পাখি-সংগ্রহ কিভাবে পাখি-পর্যবেক্ষণে পরিণত হলো?

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: বুধ, ০৭/১২/২০২২ - ১:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পাখি শিকার এবং জীবিত পাখি সংগ্রহ অনেক বছর ধরেই সারা পৃথিবীতে ধনীদের নেশা ছিল, সেটা মিশরের ফারাও, ইনকা সরদার অথবা শুরুর দিককার আধুনিক ইউরোপিয়ান যেমন Ole Worm বা Francis Willughby, যারা তাদের বিশাল সংগ্রহ গড়ে তুলতেন কৌতুহল থেকে। ১৮০০ এবং ১৯০০ সালের দিকে এই রীতি আরও ছড়িয়ে পড়ে কারণ সেই সময়ের মধ্যে ইউরোপের অনেকেরই সেই পরিমাণ অর্থ এবং সময় ছিল পাখি সংগ্রহের জন্য এবং শুধু সেই সময় নয় বর্তমানেও এই জিনিসটাকে মূলত দেখা যায় একটা বিশেষ সমাজে পরিচিত হবার প্রচেষ্টা হিসেবে।

যদিও ১৭০০ সালের দিকে ভ্রমণ অপেক্ষাকৃত সহজ হওয়ায় এবং নিত্য নতুন আগ্নেয়াস্ত্রের আবিষ্কার ঘটায় বন্য পশু-পাখি সংগ্রহ সহজ হয়েছিল। আর ১৮০০ সালের শুরুর দিকে পাখির চামড়া এবং পাখির ডিম সংগ্রহ খুবই জনপ্রিয় হয়ে গেছিল। সত্যি কথা বলতে এটাই ছিল সেই সময়ের পাখি বিজ্ঞান - একটা নমুনা সংগ্রহ করা, মাপজোক করা, সেই রেকর্ড রাখা এবং প্রয়োজন মত সেই উদাহরণ টানা। যেটার মূল লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন ধরনের প্রজাতির মধ্যে নানা ধরনের বাহ্যিক এবং অন্তর্গত পার্থক্যের তুলনামূলক সম্পর্ক টানা। যেখানে পাখি গুলি করে চামড়া ছাড়িয়ে গবেষণার চামড়া হিসেবে কোন মতে ঠেসে ঠুসে ড্রয়ারে রাখা হতো, সত্যিকারের পাখির ট্যাক্সিডার্মি মডেল হিসেবে রাখা হতো না।

সত্যি কথা বলতে পাখিদেরকে বোঝার এই বিজ্ঞানের নামেই পাখি হত্যা করে সংগ্রহ করাকে অত্যন্ত জনপ্রিয় করেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যান্য পাখিবিজ্ঞানীদের মতোই Edmund Selous পাখি মেরে তাদের নিয়ে গবেষণা করার চেষ্টা করতেন, ১৮৯৮ সালের জুন মাসে সেলাসের ৪০ বছর বয়সে তিনি এক জোড়া ইউরোপিয়ান রাতচরা পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন-

'মাটিতে থাকা অবস্থায় পরিবেশের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিশে থাকা সেই অপূর্ব জাদুময় পাখিটির অস্তিত্ব বুঝতেই তার প্রায় এক ঘন্টা লেগেছিল এবং যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে সেখানে পাখিটি আসলে ডিমে তা দিচ্ছে তখন তার রোজনামচায় লিখেছিলেন 'আমি খুব লজ্জা ভরে স্বীকার করছি যে এক সময়ে এই সুখী মনে পাখিদের খুন করে অর্বাচীন সংগ্রাহকদের দলে আমি ছিলাম কিন্তু পাখিদের জীবন্ত অবস্থায় কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করার পরে আমার মনে হয়েছে পাখি মেরে সংগ্রহ করা অত্যন্ত দানবীয় এবং ভয়ংকর একটি কাজ। পাখি পর্যবেক্ষণের যে আনন্দ তা তাকে মারার চেয়ে অনেক বেশি উৎকৃষ্ট এবং যেকোনো মানুষ যার এক জোড়া চোখ এবং একটি আগ্রহ মন আছে নিশ্চিতভাবেই রাইফেল নামিয়ে রেখে দূরবীন তুলে নেবে এবং সেটি দিয়ে এক সপ্তাহ, একদিন এমনকি এক ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করলেও সে আর কোনদিন তার শিকারি জীবনে ফিরে যাবে না। বরং ‌ শুধুমাত্র পাখি শিকার তার কাছে নিষ্ঠুর নয় বরং সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় একটি কাজ বলে মনে হবে এবং তার গুলি এবং বন্দুক তার কাছে যতটাই হাস্যকর মনে হবে যতটা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কাছে তার ছোটবেলার খেলনা মনে হয়।'

বলা চলে উনার পর্যবেক্ষণের ফলেই পাখিরা পাখি-বিজ্ঞানীদের কাছে সম্মানজনক স্থান লাভ করতে সক্ষম হল। ফলে পাখি পর্যবেক্ষণ সমগ্র পৃথিবীতে সময় কাটানোর একটি প্রধান শখে পরিণত হল যা পরবর্তীতে পাখি পর্যবেক্ষণকে বিজ্ঞানের আলোকে দেখা এবং প্রাণী সংরক্ষণে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান এনে দিল। এবং এই ব্যাপারে অবশ্যই উন্নততর দূরবীনগুলো একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল, ১৯০০ সালের প্রথমদিকে যা বেশ দূর থেকেই পাখিদেরকে কোনরকম বিরক্ত না করেই পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ এনে দিয়েছিল।

এবং যেহেতু পাখির শিকারের চেয়ে পাখি পর্যবেক্ষণের আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল তাই পাখি বিজ্ঞানে ম্যাক্স নিকলসন তার কিছু ধারণাকে সবার কাছে নিয়ে গেলেন তিনি মনে করতেন পাখি পর্যবেক্ষণের ফলে যে সমস্ত তথ্য পাওয়া যায় সেগুলো দিয়ে পাখির ব্যবহার বোঝা এবং জনসংখ্যা সম্পর্কে জানা যায়। এভাবেই শুরু হল পাখিশুমারির।

পাখি দেখার জগতে আর এক বিশাল পরিবর্তন আনল ১৯৪০ সালের দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যখন কেবল শুরু হয়েছে তখন জেমস ফিচারের বই Watching Birds, যে বইটি এক পর্যায়ে দশ লক্ষ কপির উপরে বিক্রি হয়েছিল এবং নানা ধরনের মানুষকে পাখি দেখবার নেশায় টেনে এনেছিল। বিশেষ করে যারা সরাসরি যুদ্ধে জড়িত ছিলেন, যুদ্ধের মাঝে সেই লম্বা ক্লান্তিকর বিরতির সময়ে পাখি পর্যবেক্ষণের অভ্যাস তাদের বিশাল উপকারে এসেছিল বিশেষ করে জার্মান বন্দী শিবিরে সেই হতাশাময় বিরক্তিকর পরিবেশের সময়ে পাখি দেখা নিয়ে এসেছিল কিছুটা উদ্দীপনা।

যাদের মধ্যে একজন ছিলেন জন বাক্সটন যিনি ইংল্যান্ডের Skokholm পাখি দেখা কেন্দ্রের ওয়ার্ডেন ছিলেন ১৯৩৯ ,সালে তার স্ত্রীর মাজোরীর সঙ্গে। ১৯৪০ সালের মে মাসে তিনি নরওয়েতে বন্দী হন এবং বাকি যুদ্ধের বছরগুলো বিভিন্ন বন্দী শিবিরে কাটান যেখানে তিনি সবসময় অন্যদেরকে নানা প্রজাতির পাখির দেখতে এবং তাদের আচরণ নথিবদ্ধ করতে অন্যকে উৎসাহিত করতেন। সেই বন্দী শিবির থেকেই তিনি জার্মানের সবচেয়ে নামকরা পাখি বিজ্ঞানী Erwin Stresemann এর সাথে লিখিতভাবে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন যিনি তাদের পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য নানা ধরনের বই এবং পাখির পায়ে লাগিয়ে শনাক্ত করার জন্য ব্যান্ড পাঠিয়েছিলেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি স্নাতক বাক্সটন সবার কাছ থেকে এই বিপুল পরিমাণ নোটপত্র সংগ্রহ করে Common Redstart পাখির উপরে একটি অসাধারণ মনোগ্রাফ তৈরি করতে সক্ষম হন যা ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।

যুদ্ধ শেষে দেখা গেল পাখির প্রতি মানুষের এই আগ্রহ বিরল একটি শখ থেকে জাতীয় পর্যায়ে সময় কাটানোর নেশায় পরিণত হয়েছে। যে কারণে পাখি পর্যবেক্ষকদের মধ্যে দুটি মূল ভাগ দেখা যায় যাদের একদল যে সমস্ত পাখি দেখতেন সেগুলো গণনা করতেন, তথ্য সাজিয়ে রাখতেন এবং আরেক দল কেবলমাত্র কোনরকম উদ্দেশ্য ছাড়া দেখার আনন্দেই দেখতেন। এবং যেহেতু বিপুল পরিমাণ মানুষ পাখিতে আগ্রহ হয়ে উঠছিলেন এটা ভাবনাও অবাস্তব ছিল যে তাদের প্রত্যেকেই পাখির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং উপকারী কিছু করতে সক্ষম হবেন।

১৮০০ এবং ১৯০০ সালের দিকে দেখা গিয়েছিল কেবলমাত্র ধনীরাই পাখির ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখান এবং সেটা বজায় রাখতে সক্ষম হন। এমনকি ১৯৫০ সালের দিকেও দেখা গিয়েছিল ইংল্যান্ডের তথাকথিত উচ্চ সমাজের শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের মাঝেই শখটি থেকে গেছে। কিন্তু ১৯৭০ আবং ১৯৮০র দিকে দেখা গেল অধিকাংশ পাখি-দেখিয়েরাই সমাজের মধ্যবিত্ত এবং শ্রমিক শ্রেণী থেকে আসা শুরু করেছেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাখি দেখার বিষয়টুকু পরিবর্তন হয়েছে অনেক, মানুষ এখন ঝোপঝাড়ে দূরবীন নিয়ে ধাওয়া করার বদলে হাইডে লুকিয়ে থেকে নিরিবিলিতে পাখিদের পর্যবেক্ষণ করতেই বেশী পছন্দ করে। ১৯৬০ সাল থেকে সারা পৃথিবীতে উচ্চশিক্ষার প্রসারের কারণে অনেক বেশি নারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে জীববিজ্ঞান পড়ে পেশাগতভাবে পাখি-বিজ্ঞানী হয়েছেন।

তবে যেহেতু পাখি দর্শকের একেবারে নিখুঁত সংজ্ঞা বলে কিছু নেই, সেই কারণে পাখি দেখিয়েদের সংখ্যাটাও আমাদের জানা নেই। কেবল এটুকু বলা যায় যে যুক্তরাজ্যেই পাখির সংরক্ষণের জন্য রয়েল সোসাইটির সদস্যের সংখ্যা সমগ্র যুক্তরাজ্যের সকল রাজনৈতিক দলের সদস্য সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি।

তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে সারা পৃথিবীতে যখন পাখি নিয়ে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা অনেক অনেক গুণ বেড়ে গেছে ঠিক তখনই সারা পৃথিবীতে নিয়মিতভাবে পাখির সংখ্যা কমছে যার অন্যতম প্রধান কারণ পাখির বাসস্থানের ধ্বংসসাধন। দিন দিন অনেক বেশি মানুষ এখন বিরল এবং বিরলতর পাখি খুঁজছেন। এদের মধ্যে ভালো সংবাদ হচ্ছে পাখি দেখিয়ে দেশ সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় এবং প্রযুক্তির উন্নতি ঘটায় তারা অনলাইন ডাটাবেজ এবং পাখির পরিযায়ন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। যার ফলে বিপুল বিস্তৃত সব তথ্য শূন্যবেশিত করার পর এমন অপূর্ব সব বিষয়ে আমরা জ্ঞান পাচ্ছি যা মাত্র ২০ বছর আগেও আমাদের কল্পনার বাহিরে ছিল।

মূল লেখা- টিম বার্কহেড
(টিম বার্কহেড একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন লেখক, বিজ্ঞানী এবং যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ব-বিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের এমেরিটাস প্রফেসর। )


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

চলুক

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।