মিউনিকে হুমায়ুন আজাদের মৃত্যু ও আমার স্মৃতিচারণ

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: মঙ্গল, ১৫/০৭/২০০৮ - ৩:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১২ আগষ্ট ২০০৪ সাল। দু'দিন আগে মিউনিকে বেড়াতে এসেছে রুমানা হাশেম। রুমানা নারী অধিকারের একটি বিষয়কে ভিত্তি করে ডক্টরেট করতে এসেছে জার্মানীতে। একসময় মিউনিকে থাকত, পরে অন্য শহরে বদল করেছে। একসপ্তাহের জন্যে পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে এসে এখানে আমার বাড়ীতে উঠেছে। রুমানা আমাকে ভাইয়া বলত ও আমি ওকে নিজের বোনের মতোই স্নেহ করি।

সেদিনই সকাল আটটায় ডাক্তারের কাছে একটা এপয়েন্টম্যান্ট ছিল। সকাল সকাল উঠেই তাই বেরিয়ে পড়লাম। চেম্বারে পৌঁছোনের আগের মুহূর্তেই মোবাইল বেজে উঠলো। এখানে গাড়ী চালানো অবস্থায় মোবাইল ধরলে জরিমানা করা হয়। রাস্তার পাশে থামানোর একটা জায়গা খালি ছিল। থামিয়েই মোবাইল ধরলাম। ফোনটি এসেছে ঢাকার সংবাদ অফিস থেকে। হমায়ুন আজাদ নাকি মারা গেছেন মিউনিকে। কোন একটি সুত্রে খবরটি পেয়েছেন তারা ও মিউনিখের বাসিন্দা হিসেবে আমার সাথে যোগাযোগ করে খবরটা সন্মন্ধে নিশ্চিত হতে চান । সেই সাথে আশা করেন আরো খোঁজখবর ও ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ। ডয়েচেভেলের বাংলা অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে সাক্ষাতকার দিয়ে অতি ছোট একটা পরিচিতি তৈরী হয়েছে। সেখানে ফোন করে পেয়েছেন আমার নম্বর। সে নম্বরে ফোন করে রুমানার মাধ্যমে পেয়েছেন আমার মোবাইল নম্বর। ভীষন বড় রকমের একটা ধাক্কা লাগল নিজের ভেতরে। হমায়ুন আজাদ যে জার্মানীতে আসছেন "পেন" নামে একটা সংস্থার স্কলারশীপে, তা বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় পড়েছিলাম আমি। কিন্তু ওনি যে মিউনিকেই আসছেন, তা লেখা ছিল না। আর সে মুহূর্তে কারো জানাও ছিল না, তার মৃত্যু স্বাভাবিক না হত্যা করা হলো তাকে। নিজের ভেতরে একটা লজ্জাবোধও কাজ করছিল যে আমার শহরেই এমন একটি দূর্ঘটনা ঘটলো। কোনক্রমে এপয়েন্টম্যান্ট শেষ করে বাড়ী ফিরলাম।

বাড়ীতে ফিরে দেখি হলুস্থুল ব্যপার। ফেনের পর ফোন আসছে বাংলাদেশ ও বিভিন্ন শহর থেকে। সবারই একই প্রশ্ন। এরই মঝে রূমানা আর আর আমি পুলিশের কাছে ও যে সংস্থা হুমাযুন আজাদ কে এখানে এনেছিল, তার পরিচালককে ফোন করে মৃত্যুর খবরটি সম্পর্কে নিশ্চিত হলাম। কিন্তু তখনও আমরা পরিস্কার জানি না মৃত্যুটি স্বাভাবিক কি না। পুলিশ এ ব্যপারে আমাদের সাথে কথাই বলতে নারাজ। আর পেনের পরিচালক নিজেই ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত। বাংলাদেশ দূতাবাসে ফোন করলাম অনেকবার। জার্মান রিসেপশানিস্ট মহিলা দ্বায়িত্বশীল কারো সাথেই যোগাযোগ করিয়ে দিতে চাইলেন না। আর আমার বাড়ীতে চলছে ফেনের পর ফোন। কেউ কেউ জানতে চাইল আমাদের নম্বরটা কোন সংবাদ সংস্থার কি না। এর মাঝে এর মাঝে টেলিফোনে সাক্ষাতকার চাইল ডয়েচেভেলে ও বাংলাদেশ থেকে ই টিভি। রুমানা ও আমি মিলে মিশে যতোটা জানি, জানালাম। এরই মাঝে পুলিশকে ও পেনকে আবার ফোন করে জানা গেলো মৃত্যুর আসল বর্ননা। হমায়ুন আজাদের মিউনিখে আসার খবরটি ইচ্ছাকৃতভাবেই তার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে গোপন রাখা হয়। তার থাকার বন্দোবস্ত করা হয় ইউনিভার্সিটি এলাকা শোয়াবিং একটি এপার্টমেন্টে। তার আসার পরদিন সন্ধ্যায় একটি বারবিকিউ অনুষ্ঠানে সম্বর্ধনা দেয়ার আয়োজন ছিল। অনেক রাত পর্যন্ত চলে সে অনুষ্ঠান। তারপর তাঁকে পৌছে দেয়া হয় এপার্টমেন্টে। পরদিন তাকে মিউনিকে বৈদেশিক দপ্তরে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সে অনুযায়ী পরদিন সকালে ডাকা হয় তাকে। কিন্তু বারবার ডাকার পরও দরজা না খোলায় পুলিশ ডেকে দরজা ভাঙ্গা হয় ও মৃত আবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। পোষ্টমর্টেম করে জানা যায়, তার হৃদপিন্ডের একটি ভাল্ব বন্ধ হওয়াই তার মৃত্যুর কারণ।একটি নামী পত্রিকা (Sueddeutsche Zeitung )ও তার সাংবাদিক এর সাথে কথা বলেও নিশ্চিত হলাম আমরা। হুমায়ুন আজাদের বাড়ীতে ফোন করে সহযোগীতার আশ্বাস দিলাম। তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের কান্নায় ভীষন ভারাক্রান্ত হলো মন।

এর মাঝে বেশ কতগুলো বিষয় বিব্রত করলো খুব। সাংবাদিক হিসেবে নাম যশ কুড়োতে চান, এমন বেশ কিছু জার্মান প্রবাসী বাঙ্গালী আমাদেরকে ফোন করে, আমরা যতটা জানি- তা জেনে আরো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রকাশ করলেন বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোতে পরদিন। মিউনিক খেকে ষাট কিলোমিটার দুরে থাকেন, এমনি এক প্রবাসী নিজেকে মিউনিকের বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দিয়ে পরদিন সাক্ষাতকার দিলে ডয়েচেভেলেতে। বার্লিন প্রবাসী কবি দাউদ হায়দার জনকন্ঠে লিখলেন, বিভিন্ন জার্মান শহর থেকে প্রবাসীরা এসে ভীড় জমিয়েছেন মিউনিকে হুমায়ুন আজাদকে একনজর দেখার জন্যে। গ্যোটিঙেন থেকে একজন ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লিখলেন আজকের কাগজে।

কোন বাংলাদেশীই মিউনিকে আসেনি। কোন কোন বাঙালী বালিনে বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে গিয়ে প্রতিবাদ করবেন বলেও বাড়ী থেকেই বের হননি। এমনকি মিউনিকের বাংলাদেশীদের প্রতিক্রিয়াতেও আমি ব্যাথিত হয়েছি খুব। তাদের ভেতর কোন আগ্রহ বা কষ্টবোধ দেখিনি এমন একজন কৃতি ও মুল্যবান মানুষের অকস্মাত মৃত্যুতে। তাদের কাছে ঘটনাটি বাংলাদেশে ছোটখাট এক বন্যা বা অষ্ট্রেলিয়ার কাছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পরাজয়ের মতোই একটি স্বাভাবিক খবর। এখনকার অবস্থাও একই রকম ও তাই যখন কিছু করার কথা ভাবি, ভাবতে হয় বারবার, কাকে নিয়ে করবো? পরদিন পুলিশে ফোন করে জানলাম কোন মর্গে রাখা হয়েছে তার মরদেহ। আমরা দু'জনেই সেখানে গিয়ে দেখার অনুমতি চেয়ে ব্যার্থ হলাম। পরে বিফলমনোরথ হয়ে সেই মর্গেরই আশে পাশে ঘোরাঘুরি করলাম বিরসমুখে আমরা দু'জন। মর্গেরই কিছু ছবি তুলে পাঠালাম বাংলাদেশের সংবাদপত্রে। ছাপাও হলো সেগুলো।

এমন একটি দুঃখজনক ঘটনার মাঝেও একটা বিষয় নিয়ে রুমানা ও আমি গর্বিত। সঙ্গত কারনেই হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর স্বাভাবিকতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ বিরাজ করছিল। একজন মানুষ সুস্থ অবস্থায় ঘুমোতে গেলেন, পরদিনই মৃত। সন্দেহ আসাটাই স্বাভাবিক। অনেকের চেষ্টাও ছিল তেমন কিছু প্রমান করার। তা যদি সম্ভব হতো, তাহলে আরেকটা আন্দোলন, অরাজকতা ও হরতালের শিকার হতো প্রায় প্রতিদিনের হরতাল বিদ্ধস্ত বাংলাদেশ। আমরা সাবধানী ছিলাম ও প্রাণপনে চেষ্টা করেছি আমাদের নিজেদের জানার প্রেক্ষিতে সত্যনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ সংবাদ প্রকাশের।


মন্তব্য

পুতুল এর ছবি

মনে পড়েগেল অনেক পুড়োনো কথা!
সে সময় অনেকের রাতারাতি সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন।
দুএকজ বেশ পরিচিত মানুষের এমন লালসায় একটু ধাক্কা খেয়েছিলাম।
আমাকেও ফোন করে অনেকেই অনেক খুঁটি-নাটি জানতে চেয়েছেন।
আমি আপনার এবং রুমানার সংগৃহীত তথ্যের সাথে মোটামুটি ভালই পরিচিত ছিলাম। তো সে সব কথা তাদের বলি। পরে জেনেছি তারা সেগুলো নিজেই সংগ্রহ করেছেন দাবী সংবলিত সংবাদ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন।
সবচেয়ে খারাপলেগেছে তাদের হীনমন্যতা। আমাদের সময়ের সবচেয়ে শক্তিমান একজন মানুষকে হারানোর বেদনার চেয়ে তাদের কাছে বড়ছিল; নিজেকে সাংবাদিক বা বড় কোন আতেল হিসাবে জাহির করা।
আপনাকে অনুরোধ করব হুমায়ূন আজাদের প্রয়ানের দিনটি খুব ছোট পরিসরে হলেও স্বরণ করা। এখানে আমরা যে কজন সচল আছি তাদের মিলিত চেষ্টায়। এবং অর্গানাইজিং-এর ব্যাপারটা আপনি খুব ভাল পারেন সে জন্য আপনাকেই অনুরোধ করলাম্। ভেবে দেখবেন একটু।
রাজাকারদের হুংকারের সময় আপনার এই পোষ্টটা খুব জরুরী ছিল।
এদের পশুত্ব আরেকবার সাবধান করে দিল আমাদের।
অনেক ধন্যবাদ তীরুদা।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

তীরন্দাজ এর ছবি

আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ পুতুল!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

হাসিব এর ছবি

ঘটনা তাহলে এই !

তীরন্দাজ এর ছবি

কেমন আছেন? আপনি কি সুমনদের সাথে মিউনিখে আসছেন?
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

হাসিব এর ছবি

সুমনরা ট্রেনে চেপে বসার পর বলতে পারবো । ওরা সহিসালামতে ট্রেনে চড়ে বসলে আমি এখান থেকে রওনা দেবো । আসার পথে ভালহালা টেম্পল দেখে আসার ইচ্ছা ।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট। ব্লগের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয় এধরণের পোস্টে।



ঈশ্বরাসিদ্ধে:

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

সহমত। সেই সময়টায় ভাল-মন্দ অনেক রকম খবর শুনেছিলাম। কিছু খুবই নিচু রুচির ছিল, কিছু এতটাই অতিরঞ্জিত ছিল যে বিশ্বাস করানো যাচ্ছিল না মনকে। এই পোস্টটির জন্য অনেক ধন্যবাদ।


রাজাকার রাজা কার?
এক ভাগ তুমি আর তিন ভাগ আমার!

তীরন্দাজ এর ছবি

পর্দার বাইরে থেকেও আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা ছিল, যাতে কোন হুজুগ না ছড়ায়।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

তীরন্দাজ এর ছবি

ধন্যবাদ সুমন!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

বলতে দ্বিধা নেই, সেই সময়ে দেশের পত্র-পত্রিকার নানান ধরনের রিপোর্টিং পড়ে‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍ তাঁর মৃত্যুর কারণ বিষয়ে আমারও মনে কিছুটা সংশয় জেগেছিল।

প্রয়োজনীয় পোস্ট।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর?

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

তীরন্দাজ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

পলাশ দত্ত এর ছবি

ভালো। এবঙ ধন্যবাদ।

==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।