আমেরিকার কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান ( ১ম পর্ব)

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: শনি, ৩০/০৩/২০১৯ - ২:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

যে মুক্তচিন্তার অধিকারী, দেশপ্রেমিক, স্বপ্নের ফেরিওয়ালা ও বিপ্লবী জানান দিয়েছিলেন দেহ অতি পবিত্র এক জিনিস এবং এর চাহিদাগুলো কবিতায় আনার অতি উপযুক্ত, সেই কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান এক সমতার রাজ্যে বাস করেন, মুদি দোকানী থেকে রাষ্ট্রপতি সকলেই তাঁর ভক্ত। ‘লীভস অফ গ্রাস’ তাঁর শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি যা কিনা তাঁর যুগে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, কিন্তু শতবর্ষ পরে আজও হুইট্ম্যানের শব্দেরা ভীষণ ভাবে সগৌরবে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়, যা নগরের গর্জনের মত, উত্তাল ঢেউয়ের বিস্ফোরণের মতই সজীব ও প্রমত্ত।

ওয়াল্ট হুইটম্যান তাঁর ‘লীভস অফ গ্রাস’এ আহ্বান জানিয়েছিলেন-

‘হে পথিক
তুমি যদি আমার পাশ দিয়ে চলে যাও, এবং আমার সাথে কথা বলার সাধ জাগে
তবে কেন তুমি আমার সাথে কথা বলো না?
এবং কেন আমি তোমার সাথে কথা কইব না?’

আমি কোন সময়ই শুনি নাই তাঁর আহ্বান। বইয়ের প্রতি তীব্র আকর্ষণ স্বত্বেও হুইটম্যান এবং অন্য কবিদের লেখা কেবল বাধ্য হলেই পড়েছি। কলেজে ইংরেজিতে থার্ড ক্লাস পেয়ে পাশ করেছিলাম, পরে আর কোনদিনই সাহিত্য ক্লাসের ছায়া মাড়াই নি। ‘লীভস অফ গ্রাস’ এখনো আমার বইয়ের তাকে অক্ষয় হয়ে অবস্থান করছে। সেই পঙক্তিগুলো, যা অনেক বছর আগে হোমওয়ার্ক করার জন্য দাগিয়ে ছিলাম, সেগুলো আমার কাছে দূর বাতিঘরের আলোকশিখার মত দীপ্যমান হয়ে ওঠে, এক অবাক উদাত্ত কণ্ঠ আমি দশদিক থেকে শুনেই পাই, যার উত্তর কোনদিনই দেওয়া হয় নি।

হুইটম্যান কবিতার জন্য সেই দুর্লঙ্ঘ কাজটিই করেছিলেন যা সার্ভেন্তেস করেছিলেন উপন্যাসের জন্য, বেখট থিয়েটারের জন্য এবং পিকাসো শিল্পকলার জন্য। কবিতার ভঙ্গী এবং বিষয়বস্ত নির্ধারণের জন্য বিংশ শতাব্দীর মার্কিন কবিরা এবং সারা বিশ্বের অনেক কবিই দিন শেষ হুইটম্যানের উত্তরসূরি। ‘লীভস অফ গ্রাস’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি স্কুলেই অবশ্যপাঠ্য এবং ডজনখানেক ভাষায় অনুদিতও হয়েছে।

হুইটম্যানের সন্ধানে আমি লং আইল্যান্ডের ওয়েস্ট হিলের সেই শতাব্দীপ্রাচীন খামারবাড়িতে হাজির হই যেখানে তিনি জন্মেছিলেন। আমি নানা ভাবে জানার চেষ্টারত ছিলাম যে হুইটম্যান কে ছিলেন? আর আমি তাঁর কোন কোন সৃষ্টি থেকে বঞ্চিত ছিলাম?

স্কুলের শিশুরা টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে ১৯৫১ সালে এই বাড়ীটি কিনে নিয়ে বুলডোজারের এটিকে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেয়। এই বাড়ীর দরজা আর কড়িকাঠগুলো ওয়াল্ট হুইটম্যান সিনিয়রের নিজ হাতে তৈরি, যিনি মূলত ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রি ও মৌসুমি কৃষক। ওয়াল্ট হুইটম্যানের জন্মসাল ১৮১৯ আসতে আসতেই হুইটম্যান পরিবারের লং আইল্যান্ডে প্রায় ২০০ বছর বসবাসের ইতিহাস রচিত হয়ে গেছে! এই বাড়ির আবহাওয়া ছিলে প্রবল দেশ প্রেমে আচ্ছন্ন। ওয়াল্ট হুইটম্যানের ৫ ভাইয়ের মধ্যে তিনজনেরই নাম রাখা হয়েছিল ইতিহাসবিখ্যাত তিন মার্কিন রাষ্ট্রপতির নামে- জর্জ ওয়াশিংটন হুইটম্যান, থমাস জেফারসন হুইটম্যান এবং অ্যান্ড্রু জ্যাকসন হুইটম্যান।

খামাড়বাড়িটা এখন চার লেনের প্রশস্ত হাইওয়ের পাশে, ওয়াল্ট হুইটম্যান মলের উল্টোপাশেই। সেখান ঢুকতেই পাঁচ টিনেজারের সাথে দেখা, যার পিজ্জা খাওয়াতে ব্যস্ত ছিল। ‘ তোমরা কী ওয়াল্ট হুইটম্যান সম্পর্কে জানো?’ আমার আচমকা ছুড়ে দেওয়া এই প্রশ্নে তাদের চার জনই জানালো যে তারা শুনেছে হুইটম্যান একজন ‘কুল’ কবি ছিলেন, শুধু একজন ঘাড় নাড়িয়ে বললো ‘ আমি ভেবেছিলাম মিস্টার হুইটম্যান এই শপিংমলের মালিক!’

মোটেলে ফেরার পর ভাবলাম আরেকবার কবিতার জগতে ফেরার সময় হয়েছে। গত ৩০ বছরে সেই ফ্রেশম্যান অবস্থায় বাধত্যমূলক ইংরেজি কোর্সের পর কবিতা পাঠের চেষ্টা করেছিলাম মাত্র একবার। ১৯৮৪ সালে আমার খুব পছন্দের এক বন্ধু ভয়াবহ অসুস্থ অবস্থায় ছিল, তার বান্ধবি কবিতার মাঝেই শান্তি খুঁজে পেয়েছিল, এবং একটি বিশেষ সংকলন পড়ার দিকে তার ঝোঁক চেপেছিল। যার একটা পৃষ্ঠায় উঁকি দিয়েই আমার খুব পছন্দ হয়ে যায়, পরবর্তী এক সপ্তাহ ধরে সেই কবিতাগুলি পকেটে নিয়েই ঘুরতে থাকি, যদিও কোন সময়ই কয়েক লাইনের বেশী একটানা পড়া হয় নি।
সেদিন পড়ার জন্য বেছে নিলাম ‘Out of the Cradle Endlessly Rocking’ কবিতাটি, যা সাহিত্যবোদ্ধারা কবির সেরা কাজগুলোর একটা বলে আখ্যা দিয়েছেন-

‘Out of the mocking-bird’s throat,
The music shuttle
Out of the Ninth-month midnight
Over the sterile sands and the fields beyond, where the child ….’

পরের কয়েক পাতায় অজানা কিছু ঘটার, কিছুকে পাবার আশায় আমার চোখ সেঁটে থাকলো, ‘the lilac scent was in the air’ পর্যন্ত আসতে আসতেই রাজ্যের ঘুম আমায় ঘিরে ধরে, আর ‘ Low hangs the moon, it rose late’ অবধি আসার পর টিভির রিমোট খোঁজা শুরু করে দেই।
যদিও খানিকটা অপরাধীই মনে হচ্ছিল নিজেকে, কিন্তু টিভি ছেড়ে একটা বেশ ভালো সিনেমাই উপভোগ করলাম সেই রাতে।

যদিও ওয়াল্টের বছর ৪ পুরো হবার আগেই ক’দিন হুইটম্যান পরিবার ব্রুকলিনে চলে যায়, তারপরও লং আইল্যান্ডের নিসর্গের প্রতি তাঁর ভালবাসায় কোন সময়ই ঘাটতি পড়ে নি, যা তিনি ‘ সাগরের সুন্দর, সরল শুয়ে রোদ পোহানো’ বলে উল্লেখ করতেন। তরুণকালে তিনি প্রায়ই এখানে সাঁতার কাটতে, ঝিনুক সংগ্রহের জন্য আর মাছ ধরতে আসতেন। কনি আইল্যান্ডের জনশূন্য সৈকতে একলা হাঁটতে হাঁটতে সাগরের ঢেউয়ের উদ্দেশ্যে সেক্সপিয়ার আর হোমার আবৃত্তি করতেন ভবিষ্যতের কবি।

তাকে অনুসরণ করে আমি সাগরের বেলাভূমিতে পৌঁছে যাই, এবং খুব সহজেই বুঝে যাই যে কেন তিনি ঢেউদের সাথে কথা বলতেন। ঢেউতরঙ্গ সবসময়ই জীবন, সদাই কথা শোনা ও উত্তর দেবার জন্য মুখিয়েই আছে। যদিও আমাদের মধ্যে খুব কমজনই নির্জন সৈকতে কবিতা পড়ার উদ্দেশ্যে যায়। তরুণ ওয়াল্ট অবশ্যই নিজেকে ও জীবনকে এক অনন্য উচ্চতায় আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন খুব শুরুতেই। তাঁর কাছে প্রশ্ন করি, ‘হে কবি, জানাও আমাদের কী সেই আহ্বান যা তুমি শুনতে পেতে? তোমার ভিতরে কিসের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠছিল?’

কোন উত্তর মেলে না!

মূল লেখা - জোয়েল এল.সোয়ের্ডলো
(১৯৯৪র ডিসেম্বরে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে ছাপা হয়েছিল)

(আপনারা তাড়াতাড়ি নীড়পাতায় লেখা দিলে পরের পর্ব অতি জলদি আসিবে)

ছবি: 
07/07/2011 - 11:39অপরাহ্ন
07/07/2011 - 11:39অপরাহ্ন
07/07/2011 - 11:39অপরাহ্ন

মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো একটি লেখা। দেখি নীড়পাতার স্পেস কিছুটা ফাঁকা করতে পারি কিনা।

--মোখলেস হোসেন

তারেক অণু এর ছবি

চেষ্টা চলুক, শুভেচ্ছা

অবনীল এর ছবি

পড়ছি হুইটম্যান সিরিজ। ভালো হচ্ছে। চলুক।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।