ছোটগল্প: নেতাই

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: বিষ্যুদ, ২২/১১/২০০৭ - ৪:০১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সমানে পাল্লা দিয়ে ছুটছে তো ছুটছেই নেতাই। সামনে আখন্দ সাহেবের বিরাট বাগানবাড়ী, তারপরেই আলিশান মাঠ একটা, সেটা কোনাকুনি পার হয়ে বাসন্তী সংসদের পাশ ধরে আরো অনেকদুর ছুটতে হবে ওকে। তার সামনে ছুটছে প্রায় তারই বয়েসী আরেকজন, যার পোশাক-আসাক, এমনকি গায়ের রংও আলাদা। এই সাতসকালে ছুটতে ছুটতে হাত-পা জমে যায় মাঝে মাঝে, পেটের ক্ষিদেটা নাড়িভুড়ি উল্টে দিতে চায় একএকসময়, তারপরেও রেহাই নেই নেতাইএর। পাহারাদার হিসেবে পেছন পেছন ছুটতেই হবে তাকে। একটু যদি পিছিয়ে পড়ে, শুনতে হয় সামনের জনের গালাগালি, তা ও যদি সময় ভালো থাকে, না হলে গালাগালির সাথে কিল, চড় কোনটাই বাদ পড়েনা। এতো ভালো পোশাক পড়া, নামী দামী স্কুলে পড়া একজনের মুখে এতো খারাপ খারাপ গালি কি করে আসে, তা একেবারেই মাথায় আসেনা নেতাইএর। নইলে গালাগালি কি নেতাই কম জানে ? বাপতো রিক্সা ড্রাইভার, মারার সময় হাত আর মুখ একসাথেই চলে সমান গতিতে। কিন্তু এই শালার মুখে যা ছোটে, তার সাথে তার বাপ আর সে, দু’জনেই একসাথে পাল্লা দিয়ে পারবে কি না সন্দেহ। এরা তো ওর নামই পাল্টে দিয়েছে। বাপ যতোই মারুক না কেনো, জন্মের পর সুন্দর একটা নাম তো দিয়েছিলো। ঘটা করে নাম রেখেছিলো রহিম। সাধারণতঃ তো বস্তির ছেলেদের নাম আইজ্জা, মইজ্জা, টুইন্না ই হয়। নামটা বাপ রহিম তো রাখলোই, সেই সাথে আবার শখ করে ডাকতো রহিম বাদশা। এ বাড়ীতে বাপ যখন তাকে দিয়ে গেলো, তখন এরা বললো, ন্যাতার মতো কি পরে আছে এই ছোকরা, নাম দেয়া হোক নেতাই। সেই থেকে নাম নেতাই ই রয়ে গেলো। কার কাছে যেনো শুনেছে, নেতাই নাকি হিন্দুদের নাম হয়। মুসলমানের ঘরে জন্ম ওর, হিন্দুদের নাম নিয়ে এখন ওকে চলতে ফিরতে হয়। এর চেয়ে বড় বেইজ্জতি আর কি হতে পারে ?

সামনের জন অর্থাৎ মেজমালিক হঠাৎ করে থেমে যাওয়াতে থামতে হলো নেতাইকেও। সেই সাথে থামলো ওর ভাবনার স্রোতগুলোও। খুশীই হলো সে। একটু দম নেয়ার সময় পাওয়া যাবে এবার। রাস্তার মোড় থেকে বেরিয়ে এলো আরো তিনজন একই বয়েসি ছেলেপিলে। হইহই করে উঠলো সামনের জনকে দেখে খুশীতে। খুব উত্তেজিত হয়ে কি সব বলাবলি করছিলো, বোঝা গেলোনা। বুঝতে হলে তো কাছে যেতে হয়। সে সাহস কি আছে তার ? একবার কাছে গিয়ে কি মারটাই না খেয়েছিলো। এবার কিন্তু একজন ওকে হাত ইশারা করে ডাকলো। ভয়ে ভয়ে কাছে এগিয়ে গেলো নেতাই।
-- তোর নাম কি রে ?
মোটামতো ছেলেটা জিগগেস করলো ওকে। ছেলেটার মাথার টেরিকাটা চুল ও গায়ে দৈত্য দানোর ছবি আঁকা কালো জামা। এধরণের দৈত্য দানো মাঝে মাঝে সে টেলিভিসনে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছে। এসব দৈত্যের মাঝে নাকি ভালো দৈত্যও আছে, গরীবদেরকে নাকি সাহায্য করে ওরা। এমন একটা ভালো দৈত্য যদি এখানে থাকতো, তাহলে তো কোন কষ্টই থাকতো না তার।
-- আমার নাম রহিম বাদশা।
ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলো নেতাই। কি জানি কেনো, নেতাই নামটা বলতে ইচ্ছে হলো না ওর।

চট করে এসে তার কানটা টেনে ধরলো তার মেজমালিক। এতো জোরে যে চোখে পানি এসে গেলো ওর। তারপরেও চটাস্ শব্দে একটা চড় এসে পড়লো তার গালে।

-- তোর নাম রহিম বাদশা হলো কবে থেকে শালা উল্লুকের বাচ্চা। তোর নাম না আমি নেতাই রেখেছি। উঠবস কর কান ধরে ! বল্ বার বার, আমার নাম নেতাই, আমার নাম নেতাই।

বাপকে গালি দেয়াতে খুব রাগ হলো ওর, তারপরেও নেতাই কথামতো কাজ করে এ যাত্রা রক্ষা পেলো। অন্যরা খুব মজা করেই এ দৃশ্য দেখছিলো। ওদেরই একজন আবার কাছে ডাকলো ওকে।
-- যা, ওই দূরের দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আয়। এক দৌড়ে যাবি আর আসবি। যদি দেরী করিস, তাহলে তোর বাপের দেয়া নামের সাথে নেতাই নামটাও ভুলিয়ে দেবো আবার।
অন্যরা সবাই হেসে উঠলো জোর আওয়াজ করে। মনে হলো এরচে’ মজার কথা কখনো শোনেনি ওরা। নেতাই ছুটলো আবার প্রাণপনে। আলিশান মাঠটা কোনাকুনি পার হয়ে বাসন্তী সংসদের পাশ ধরে ছুটলো নেতাই আবার।
মালকিন

নেতাইএর মাঝে মাঝে মনে হয় ওর ভেতরে জান নেই কোন। আর জান যদি থেকেও থাকে সেটা মানুষের কি না এ নিয়ে ভীষন সন্দেহ ওর। হয়তো কুত্তা বা বেড়ালেরটাই ওর ভেতর ঢুকানো হয়েছে। তবে নেতাইএর মনে হয় এটা বেড়ালের জানই হবে। নইলে এতোদিনে মার খেয়ে নিশ্চয়ই মরে যেতো ও। ওই তো, সেদিন পাশের বাড়ীর ওর বয়েসী একটা ছেলে সিড়ি থেকে পড়ে মারা গেলো হঠাৎ। আর সেদিন নেতাইকে সামান্য একটা ভুলের জন্যে মেজমালিক লাথি মেরে ফেলে দিলো সিড়ি থেকে। নাক মুখ দিয়ে বেশ রক্ত পড়েছিলো সত্যিই। তারপরেও পুরো বাড়ী পরিষ্কার, বাজার, দিদিমনির ফুটফরমাস, মালকিনের মোটা মোটা ঠ্যাং মালিশ, সবই সে ঠিক মতোই করতে পারলো। তাছাড়া একএকজনকে দু’দিন পরপরই জ্বরে পড়ে থাকতে দেখে সে। সে নিজে তো কোনদিন এমন করে পড়ে থাকেনি। মাঝে মাঝে গা গরম হয়েছে বটে, নাক দিয়ে সর্দিও পড়েছে, কিন্তু ওদের মতো বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়নি তাকে কোনদিনও।

বারান্দর সিড়িটা ঘসে মেজে মুছতে মুছতে এসব কথা ভাবছিলো নেতাই। হঠাৎ মালকিনের ডাক শুনে চমকে উঠলো। বালতি ছলকে কয়েক ফোটা নোংরা পানি পড়লো সিড়িতে। বিড়বিড়িয়ে গালাগালি করে সে জায়গাটা মুছেই নেতাই ছুটলো আবার মালকিনের কাছে।
-- কিরে হারামজাদা, ডাকলে সাথে সাথে আসতে পারিস না ?
দাঁত খিঁচালো মালকিন। নেতাইএর মনে হলো টেলিভিশনের সবগুলো দৈত্য দানো একসাথে এসে জমা হয়েছে মেয়েমানুষটার চেহারায়। নেতাই ভয় পেলো খুব, এবার বোধ হয় কপালে মার আছে আবার। কিন্তু দিদিমনি এসে যাওয়ায় রক্ষা পেয়ে গেলো।

-- নেতাই, আমার সাথে এক্ষুনি যেতে হবে সুমিতাদের বাসায়। দিদিমনি ব্যাস্ত হয়ে জানালো। তারপর বালতিটা দেখিয়ে বললো,
-- জলদী রেখে আয় এটা কলঘরে পরিষ্কার করে।

নেতাই খুশী হয়ে গেলো খুব। ছুটলো পড়ি কি মরি করে কলঘরের দিকে। কয়েকবারই দিদিমনির সাথে ও বাসায় গিয়েছে সে। রিক্সায় করে যাওয়া যায় ও সেখানে টুকিটাকি কেনাকাটা ছাড়া কোন কাজই করতে হয়না তাকে। বাকী সময়টা বারান্দায় বসে বসে অন্যদের খেলাধুলাও দেখা যায়। একবার একটা বল এসেছিলো পায়ের কাছে, লাথিও মেরেছিলো বলে, কেউ ধমকও দেয়নি। তাছাড়া ও বাড়ীর মালকিন তাকে একবার একটা বিস্কিটও খেতে দিয়েছিলো। সে বিস্কিটের স্বাদ তার এখনও লেগে আছে মুখে।

দিদিমনির পায়ের কাছে বসে বসে এসব কথা ভাবছিলো নেতাই। উল্টোদিক থেকে একটা রিক্সা আসছিলো টুংটাং করতে করতে। ড্রাইভারকে দূর থেকে ওর বাবার মতোই মনে হচ্ছিলো। কিন্তু কাছে আসার পর একটু হতাশ হতে হলো নেতাইকে। বাবাকে অনেকদিন দেখেনা সে। একবার বাবা ওবাড়ীতে গিয়েছিলো নেতাইএর সাথে দেখা করতে। ওরা দেয়নি। গালাগালি করে বের করে দিয়েছে। দিদিমনি এই বাড়ীতে একটিমাত্র মানুষ, যার কাছ থেকে মাঝে মাঝে ভালো ব্যাবহার পায় নেতাই। বিশেষ করে ওই লোকটা যখন আসে। দেখতে কিছুটা ষন্ডা-গুন্ডার মতো হলে কি হবে, খুব সুন্দর পোষাক-আসাক লোকটার। তাছাড়া ব্যাবহারও ভালো। নিদেনপক্ষে মেজমালিকের চেয়ে ভালোতো বটেই।

লোকটা যখন আসে, তখন কেমন যেনো তটস্থ হয়ে থাকে দিদিমনি। অনেক আগে থেকেই সাজগোজ শুরু করে দেয়। নেতাইকেও তখন সাজগোজের সময় এটা ওটা খুঁজে বের করে দিতে হয়। তবে দিদিমনির মন তখন ভালো থাকে খুব। সিনেমার গানগুলো সব গুনগুন করে একটার পর একটা গাইতে থাকে। নেতাই গানের কথাবার্তা এতশত বোঝে না, কিন্তু সুরগুলো কানের মাঝে লেগে থাকে।

লোকটা আসার পর ঘর পরিষ্কারের কথা বলে নেতাইকে মালকিনের কাছ থেকে ডেকে নেয় দিদিমনি। তারপর তাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় দরজার সামনে হাতে একটা ন্যাকড়া দিয়ে। যদি কেউ আসে, তখন যেনো দরজা মোছার ভান করে নেতাই। এই সময়গুলোতে দিদিমনির ঘরে ঢোকা তার জন্যে একেবারেই বারণ। একবার দুর থেকে ডাকছিলো মালকিন দিদিমনিকে, সেটা বলতে গিয়ে ঘরে ঢুকেছিলো সে। তখন ওদের দু’জনকে যে অবস্থায় দেখেছিলো, সেকথা মনে হলে এখনও লজ্জায় জিব কাটে নেতাই। নিজের বাবা-মাকে ও একবার এমনি অবস্থায় দেখেছিলো নেতাই। তখনতো অনেক ছোট ছিলো সে। কিন্তু তারপরেও বাবা তাকে যে মারটি দিয়েছিলো তা এখনও মনে আছে নেতাইএর। কিন্তু কি করতে পারতো ও ? এক ঘরের একটা বস্তিতে কোথায় যেতো সে তখন ? আর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলেই বা কি করতে পারতো সে ? বাবার মারের পর থেকে ঘুম ভাঙ্গলেও এই সময়গুলোতে মরার মতো পড়ে থাকতো সে চোখ কান মটকে। এভাবে পড়ে থাকাটা খুব কষ্টের হলেও বাবার মারের চেয়ে অনেক অনেক ভালো। এতোটা ভয় পেতো সে বাবাকে তখন, যে পেসাব পেলেও বাইরে যেতোনা নেতাই। একবার তো কাঁথাই ভিজিয়ে ফেলেছিলো। সেজন্যে আবার মায়ের থাপ্পড় খেতে হলো পরদিন।

সেদিন যাবার সময় লোকটা নেতাইএর দিকে রাগী রাগী চোখে তাকালেও দিদিমনি কিন্তু কিছুই বললো না তাকে। বরং পয়সা দিলো লজেন্স খাবার জন্যে। নেতাই অবশ্য সে পয়সা দিয়ে কিছুই কেনেনি। মায়ের জন্যে রেখে দিয়েছে জমা করে। মায়ের জন্যে মিষ্টি কিনবে সে। মা দু’মাস যাবৎ বিছানায় পড়ে। কি রোগ হয়েছে কে জানে ? মতি কবিরাজ তো কিছুই ধরতে পারলো না। শুধু কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়ে যায় এসে। মা রোগে ভুগে ভুগে মিষ্টি মিষ্টি করে পাগল হয়ে গেলো, বাবা একবারও কিনে দিতে পারলো না। আর মিষ্টি কিনবেইবা কি দিয়ে, দু'বেলা খাবারই জোটেনা ! সেজন্যেই তো বাবা ওকে এবাড়ীতে দিয়ে গেলো। এখানে আর কিছু না হোক, কিল চড়ের সাথে হলেও খাবারতো জোটে !

ক’দিন যাবৎই বাড়ীতে একটা উৎসব উৎসব ভাব টের পাচ্ছে নেতাই। পুরো বাড়ী পরিষ্কার করা হচ্ছে, কেনা হচ্ছে খাবার দাবার, আত্মীয় স্বজনরাও আসছে একে একে। নেতাইকেও খাটতে হচ্ছে খুব, কিন্তু তারপরেও ভালোই লাগছে ওর। তাছাড়া আত্মীয়দের কেউ কেউ ওকে কোন কাজ করিয়ে কিছু পয়সাও দিচ্ছে হাতে। সকিনা খালার কাছে জানলো, বিয়ে নাকি দিদিমনির। তারপর আবার এদিক ওদিক চেয়ে নেতাইএর কানের কাছে মুখটা এনে বললো,
-- পিরিত করল একজনের লগে, অহন বিয়া করতাসে আরেকজনরে।
নেতাই পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারলো না খালার কথা। তার চেহারার প্রশ্নবোধক চিহ্নটা পড়ে নিতে পারলো সকিনা খালা।
-- বোজস্ না। যেই সাব এতদিন আইত, তারে বিয়া না কইরা করতাসে চিটাগাং এর পয়সাওয়ালা আরেক সাবেরে।
নেতাই ঘটনাটা এতোক্ষনে বুঝতে পারলেও এর ভেতরে দোষের কি ইছে বুঝলো না। সেটাও ধরে ফেললো সকিনা খালা। তাই চেহারায় রাজ্যের একটা হতাশা ফুটিয়ে বললো,
-- বড়লোকের কারবার আমি নিজেই বুজিনা, তুই পোলাপান মানুষ, কেমনে বুজবি ? এহানে খালি টেহাপয়সার খেলা। আমাগর টেহাপয়সা নাই, বুজি ও না।

একটা কথা যে ঠিক বললো না সখিনা খালা, তা ধরতে পারলো নেতাই। সখিনা খালা গ্রামে নতুন বাড়ী করেছে, তা তো সে নিজেই বলেছে। টাকা পয়সা না থাকলে বাড়ী করে কি করে ? তার ঘরেই তো মাটিতে ঘুমোয় নেতাই। তখন তো সকিনা খালার রাজ্যের বকবকানি শুনতে হয় তাকে। খালা রান্নাঘরে কাজ করে, মাঝে মাঝে তাই লুকিয়ে এটা ওটা খেতে দেয়। বিনিময়ে রাতে গা-হাত-পা টিপে দিতে হয় তার। খালার নাক ডাকা শুরু না হওয়া পর্যন্ত নিস্তার পায় না সে। মাঝে মাঝেই আবার বারান্দায় ঘুমোতে হয় নেতাইকে। সকিনা খালা আগে থেকেই জানিয়ে রাখে ওকে। প্রথম প্রথম ভয় পেতো সে বারান্দায় ঘুমোতে, ওখানে ঘুমোনোর কারণটাও বুঝতে পারতো না। তারপর একবার মালিককে একবার সকিনা খালার ঘরে ঢুকতে দেখে যা বোঝার, বুঝে নিয়েছে সে। কিন্তু সে সময় এতোটা ভয় পেয়েছিলো নেতাই যে, এখন আর ওই দরজার দিকেই তাকানোরই সাহস পায়না । বাড়ীর অন্যান্য চাকর বাকররা মাঝে মাঝে আড়ালে আবডালে ফিসফিস করে সকিনা খালাকে নিয়ে, কিন্তু নেতাই এসবে যোগ দেয়ার সাহস পায়না একেবারেই।

বিয়েতে নেতাইকেও নাকি যেতে হবে সবার সাথে। নইলে মালকিন আর মেজমালিককে দেখবেই বা কে ? খুব খুশী নেতাই। নতুন জামাকাপড় কিনে দেয়া হয়েছে। ট্রেনের দুটো কামরা রিজার্ভ করা হয়েছে। পথে নোংরা হয়ে যেতে পারে, ভেবে পুরানো কাপড় পরেই সবার সাথে ট্রেনে উঠলো সে। মালকিন আর মেজমালিক যে কামরায় উঠলো, সেখানেই থাকতে বলা হলো তাকে ওদের দরকারী ফুট ফরমাসের জন্যে।

ট্রেন ছাড়ার সময় কি যে উত্তেজনা নেতাইএর ভেতরে ! এই প্রথম চড়লো সে, যদিও ট্রেন তাকে প্রতিদিনই দেখতে হয়েছে। রেললাইনের পাশেই তো বস্তি ওদের। সারাদিন কতো ট্রেন যে চলে তার কি ইয়ত্তা আছে ?

অনেক জানা অজানা জায়গায় থামলো ট্রেন। চারিদিকে এতো লোকজন, এতো হট্টগোল, এতো আওয়াজ দেখেনি কখনো নেতাই। একজনের পর একজন হকার আসছে, একটার চেয়েও আরেকটা লোভনীয় খাবার দাবার দিয়ে। অনেক কিছুই কেনা হলো, নেতাইও ভাগ পেলো। । এমনকি মালকিন আর মেজমালিক পর্যন্ত আজ ভালো ব্যাবহার করছে ওর সাথে। নেতাই খুশী হলো, অবাকও হলো। এমন ব্যাবহার যদি ওরা ওর সাথে সবসময় করতো, তাহলে নেতাইএর কি কোন কষ্ট থাকতো জীবনে ?

এসব ভাবতে ভাবতে কেমন করে যেনো ঘুমিয়ে পড়েছিলো নেতাই। ঘুম যখন ভাংলো, তখন দেখে অন্ধকার হয়ে এসেছে বাইরে। অবাক হলো মালকিন বা মেজমালিক তাকে ধমক দিলোনা ভেবে। মন খারাপও করলো এতো সুন্দর সময়টা ঘুমিয়ে নষ্ট করলো বলে। পিট্ পিট্ করে এদিক সেদিক তাকালো সে। অন্য সবার চোখেই কেমন যেনো একটা ঘুম ঘুম ভাব। নেতাইও তার চোখ বন্ধ করলো আবার। কেমন যেনো সপ্নে দেখলো বাবা ও মা কে ওর সাথে বনে থাকতে ট্রেনে।

হঠাৎ ঘটাং শব্দে থেমে গেলো ট্রেন। একজনের উপর আরেকজন ছিটকে পড়লো প্রায়। সবার চেহারাতেই চমক আর ভয়ের ছাপ। নেতাইও ভয়ার্ত চোখে তাকালো এদিক সেদিক। তার একটু আগের দেখা সপ্নের বাবা-মা ও যেনো ছিটকে পড়লো কোন এক অপরিচিত দূরত্বে। কেউ একজন বললো, ডাকাত নাকি পড়েছে। সামনের বগিগুলোতে ডাকাতি করতে করতে পেছনের দিকে আসছে। হঠাৎ দেখলো তার সামনে মেজমালিক দাঁড়িয়ে মালকিনের ঈশারায়। নেতাইকে বলছে তার কাপড় চোপড় খোলার জন্যে। নেতাই কারণ বুঝতে না পারলেও যা বলা হয়েছে তাই করলো। মেজমালিকও সবার সামনেই কাঁপতে কাঁপতে নিজের কাপড় চোপড় খুলে নেতাইএর গুলো পড়লো। তারপর গিয়ে বসলো নেতাইএর জায়গায়, মেঝের এক কোণায়। নেতাইকে ঈশারা করলো সে তার নিজের জায়গায় গিয়ে বসতে।

ধড়াম আওয়াজ করে খুলে গেলো দরজা। তিনজন মুখোশপড়া লোক ঢুকলো উদ্যত পিস্তল হাতে। বাকী যাত্রীদেরকে কোনকিছু বলতেও হলোনা। ডাকাতরা কামরায় একএকজনের কাছে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই প্রত্যেকে টাকাপয়সা ও যা কিছু দামী জিনিসপত্র আছে, ওদের ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলো কাঁপতে কাঁপতে। তারপরেও যা কিছু বাকী রইলো, সেগুলো ছিনিয়ে নিলো ডাকাতরা নিজেই। কাউকে কাউকে মারও দিলো বেড়ধক। নেতাইএর কাছে এসে তার পকেট থেকে ছিনিয়ে নিলো মেজমালিকের মানিব্যাগ। সবশেষে একজনের নজর পড়লো মেঝেতে বসে থাকা মেজমালিকের উপর। এগিয়ে গেলো সে তার দিকে। বাকী দু’জনও অনুসরণ করলো তাকে। একজন উঠে দাঁড়াতে বললো তাকে। মেজমালিক কাঁপতে কাঁপতে তাই করলো। তার চেহারায় অন্তহীন ভয়ের ছাপ। মনে হলো যেনো ফিট হয়ে পড়বে এই মূহুর্তেই। ডাকাতদের একজন তার দিকে তাকিয়ে হাসলো বিশ্রীভাবে,
-- যা কাপড় পড়েছে এই শালা, ওর কাছে আর কি থাকবে ? চল অন্য কামরায় যাই।
কারো কাছে যে কিছু না ও থাকতে পারে, সেটা ভেবেই যেনো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো আরেকজন ডাকাত। পিস্তলটা পকেটে রেখে চুল টেনে ধরলো মেজমালিকের। মুখের কাছে মুখটা নিয়ে বললো,
-- এই, তোর নাম কি রে হারামজাদা ?
ভয়ে সাদা হয়ে গেলো মেজমালিকের চেহারা। গোলাকার হয়ে গেলো চোখের মনি দুটো। ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইলো চোখের গর্ত থেকে।
-- কিরে, নাম বল ! বলছিস না কেনো হারামজাদা ? দাঁত খিঁচিয়ে ধমক দিলো আরেকজন।
-- আমার .... আমার নাম রহিম বাদশা।
-- কি বলছিস ? বসে আছিস্ ন্যাতা পড়ে একটা। আর নাম বলছিস রহিম বাদশা। এখন থেকে তোর নাম হবে নেতাই। বুঝলি শালা, এখন থেকে তোর নাম হবে নেতাই।
-- হ্যা, আমার নাম নেতাই। বলতে বলতে চোখের মনিদুটো যেনো উধাও হয়ে গেলো মেজমালিকের চোখের গর্ত থেকে।
থুক করে একদলা থুতু ফেললো একজন মেঝেতে।
-- এভাবে হবে না শালা। এত সহজে ছাড়বো না তোকে। নাক খত দে মেঝেতে। তারপর বল, আমার নাম নেতাই, আমার নাম নেতাই।
মেজমালিক সে থুতুর উপর নাক খত দিলো। প্রথমে বিড় বিড় করে, তারপর জোরে, আরো জোরে বলতে লাগলো,
নেতাই, আমার নাম নেতাই। নেতাই....... নেতাই....... নেতাই....... নেতাই..... নেতাই।


মন্তব্য

শেখ জলিল এর ছবি

নেতাই বদল তো বেশ!

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

হাসান মোরশেদ এর ছবি

নিয়তির নির্মম পরিহাস হাসি!

এই গল্পটা নিশ্চয় অনুবাদ নয় ।
-----------------------------------------
ভালো নেই,ভালো থাকার কিছু নেই

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

দ্রোহী এর ছবি

চালর্স ডিকেন্স টাইপ গল্প!! বেশ লেগেছে পড়তে।


কি মাঝি? ডরাইলা?

তীরন্দাজ এর ছবি

ধন্যবাদ!

না, এটা অনুবাদ নয় হাসান মোরশেদ। নিজস্ব কারখানার মাল!
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

কনফুসিয়াস এর ছবি

বাহ!

-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

হাসিব এর ছবি

ভাল্লাগলো পড়ে । কিছু টাইপো আছে । ঠিক করে দেবেন দয়া করে ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।