয়ে সর্বদাই একটা গন্ধকে হাতড়ে বেড়ানো- এ সবই ভীষণ জীবন্ত মনে হয়েছে আমার কাছে, আপনার বর্ণনাগুনে আর প্রকাশভঙ্গীতে!

শম্ভুচরণ যাদবের বর্ণিত গন্ধ পাঠকের নাসারন্ধ্রেও পৌঁছে। তার ত্রিশ বছর পূর্বের দুঃসহ জীবনের স্মৃতিগুলো দুঃসহ গন্ধের মতই তাকে তাড়া করে ফেরে আমৃত্যু! ম্যানেজারবাবুর প্রশ্নের উত্তরে শম্ভু যদিও বলে, 'হামার লাগি আর কে অপেক্ষা করিছে বাবু' আর 'আপনাদের মেহেরবানীতে দো বকত কি রোটি মিল জাতি হে, ওর কিছু চাই না', তবু

কথাগুলি বলতে বলতে ওর চেহারাটা কেমন জানি অদ্ভুত বিরান ভূমির মত হয়ে যেত। যেন সে কিছু খুঁজছে। কোথাও দিকভ্রান্ত এক অনার্য সমাজের পরিত্যক্ত এক জাতক যেন খুঁজে মরছে তার হারানো মশাল।

আমার মতে, এ জায়গায় গল্পটি সার্থকতা পেয়েছে! অনার্য দ্রাবিড় জাতির বহু যুগের শোষণ-নির্যাতন-দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্য থেকেও স্বপ্নের মশাল জ্বালানোর কথা বলা হয়েছে এখানে, তাদের অর্ন্তলীন আকাঙ্ক্ষাকে দেয়া হয়েছে ভাষা!

তাপসাদাকে এমন অসাধারণ গল্প উপহার দেয়ার জন্য অজস্র ধন্যবাদ!

তাপস শর্মা এর ছবি

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ মামুন ভাই। ভালো লাগলো আপনার সুন্দর মতামত পেয়ে। আসলে পান্ডব'দা বলায় আমারও মনে হয়েছে যে গল্পটা আরেকটু ঘষামাজা করলে ভালো হয়। আপনাকে আবারো থ্যাঙ্কস।

ইদানিং কিছু লিখছেন না যে?

আশরাফুল কবীর এর ছবি

অনেক সুন্দর লিখেছেন তাপসদা, অভিনন্দন আপনাকে বাঘের বাচ্চা

তাপস শর্মা এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ আশরাফুল। হাসি

সুমাদ্রী এর ছবি

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গল্পের কাঠামোটা বেশ শক্ত করেই তৈরী করেছেন। পাণ্ডবদা'র মত আমারও মনে হয়েছে এখানে অনেকগুলো গল্প ছিল, সবগুলো একসাথে ঢোকাতে গিয়ে বড় বড় লাফ দিয়েছেন। এই প্লটটা উপন্যাস হতে পারত, কারণ এখানে প্রতিটা উপ-চরিত্রের ছোট ছোট গল্প আছে দেখা যাচ্ছে। শম্ভুর, তার বাবার, তার মা'র, ভাই-বোনগুলোর মায় ইটভাটার মালিকেরও। যে গন্ধটা শম্ভু টের পেত সেটা কিসের? যাহোক ভাল লিখেছেন। আরো লিখুন।

অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।

তাপস শর্মা এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ সুমাদ্রী ভাই। ভালো লাগল আপনার প্রতিক্রিয়া পেয়ে।

মাথায় রইলো কথাগুলি।

হুম, সেই গন্ধটা একটা বিশেষ বিশেষণ বলতে পারেন গল্পটার জন্য। শম্ভুর ছায়া কিংবা রূপক। এবং সেটাই মূল দ্বন্দ্ব।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

চলুক

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

তাপস শর্মা এর ছবি

ধন্যবাদ প্রিয় কবি! হাসি

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

গল্পটা আমার খুবই ভালো লেগেছে।
তবে যদি প্রকৃতি আরেকটু জায়গা পেত আরও ভালো হত দাদা।

তাপস শর্মা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ প্রদীপ্ত।

ভালো থেকো।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক বেশি জীবন্ত গল্পটা। ভাষার সাবলীল ব্যবহার ভাল লেগেছে।
চালিয়ে যান তাপসদা। চলুক

[পলাতক]

তাপস শর্মা এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ - পলাতক। চেষ্টা করি......

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।