হাসিকর, মূল: হাইনরিখ ব্যোল, জার্মান থেকে অনুবাদ: তীরন্দাজ

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: সোম, ২৬/১১/২০০৭ - ৭:০২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কেউ যদি আমাকে আমার পেশা কি জানতে চায়, খুবই লজ্জায় পড়ে যাই। এ প্রশ্নের উত্তরে মুখে কোন কথা যোগাতে চায় না, যদিও আমি যৌক্তিক কথার মানুষ হিসেবেই পরিচিত। আমি সেসব লোকদের হিংসা করি, যারা সরাসরি বলতে পারে, 'আমি এক রাজমিস্ত্রী, নাপিত বা ক্যাশিয়ার'। লেখকদের প্রতি আমার হিংসা, তাদের নামের সহজসাধ্যতার কারণে। এধরণের প্রতিটি পেশার ক্ষেত্রেই পরিচয় ও বড় কেন বিবরণ দিতে হয়না। কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তরে আমি বাধ্য হই বলতে, ‘আমি একজন হাসিকর’। পরপরই দ্বিতীয় প্রশ্ন, ‘এটা কি আপনার জীবিকা’? যখন দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে সত্যি বলার জন্যে ‘হ্যা’ উত্তর দিতে হয়, তখন আরো কিছু প্রশ্নের অবতারণা ঘটে । আসলে আমার হাসি দিয়েই বেশ ভালভাবেই জীবন চালাই এবং অর্থনৈতিক বিচারে বলা যেতে পারে, এ হাসির বাজারও বেশ ভাল। আমি একজন ভাল ও দক্ষ হাসিকর, এতো ভাল আর কেউই হাসতে পারে না, কেউই হাসির খুটিনাটি সুক্ষতা এর চেয়ে ভাল জানেনা। অযাচিত প্রশ্ন থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে, বহুদিন ধরে নিজেকে অভিনেতা বলে পরিচয় দিতাম। কিন্তু আমার চেহারায় ও বাচনভঙ্গীতে অভিনয়ের পরিস্ফুটন এতোই কম যে, এ পরিচয় নিজের কাছেই সত্যি বলে মনে হতো না। আমি সত্যবাদী ও সত্যটি এই যে, আমি একজন হাসিকর, ক্লাউন নই, কৌতুকঅভিনেতাও নই। আমি লোকজনকে আনন্দ দিতে পারিনা, তবে আনন্দের পটভুমিকা তৈরী করতে পারি। আমি এক রোমান সম্রাটের মতো হাসতে পারি, প্রয়োজনে হাসতে পারি এক নরম মনের ছাত্রের মতো। উনিশশো শতাব্দীর হাসিতে আমি যেমন পটু, তেমনি পটু সতেরশো শতাব্দীর হাসিতেও। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে আমি প্রতিটি শতাব্দীর, প্রতিটি সামাজিক শ্রেনীর, প্রতিটি বয়েসের হাসি হাসতে পারি। জুতোর শুখতলা লাগানো যেমন ভাবে শিখতে হয়, হাসিও আমি তেমনি শিখেছি। আমেরিকার হাসি তার বুকের মাঝে আছে, আফ্রিকার হাসির বিভিন্ন রং, সাদা, লাল, হলুদ। আমাকে পয়সা দিলে পরিচালক যেমন চাইবেন, তেমনিই হাসব।

আমি প্রায় অপরিহার্য হয়ে পড়েছি, গ্রামোফোন রেকর্ডে হাসি, টেপেও হাসি। রেডিওতে নাটকের পরিচালকদের আমার দিকে নজর খুব। আমি বিষাদের হাসি হাসি, প্রশ্রয়ের হাসি হাসি। কখনো হাসি ট্রামচালকের মতো, কখনো খাবারের দোকানের শিক্ষানবীসের মতো। কখনো সকালের হাসি, কখনো বিকেলের হাসি, কখনো বা রাতের, কখনোবা গোধুলিলগ্নের। মোদ্দা কথা হচ্ছে, যখন যেভাবে হাসা দরকার, তা আমি অবলীলায় হেসে দিই প্রতিবারই।

আমার এই পেশা যে যথেষ্ট পরিশ্রমের, আশা করি তা বোঝাতে পেরেছি। তাছাড়া আমার বিশেষ ক্ষমতায়, যাকে ‘ছোয়াঁচে হাসি’ বলে আখ্যা দেয়া যেতে পারে, ভীষন দক্ষ আমি। বিশেষ করে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেনীর কৌতুকঅভিনেতারা যখন অভিনয়ের সময় স্বাভাবিকভাবেই চুড়ান্ত সাফল্যে পৌছানোর জন্যে ভয়ে কাঁপতে থাকেন, তখনই আমাকে ছাড়া একেবারেই চলে না তাদের। আমি প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই ভেরাইটি শো গুলোতে এক কোনে চুপচাপ বসে থাকি, ও দুর্বল মূহুর্তগুলোতে আমার তথাকথিত ‘ছোঁয়াচে হাসি’ হেসে দিই। খুব মেপেঝুকে করতে হয় তা, একটু আগে বা পরে হলে পরিকল্পনা ভেস্তে যাবার সমূহ সম্ভাবনা। একেবারে সঠিক সময়ে পরিকল্পনামাফিক হাসিতে ভেঙ্গে পড়ি আমি। সমস্ত দর্শকরাও হাসির সোরগোল তোলে ও তাতেই পার পেয়ে যায় অভিনেতার চুড়ান্ত মূহুর্ত।

তারর সন্তর্পনে পোষাক পাল্টানোর ঘরে গিয়ে ওভারকোটটি পড়ি, অবশেষে কাজের ছুটি ভেবে আনন্দিত মনে বেরিয়ে পড়ি। বেশীভাগ ক্ষেত্রেই বাড়ীতে পৌঁছেই টেলিগ্রাম পাই, ‘হাসার জন্যে আপনাকে জরুরী প্রয়োজন। মঙ্গলবার রেকর্ড করা হবে’। কয়েক ঘন্টা পরেই আমাকে নিজের ক্ষমতাকেই অভিশাপ দিতে দিতে ট্রেনে চড়তে হয়।

নিশ্চয়ই সবাই বুঝতে পারবেন যে, আমি ছুটির দিনে না কোথাও বেড়াতে গেলে হাসতে খুব একটা আগ্রহী হই না। যে দুধ দোয়ায়, সে গরুকে ভুলতে পারলে খুশী হয় আর রাজমিস্ত্রী খুশী হয়, যদি সে ইট-সুড়কী ভুলতে পারে। কাঠমিস্ত্রীর বাড়ীর দরজাই সবচেয়ে ত্রুটিপূর্ণ, তার সব ড্রয়ারই টেনটুনে খুলতে হয়। ময়রা ভালবাসে টক শশার আচার, কশাই ভালোবাসে রসগোল্লা। রুটিওয়ালার রুটির চেয়ে মাংসের বেশী ঝোঁক। পেশাদার হিসেবে ষাড়ের সাথে যারা যুদ্ধ করে, অবসরে তারা পোষে কবুতর। মুষ্টিযোদ্ধারা শিশুদের নাকে রক্ত দেখলে ভয়ে সাদা হয়ে যায়। আমি নিজেও এসব ভাল টের পাই, কারণ কাজের শেষে হাসি না কখনোই। আমি একজন গম্ভীর ধরণের মানুষ ও লোকে আমাকে সেজন্যে হতাশাবাদী আখ্যা দেয়।

আমাদের বিবাহিত জীবনের প্রথমদিকে আমার স্ত্রী আমাকে প্রায়ই বলতো, ‘হাসো না একবার’! কিন্তু এতদিনে সে বুঝে নিয়েছে যে, তার এই অভিলাস পূরণের সাধ্য আমার নেই। আমি তাতেই খুশী হই, যদি আমার পরিশ্রান্ত চেহারার ছাপ, উত্তেজিত মেজাজ খুব সতর্কতার সাথে ঠান্ডা করতে পারি। অন্যদের হাসিও বিরক্ত করে আমাকে, কারন তা আমাকে আমার পেশার কথা মনে করিয়ে দেয়। এভাবেই আমরা একটা শান্তিপূর্ন, শান্ত জীবন যাপন করি, কারণ আমার স্ত্রীও হাসতে ভুলে গিয়েছে। মাঝে মাঝে ওকটু মুচকি হেসে আমার হাতে ধরা পড়ে সে, তখন আমিও মুচকি হাসি। আমরা খুব কম আওয়াজে কথা বলি, কারন ‘ভেরাইটি শো’ ও ‘রেকর্ডিং রুম’ এর শোরগোলকে ঘৃণা করি আমি।

যে মানুষ আমাকে ভাল চেনেনা, তারা আমাকে একজন তালাবন্ধ মুখের মানুষ হিসেবে ভাবে। হয়তো আমি সেরকমই, কারণ পেশার হাসির জন্যে বেশ ঘনঘনই মুখ খুলতে হয় আমার।

ভাবলেশহীন চেহারা নিয়ে জীবনের পথে চলছি আমি। মাঝে মাঝে, কদাচিৎ মৃদু হাসিকে প্রশ্রয় দিই। মাঝে মাঝে ভাবি, আমার পুরো জীবনে একবারও হেসেছি কি না। আমার মনে হয় না। আমার সহোদররা নিশ্চয়ই বলবে যে ছোটবেলা থেকেই আমি বেজারমুখো।

বিভিন্ন ধরণের হাসি আমি হাসি, অথচ আমার নিজের হাসি কেমন, এতদিনে সেটাই জানা হলোনা আমার।


মন্তব্য

মুজিব মেহদী এর ছবি

যে দুধ দোয়ায়, সে গরুকে ভুলতে পারলে খুশী হয় আর রাজমিস্ত্রী খুশী হয়, যদি সে ইট-সুড়কী ভুলতে পারে। কাঠমিস্ত্রীর বাড়ীর দরজাই সবচেয়ে ত্রুটিপূর্ণ, তার সব ড্রয়ারই টেনটুনে খুলতে হয়। ময়রা ভালবাসে টক শশার আচার, কশাই ভালোবাসে রসগোল্লা। রুটিওয়ালার রুটির চেয়ে মাংসের বেশী ঝোঁক। পেশাদার হিসেবে ষাড়ের সাথে যারা যুদ্ধ করে, অবসরে তারা পোষে কবুতর। মুষ্টিযোদ্ধারা শিশুদের নাকে রক্ত দেখলে ভয়ে সাদা হয়ে যায়।

কথাগুলোকে যে সত্য সত্য লাগছে বড়ো!
...................................................................
অসংখ্য 'নেই'-এর ভিড় ঠেলে
জ্বলজ্যান্ত 'আছে' খুঁজে পাওয়া হলো আসল ফকিরি

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী

হাসিব এর ছবি

তীরন্দাজের কাছে সাম্প্রতিক জার্মান সাহিত্য নিয়ে বিশ্লেষণধর্মি লেখা দাবি করছি । সাথে জার্মান আটপৌরে জনগণের সাহিত্য নিয়ে চিন্তাভাবনার একটা আলোকপাত । খুব বেশী দাবি হয়ে গেলো না বোধহয় ।

কর্ণজয় এর ছবি

ঝরঝরে ব্যোলের ঝিরঝিরে অনুবাদ..

হাসান মোরশেদ এর ছবি

'হাসিকর' বেশ অপ্রচলিত শব্দ ।
হাসিবের মতো আমিও বলি,জার্মান সাহিত্যের এই সময়টা কেমন? জার্মানরা এই সময়ে কি লিখছেন?

-----------------------------------------
ভালো নেই,ভালো থাকার কিছু নেই

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

তীরন্দাজ এর ছবি

অনেক কাজই বাকী রয়ে গিয়েছে। যাদের লেখাগুলো অনুবাদ করলাম, তাদের সম্পর্কে লিখবো বলে ভেবেছিলাম। সময় করে উঠতে পারিনি।

যে লেখাগুলো অনুবাদ করেছি এ অবধি, সেগুলোর মাঝে জার্মান ভাষার প্রভাব ও মুদ্রণ প্রমাদ ক'দিন পরে দেখলে নিজেরই চোখে পড়ে। সেসব ঠিক করা নিয়েও ব্যাস্ত বেশ। কাফকার একটি বড় গল্পের অনুবাদে এ সমস্যা দুর করা নিয়ে আপাতত: ব্যাস্ত বেশ। সামনের একুশের বই মেলায় একটা পরিকল্পনা রয়েছে। দ্বিতীয় একজোড়া চোখ থাকলে ভাল হতো। আপনারা কেউ আছে কি?

এসব শেষ করে বর্তমান জার্মান সাহিত্য নিয়ে ভাবার সময় বের করতে পারবো।

আপনাদেরকে অশেষ ধন্যবাদ।

**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

তীরন্দাজ এর ছবি

'হাসিকর' এর বদলে অন্য কোন শব্দ মনে হয় কারো?

হাসিবাজ কেমন মনে হয়?

**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

হাসান মোরশেদ এর ছবি

হতেই পারে ।
-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

পুতুল এর ছবি

অনেক জার্মাম শব্দের বাংলা প্রতি শব্দ পাওয়া খুব কঠিন, অনেক সময় অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে নতুন (প্রতি)শব্দ তৈরী করে নিতে হয়। এছাড়া অন্য বিকল্প ইংরেজী শব্দ ব্যাবহার করা। আমার কাছে গল্পটা পড়ে মনে হল " কৌতুক অভিনেতা" বা (গোপাল)ভার, রসিক ইত্যাদি হতে পারে। কিন্তু এর কোনটাই মূল জার্মান শব্দের প্রতিশব্দ নয়। অনুবাদ পরের মূখে ঝাল খাওয়া হলেও পাচকের ঝামেলা প্রচুর। কিন্তু সার্ববিক ভাবে অনুবাদ ভাল হয়েছে।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

তীরন্দাজ এর ছবি

পুতুল, এ লোক যে কৌতুকঅভিনেতা বা ভাড় নন, তা তিনি বারবারই বলেছেন। আমি তাকে এই আখ্যা কি করে দিই?
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।