কর্মস্পৃহা স্তিমিত করার গল্প, মূল: হাইনরিখ ব্যোল, জার্মান থেকে অনুবাদ: তীরন্দাজ

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: বুধ, ১৪/১১/২০০৭ - ৪:৫৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ইউরোপের পশ্চিম উপকূলের কোন এক বন্দরে এক ছেড়া পোষাক পড়া লোক তার জেলেনৌকায় বসে ঝিমোচ্ছিল। কাছাকাছিই এক ফিটফাট পোষাকের ট্যুরিস্ট তার ক্যামেরায় একটি রঙ্গিন ফিল্ম ঢুকিয়ে নৈস্বর্গিক ছবি তোলার জন্যে তৈরী হচ্ছিল। ছবির দৃশ্যগুলো এরকম হতে পারে: নীল আকাশ, সবুজ সাগর আর তার ফেনিল ঢেউ, কালো নৌকা, জেলেদের লাল টুপি, ক্লিক! তারপর আবার ক্লিক! জানা কথা, ভাল জিনিস তিনবার হওয়া জরুরী, তাই আরেকবার ক্লিক! কর্কশ, প্রায় শত্রুর মতো বিরক্তিকর আওয়াজে ঝিমুনি বন্ধ হয়ে গেল জেলের, ঝিমোনোর মাঝেই সোজা হলো, ঝিমোতে ঝিমোতেই তার সিগারেটের প্যাকেট খোঁজায় এদিক সেদিক হাতড়ালো। কিন্তু যা খুঁজছে, তা পাওয়ার আগেই অতি উৎসাহী ট্যুরিস্ট জেলের মুখে সিগারেট না ঢুকালেও তার নাকের ডগার সামনে একটি প্যাকেট তুলে ধরলো। চার নম্বর ক্লিক! তাতেই পূর্ন হলো ভদ্রতার চুড়ান্ত পর্ব। এই চকিত ভদ্রতার সীমাহীন প্রাচুর্যে যে দায়বোধ জন্ম নিল, তাকে হজম করার জন্যেই এক কথোপকথনের আবহ সৃষ্টি করায় প্রয়াসী হলো ট্যুরিস্ট।

‘আজ নিশ্চয়ই অনেক মাছ ধরবেন আপনি’?
জেলে না সূচক উত্তরে মাথা নাড়লো।
‘আমি শুনেছি, আজকের আবহাওয়া বেশ অনুকুল’।
জেলে হ্যা সূচক উত্তরে মাথা নাড়লো।

‘তার মানে, আজ আপনি মাছ ধরতে বেরুচ্ছেন না’!
উত্তরে জেলে আবার মাথা নাড়লো। ট্যুরিষ্টের উত্তেজনা বাড়লো আরো। এই হতশ্রী পোষাক পড়া জেলের মঙ্গলই তার একান্ত কাম্য। সুতরাং এই প্রাপ্ত সুযোগের সদব্যাবহার না করাটা তার বুকে যেন পেরেক ঠুকলো।

‘ও, আপনার শরীর খারাপ’?

ইশারাতেই কাজ হবে না বুঝে অবশেষ মুখ খুললো জেলে। ‘আমি খুব ভাল আছি’। বললো সে। ‘এর চেয়ে ভাল বোধ এর আগে কখনও করিনি’। বলেই উঠে দাঁড়ালো সে। হয়তো দেখাতে চাইল, কতোটা সুঠাম তার শরীরের গড়ন।

‘আমি অবিশ্বাস্যরকম ভাল বোধ করছি’।

ট্যুরিস্টের চেহারা আরো বেশী গোমড়া হলো প্রতিবারই এবং যে প্রশ্নটি কলজে ছিদ্র করে বেরিয়ে আসতে চাইছে, সেটি সামলাতে পারলো না।

‘তাহলে আজ নৌকো নিয়ে বেরুচ্ছেন না কেন’?

উত্তটি ছিল খুব তড়িৎ ও সংক্ষিপ্ত। ‘কারণ আজ সকালে একবার ধরেছি’।

‘অনেক মাছ পেয়েছিলেন’?

‘এতোটা ভাল যে, আজ আবার ধরতে যাবার কোন দরকার দেখছি না। চারটে গলদা চিংড়ি ও গোটা বারো ম্যাক্রেল ধরেছি আজ’।

জেলে এবার সত্যি সত্যিই ঘুম থেকে জেগেছে বলে মনে হলো। ট্যুরিস্টের অযাচিত চিন্তিত চেহারা যে তাকে ঘিরেই, তা টের পেলো। কাঁধে হালকা চাপড় দিয়ে বললো,

‘আগামীকাল ও পরশুর জন্যেও যথেষ্ট ধরেছি’।

তারপরও ট্যুরিষ্টকে আরেকটু শান্ত করার জন্যে বললো,
‘আমার কাছ থেকে একটি সিগারেট নেবেন’?
‘হ্যা, ধন্যবাদ’!

পাঁচ নম্বর ক্লিক! দুজনের মুখেই সিগারেট জললো। ট্যুরিস্ট মাথা নাড়তে নাড়তে বন্দরের বেদীতে বসলো। ক্যামেরাটা রেখে দিল পাশে, মনে হলো তার কথায় গুরুত্ব বাড়ানোর জন্যে তার দু’টো হাতই দরকার।

‘আপনার ব্যাক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই না আমি। তারপরও, ধরুন আজ যদি আপনি দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার, এমনকি চতুর্থবারের জন্যে বেরুতেন, তাহলে দুই ডজন, তিন, চার বা পাঁচ, এমনকি দশ ডজনও ম্যাক্রেল ধরতে পারতেন। চিন্তা করে দেখুন তো একবার’!

মাথা নাড়লো জেলে।

ট্যুরিস্ট থামলো না। ‘আপনি যদি, শুধুমাত্র আজই নয়, বরং আগামীকাল, আগামীপরশু, প্রতিটি অনুকুল দিনেই দু’বার, তিনবার, এমনকি তারচেয়ে আরো বেশীবার বেরুতেন, তাহলে কি হতো ভাবতে পারেন’?

জেলে আবারো ঝাঁকি দিলো মাথা।

‘এক বছরের মাঝে একটি ইন্জিন কিনতে পারতেন। দুই বছরের মাঝে আরেকটি নৌকা। দুই অথবা চার বছরে একটি ছোটখাট ট্রলারও হয়ে যেতো আপনার। দুই নৌকা ও ট্রলারে আরো অনেক বেশী মাছ ধরতে পারতেন। একসময় দুটো ট্রলারের মালিক হয়ে যেতে পারতেন। তারপর আপনি ... ।
উত্তেজনায় কথাই বন্ধ হয়ে রইল কয়েকটি মূহুর্তের জন্যে।

‘তারপর একটি কোল্ড ষ্টোরেজ তৈরী করাতে পারতেন, হয়তোবা ধোঁয়ায় মাছ শুকোনোর এক ফ্যাক্টরী, পরে আরেকটি মশলা সহ মাছ সংরক্ষনের বড় কারখানা। আপনার নিজস্ব একটি হেলিকপ্টার থাকতো, ওখান থেকে ওয়ারলেসে আপনার ট্রলারের কর্মীদের মাছের ঝাঁকের গতিবিধি জানিয়ে দিতে পারতেন। আপনি সালমন মাছ ধরার লাইসেন্স করে নিতে পারতেন, একটি মাছের রেস্তেরা খুলতে পারতেন। গলদা চিংড়ি কোন দালাল ছাড়া সরাসরি প্যরিসে রপ্তানী করতে পারতেন। এবং তারপর ... ‘।

আবারো কথা আটকে গেল ট্যুরিস্টের। মাথা নাড়তে নাড়তে নিজের ভেতরের উত্তেজনায় অবশপ্রায়, তার ভ্রমনের আনন্দ পুরো নষ্ট হবার পথে। শান্ত গড়িয়ে পড়া ঢেউ এর দিকে তাকাল, যেখানে মুক্ত মাছের দল লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। ‘এবং তারপর’। ও আবার উত্তেজনায় খেই হারালো ট্যুরিস্ট।

জেলে আস্তে চাপড় দিল তার পিঠে, যেন দম আটকে যাওয়া শিশুর পিঠে চাপড় দিয়ে সুস্থ করছে তাকে। তারপর খুব আস্তে প্রশ্ন করলো,

‘তারপর কি হতো’?
‘তারপর’! উৎফুল্ল আওয়াজে উত্তর দিল ট্যুরিস্ট। ‘তারপর আপনি শান্তিতে বন্দরে বসে সুবিশাল সমুদ্রের দিকে চোখ রেখে ঝিমোতে পারতেন’।
‘কিন্তু আমি তো এখন তা ই করছি। আমি শান্তিতে বন্দরে বসে ঝিমুচ্ছিলাম, আপনার ক্যামেরার ক্লিকই আমার শান্তি নষ্ট করলো’।

আপন মনে ভাবতে ভাবতে এবার সত্যি সত্যিই সটকে পড়লো ট্যুরিস্ট। তার সমস্ত কর্মজীবন একসময়ের অবসরের সপ্নেই গাঁথা। এবার আর দরিদ্র পোষাকের জেলের জন্যে তার একটুও সমবেদনা হলোনা, বরং হলো সামান্য হিংসা।

(এই অনুবাদটি অন্য ব্লগে দিয়েছিলাম। কেউ কেউ হয়তো পড়েছেন। যারা পড়েননি, তাদের জন্যে এখানে দিলাম।)


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

তার সমস্ত কর্মজীবন একসময়ের অবসরের সপ্নেই গাঁথা।

কথা সইত্য। মন খারাপ

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

হাসান মোরশেদ এর ছবি

এই হলো তীরু'দার অনুবাদ ।
এই অনুবাদগুলোর জন্য অপেক্ষা করছি ।
আচ্ছা,এই গল্প কি জার্মান সাহিত্যের উপদেশমুলক গল্পের একটি? এরকম গল্প যেনো সব ভাষাভাষি সাহিত্যেই ভিন্ন ভিন্ন আংগিকে লেখা হয়েছে । অল্পতে সন্তুষ্টু হও,সন্তুষ্টিতেই সুখ...

অনুবাদের ক্ষেত্রে একটা বাড়তি অনুরোধ থাকবে,ছোট্র করে লেখক পরিচিতি সম্ভব হলে ।
-----------------------------------------
'প্রিয়তম পাতাগুলো ঝরে যাবে মনে ও রাখবেনা
আমি কে ছিলাম,কি ছিলাম--কেন আমি
সংসারী না হয়ে খুব রাগ করে হয়েছি সন্ন্যাসী
হয়েছি হিরন দাহ,হয়েছি বিজন ব্যথা,হয়েছি আগুন'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

গল্পটা পড়তে গিয়ে টানছিল সামনের দিকে। শেষের দিকটা একদম আমাদের ঐ গল্পের মত। এক আলসে ছেলে শুয়ে শুয়ে ঝিমুচ্ছিল....বন্ধু এসে বলল পড়াশুনা কর, করলে এই হবি সেই হবি, শেষে বড় হয়ে খাটে শুয়ে থাকতে পারবি।.. অনুবাদ ভাল লাগল।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

ভাল লাগলো অনুবাদ। ব্যোলের 'দ্য লস্ট অনার অফ ক্যাটেরিনা ব্লুম' নামের একটা ছোট উপন্যাস পড়েছিলাম অনেক বছর আগে, পেঙ্গুইন অনুবাদ। মনে খুব দাগ কেটেছিল মনে আছে - জারমান লেখকদের নিয়ে আরো কোন রিকমেন্ডেশান থাকলে দিয়েন।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

তীরন্দাজ এর ছবি

আমার মনে হয় না, যে ব্যোল উপদেশ হিসেবে এ ধরণের গল্প লিখেছেন। তার লেখার ধারা বিচার করে যতটুকু বুঝতে পারি, তা হচ্ছে তিনি তার দৃষ্টিভঙ্গী ও চিন্তা সুচারুভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেন। বাকীটা পাঠকের বোধের উপর ছেড়ে দিতে চান। উপদেশের হলে তিনি নিজেই সে গড্ডালিকা প্রবাহের শিকার, যা তিনি প্রতিবারই সমালোচনায় বিদ্ধ করতে চান।

অনুবাদ ভাল লাগছে জেনে খুশী হলাম। লেখক পরিচিতি সামনে দেব। আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।

**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

সুমন চৌধুরী এর ছবি

ভাল্লাগলো বরাবরের মতো। আরো চাই। হাসি



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।