কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে সালীম আলীর বহুল পঠিত আত্মজীবনীটি পড়ে যেন অন্য রকমের স্বাদ পেলাম, উনি যেহেতু ইংরেজিতে লিখেছিলেন এবং সেই ভাষাতেই পড়েছিলাম একাধিকবার উদ্দেশ্যে অনেক আগে কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদ যেন অসাধারণ ভাবানুবাদের এক উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে রইল, এত সুন্দর কাব্যিক ভাষা ও উপমা তিনি বাঙালি পাঠকের জন্য প্রয়োগ করেছেন যে মন্ত্রমুগ্ধের মতো একটানা বইটি পড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই এবং সেই অপূর্ব অনুবাদের মুন্সিয়ানার শুরু কিন্তু বইটির নাম থেকেই, The Fall of a Sparrow এর বাংলা করলেন 'চড়াই-উতরাই', যেটা মনে হয় স্বয়ং সালিম আলীও চিন্তা করতেন না।
৮৭ বছর বয়সে বইটি লেখা শুরু করেন ততদিনে চিরতরুণ পাখিবুড়ো উপাধি পেয়ে যাওয়া সালিম আলী। শৈশবের করে মনে করেছেন প্রথমেই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে, যে ধূসর সময়ে প্রকৃতি সংরক্ষণ জিনিসটাই ছিল মাঝে মাঝে শোনা বিরল একটি বিষয়। বাজারে কোয়েল, তিতির ইত্যাদি ধরনের পাখি বিক্রি হতো প্রচুর, শিকারের অভাব ছিল না কোথাও। পাখি নিয়ে উপমহাদেশে কাজ শুরু করেছিলেন যে ব্রিটিশ সাহেবেরা তাদের বালকজীবনে শখের বসে পাখি ডিম সংগ্রহ করা ছাড়া এমন কোন অভিজ্ঞতা ছিল না, কিন্তু উপমহাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য, অঢেল সময় এবং একাকীত্বের সদ্ব্যবহারের জন্য অনেকেই এই বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন, এবং গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ করেন।
বাসায় খাবার জন্য কিনে আনা সেই পাখির গাদা থেকে উনি কয়েকটা চুপচাপ সরিয়ে ফেলতেন এবং তারের জাল ও পুরাতন প্যাকিং বাক্স দিয়ে বাসা বানিয়ে সেখানে জবেহ করার হাত থেকে উদ্ধার করা পাখিগুলো পুষতেন। হয়তো এই ভাবেই শিশুমনে পাখি প্রেম জেগে উঠেছিল।
যখন তার হাত খরচের জন্য মাসিক বরাদ্দ ছিল দুই টাকা, সেইটা থেকেও উনারা নিয়মিত এলাকার পাখির বাজারে যে নতুন নতুন পাখি সংগ্রহের চেষ্টা করতেন। আবার মাত্র ৯/১০ বছর বয়সে উনি পাখি সংক্রান্ত প্রথম নোটটি লিখেছিলেন খাতায়, সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে তার ৬০ বছর পরে এটি উনি নতুন করে আবিষ্কার করে লেখাটি একটু খোল নলচে বদল করে দিলে নিউজ লেটার ফর বার্ড ওয়াচার্স-এ ছাপা হয়।
সুললিত ভাষায় এরপরে বর্ণনা করা হয়েছে উনার স্কুলজীবনের কথা, পরবর্তীতে সংসার জীবনের আরম্ভ এবং বার্মার রেঙ্গুনে দীর্ঘ বছরগুলো কাটানোর কথা। সালিম আলীর মনের পর্দায় ভেসে ওঠে স্কুলজীবনের নানা রঙের দিনগুলি, তিনি মাঝারি মানের ছাত্রই ছিলেন, গৎবাঁধা লেখাপড়া তাকে আকৃষ্ট করতে পারে নি কখনোই, তাই ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত ভারতীয় লেখকদের বাছাইকৃত রচনা নিয়ে প্রকাশিত বইয়ে নিজের লেখা দেখে বেশ অবাক হয়েছিলেন, বিশেষ করে যেখানে ঠাই পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সরোজিনী নাইডুর রচনাও! নানা অসুখের ভুগে লেখাপড়ায় কিছুটা ছেদ ঘটে তার, অবশেষে ১৯১৩ সালে বম্বে বিশ্ব –বিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন তিনি। নানা রোমাঞ্চকর সত্য কাহিনী পড়ে তখন পর্যন্ত জীবনের লক্ষ্য ছিল বিখ্যাত একজন শিকারি হওয়া ( বিগ গেম হান্টার) কিন্তু বাড়ীতে নানা ধরনের পাখি পোষা এবং প্রকৃতিতে পাখি দেখার নেশা থেকেই সিদ্ধান্ত নেন সম্ভব হলে জীববিজ্ঞানকেই পেশা হিসেবে নিবেন জীবনে। ১৯১৪ সালে তিনি বার্মা গমন করেন, মূলত এক আত্মীয়ের সাথে জীবিকা অর্জনের তাগিদে ব্যবসা করার জন্য।
এই ফাঁকে নতুন করে পেশা বেছে নেওয়া, জার্মানি যাওয়া, বোম্বের জীবন ইত্যাদি ঘটনাএসেছে পালাক্রমে কিন্তু আমার কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছিল যে সালিম আলী ভারতীয় উপমহাদেশে যেভাবে পাখি রিং করা শুরু করেছিলেন।
পাখিবিদ সালিম আলীকে তাঁর বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল- ধর্মের আওতার মধ্যে কি আপনি মানুষ হয়েছেন? আজকের জীবনে এখনো তার টান অনুভব করেন? আপনার ওপর সুফি মতবাদ এর কি কোন প্রভাব পড়েছে?
সালিম আলীর উত্তর - ছোটবেলায় মুসলিম পরিবারভুক্ত সেসময়কার সব ছেলে মেয়ের মতোই খুব কম বয়সেই পাখি পড়ানোর মতো করে কোরআন পাঠ আর আবৃত্তি করতে শেখানো হয়েছিল। জে আরবি ভাষায় কোরান লেখা হয়েছিল, তার একবর্ণও আমরা জানতাম না। হাঁটু গেড়ে নামাজ পড়ার ব্যাপারেও আমাদের তালিম দেয়া হয়েছিল। সখেদে স্বীকার করছি,এসব কিছু আমার মধ্যে আধ্যাত্মবাদ জাগিয়ে তুলতে পারেনি। বরং ফল হয়েছিল উল্টো। পরে নমো নমো করে নামাজ পড়ার আর ধারে কাছে যাইনি। গোটা ব্যাপারটা অর্থহীন, এমনকি বুজরুকি বলে মনে হয়েছে।
১৯৩৭ আফগানিস্তানের পাখির নমুনা সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণের জন্য ভ্রমণের সময় সালিম আলী লিখেছিলেন-
"আফগানরা যেরকম কট্টর গোড়া মুসলমান আর সেটা এমনই এক অরাজক দুর্বৃত্তের দেশ যে, সেখান থেকে জানমাল নিয়ে ফেরা সম্ভবই নয় ইত্যাদি ইত্যাদি- এমনটাই বলেছিল সবাই। প্রকৃত ঘটনা হল, আমাদের গোটা সফরে একজনও জিজ্ঞেস করেনি আমাদের কার কী ধর্ম। আমরা দেখলাম আফগান দেশের মানুষজনেরা অসম্ভব দিলদরাজ আর অতিথিবৎসল। আমরা পাখি সংগ্রহের কাজে গিয়ে দেখেছি, আমাদের দেখে প্রায়ই মাঠের কাজ ফেলে গ্রামের মানুষেরা ছুটে এসে বলেছে 'তোমরা আমাদের খাতিরের মেহমান। আমাদের বাড়িতে এসে একটু চা খেয়ে যাও।' যেখানেই আমরা তাঁবু ফেলেছি, রাস্তার ধারে ট্রাকের ওপর খোলা পড়ে থেকেছে আমাদের যার যা মালপত্র, খাবার-দাবার,এমনকি গুলিগোলা পর্যন্ত। কখনো একটা কোন জিনিসও খোয়া যায়নি। কখনও কোনো লোক আমাদের কোনোভাবে একটুও জ্বালাতন করেনি। একমাত্র মাছি ছাড়া।"
সালিম আলি একবার সুইডেন থেকে মোটরসাইকেল চালিয়ে মুম্বাই এসেছিলেন। তিব্বতের মানস সরোবর সহ বহু দুর্গম জায়গায় গিয়েছেন পাখির খোঁজে। আজীবন তিনি ছিলেন একজন ভ্রমণপিপাসু মানুষ।
কারাবদ্ধ থাকা অবস্থায় তরুণী ইন্দিরা গান্ধীকে সালিম আলীর পাখির বই কতটা অভিভূত ও উৎসুক করে তুলেছিল পাখিদের জগত নিয়ে এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ইন্দিরা গান্ধীর নিসর্গ রক্ষায় প্রবল সমর্থন ও কার্যক্রমের পিছনে সালিম আলীর ভূমিকা নিয়ে সামান্য আলোচনা আছে।
সেই সাথে তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথমদিকের একজন নেতৃত্বস্থানীয় প্রকৃতিসংরক্ষণবীদ, যথেচ্ছ শিকারের বিরোধিতা করেছেন সবসময়ই, সারগুজার মহারাজার কথা উল্লেখ করে বলেছেন যখন রাজাকে প্রশ্ন করেছিলেন জীবনে কতগুলো বাঘ মেরেছেন? উত্তরে বেশ দুঃখ নিয়ে মহারাজা বলেছিল মাত্র ১১৪০টি! আরও বাঘ কেন হত্যা করতে পারেন নি সিএ নিয়ে তাকে যথেষ্ট দুঃখিত দেখাচ্ছিল। বলেছেন সেই মহারাজারই এক জ্ঞাতি ভাইয়ের কথা যার গুলিতে উপমহাদেশের শেষ বুনো চিতাটি ইতিহাস হয়ে মুছে যায় প্রকৃতি থেকে। সালিম আলী চেষ্টা করেছেন স্বাধীন ভারতে যত বেশি সম্ভব প্রকৃতি সংরক্ষণ করতে।
১৯৮৫ সালে মূল বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। অপূর্ব এই বাংলা অনুবাদটি ২০০২ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট থেকে প্রকাশিত হয়। বর্তমানে এটি বাজারে বেশ দুর্লভ ।
মন্তব্য
শিরোনামের অনুবাদ অপূর্ব হয়েছে!
অন্য ভাষার বইয়ের শিরোনামের এমন সরস, লাগসই অনুবাদ বাংলায় দেখলে মন ভালো হয়ে যায়।
একদম ভ্রাত
facebook
নতুন মন্তব্য করুন