সদ্য পড়া বই, জ্য পল সাত্রের আত্নজীবনী - শব্দেরা

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: রবি, ২৮/০৪/২০১৩ - ৯:৫৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বছর কয়েক আগে 501 Must Read Books নামের এক বই জোগাড় করেছিলাম, অলস পাঠকেরা যেমন করে আর কী, যেন সেই ৫০১টা বই পড়লেই জগতের সব সাহিত্য সম্পর্কে ঝানু হয়ে যাব, বেছে বেছে কিছু পড়া হবে আর মাঝে মাঝে ইজি চেয়ারে পা ঝুলিয়ে কপাল কুঁচকে ভাবব যে এই কয়টা বই-ই এখন পর্যন্ত পড়তে পারলাম না! যাই হোক, সেই বইয়ের জীবনীগ্রন্থ অধ্যায়ে ছিল ফরাসী দার্শনিক জ্য পল সাত্রের আত্নজীবনী শব্দেরা ( The Words / Les mots ), বইটি সম্পর্কে অল্প কয়েক লাইন পড়েই আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম, প্রতিজ্ঞা করেছিলাম খুব তাড়াতাড়ি বইটি পড়ার, কিন্তু তামাম পুরনো বইয়ের দোকান তামা তামা করে খোঁজার পরেও বইটা না মেলায় অবশেষে ভিনদেশ থেকে নেটের মাধ্যমে চেয়ে পাঠানো হল, কদিন আগে হাতে এসে পৌঁছল পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত অমূল্য বইখানা। মোট দুই অধ্যায়ে বিভক্ত ১৫৮ পাতার বইটা, পড়া এবং লেখা, দুই ভাগ পড়ে ফেললাম তিরতির ভালো লাগার আবেগে পরপর দুই রাতে, অসাধারণ বইটা সম্পর্কে মুগ্ধতা জানানোর উপযোগী মণিমাণিক্যময় শব্দভাণ্ডার অর্জন আমার হয় নি, তাই কেঠো ভাষাতেই স্বল্প পরিসরে জানাচ্ছি অবশ্যপাঠ্য জীবনীটির মূল বিষয়।

আর হ্যাঁ, জ্য পল সাত্রের নাম প্রথম কবে শুনেছিলাম তা মনে নেই, কিন্তু সাধারণ জ্ঞানের বইতে প্রশ্ন ছিল কোন লেখক সর্ব প্রথম স্বেচ্ছায় নোবেল পুরস্কার বর্জন করেছিলেন? উত্তর ছিল- জ্য পল সাত্রে, ১৯৬৪ সালে সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার তিনি গ্রহণ করেন নি, কারণ সারাজীবনই তিনি কোন পুরস্কার গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন না! সেই সাথে পড়েছিলাম তার এবং সিমন দ্য বোভেয়ারের মধ্যকার অসাধারণ সম্পর্ক নিয়ে, যদিও তার লেখা পড়ার সুযোগ হয় নি, বরং সমসাময়িক অ্যালবেয়ার ক্যামুর লেখাতে বুঁদ হয়েছিলাম এবং আছি অনেক বছর ধরে। কিন্তু মনে হচ্ছে জ্য পল সাত্রের লেখাগুলো পড়ে ফেলা দরকার এখন।

শব্দেরা লেখকের জীবনের প্রথম দশ বছরের কাহিনী! ব্যস, এই দশ বছরের মাঝেই কী করে এক বালক পড়ার এবং লেখার জগতে প্রবেশ করলেন, কী করে সিদ্ধান্ত নিলেন লেখক হবার তারই গূঢ় রহস্য তুলে ধরেছেন একের পর এক ঘটনার পরত উম্মোচন করে।

অধ্যায় ১- পড়া

সাত্রে বইটি শুরুই করেছেন তার মায়ের বংশের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস দিয়ে, ১৮৫০ সাল থেকে এর সূত্রপাত। সাত্রের জন্মের ২ বছরের মধ্যেই তার বাবা মারা যান, মা তাকে নিয়ে নানা বাড়ীতে আশ্রয় নেন, নানা ভদ্রলোক ছিলেন জার্মান ভাষার শিক্ষক, উনি সাত্রেকে অংকের শিক্ষা দেন এবং খুব কম বয়সে ক্ল্যাসিকাল সাহিত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।

বই পড়া শুরুর পরপরই সাত্রে খুঁজে পান নিজের জগত, ছোট ছেলেটি অবলীলায় বলে- অবশেষে আমি আমার ধর্ম খুঁজে পেয়েছি, বই-এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে আর কিছুই নয়, গ্রন্থাগারই আমার উপাসনালয়। অসাধারণ সব বাক্য বিন্যাসের মাধ্যমে নিজেরসহ বিশ্বের সকল মানুষের শৈশব মূর্ত করে তুলেছেন তিনি ভাস্করের দক্ষতায়, কেন শৈশবের তাড়না এবং অভিজ্ঞতা মানুষের সারা জীবনে প্রভাব ফেলে তা বলেছেন তীক্ষ সব ছোট ছোট বাক্যে, যা আমাদের মর্মে গিয়ে বিঁধে।

এই সময়ই সাত্রে দেখতে পান সারা বিশ্ব ভরে আছে অপূর্ব সব শব্দে, যে শব্দেরা কাঁদে, হাসে, অভিমান করে, লজ্জায় দূরে সরে যায়, ভালবাসায় কাছে আসে! মহাবিশ্বে যেন সুন্দর, মসৃণ সব শব্দে পরিপূর্ণ, তার কাজ শুধু সেই শব্দের চিহ্নিত করার আনন্দ উপভোগ করা আর সম্ভব হলে তাদের পাশাপাশি সাজিয়ে সুন্দরতর করে তোলা। সমগ্র মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্ত যেন সাত্রের পদতলে লুটিয়ে নিজের নামের আকাঙ্ক্ষা করছিল, নিজেকে সৃষ্টিকর্তা আসীনে তুলে শিশু সাত্রে নাম দিয়েছিলেন সমস্ত জানা-অজানা বস্তুর। পরবর্তী জীবনে বলেছিলেন সেই অসীম কল্পনা ছাড়া হয়ত কখনই তার লেখক হওয়া হয়ে উঠত না।

সাত্রের বিশ্বে কোন মৃত মানুষ ছিল না, কারণ সবাই-ই তাদের সাহিত্যকর্মে বেঁচে আছে, সেই লেখকই হোক বা বইয়ের কোন চরিত্র। সাত্রে এই বুঝতে পেরেছিলেন আপন বুদ্ধিতেই যে বয়সের তুলনায় তার মানসিক জগত অনেক অনেক বেশী পরিপক্কতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নানার দেয়া এই বইগুলোর কারণেই। অবশ্য মা এবং নানীর প্রশয়ে শিশুতোষ বইয়ের জগতে অনুপ্রবেশ ঘটে তার মাঝে মাঝে, যদিও নানা সেটা জানতে পেরে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেন। বাবাহীন পরিবেশে মায়ের সাথে বড় হবার সময় কী নিজের মাঝে ইডিপাস কমপ্লেক্সেটি টের পেয়েছিলেন তিনি কিছুটা? এইসবের সাথে সাথে জানিয়েছেন ধর্ম এবং ঈশ্বর নিয়ে তার জ্ঞানের পথে যাত্রা এবং মনের মাঝে নিঃসঙ্গ ঈশ্বরের মরে যাওয়ার সংক্ষিপ্ত গল্প।

খুব কম বয়সে মাদাম ব্যোভারি পড়ে ফেলায় মা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন তাহলে বড় হলে সাত্রে কী পড়বেন? নির্লিপ্ত সাত্রের উত্তর ছিল- I shall live them. সেই সাথে জানিয়েছেন একজন বেড়ে ওঠা শিশুর ভয়াবহতম দুঃস্বপ্নের কথা যেখানে সে নিজেকে আবিস্কার করে স্রেফ সাধারণ এক শিশু হিসেবেই। সেই দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটে না কখনোই, তাকে জয় করতেই নিজেকে অসাধারণ সব কাহিনীর, অভিযানের নায়ক বলে কল্পনা শুরু হয়, পড়ে ফেলেন এমন সব বই এবং বিশেষ করে জুল ভার্ণের মাইকেল স্ট্রগফ, যা নিয়ে তার মুগ্ধতা ছিল আজীবন, ভেবেছিলেন জীবন পেতে হলে মাইকেল স্ট্রগফের মতই হওয়া উচিত।

সেই বয়সী একজন শিশুর জন্য দুটি সমান্তরাল জীবন একই সাথে কাটিয়েছেন সাত্রে, এবং অনুভব করেছেন তার দুইটির অস্তিত্বই মিথ্যা। এবং শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে নানার নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোই কোন অর্থ ছাড়াই তার জীবনকে নতুন আঙ্গিকে সাজিয়েছিল।

অধ্যায় দুই- লেখা

সম্পূর্ণ অধ্যায় জুড়ে শিশু সাত্রের লেখক হবার গল্প, লেখার সাথে শখ্যের আলাপ, কল্পনা আর বাস্তবতার গ্রহণযোগ্য মিশেল দেবার ক্ষমতার আখ্যান।

satre

( অসাধারণ বইটি অবশ্যপাঠ্য, কিন্তু নিখুঁত প্রতিটি বাক্য অনেক অনেক বার ভাবিয়ে ছাড়ে )


মন্তব্য

পিনাক পাণি এর ছবি

বেশ আগে তাঁর একটা ছোটগল্পের বই পড়েছিলাম 'দ্য ওয়াল' সেখানকার দুইটা গল্প ভালো লেগেছিল- 'দ্য ওয়াল' আর একটার নাম বোধয় 'চাইল্ডহুড ওফ আ লীডার', তবে পরে বই এর অভাবে আর সাত্রে পড়া হয়নি- ভুলেও গেছিলাম। আপনার পোস্ট এর কল্যাণে মনে পড়লো- পড়ে ফেলতে হবে।
পোস্টে লাইক হাসি
চলুক চলুক

তারেক অণু এর ছবি
স্যাম এর ছবি

এত ছোট কেন? রেগে টং
আমি প্রায় সব ভুলে যাই কিন্তু তার দুইটা কথা কেম্নে জানি এখনো মনে আছে - If you're lonely when you're alone, you're in bad company আর We are our choices

তারেক অণু এর ছবি

We are our choices

যেন বইটা আপনি পড়েন, এই কারণেই ছোট খাইছে

অতিথি লেখক এর ছবি

অধ্যায় দুই- লেখা

শুরু হয়াই শেষ !! ইয়ে, মানে...

তারেক অণু এর ছবি

সুমাদ্রী এর ছবি

সারত্রে পাঠ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর বেশ কয়েকটা বই বাংলায় অনুদিতও হয়েছে- ছায়াহীন কায়া, বিবমিষা ইত্যাদি। অশেষ ঋণী তাঁর কাছে, প্রথম যৌবনে যার কাছ থেকে পেয়েছিলাম অস্তিত্ববাদের দীক্ষা। লেখাটার জন্য ধন্যবাদ।

অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।

তারেক অণু এর ছবি

আমার কিছুই পড়া নাই উনার লেখা মন খারাপ

সুমন চৌধুরী এর ছবি

২০০১ এর ডিসেম্বর থিকা ২০০৩ এর আগস্ট পর্যন্ত পড়েছি। কতবার মনে নাই।

তারেক অণু এর ছবি

মাইরালা ! মাইরালা ! এই জন্যই আপনি বদ্দা !

সাদিয়া এর ছবি

এখনি পড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সময় নেই।পরীক্ষাটা শেষ হলেই পড়া শুরু করে দিব আশা করি।দিনগুলো বড্ড ছোট,কিছু সময় যদি কালের সমুদ্র থেকে চুরি করে ২৪ ঘন্টার সাথে আঠা দিয়ে জুড়ে দেওয়া যেত মন খারাপ

তারেক অণু এর ছবি

ইস, সময়ের অভাব, সবসময়ই মন খারাপ

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার লেখা পড়ে কেন জানি বারবার প্রথম আলোর সেই নাচ-গানের অনুষ্ঠানটার কথা মনে পড়ছে ইয়ে, মানে... মাফ করবেন মন খারাপ

তারেক অণু এর ছবি

মন খারাপ
অনেক দিন লিখতে পারছি না

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ বই-প্রতিক্রিয়া অণুদা। এরপর এই বই না পড়ে থাকা ‌যায়না।

তারেক অণু এর ছবি
সুহান রিজওয়ান এর ছবি

বই নামিয়েছি, পড়ে জানাবো কেমন লাগলো।

তারেক অণু এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

"words are loaded pistols"-জ্য পল সার্ত্রে........... হাততালি

তারেক অণু এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক চলুক

আব্দুল্লাহ এ.এম.

তারেক অণু এর ছবি
প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

হাঁ, হাঁ, পড়বো।

তারেক অণু এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

বর্ণনা দারুন লাগলো হাসি

তারেক অণু এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

মাছি পড়ার পর থেকেই সার্ত্র ও অস্তিত্ববাদের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। ১৫৮ পৃষ্ঠা জেনে হুকুম দেবার বাসনা জেগে উঠছে। আরো ভালো হয় আপনার হাতে করা একখানা অনুবাদ পেলে।

দারুণ হয়েছে অণু দা! হাততালি

নির্ঝর অলয়

তারেক অণু এর ছবি

অনুবাদ পারব না রে ভাই, অত ক্ষেমতা নাই আসলেই।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

সাত্রের আত্মজীবনী পড়তে আসলেই অসাধারণ। এই বই প্রথম পড়েছিলাম কারো একজনের অনুবাদে। টাইটেলে নাম ছিল- শব্দ। অনুবাদকের এই বাছাই খুব মনে ধরেছিল। আসলেই তো, শব্দেরা থেকে শব্দ অনেক বেশি বহুবাচনিক। অনুবাদটা ও বেশ ভালো ছিল।

তারেক অণু এর ছবি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।