এডওয়ার্ড ব্লাইদ ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত পাখিবিদদের একজন। ইংল্যান্ডে শিক্ষা গ্রহণের পর তিনি টানা বিশ বছর বেঙ্গলের ( অবিভক্ত বাংলা) এশিয়াটিক সোসাইটির জাদুঘরে কর্মরত ছিলেন, যেখানে কাজের চাপের কারণে নিজে খুব বেশী ফিল্ডওয়ার্কে যেতে না পারলেও সমগ্র ভারতবর্ষ থেকে আসা পাখির নমুনা সংগ্রহ সাজিয়ে, বর্ণনা লিখে, প্রজাতি অনুসারে আলাদা করে রাখতেন। ১৮৬০ সালের দিকে দ্য আইবিস ( The Ibis) জার্নালের এমন কোন সংখ্যা ছিল না যেখানে ব্লাইদের এশিয়ার পাখির উপরে করা কাজের উপরে কোন বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো না। উনার মৃত্যুর পরে তাঁর বন্ধু, বিখ্যাত পাখিবিদ অ্যালান হিউম লিখেছিলেন,
“ব্লাইদের বহুমুখী পরিশ্রম সম্পর্কে যতই বলা হোক, তাঁর গুরুত্ব সম্পর্কে বাড়িয়ে বলা অসম্ভব। কোন রকম সোনার চামচ মুখে নিয়ে না জন্মেও কেবলমাত্র প্রবল ইচ্ছাশক্তি, দক্ষতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে যে খ্যাতি তিনি অর্জন করেছিলেন তাকে অতিক্রম করা অতি দুরূহ এবং যে পরিমাণ কাজ তিনি সম্পন্ন করেছিলেন, বিজ্ঞানের এই ক্ষেত্রে আর কেউ একাকী এত কাজ করে নি। কোন রকম অবহেলা, রূঢ়তা, সম্পদের হাতছানি বা সুযোগসুবিধার প্রলোভন তাকে বিজ্ঞান সাধনার সেই মহৎ পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি। অসম্ভব কম উপার্জন এবং অবহেলার শিকার হওয়া সত্ত্বেও তিনি সবসময়ই মনে করতেন কর্মক্ষেত্রে তাঁর থাকার কারণের তিনি সেই কাজগুলো সম্পন্ন করার সুযোগ পাচ্ছেন যা ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র, যা আর কেউই সেই সময়ে করতে পারত না এবং তিনি সম্পূর্ণ একাকী যে নিয়মিত গতিতে বিশাল কর্মযজ্ঞ সাধন করে গেছেন তা রূপকথার নায়কদের মতই অবিশ্বাস্য।“
পিতামাতার চার সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ এডওয়ার্ড ব্লাইদ ১৮১০ সালের ২৩ ডিসেম্বর লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে তাঁর পিতৃবিয়োগ হয় এবং মা তাকে উইম্বল্ডনের স্কুলে পাঠান যেখানে লেখাপড়ার চেয়েও নিসর্গের প্রতি তাঁর ঝোঁক এবং কাছে বনে ও মাঠে নিয়মিত যাতায়াতের কারণে তিনি সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৫ বছর বয়সে তিনি রসায়নবিদ্যা পড়ার জন্য স্কুল ত্যাগ করেন, ধারণা ছিল এরপর তিনি বিশ্ব-বিদ্যালয়ে অধ্যয়নের শেষ গির্জায় যোগ দিবেন। কিন্তু প্রাকৃতিক জগত নিয়ে আগ্রহের কারণে ব্লাইদ নিয়মিত ভোর ৩টা বা ৪টার সময়েই উঠে পড়তেন, যাতে তিনি পড়তে, লিখতে এবং আঁকতে পারেন অথবা প্রকৃতিতে যেয়ে পাখি, কীটপতঙ্গ এবং অন্যান্য প্রাণী সংগ্রহ করতে পারেন। কয়েক বছর পরে তাঁর বংশানুক্রমে প্রাপ্ত সামান্য সম্পত্তি দিয়ে লন্ডনের বাহিরে এক ড্রাগ স্টোর কিনেন। তিনি প্রায়ই স্থানীয় ভাবে দেখা পাখিদের আচরণ ও বিবরণ নিয়ে লিখতেন।
ব্লাইদ ব্যবসার দিকে খুব কম মনোযোগ দিতেন এবং পল মলে ( Pall Mall) একটা কক্ষ ভাড়া করেছিলেন যাতে গ্রন্থাগার এবং ব্রিটিশ জাদুঘরের কাছাকাছি থাকতে পারেন। নানা লেখা প্রকাশনা এবং বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে তিনি ক্লায়কেশে জীবন চালিয়ে নিতেন। ১৮৩৩ থেকে ১৮৩৬ সালের মধ্যে তাঁর জন্য উৎসাহের নানা বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল ‘ Habits of Bearded Tit’, ‘The Predaceous Habits of the Shrike’, ‘Observations on the Cuckoo’ ‘The Occurrence of the Carrion Crow in Ireland’ ইত্যাদি নানা বিষয়ে বিস্তৃত। ১৮৩৬ সালে গিলবার্ট হোয়াইটের Selborne জার্নালে ব্লাইদের জীববিজ্ঞানের নানা পর্যবেক্ষণসহ প্রকাশিত হয়, যা ভূয়সী প্রশংসা লাভ করে। ব্লাইদ নিয়মিত Rennie;র ‘ফিল্ড ন্যাচারালিস্ট’-এর জন্যেও লিখতেন কিন্তু যে পাখির নামগুলো তাঁর কাছে যথার্থ মনে হতো না সেগুলো ইচ্ছামত পরিবর্তন করে দিতেন। Hugh Strickland এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং এরপর থেকে ব্লাইদ সতর্কতার সাথে Code of Nomenclature বজায় রাখতেন এবং পাখির নামের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার গুরুত্ব বুঝতে পারেন।
তাঁর ব্যবসা সম্পূর্ণ মার খাবার পরে লন্ডনের অর্নিথোলজিক্যাল সোসাইটির কিউরেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন, কিন্তু ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে তাকে উষ্ণ আবহাওয়ার কোন দেশে যাবার পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপর এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে বেতনভুক্ত চাকরির প্রস্তাবে তিনি রাজি হয়ে ১৮৪১ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতা চলে আসেন। এর পরের বিশ বছর তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ভারতবর্ষের নিসর্গ নিয়ে জ্ঞান আহরণের জন্য এবং জাদুঘরের নমুনা সংগ্রহ এবং ক্যাটালগ আধুনিকায়নের জন্য। ১৮৪৯ সালে তিনি ‘ক্যাটালগ অফ দ্য বার্ডস অফ এশিয়াটিক সোসাইটি’ প্রকাশ করেন এবং সোসাইটির জার্নালে নিয়মিত লেখা শুরু করেন। এছাড়া তিনি ইন্ডিয়ান ফিল্ড, ইন্ডিয়ান স্পোর্টিং রিভিউ এবং দ্য ক্যালকাটা রিভিউতে লেখা শুরু করেন।
দুর্বল স্বাস্থ্য এবং স্বল্প উপার্জনের কারণে ব্লাইদের ফিল্ড-ওয়ার্ক খুবই কম সম্ভবপর হতো, ২০ বছর ভারতবর্ষে থাকাকালীন অবস্থান তাঁর বেতন একটি পয়সাও বাড়ে নাই। তিনি সর্বোচ্চ ১০০ মাইল দূরের খুলনা,মেদিনিপুরের জঙ্গল পর্যন্ত ভ্রমণ করতে পারতেন নমুনা সংগ্রহে কাজে এবং একবার মায়ানমারে গিয়েছিলেন। পাখির চামড়া সংগ্রহ ছিল তাঁর অন্যতম প্রধান কাজ এবং তিনি হিউম, টিকেল এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য সংগ্রাহকদের কাছ থেকে এমন নমুনা নিয়মিত পেতেন, এছাড়া চীন এবং তাইওয়ান থেকে মাঝে মাঝে সুইনহো তাকে নমুনা পাঠাতেন।
এডওয়ার্ড ব্লাইদের সন্মানে ৩ সরীসৃপ এবং ১২ প্রজাতির পাখির নামকরণ করা হয়েছে যেমন ব্লাইদের-মাছরাঙা (Blyth’s Kingfisher), ব্লাইদের-শিকরেঈগল (Blyth’s HawkEagle), ব্লাইদের-ট্রাগোপান (Blyth’s Tragopan), ব্লাইদের-নলফুটকি (Blyth’s Reed Warbler), ব্লাইদের-তুলিকা(Blyth’s Pipit), ব্লাইদের-ধনেশ Blyth's hornbill, ব্লাইদের-পাতাফুটকি Blyth's leaf warbler, ব্লাইদের-জলপাই বুলবুলBlyth's olive bulbul, ব্লাইদের-টিয়া Blyth's parakeet, ব্লাইদের-ব্যাঙমুখো Blyth's frogmouth, ব্লাইদের-তুতি Blyth's rosefinch, ব্লাইদের-লাটোরাছাতারে Blyth's shrike-babbler।.
নলফুটকিকে ব্লাইদ প্রথমে Acrocephalus dumetorum নাম দিয়েছিলেন কিন্তু পরে হেনরি ড্রেসার ১৮৭৬ সালে বর্তমানে চালু নামটি দেন। ব্লাইদই প্রথম ব্লাইদের-তুলিকার বিবরণ দিয়েছিলেন।
৪৪ বছর বয়সে তিনি মিসেস সুটন হজ ( Sutton Hodges) নামের এক বিধবা মহিলাকে বিয়ে করেন, যিনি ইংল্যান্ডে তাঁর পূর্বপরিচিত ছিলেন। দুঃখজনক ভাবে মাত্র তিন বছর পরেই মহিলা মারা যান, যে দুঃখবোধ ব্লাইদ আর কাটিয়ে উঠতে পারেন নাই।
সেই সাথে তাঁর বেতন বাড়ানোর এবং অবসরভাতা নিশ্চিত করার আবেদন ক্রমাগত অগ্রাহ্য হতেই থাকে, এবং ১৮৬১ সালে তাঁর স্বাস্থ্য এতই খারাপ হয়ে যায় যে ইংল্যান্ডে ফিরে আসতে বাধ্য হন। যদিও ভারত ত্যাগ করার সাথে সাথেই তাঁর চাকরিক্ষেত্র থেকে বছর ১৫০ পাউন্ডের অবসরভাতা মঞ্জুর করা হয়েছিল। ব্লাইদের অনুপস্থিতে ‘স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্যাটালগ’ প্রকাশের দেখভাল করেছিলেন উনার বন্ধু, উপমহাদেশের আরেক প্রথিতযশা পাখিবিদ ডাক্তার জার্ডন।
ইংল্যান্ডে ফিরে যাবার পরের এগার বছর ব্লাইদ সম্পূর্ণ ভাবে নিজের ভালোবাসার কাজেই আত্মনিবেদন করেন এবং নানা বৈজ্ঞানিক জার্নাল এবং পত্রিকায় তাঁর অজস্র মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৮৬০ সালে তিনি B.O.U এর অনারারি সদস্য নির্বাচিত হন এবং মৃত্যু পর্যন্ত এক অসাধারণ কর্মপাগল সদস্য হিসেবেই ছিলেন।
ভারতে থাকার সময়েই চার্লস ডারউইনের সাথে ব্লাইদের যোগাযোগ ছিল। এবং বোঝা যায় যে ডারউইন ব্লাইদের সমস্ত প্রবন্ধ খুঁটিয়ে পড়েছিলেন বিশেষ যেখানে যেখানে নানা প্রজাতির পার্থক্য, টিকে থাকার সংগ্রাম ও যৌন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের পর্যবেক্ষণ উল্লেখ ছিল। ব্লাইদ বিশ্বাস করতেন, ‘যে প্রাণী সার্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে বেশী খাপ খাওয়াতে পারে তারই টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশী এবং তারই বেশী সংখ্যায় সন্তান হবে, যে সন্তানেরা হবে টিকে থাকার জন্য অধিকতর গুণের অধিকারী।‘ যদিও ব্লাইদকে তাঁর প্রভাবের জন্য খুব একটা কৃতিত্ব দেওয়া হয় না তবুও ধারণা করা হয়ে থাকে ডারউইনকে বহু ধারণা দেবার পিছনে উনার হাত আছে এবং ব্লাইদই সম্ভবত প্রথম যিনি ডারউইনকে আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসের বিবর্তন নিয়ে কাজ যে একই ধরনের ধারণার পক্ষে কথা বলে সেটা জানিয়ে সতর্ক করেছিলেন।
এডওয়ার্ড ব্লাইদ ছিলেন একজন বিনয়ী এবং আত্মনির্ভরশীল মানুষ, যিনি ছিলেন অসামান্য স্মৃতিশক্তির অধিকারী এবং সারা জীবন পাখিবিদ্যার পিছনে উৎসর্গ করেছিলেন। ১৮৭৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর ৬৩তম জন্মদিনের অল্প কদিন পরেই হৃৎপিণ্ডের অসুখের কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। জন গুড ( John Gould) উনার এপিটাফের জন্য লিখেছিলেন, “তাঁর সময়ের প্রথম দিককার জীববিজ্ঞানী এবং ভারতবর্ষে জীববিজ্ঞানের স্থপতি।“ ( One of the first zoologists of his time and the founder of that science in India.)
( মূল লেখাঃ বারবারা মিয়ার্নস এবং রিচার্ড মিয়ার্নস)
ব্লাইদের অন্যতম কীর্তি ছিল গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ থেকে চার্লস ডারউইনের সংগ্রহ করা পাখির নমুনা ঢেলে সাজানো এবং আবিষ্কার করা যে দেখতে প্রায় একইরকম ডারউইন ফিঞ্চেরা আসলে একই পরিবারের আলাদা আলাদা প্রজাতি এবং তাদের অনেকের বাসস্থান আলাদা আলাদা দ্বীপ, যে জ্ঞানের উপরের পরবর্তীতে গড়ে ওঠে জীবনের বিবর্তনের শুদ্ধতম জ্ঞান।
মন্তব্য
Gould বাংলায় লিপ্যন্তর করলে গুল্ড হবে, গুড নয়।
নতুন মন্তব্য করুন