কিক্ (Kick): ধনী মানুষের ছেলেমেয়েদের মরণখেলা

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: শুক্র, ০৪/০৪/২০০৮ - ৭:০১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িটিএরা বয়েসে তরুণ। স্কুলে বা কলেজে পড়ে। বাকী সময়টি দলবেঁধে ঘুরে বেড়ায়। উদরপূর্তির কথা ভাবতে হয়না। পকেট খুব ভর্তি না থাকলেও একেবারে গড়ের মাঠ নয়। পড়াশোনার বাইরে এদের খেলাধুলো আনন্দফুর্তিরও অনেক জায়গা রয়েছে। কিন্তু সেখানে ওরা যেতে চায়না। সহজপ্রাপ্য আনন্দে মন ভরেনা এদের আর। অবাধ মেলামেশায় কোন বাঁধা এই সমাজে নেই বললেই চলে। সুতরাং সেক্সও সহজপ্রাপ্য আনন্দের মাঝেই পড়ে। ওরা তাই দুস্প্রাপ্য আনন্দ খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু দুস্প্রাপ্য আনন্দের সংজ্ঞা কি, স্বভাবতই জানা নেই ওদের। পার্থিব সবই তো হাতের মুঠোয়! ওরা তাই মাঝে মাঝে পাথর ছোড়ে, মাঝে মাঝে বিয়ারের বোতল। কখনও কারো বাড়ী জানলা ভাঙ্গে, কখনও কারো দোকানের শো'কেস। কিন্তু এতেও যথেষ্ট কিক্ (kick) নেই। শরীর সামান্যই গরম হয় ওতে। আরো উত্তাপ চাই ওদের। এবার নতুন খেলা। হাইওয়েগুলোর উপরে পারাপারের জন্যে যে সব সেতু রয়েছে, সেখান থেকে হাইওয়েতে চলন্ত গাড়ীর উপর ছোটবড় পাথর ছুড়ে মারা। কখনও বিয়ারের বোতল, কখনও কাঠের গুড়ি। দুর্ঘটনা ঘটে, গাড়ীর কাচ ভাঙ্গে, কিছু মানুষ আহত, গাড়ী চলাচলে চরম বিশৃঙ্খলা। এবার 'কিকে'র পরিমান সাময়িক হলেও চুড়ান্ত! রক্তের উষ্ণতাও টের পাওয়া যায় ধমনীর স্পন্দনে স্পন্দনে।

কিন্তু ওদের এই হতাশা আর আনন্দের শিকার আরো ভয়াবহও হয়ে ওঠে কখনো কখনো । কারো জন্যে এদের 'কিক' মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়, ধ্বংস হয় কোন কোন পরিবার। এক সপ্তাহ আগে ওল্ডেনবুর্গ শহরের এমনি এক সেতু থেকে ছুড়ে ফেলা কাঠের গুড়ির আঘাতে জীবন হারান দুই সন্তানের এক জননী। ছয় কেজি ওজনের গুড়িটি এসে আঘাত করে গাড়ীর সামনের কাঁচের ডানদিকে। ইস্টারের ছুটি কাটিয়ে স্বামী আর সন্তানের সাথে বাড়ী ফিরছিলেন। স্বামীর পাশেই বসেছিলেন। তারই উপর এসে পড়ে কাঠের গুড়িটি। স্বামী ও পেছনে বসা দুই শিশুসন্তানের চোখের সামনেই মৃত্যবরণ করেন মা।

পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে আততায়ীদের। সাক্ষীদের জেরা করে ফ্যন্টম ছবি তৈরী করা হয়েছে আততায়ীদের। ফ্যান্টম ছবিএলাকার শত শত কিশোর যুবক সবারই বাধ্যতামূলক ডি এন এ টেস্ট করা হচ্ছে। ধরা পড়লে এদের সর্বোচ্চ শাস্তিই প্রাপ্য, এ কথা বার বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে পুলিশ ও মিডিয়া। এ ধরণের ঘটনা ইদানীং অহরহই ঘটছে। দেড় বছর আগেও এভাবেই নিহত হয়েছে একজন। আহতের খবর প্রায়শ:ই শোনা যায়। কিন্তু যেহেতু আততায়ী একজন বা সঙ্গবদ্ধ কোন দল নয়, সেহেতু পুলিশও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। কিছু কিশোর যুবক এ ধরণের কর্মকে এক ধরণের খেলা হিসেবেই নিয়েছে।

আমাদের দেশেও হত্যাকান্ড ঘটে। কিন্তু এর পেছনে কারণ থাকে। অভাব, ঘৃণা, লোভ, ক্রোধ ইত্যাদি। কিন্তু এদের কি মোটিভ? শুধুমাত্র খেলা? খেলতে খেলতে হত্যা?

আমরা গরীব দেশের মানুষ। নিত্যদিন নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অনেকেরই। দ্রব্যমূল্যে আকাশচুম্বী। অতি সাধারণ প্রয়োজনীয় দ্রব্যটি সহজে না পেয়ে আমরা হতাশ। কেউ কেউ আছেন, যাদের এই হতাশা নেই। তাদের পান্তা ফুরোয় না, দ্রব্যমূল্যের কথা ভেবে মাথা গরম করতে হয়না তাদের। এসব সত্বেও তাদেরও ভেতরেও হতাশার অনেক কারণ রয়েছে। তাদের মাঝে মাঝে টাকা ছড়িয়েও অনেক কিছু খুঁজে না পেয়ে হতাশা। রাস্তায় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ীতে বসেও ট্রাফিক জ্যামে এগুতে না পেরে হতাশা।

এসব হতাশার অনেকগুলো কিম্ভুতকিমাকার চেহারা রয়েছে। তারপরও একটি গরীব দেশের ঘুনধরা সমাজে এই কদর্য চেহারার হতাশা সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণেই তেমন অপরিচিত মনে হয়না। আর সে কারণেই আমরা সেগুলোকে দুর না করতে পারলেও মাঝে মাঝে পাশ কাটানোর সাহসটুকু করার কথা ভাবতে পারি। সকালের হতাশাগুলো জানি বলেই সমাধান জানা না থাকলেও বিকেলের হতাশাগুলো আড়াল করে দিতে পারি।

ধনী দেশগুলোর হতাশার অনেকটাই অন্যরকম চেহারা। তাদের সামাজিক ও আর্থিক নিশ্চয়তার কারণে আমাদের মতো প্রত্যক্ষ সমস্যাগুলো নিয়ে খুব কমই ভাবতে হয় তাদের। কিন্তু এই লুকনো হতাশাজনিত সমস্যার কোন সামাধান খুজে বের করতে পারেনি মনস্তত্ববিদেরা। অজানা কারণে মাঝে মাঝেই কোন একটা হুজুগের বাতাস লাগে তরুনদের গায়ে। তাতে ভুমিকম্পের মতো কম্পিত হয় গোটা সাজানো, সুসম, পরিপাটি সামাজিক নিয়ম কানুন।

তাই মাঝে মাঝে মনে হয় আমার, কোথাও না কোথাও জানা কিছু অতৃপ্তি, জানা কিছু অপরিপূর্ণতা, কোন জানা কিছুর অভাব থাকাটা জরুরী বেশ। তখন লক্ষ্যস্থির করে একটি দিকে এগুনোর কারণ খুজে পাওয়া যায়। লক্ষহীন জীবনের যে হতাশা, যতোই পরিপূর্ণ থাকুক না কেন সব, সে হতাশা যে কোন সময়ে বিধ্বংসী আঘাত হানে নিজের ও অন্যের উপরে।


মন্তব্য

অমিত এর ছবি

a clockwork orange মুভিটার কথা মনে পড়ে গেল

অমিত এর ছবি

a clockwork orange মুভিটার কথা মনে পড়ে গেল

দিগন্ত এর ছবি

একটা ব্যাপার হল অর্থনীতিই উন্নতির একমাত্র পথ নয়, সাথে সামাজিক উন্নতিও চাই। উন্নত দেশগুলোতে সামাজিক উন্নতির দিকে তেমন একটা নজর দেওয়া হয় না।
---------------------------------
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

তীরন্দাজ এর ছবি

আমার মনে হয়না, সমস্যাটির এক সহজ ব্যখ্যা দেয়া যায়। সামাজিক শিক্ষা শিশুদেরকে খুব যত্ন করেই দেয়া হয়। কোথায় কি ভাবে চলতে হবে, কাকে কতবার ধন্যবাদ জানাতে হবে, অন্যের কাছ থেকে কিছু কেড়ে নিতে নেই, এসব ওরা ভাল করেই শেখে।

আমার মনে হয় এর সাথে অর্থনৈতিক মুক্তি ও অনেকটাই যান্ত্রিক জীবন ব্যবস্থা বেশি করে জড়িত। সমাজটাই এমনভাবে তৈরী যে, পারস্পরিক সাহায্য ছাড়াও সবাই এগিয়ে যেতে পারে। কারো প্রতি কারো নির্ভর করতে হয়না। এই নির্ভরতার প্রতিটি ক্ষেত্রই রাস্ট্রীয় সঠাম বুননে পরিপূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। তাতে একক মানুষ হিসেবে সামাজিক দ্বায়িত্ব বলতে কারো কিছুই থাকে না, যদি না কেউ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে কিছু না করেন। তাতে যে শুন্যতা ভর করে, "আমি কার জন্যে কি করছি?" সে প্রশ্নটি থেকে ধীরে ধীরে জন্ম নেই "আমি কেন আছি?" এই প্রশ্নটি। তখন নিজের আইডেন্টিটির উপর বিশ্বাস হারায় অনেকেই। আর যে মানুষের নিজের আইডেন্টিটির উপর বিশ্বাস নেই, সে মানুষ যা খুশী করতে পারে, নিদেনপক্ষে নিজের প্রতি নিজের নজর ফেরানোর জন্যে হলেও।
**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

দিগন্ত এর ছবি

গুলিয়ে গেল সব .... তার চেয়ে ভাল ব্যাখ্যা আছে। কিছু মিউট্যান্ট থাকবেই যারা এসব করে বেড়াবে।
---------------------------------
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

মানুষের জীবনে কিছুটা অভাব থাকাটা বোধহয় জরুরী।
যেটা অন্তত স্বপ্ন দেখার কিছুটা জায়গা এবং সুযোগ করে দেয়।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

স্বপ্নাহত এর ছবি

জটিল অবস্থা দেখি!!

=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=
LoVe is like heaven but it hurts like HeLL

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

অতিথি লেখক এর ছবি

সব চাহিদা পুরন হয়ে গেছে...এখন খুনাখুনির স্বাদ নিতে ইচ্ছুক।ইসস... অভাব নামক জিনিসটা থাকা আসলেও দরকার।

-নিরিবিলি

নিঘাত তিথি এর ছবি

সত্যিই কিছু অভাবের প্রয়োজন আছে। অভাবের অভাবও কি ভয়ংকর করে তুলতে পারে মানুষকে!
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

অতিথি লেখক এর ছবি

তীরন্দাজ,
আসলেই খুব ভালো বলেছেন।

তীরন্দাজ লিখেছেন:
আমার মনে হয় এর সাথে অর্থনৈতিক মুক্তি ও অনেকটাই যান্ত্রিক জীবন ব্যবস্থা বেশি করে জড়িত। সমাজটাই এমনভাবে তৈরী......

তবে একটু বললে বলা যায়,
ধরলাম এদের মধ্যে মানবিক দিকের অভাব / বৈকল্য ঘটেছে এবং যান্ত্রিকতা বেড়ে গেছে। একথা মানলে কিন্তু এটাই দাঁড়ায় যে,কোন সামাজিক অনিষ্টতা,তাদের মনন দিয়ে রুখতে না চাইলেও বা না পারলেও, আইনের(যান্ত্রিকতার অবিচ্ছেদ্দ অংগ) ভয়ে তারা রুখে যায় বা দেয় বা নিজেদেরকে কন্ট্রোল করে নেয়। সুতরাং কাউকে মেরে ফেললে আইন যে ছেড়ে কথা বলবে না এই বোধটুকু ও কিন্তু তাদের ষোল আনাই থাকার কথা। কিন্তু তাও কেন করছে? হতে পারে কিঃ
১। এগুলো কোন নেশাখোর ব্যাক্তির কাজ?
২। এগুলো পারভার্টেড টাইপের কারো কাজ?
৩। এগুলো হঠাৎ হঠাৎ ঘটা কোন কাজ? অতটা নিয়মিত নয়।
----------
তবে হ্যাঁ সাধারন উশৃংখলতা একটা আলোচ্য বস্তু হতে পারে। ওদের সাধারন উশৃংখলাতা 'র সাথে আমাদের সমাজের সাধারন উশৃংখলাতার বিস্তর ফারাক এতে কোন সন্দেহ নাই। আর এটা যে কিছুটা অভাব কমের কারনে এবং নতুন আনন্দ খোঁজার তাগিদে সেটা পরিষ্কার।

কালবেলা

তীরন্দাজ এর ছবি

১) এরা নেশা করে বটে। তবে কিশোর বা যুবক বয়েসে (১৬ র পর যদিও আইনসঙ্গত নিয়ম ১৮ বছর)মাঝে মাঝে বিয়ার টানাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

২) জানিনা, এরা পারভার্টেট কি না। কেউ কেউ বটেই। অনেকেই আনন্দচ্ছলে করে, কি ধরণের বিপদ হতে পারে তা না ভেবেই।

৩) একেবারে হঠাৎ হঠাৎ নয়। একবার শুরু হলে বেশ ক'দিন এগুলো ঘটতে থাকে। গত দু'বছরে বেশ কয়েকবার ঘটেছে।

প্রত্যকেই হয়তো ভাবে, ধরা পড়বে না। ফলাফল যে এত খারাপ হতে পারে, তা ও হয়তো ভাবে না আগে অনেকেই।

**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।