পুশকিন ( ২য় পর্ব)

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: সোম, ১৫/০৪/২০১৯ - ১০:৩৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কবির জন্য নির্বাসনের আইনগুলো কিছুটা শিথিলযোগ্যই ছিল। দুচোখে কৌতূহল এআর আনন্দ নিয়ে পুশকিন ক্রিমিয়ার কৃষ্ণসাগর তীরের বাকচিসারায়ে এক সংস্কার করা প্রাচীন তাতার প্রাসাদ নিয়ে কৌতুকও করেছিলেন। কাছেই এক ঝর্ণার সম্পর্কে এই কিংবদন্তীও শুনেন যে এক গোত্রপতি বৃদ্ধ খান তারই হারেমের এক কুমারীর প্রেমে পড়েন, এবং সম্ভবত এই প্রেমই সেই তরুণীর মৃত্যুর কারণ ছিল, হারেমের কোন মহিলা হিংসার বশবর্তী হয়ে তাকে খুন করে, খান সেই ঝর্ণা নির্মাণ করে তার শোকের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে।

এইভাবেই তাঁর কবিতা ‘The fountain of Bakhchisaray’র জন্ম নেয়, এবং যা প্রকাশের জন্য সেন্ট পিটার্সবার্গের এক প্রকাশক ৩০০০ রুবল দিতে রাজী হন, সেই আমলে ৬০০ লাইনের একটি কবিতার জন্য ৩০০০ রুবল, মানে লাইন প্রতি ৫ রুবল কেউ কখনো শুনে নাই! পুশকিন নিজের অজান্তেই একটা নতুন পেশা আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন – ‘লেখালেখি’ ।

বোঝাই যাচ্ছে দুর্বল জুয়াড়ি হিসেবে উল্টাপাল্টা বাজি ধরে এই বিপুল পরিমাণ টাকা খোয়াতে তাঁর বেশি সময় লাগেনি, এবং সেই সাথে ব্যাগ ভর্তি লেখাও হারিয়েছিল।

গ্রন্থাগার দেখলেই পুশকিন গোগ্রাসে পড়তেন সেখানের সংগ্রহ। তিনি শেক্সপিয়ার আর বায়রন পড়তেন ইংরেজিতে, জেমস ফেনিমোর কুপার পড়তেন ফরাসীতে। গ্রীক আর রোমান সমস্ত ক্ল্যাসিক, শিলার, করনেইল। জার প্রথম নিকোলাস যে বলতেন পুশকিন রাশিয়ার সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ, তাতে কোন উত্যুক্তি ছিল না।

তাঁর সৃষ্টি ছিল সদা পরিবর্তনশীল, সৃষ্টিশীলতার উল্লাসে কাঁপা। কোন কোন বন্ধু তাকে সারা রাত কয়েক টুকরো কাগজ নিয়েই জাগতে দেখেছে। পরদিন ভোরে দেখা যেত কাগজগুলো তেমনই আছে, কবি ব্যস্ত নিজের সাথে কবিতা আবৃত্তি করতে। সিসিনাউতে তিনি ইতিমধ্যেই ওনেজিন রচনায় হাত দিয়েছিলেন।

ভাই লিয়েফ এবং সেণ্ট পিটার্সবার্গের বন্ধুদের কাছে কিন্তু প্রকাশকদের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য কবিতা পাঠাতেন। মাঝে মাঝেই সেন্সরশীপকে ‘ক্ষুদে বয়স্কা’ বলে অভিহিত করে রাগও ঝাড়তেন, কেননা তাঁর লেখায় ব্যবহৃত অনেক শব্দেই সেন্সরের আপত্তি ছিল যেমন রাশিয়ানদের তিনি ‘মুক্তিকামী’ বলে অভিহিত করতেন।

শুধু সেন্সরই নয়, কবির উপরে কড়া নজরদারি ছিল পুলিশেরও, যারা তাঁর প্রতিটি চিঠি পড়ে তবেই হস্তান্তর করত, এবং রিপোর্ট চলে যেত সরাসরি জার আলেক্সান্ডারের কাছে। এই সময়ে অবশ্য জিনিসটা একটু অবিশ্বাস্যই লাগে যে রাশিয়ার অধীশ্বর জার স্বয়ং সামান্য কিছু সাফল্য পাওয়া এলোমেলো চুলের, লাল ব্যাগি ট্রাউজার পরা এক ছোকরা কবির ব্যাপারে এত উৎসাহ দেখাচ্ছেন। হয়তো এটাই ছিল রাজকীয় প্রথা। সংগোপনে জারকে নিয়ে খেদোক্তি লিখলেও জনসম্মুখে প্রকাশিত লেখাগুলোতে তিনি বেশ সতর্কই ছিলেন। ২৩ বছর বয়সে আরো পরিপক্ক হয়ে উঠেছিলেন, যা নিয়ের বন্ধুরা বলতো এতদিনে তুমি অভিজ্ঞতার ফলে ক্ষোভকে চাপা দিতে শিখে গেলে!

১৮২৩ সালে তিনি স্ফূর্তি সহকারে লিখলেন অবশেষে ইউরোপে পা দিলাম, এর মানে আসলে কৃষ্ণসাগর তীরের ওডেসা বন্দরের কথা বোঝানো হয়েছে। সেন্ট পিটার্সবার্গের বন্ধুরা তাকে এই বদলি করাতে সক্ষম হয়। ৩০ হাজার মানুাষের এই গমগমে বন্দরে রাশিয়ানদের সাথে সাথে ইতালিয়ান আর ইহুদিরাও ব্যবসা করার জন্য ভিড় জমাচ্ছিল। সেখানের ওপেরায় কবি রসিনি উপভোগ করতে পারতেন, আর ফরাসি ওয়াইনের আগমন ছিল করমুক্ত।

সেই সময়ের ওডেসা ছিল এখনের ভিয়েনার মতই জাঁকজমকপূর্ণ। পুশকিনের বাসভবনের সাথেই ছিল রাজকীয় ব্রিস্টল হোটেল, যার এখনের নাম ক্রাসনায়া ( সুন্দর), যারা প্রতিটি স্তম্ভ ছিলে সুদৃশ্য ফুলে নয়নাভিরাম মানে মোড়ানো।

সেই আমলের ইউক্রেনের বিনামূল্যের বিনোদনেরা যেন উপচে পড়ছিল। ক্রাসনায়ার সামনে ভিড়রত লাস্যময়ীরা কোন প্রার্থনার জন্য সেখানে আসত না। তাদের ভিড়ে সুন্দর কোন মুখ দেখা পুশকিন বলে ফেলতেন ‘ তোমায় ছাড়া বাঁচব না’। কোন এক জেনারেলের স্ত্রী অ্যানা, কামনার বহ্নি চোখে ক্যালিপসো, জিপসি রমণী জেমফিরা যে কিনা কবির সাথে তাঁবু ভাগাভাগি করে নিয়েছিল, এমন সব স্মৃতি বাড়তে থাকে পুশকিনের। এক লেখায় ১১৩ জন রমণীর সাথে প্রেম করার কথা উল্লেখ করেনও!

জাদুঘরের গাইডকে যখন প্রশ্ন করলাম পুশকিনের নারীঘটিত এই কিচ্ছাগুলো সে বিশ্বাস করে কিনা, শুধু হেঁসে বলে ছিল ‘ লোকটার হৃদয় অনেক বড় ছিল’। জীবনীকারেরা বলেন তাঁর জীবনের এত অসংখ্য অল্পক্ষণের সম্পর্কের কথা পাওয়া যায় কবিতাগুলো পড়লে, অনেক কবিতা সেই অভিজ্ঞতাগুলোরই ফসল।

ওডেসার স্থানীয় গভর্নরের স্ত্রী এলিজা ভোরোন্টসোভার সাথেও সম্পর্কে জড়ানোর সাহস দেখান পুশকিন, যার হাসি দেখেই তাঁর কাছে চুম্বনের আহ্বান বলে মনে হত। এলিজা অসংখ্য কবিতায় অমর হয়ে আছেন। তার দেওয়া এক সোনার সিলমোহর ছিল কবি সৌভাগ্যের স্মারক স্মরণে বহন করতেন-

Shield thee, love, from evil preying,
From new heart-wounds…
From forgetting, from betraying.

ওডেসায় এক সুখী বছর কাটানোর পরপরই নানা ব্যাপারে অতিষ্ঠ, আত্নদন্ধে জর্জরিত পুশকিন অসতর্ক ভাবে এক চিঠিতে লিখেন যে সেখানের এক ইংরেজ অধিবাসীর কাছ থেকে নাস্তিক্যবাদের জ্ঞান নিচ্ছেন তিনি। সেই আমলে নাস্তিকতাকে জারের সমালোচনা করার মতই গর্হিত অপরাধ হিসেবে দেখা হত, এবং সেই চিঠিটা পুলিশে হাতে পড়ে যায়!

জারের হুকুমে এবার কবিকে এমন কোথাও পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যেখানে তাঁর ‘অসুস্থ’ ধারণা ছড়ানোর মত লোক পাওয়া যাবে না। শেষমেশ তাঁর মায়ের স্টেট মিখালোভস্কিতে তাকে পাঠানো হয়, যা পেস্কভ শহরের কাছেই, কিন্তু সেন্ট পিটার্সবার্গে থেকে ৩৬ ঘণ্টার এক কষ্টকর ঘোড়ার গাড়ী টানা দূরত্বে অবস্থিত!

লেখালেখির জন্য নির্জনতা চাইলে, এটি ছিল লেখার জন্ এক সেরা স্থান।স্থানু বাড়িটি, যাকে কবি ভগ্ন পর্ণকুটির বলতেন ) এক ধীরে বয়সে চলা স্রু নদী আর পুকুরের পাশে ছিল। আমার দেখা বিশাল রাশিয়ায় সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ স্থানগুলোর মধ্যে এটি একটি।

কিন্তু বন্ধুদের মতে নগরজীবনে অভ্যস্ত পুশকিনকে এই নির্জন জায়গায় পাঠানো ছিল হত্যারই নামান্তর। বরিস কাজমিন নামের এক স্থানীয় ইতিহাসবিদের মতে পুশকিনের সামনে পথ ছিল এক বেহদ্দ মাতাল হবার অথবা কালজয়ী কবি হবার। চারপাশের অবস্থায় অতিষ্ঠ হলেও তিনি ভেঙ্গে পড়েন নি কখনো। বরং চেয়ে পাঠিয়েছিলেন কিছু বই। সেই তালিকায় ছিল হ্যারল্ড, ওয়াল্টার স্কট, ইতিহাসের বই ও বাইবেল। সেই সাথে বিশেষ চীজ আর মাস্টার্ড সস।

একাকী হলেও, আসলে জীবনের কোন সময়ই তাঁর অনেক সঙ্গীসাথী ছিল না। বরং তিনি কল্পনায় তাঁর লেখার নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে কাজ করতেন, তাদের নিয়ে লিখতেন। লেখার পর মেঝে নোংরা করে ফেলতেন চিবানো পালকের কলমের অংশে।

সেন্ট পিটার্সবার্গে ৬০টি কবিতার সংকলন My Ravings প্রকাশিত হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে ১২০০ কপি বিক্রি হয়ে যায়, সেই আমলে এটি বেশ ভালো রেকর্ড।

সেন্সর বোর্ড যথারীতি বিব্রত হয়ে কাঁচি চালিয়ে গেলো, বিশেষ করে ফরাসী বিপ্লবী-কবি নিয়ে লেখা Andre Chenier থেকে ফরাসী বিপ্লব সম্পর্কিত সকল শব্দ মুছে ফেলা হয়। রাজপরিবার ইউনিয়ন অফ ওয়েলফেয়ার পরিকল্পনাকারীদের সাথে কবির সম্পর্কের কানাঘুষো ভুলতে পারে নি।

অবশেষে পুশকিন ‘ইউজেন ওনেজিন’এর প্রথম canto প্রকাশের জন্য পাঠান। পরবর্তী এক বছর মোট ৮টি পুরু পর্ব জমা হয়, অনেকটা ছন্দবদ্ধ অপেরার মত। রাশিয়ার প্রতিটি শিক্ষিত মানুষ অপেক্ষা করতে এর পরবর্তী পর্বের জন্য।

কালজয়ী মাস্টারপিস হিসেবে এর ঘটনার ব্যপ্তি বেশ ছোট, ওনেজিন সেন্ট পিটার্স বার্গের একজন অসফল ব্যক্তি, জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি গ্রামে ফিরে যান, যেখানে তার সাথে সরল গ্রাম্যবালা তাতিয়ানার দেখা হয়। চুম্বকের মত আকর্ষিত হয়ে তাতিয়ানা প্রেম জ্ঞাপন করে, ওনেজিন তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। লেনস্কি নামে এক কবির বন্ধুর সাথে চরম কিছু তিক্ত ঘটনার পর ডুয়েল লড়ে, যাতে লেনস্কি খুন হয়। এরপর ওনেজিন ঘোরাঘুরির মধ্যেই থাকেন। ৫ বছর পর এক বলনাচের আসরে আকর্ষণীয়া এবং বিবাহিত তাতিয়ানার সাথে তার দেখা হয়। ওনেজিন এবার তার প্রতি ব্যপক আকর্ষিত হয়ে প্রেম নিবেদন করে বসেন। এবার তাতিয়ানা প্রত্যাখান করে। যবনিকা!

ওনেজিন শুধুমাত্র পুশকিনের অসাধারণ সব লাইনের জন্যই না, সেই সাথে তার খেয়ালি জীবন আর অভিজাতদের জীবনের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি আঁকার জন্য। ওনেজিনের সাথে তাদের সজ্জাকক্ষে প্রবেশ করেই হালফ্যাশনের সহযোগী হয়ে সব আকারের ও ধরনের চিরুনি, কাঁচি, নখ ঘষার যন্ত্র, পাউডারের তুলি সম্পর্কে সম্যক জানতে পারি। আবার কবি সেখানে ৬৩ লাইনের কবিতায় নারীর পদযুগল নিয়ে তাঁর তীব্র আকর্ষণের বর্ণনা দিয়েছেন ওনেজিনের মুখ দিয়ে। এই সমস্ত লম্বা প্যাঁচালো গল্পের দক্ষ ভাবেই তিনি গল্প এগোনোর সাথে সাথে একের পর এক নতুন নতুন চরিত্রের সমাগম ঘটিয়েই গেছেন।

এই ফাঁকে পুশকিন তাঁর ঐতিহাসিক নাটক ‘বরিস গদুনভ’ লেখা শেষ করেন, যা মূলত ১৬০০ সালের দিকে এক উম্মাতাল সময়ের গল্প যখন এক আগন্তকের রাশিয়ার সিংহাসনের অধিকার দাবি সারা দেশকে প্রায় গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল।

নিজের এই কাজ নিয়ে আত্মপ্রেমে ভালোই মজেছিলেন কবি, মুসসোর্গস্কির অপেরা এর উপরেই ভিত্তি করে রচিত হয়েছিল , নিজ কক্ষে একাকী এটা পড়ার সময় প্রবল আবেগে কবি হাততালি দিয়ে বলে উঠতেন, আহ পুশকিন, আহ পুশকিন , তুই একটা সত্যিকারের হারামখোর!

১৮২৫ এর পয়লা নভেম্বর জার প্রথম অ্যালেক্সান্ডার সিংহাসনের কোন উত্তরসূরি রেখেই মারা যান। পরবর্তী জার হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হন তারই ভাই নিকোলাস, যদিও এটা নিশ্চিত হতে হতেই কয়েক সপ্তাহ চলে যায়।

এই ফাঁকে ইউনিয়ন ওয়েলফেয়ারের স্বপ্নে বিভোর ৩০০০ বিপ্লবী সিনেট স্কয়ারে অবস্থান নেই, যদিও তারা ছিল অসংঘটিত, এবং তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে জারের ১২হাজার সৈন্য! কয়েক ঘণ্টা অস্ত্রহীন নিষ্পত্তির ব্যর্থ চেষ্টা চালানোর পর জার বিদ্রোহীদের উপরে গুলিবর্ষণের আদেশ দেন। গুলি শুরুর পরপরই বিপ্লবীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে, অনেকেরই পাশের জমাট বাঁধা নেভা নদীর উপরে দিয়ে দৌড়ে পালাতে যেয়ে বরফ ভেঙ্গে সলীল সমাধি ঘটে। পরবর্তী ৩৫ বছরে রাশিয়ায় কোন সাংবিধানিক রাজতন্ত্র আসে নি, স্বেচ্ছাচারিতায় চলেছে পুরোটা সময়।

সেই বিদ্রোহের পরবর্তীতে বিপ্লবীরা যে নির্মম শাস্তি পেয়েছিল সেটাই রাশিয়ান হৃদয়ে দাগ কেটে যায় চিরদিনের মত, পুশকিন সঙ্গোপনে জার প্রথম নিকোলাস সম্পর্কে লিখেছিলেন

He was made emperor, and right then
Displayed his flair and drive:
Sent to Siberia a hundred-twenty men
And strung up five.

সাজাপ্রাপ্তদের অনেকেই কবির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। পুলিশ বিপ্লবীদের কাগজপত্রে পুশকিনের লিবার্টি সহ অন্যান্য কবিতা খুঁজে পায়। গ্রামে গৃহবন্দী অবস্থায় উদ্বিগ্ন তরুণ কবি তাঁর স্মৃতিকথায় চিমনীতে জ্বালিয়ে দেন। এবং ডুবন্ত জাহাজ নিয়ে এক ঠাসবুনটের কবিতা লিখেন, যেখানে তিনিই একমাত্র বেঁচে থাকেন, যে মাল্লাদের গোপন প্রেরণাদাতা ছিল।

১৮২৬সালের সেপ্টেম্বরে জার স্বয়ং তাকে জিজ্ঞেসাবাদের জন্য ডেকে পাঠান, দীর্ঘ আলাপের পর তুষ্ট জার জানান পুশকিন তাঁর সাম্রাজ্যবিরোধী লাইনগুলো সরিয়ে ফেলতে রাজি হয়েছে ( যা অবশ্যই মিথ্যা)। তাই বলা যায় যদি পুশকিন নিজেকে এখন থেকে শুধরে চলে তাহলে তাকে ক্ষমা করতে জার রাজি আছে। আর এখন থেকে জার নিজেই তাঁর কবিতায় সেন্সরের কাঁচি চালাবে!

দীর্ঘ ৬ বছর পর এই মুক্তি এলো! কিন্তু কদিন পরেই পুশকিন উপলব্ধি করলেন এই মুক্তি নানা দিক দিয়েই বাঁধা। গুপ্ত পুলিশের লোক তাঁর কাছে অতি নিয়মিত আসতেই থাকত। বিপ্লবীদের জাগরণে ভীত হয়ে জার এই গুপ্ত বাহিনী স্থাপন করেছিল রাজ্যের সমস্ত খবর খতিয়ে দেখার জন্য। তাদের নজর থেকে কোন সাংবাদিকের ধাঁধাঁময় সংবাদ, কোন গোপন বার্তা দেয়া কবিতা- কোনকিছুই রেহাই পেত না। আর এর প্রধান কাউন্ট অ্যালেক্সান্ডার বেঙ্কেন্ডরফ স্বয়ং পুশকিনের তদারকি করতেন! কেজিবি চীফের সাথে সাক্ষাতের কথা কল্পনা করলেই সেই অবস্থাটা বোঝা যায়।

পুশকিন যখন অল্প সংখ্যক শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে গদুনভ পড়ছিলেন, বেঙ্কেন্ডরফ সেটার খবর পেয়ে কবির হাত-পা যেন বেঁধে ফেললেন, কারণ জারকে না দেখানো পর্যন্ত কবি অবশ্যই এটা পড়তে পারবেন না! এবং বেঙ্কেন্ডরফ মনে করল এই নাটকের বিস্তারিত কাটছাঁট এর দরকার। জার মনে করতেন এই নাটকের কিছু কিছু কথা সেই বিপ্লবীদেরই আকাঙ্খার প্রতিদ্ধনি।

পুশকিনের জীবদ্দশায় তাঁর বিপুল রচনার মাত্র ১০ ভাগ আলোর মুখ দেখে। বাকীগুলো জানা যায় তাঁর রেখে যাওয়া কাগজপত্র থেকে, যা এখন অতি পাহারার মাধ্যমে সংরক্ষিত। এক সময়ে যেখানে এই নগরীর প্রাচীন কাস্টম হাউজের ভল্টের ধাতব দরজার পিছনে যেখানে একসময় স্বর্ণের চালান রাখা হতো, এখন এর নাম পুশকিন হাউজ, যেখানে রাশান ভাষার বিশেষজ্ঞরা কাজ করে যাচ্ছেন নব নব তথ্যের সন্ধানে। এখন তাদের যাত্রা পুস্কিন রচনাবলীর টিকা-টিপ্পনীসহ সংস্করণ প্রকাশ করার দিকে। তবে রাশিয়ার বর্তমানে নাজুক অর্থনীতিতে সেটা কতদিনে আলোর মুখ দেখবে তা বলা মুস্কিল।

লেখা- মাইক এডওয়ার্ডস
( ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে ১৯৯২র সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত )

( চলবে, পরের পর্বে সমাপ্ত। )


মন্তব্য

স্পর্শ এর ছবি

এক সাথে পড়ে ফেললাম দুই পর্ব। পুশকিন এর নাম শুনলেও তার বর্ণাঢ্য জীবন এবং কর্ম সম্পর্কে ধারনা ছিল না। লেখার এ পর্যন্ত পড়ে মনে হচ্ছে, পুশকিনের প্রকৃতস্বাদ পেতে রাশান না জানলে চলবে না। মাত্র ৩৭ বছরেই কত কিছু করে গেছেন কবি! ৩৭ থেকে নিজের বয়সটা বিয়োগ দিয়ে আরেকটি বিষন্নতার রশদ পেলাম। এর আগে গণিতবিদ গ্যালোয়ার কথা জানতাম যে কম বয়সে ডুয়েল লড়তে গিয়ে মরেছিলেন। পুশকিনের কথাটা জানতাম না। ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

তারেক অণু এর ছবি

হ, পাকনা জিনিয়াস! সব কিছু কইরা ফালাইছে, প্রেমিকার সংখ্যাও বাড়ায়ে গেছে এত এত মাস্টারপিস লেখার ফাঁকে ফাঁকে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।