যাযাবর জীবনের গল্প (ছয়) – গ্রীস থেকে বেলগ্রেড

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: বুধ, ২৭/০৫/২০০৯ - ২:৩২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এবার ইউরোপের কোথাও পড়াশোনা শুরু করবো, এই উদ্দ্যেশ্যে জাহাজী জীবন ছেড়ে মাটিতে পা রাখলাম। প্রথম যাত্রাপথ, ট্রেনে চড়ে টিটোর যুগোস্লাভিয়ায়। বেলগ্রেডে কয়েকদিন কাটিয়ে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে ধর্ণা দিয়ে পড়াশোনার সুযোগ খোঁজা। বেলগ্রেডে সে সুযোগ হলেই বা ক্ষতি কি! বাংলাদেশের সাথে নিবিড় বন্ধুত্ব যুগোস্লাভিয়ার। সে বন্ধুত্বের সুত্র ধরেই দেশটির প্রতি একটি দূর্বলতাও ঘন হয়েছে ভেতরে।

সাদরুল ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নেয়া সহজ হলোনা। সাগর মহাসাগরের ঢেউকে সামনে রেখে একটি বছর একসাথে কাটিয়েছি। তার আগে আড়াই মাস ইস্তান্বুলে। জীবনযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ফেলেছি একসাথে। খারাপ সময়ের বন্ধুত্বের বাঁধন ইস্পাতের মতো শক্ত হয়। সে শক্ত বাঁধনে শাজাহান ও পান্না সহ আমাদের চারটি আত্মা যে একই তারে গাঁথা! আমাদের দেখা হবে আবার কোন এক সুন্দর সময়ের নিবিড়তার মাঝে, এই ভরসা বুকে করে বিদায় নিলাম। জাহাজী জীবন ছাড়তেও ভার হলো মন। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রথম সিঁড়িটির গাঁথুনি তো এখানেই স্থাপন করেছিলাম!

এখন পকেটে প্রায় এক হাজার পাউন্ড। আমার দশ মাসের হাড়ভাঙ্গা খাটুনীর ফসল। যে অবস্থায় দেশ ছেড়েছিলাম সে তুলনায় এখন নিজেকে রাজাও ভাবতে পারা যায়। তারপরও এই দেড় বছরে জীবনকে যে ভাবে প্রতিদিন অনুভব করেছি আর অভিজ্ঞতার ভান্ডার যতটুকু পূর্ণ করতে পেরেছি, তাতে জানি, সে টাকা যথাযত কাজে লাগাতে না পারলে তড়িঘড়ি ভিখিরি হতেও বেশী সময় লাগবে না।

ছজনের একটি কামরা। সহযাত্রী পাঁচজনের একজন হাঙ্গেরী ছেলে, বেহালা বাদক। সঙ্গীত নিয়ে পড়াশোনা করছে। আমার পাশেই বসলো ও। শুরু থেকেই বেশ আলাপ জমলো আমাদের। আমিও সঙ্গীতে আগ্রহী, সখের বসে নিজেও গান করি। সেটা জেনে আমার প্রতি আগ্রহ গেলো তার। বেহালা সাথে থাকলে হয়তো বাজানোও শুরু করতো। কিন্তু তারপরও মুখেই বিভিন্ন সুর বিচিত্র মুখভঙ্গী করে শুনিয়ে দিল মোসার্ট আর বাখের কয়েকটি সুর। আমার উল্টোদিকে বসেছে সুইডেনের একটি মেয়ে। গ্রীসে ছুটি কাটিয়ে দেশে ফিরছে। সামান্য পর সেও আগ্রহী হয়ে আমাদের সাথে আলাপে যোগ দিল। নানা গল্পে আমরা তিনজন এতো বেশী মেতে গেলাম যে, কামরার বাকী তিনজনের কথা ভাবারই কোন অবকাশ হলো না। কথা হলো বেশী হাঙ্গেরীর বরিসের সাথেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য নিয়ে খুটিনাটি অনেক কিছু জানতে চাইল। আমি যা জানি, গুছিয়ে বলার চেষ্টা করলাম। ও মনোযোগ দিয়ে শুনলো। ওর কাছ থেকেও হাঙ্গেরীর অনেক কথা শুনলাম। আর আমাদের সমস্ত আলাপের মনযোগী শ্রোতা সুইডেনের এডিথ। তিনটি আলাদা বিশ্ব, তৃতীয় বিশ্বের নব্যস্বাধীন গরীব বাংলাদেশ, পূর্ব ইউরোপের আধা সমাজতান্ত্রিক দেশ হাঙ্গেরী, আর উত্তর ইউরোপের এক ধনতান্ত্রিক দেশ সুইডেন। আমরা প্রত্যেকেই মাতৃজঠর থেকে এক প্রভাভমুক্ত বোধ নিয়েই পৃথিবীতে পা ফেললেও, ধীরে ধীরে আপন দেশ, সমাজ আর শিক্ষার ধারায় অনেকাংশেই প্রভাবিত। আমাদের চলন, বলন ও শিক্ষা আলাদা হলেও কোন এক অদৃশ্য যোগসূত্রের বন্ধন আমাদের হয়তো রয়েছে। নইলে আলাপের এতটা গভীরতায় আমরা কখনোই পা ফেলতে পারতাম না। নিজে ইউরোপের এই খোলামেলা, স্বতস্ফূর্ত জীবন ধারায় আনকোরা নতুন বলেই হয়তো কোন যোগসূত্রের সন্ধানে আতিপাতি হাতড়ে বেড়ালাম আমাদের আলাপচারিতার ফাঁকে ফাঁকেই। সে হাতড়ানোয় কোন কূল খুঁজে না পেলেও এই পরিচয়ের ভেতরে নতুন যেসব উপলব্ধি ঘিরে ধরলো আমাকে, তা আবারো সাহস হয়ে শক্তি দিল এগিয়ে চলার। সামনের পথের ভাবনা, সাদরুল ভাই এর সাথে বিচ্ছেদের বেদনা ছাড়িয়ে আমিও তরতাজা হয়ে উঠলাম আবার। নিজস্ব চারদেয়ালের পরিধি পেরিয়ে এই অপরিচিত বিশ্বের মাঝে আমার অস্তিত্ব আমার ভেতরেই শক্তিশালী হয়ে উঠলো ধীরে ধীরে।

কিন্তু রাতে ঘুমোনোর সময় ওদের চাইতে আমার পদক্ষেপ কতোটা আলাদা আর অগোছালো, তার প্রমাণ হয়ে গেলো। ওদের সবার বাক্স প্যাটরাতেই শীতের প্রস্তুতি হিসেবে কম্বল জাতীয় কিছু একটা ছিল। আমার মতো এই অদূরদর্শী পরিব্রাজকের ব্যাগে এসবের কিছুই ছিলনা। বসার সিটগুলো সামনে টেনে নিলেই যে দুজন মুখোমুখি বসা, তাদের ঘুমোনোর বেশ আরামদায়ক একটি বিছানা হয়ে যায়। একজনের পা আরেকজনের শরীর থেকে আলাদা করে রাখার জন্যে বেশ সাবধান হতে হয় বটে, কিন্তু ভ্রমনের সময় এতো কিছু ভাবে কে! আমার উল্টো দিকে বসেছিল এডিথ। রাতের শীতের প্রথম কাঁপুনিটুকু অনুভব করার সাথে সাথেই সমস্যাটি বুঝতে দেরী হলোনা ওর। ওর কম্বলের নীচেই ঘুমোনোর প্রস্তাব দিল আমাকে। নিজেকে বিশ্বের এক অস্তিত্ব হিসেবে প্রমাণের প্রয়াসে যে শক্তি জমিয়েছিলাম এতক্ষনে নিজের ভেতরে, ইউরোপীয়ান শীতে তা নি:শেষ হবার আগেই ওর সহৃদয়তার আহব্বানে সাড়া দিলাম। এক অনিন্দসুন্দরী ইউরোপীয়ান ললনার দেহের ওমে আরাম বোধ করলেও ভালো ঘুম হলোনা সারারাত। আকাশে একটু আলো দেখা দেবার পরপরই বাইরে বেরিয়ে করিডোরে গিয়ে সকালকে অভিনন্দন জানিয়ে আমার অসহয়তার খবর জানালাম।কিছু যুগোস্লাভিয়ান যুবকের সাথে আলাপ হলো। এডিথকে ঘিরে ওদের চোখের অর্থপূর্ণ হাসি বিব্রত করলেও সবাই ঘুম থেকে জাগার আগে কেবিনে ঢুকলাম না আর। যখন ঢুকলাম, তখন বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছে সবাই। চা আর কফির ব্যাবস্থা চলছে। বরিস আর এডিথ সহ সবাই সুপ্রভাত জানালো। আমিও উত্তর দিলাম। এডিথ মুচকি হেসে দুই হাতে নিজের নিতম্বের প্রস্থ মেপে আমার নিদ্রাহীন রাতের কারনটি বুঝিয়ে নিল। সেকারনেই নাকি জায়গা কম ছিল আমার। উত্তরে লাজুক হেসে জানলার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

সেদিন দুপুরে বেলগ্রেড পৌঁছে বিদায় নিল এডিথ আর বরিস। আমি আবার একা। প্রথমে হোটেল খোঁজার পালা। সারা বেলগ্রেড খুঁজেও আমার গ্রেডের কোন হোটেল পেলাম না। যখন দেখলাম দিন শেষ হয়ে রাতের আধার গ্রাস করছে বেলগ্রেডের অলিগিলি, বাধ্য হয়ে হোটেল স্লাভিজায় উঠলাম। দশ তলার একটি কামরায় স্থান হলো আমার। কোথাও কিছু একটা খেয়ে ঘুমিয়ে পরলাম সাথে সাথেই, আগামী দিনের শক্তি সঞ্চয়ের আশায়। এক রাতের জন্যে পঞ্চাশ ডলার ভাড়া দিয়ে যে খঁচখচানি জমেছিল বুকের ভেতরে, তাতে একটু দেরীতে ঘুম এলো বটে। তাতে কাল কি কি করবো, সেরকম একটি পরিকল্পনা করে ফেল্লাম।

পড়াশোনার কোন সুবিধে হবে না এখানে, সেটা একদিনেই বুঝে ফেলতে দেরী হলোনা। বাংলাদেশ দূতাবাসও তেমন কোন সহায়তার আশ্বাস দিতে পারলো না। তাই ইটালীর মিলানো যাবো বলে ঠিক করলাম। অস্ট্রিয়ানরা নাকি ভিসা সহজে দিতে চায়না, আগেই শুনেছি, মিলানো গিয়ে তাই সুইজারল্যান্ডের ভিসার চেষ্টা করবো। জার্মানী ভিসার কোন দরকার না পড়লেও অস্ট্রিয়া বা সুইজারল্যান্ড হয়ে স্থলপথে জার্মানী ঢোকার এটাই একমাত্র পথ। পরদিন সকাল সাতটায় ট্রেণ। হোটেল ছেড়ে তাই রাতেই বেলগ্রেড রেলষ্টেশনের ওয়েটিং রুমে আস্তানা গাড়লাম। পিছল একটি বেঞ্চের উপর বসে ভয়াবহ একটি রাত কাটালাম। দেয়ালে হেলান দিলে পিছলে যায় দেহ। কোথায় একরাতের স্লাভিজা হোটেল, আর কোথায় ওয়েটিং রুমের এই বেঞ্চ! আমিরি আর ফকিরির কি বিশাল ব্যাবধান!

চলবে ….

(এই কাহিনী আমার জাহাজী জীবনের গল্পের পরবর্তী পদক্ষেপের স্মৃতিনামচা)


মন্তব্য

তুলিরেখা এর ছবি

আপনার এই অপূর্ব যাযাবর লেখাগুলোর জন্য কী আঁকুপাঁকু অপেক্ষা যে করি!
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তীরন্দাজ এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ তুলিরেখা। মাঝে মাঝে ব্যাস্ততার কারণে লিখতে পারি না।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

মফিজুল হক [অতিথি] এর ছবি

চমৎকার সিরিজ। অনেকদিন পর লিখলেন মনে হয়। আমি আপনার এই সিরিজের প্রায় সব লেখাই পড়েছি। সচল নয় বলে কমেন্ট করার জটিলতার কারনে হয়ত কমেন্ট করা হয় না কিন্তু কয়েকদিন পরপর আপনার ব্লগে টু মারতে অবশ্য ভূল হয় না। হাসি

আশা করি পরের পর্ব তাড়াতাড়ি ছাড়বেন।

তীরন্দাজ এর ছবি

ধন্যবাদ ভাই। পরের পর্বও বেশ তাড়াতাড়িই ছাড়বো!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

মূলত পাঠক এর ছবি

আপনার অভিজ্ঞতার যা পরিধি দেখছি তাতে আপনার কোনো স্টাইলফাইলের তোয়াক্কা করতে হবে না কোনোদিন। এমনকি যুক্তাক্ষরবর্জিত ভাষাতে লিখলেও পড়ে মুগ্ধ হবো।

পরের পর্বের প্রতীক্ষায় রইলাম।

তীরন্দাজ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ! চুপি চুপি জানতে চাইছি! কোথাও যুক্তাক্ষরবর্জিত কিছু লিখলাম কি? বানানে নিজেরই দূর্বলতা আছে, তাই জানতে চাইলাম।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

মূলত পাঠক এর ছবি

না না, আমি বলছিলাম যদি শিশুদের জন্য সোজা করেও লেখেন তাহলেও সেটা বিষয়বস্তুর গুণেই সুখপাঠ্য হবে। হাসি

ভুতুম এর ছবি

চরম হিংসা জানাচ্ছি। আপনি তো মিয়া মহা যাযাবর! লেখেন লেখেন, অন্তত আপনার লেখা পড়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাই।

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

তীরন্দাজ এর ছবি

হিংসা কইরেন না ভাই! দুই পর মইরা যামু! তবে হিংসার জন্যেও ধন্যবাদ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

মাহবুব লীলেন এর ছবি

বহুদনি পর আবার এই সিরিজ....

তীরন্দাজ এর ছবি

আর ছোট্ট একটি পর্ব বাকী আছে। তারপরও কিছু কাটাকাটির পর পুরো লেখা পৌঁছে যাবে আপনার কাছে!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

মাহবুব লীলেন এর ছবি

পাঠিয়ে দেন
আপনার বইটাই হবে আমার অন্য কারো বইয়ে কাজ করা সর্বশেষ বই

০২

কী কারণে জানি একটা প্লান করেছিলাম যে অন্যদের একশোটা বইয়ের প্রিপ্রেসে কাজ করব আমি

সেই একশোটা পার হয়ে গেছে সেই কবেই
কিন্তু তারপরেও অন্যদের বইয়ে প্রিপ্রেসে কাজ করতে ভাল্লাগতো
মনে হতো এইটুকু করলে যদি একটা বই আরোও একটুখানি নির্ভুলভাবে বের হয় তাতে ক্ষতি কী?

আপনাকে আমি আপনার এই বইটাতে কাজ করার ইচ্ছার কথা বলেছিলাম গত বছর
তখন পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করতাম বাংলা ভাষায় নির্ভুল প্রকাশনা সম্ভব

কিন্তু এখন আমার মনে হয় যে বাংলা ভাষায় বোধহয় নির্ভুল প্রকাশনা সম্ভবই না

টেকনলজি আয়ত্ব করতে না পারা- টেকনোলজির সাথে টেকনোলজি মিশ খাওয়াতে না পারা- বাংলা ভাষার জটিল বানান পদ্ধতি আর বাংলা ভাষাটার প্রতি উদাসীনতা আর আয়ত্বহীন টেকনোলজি ব্যবহার করতে চাওয়া....

এত কিছু পার হয়ে বাংলা প্রকাশনা নির্ভুল হবে সেই আশাটা আমি আর করতে পারি না এখন...

০৩

যখন মানুষ কাগজে কলম পিষে পিষে লিখত তখন কচ্ছপের মতো ধীর গতিতে একেকটা শব্দ তৈরি করত বলে ভুল কী-তে আঙ্গুল পড়ে গিয়ে টাইপোর মতো কোনো উৎপাত আসতে পারতো না লেখায়...

লেটার প্রেসে একটা একটা করে অক্ষর বসাতো দীর্ঘদিন থেকে উল্টো অক্ষর বসিযে শব্দ তৈরি করা লোক; অনেক ভুল বানানই তার হাত গলে গিয়ে ফর্মায় বসার সুযোগ পেতো না....

একসময় আমরা একটা ভাষাতেই কথা বলার চিন্তা করতাম
তাই ভাষাটাকে নাড়াচাড়া করায়- ঠিকঠাক করায় আমাদের যেমন নজর ছিল তেমনি ছিল ইস্কুল থেকে বাড়ি পর্যন্ত অন্য সকলের নজর। তাই এক ভাষায় নাড়াচাড়া করা মানুষ যখন সেই বাংলায় লিখত তখন তার হাত দিয়ে অবলীলায় বেশিরভাগ বানানই শুদ্ধ হয়ে লেখা হয়ে যেত...

কিন্তু এখন আমরা শব্দ লিখি না; ঝড়ো-কী বোর্ডে টাইপ করি শব্দ
কথা বলতে বলতে- হাসতে হাসতে- আড্ডা দিতে দিতে টাইপ করি শব্দ আর শব্দের ফাঁকে ফাঁকে তৈরি হয়ে যায় ভুল আঙ্গুলের টাইপো

এখন প্রেসে কেউ শব্দ গেঁথে ফর্মা বানায় না; করে পেজ সেটাপ
সেই প্রেসের যন্ত্র আবার লেখকের টাইপরাইটার যন্ত্রের সাথে একই ইস্কুলে একই বানান শেখা যন্ত্র নয়
তাই সে তার মতো করে অনেক কিছুই চেঞ্জ করে দেয়; কোনো সময় দেয় ভেঙ্গে; কোনো সময় দেয় গায়েব করে আর কোনো সময় দেয় হাবিজাবি করে....

আর ইস্কুল-বাড়ি- রাস্তাঘাটে বাংলা নয় অন্য একটা ভাষা না জানার জন্য লজ্জিত হতে হয়
তাই ওই ভাষাটা না জানার জন্য লজ্জিত হতে হতে আর জানার জন্য চেষ্টা করতে করতে মাঝে মাঝেই বাংলা ভাষাটা ঠিক মতো না জানার জন্য গর্বই করে ফেলি

আমি বাংলা ভাষাটা ঠিকমতো লিখতে পারি না
কথাটা এখন অনেকের জন্যই সামাজিক মর্যাদার প্রতীক....

০৪

লেখকরা কম্পিউটার অপরেটর নির্ভরতা কাটিয়ে নিজে টাইপ করা শিখে ফেলার পর কেউ ভাবলো ভুলের পরিমাণ হয়তো কমে যাবে
কিন্তু বাংলাদেশে যেমন অঞ্চল আর সময় ভেদে টানা গাড়ি আর ঠেলাগাড়ির বিভিন্ন ধরন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটার চাকা আরেকটায় ফিট হয় না

তেমনি অবস্থা বাংলা ফন্ট আর প্রোগ্রামের
লেখক যা লেখে তা সম্পাদকের পিসিতে খোলে না
সম্পাদক যেটায় প্রিন্ট ফাইনাল করে সেটা প্রকাশকের পিসিতে গিয়ে চেহারা বদলে ফেলে

প্রকাশকের পিসিতে যেটার প্রুফ দেখা হয় সেটা গ্রাফিক ডিজাইনারের সফটওয়ারে ঢুকলে নামগোত্র ভুলে যায় সব....

বছর বিশেকের অভিজ্ঞতায় তাও একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল সবার কোথায় কোথায় মেশিন বানান এডিট করে ফেলতে পারে...

তখনই এলো ইউনিকোড; তারও ধরন বিভিন্ন; একটা আরেকটারে চেনে না; অথবা অর্ধেক চেনে তো অর্ধেক না

আর প্রকাশনায় যারা কাজ করে তারা এই ইউনিকোড বস্তুটাকেই চেনে না
আর যারা এই ইউনিকোডটা বানায় তারা প্রকাশনার ধারে দিয়ে যাবারও চিন্তা করে না

ফলে প্রকাশক যেমন বিব্রত হয় ইউনিকোড দেখে তেমনি ইউনিকোড বিব্রতহয়ে পড়ে প্রকাশনার প্রসেসে ঢুকে....আর মাঝখান থেকে বাংলা বানান আরেকবার জুতোপিটা খায় অনায়ত্ব টেকনোলজির খপ্পরে পড়ে...

০৫

কর্পোরেট প্রকাশনাগুলো বাংলা হলেও নির্ভুল থাকে
কারণ প্রতিটা প্রকাশনার পেছনেই থাকে শয়ে শয়ে মানুষের পেইড ওয়ার্কিং আওয়ার

কিন্তু একটা বইয়ের পেছনে ওয়ার্কিং আওয়ার বলতে যা তার সবটাই লেখকের আবেগভরা নির্ঘুম রাত; বন্ধুকে উৎসাহ দেবার জন্য লেখক দোস্তদের বইয়ের ভেতর থেকে দুয়েকটা কোটেশন খুঁজে বের করার মতো সামাজিক দায় আর দয়া করে প্রকাশকের পেজ সেটাপ করে দেবার মহানুভবতা....

প্রকাশনার আগে লেখক বই দেখার নামে স্বপ্ন দেখতে থাকেন বইয়ের দিগন্ত বিস্তৃত প্রচারের

লেখক দোস্তরা খুঁজতে থাকেন কোটেশন
আর প্রকাশক বুঝতে থাকেন কী করলে লেখাগুলোকে ফর্মার ভেতরে নিযে আসা যাবে

ফলে বানানের জায়গায় বানানটাই চোখে পড়ে না কারো
জিজাইনের কথাটা মাথায়ই আসে না কারো
আর এটাকে শিল্প ভাবার মতো বোকামি চিন্তাও করতে যায় না কেউ

০৬

বাংলা ভাষায় নির্ভুল প্রকাশনা হওয়া সম্ভব না আমি এখন বিশ্বাস করি
তাই প্রিপ্রেসে কাজ করার চিন্তাটাই একেবারে বাতিল করে দিয়েছি আমি

বানান নিয়েও আর মাথা ঘামাবো না; নিজের লেখায়ও না
হোক যা ইচ্ছা তা

আমি ইচ্ছা করে ভুল করলেও ভুলের পরিমাণ প্রেসের ভুল থেকে অনেক অনেক কমই হবে

তাহলে কী দরকার খামাখা এইসব বানান টানান নিয়ে মাথা নষ্ট করার?

০৭

কথাগুলো আপনাকে বলা নয় তীরু দা
কথাগুলো বলার জন্য একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজছিলাম
আপনার কমেন্টের কারণে পেয়ে গেলাম....

০৮

পাঠিয়ে দেন আপনার বইটা
এটাই হবে আমার প্রিপ্রেসের কাজ করা অন্যের সর্বশেষ বই

তীরন্দাজ এর ছবি

আমার ব্লগে যে মন খুলে বলতে পেরেছেন, এটা আমার জন্যেই আনন্দের। আমি আরেকটু ভেবে চিন্তে আপনাকে লিখবো। এখন অফিসে, এখানে টুকটাক কোন উত্তর দেয়া ছাড়া বেশী ভাবার অবকাশ থাকে না।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

s-s এর ছবি

আগেই বলেছি তারকা টারকা একদম বাকোয়াস এ ধরনের লেখায়, তারপরেও তারাদিতেই হয়, তাই পাঁচ। শ্রদ্ধেয় তীরুদা'র কাছে প্রশ্ন লেখাটা পড়ে ঠিক বুঝিনি আপনি কি সুইজারল্যাণ্ড নাকি জার্মানি কোন্ দেশে যেত চাইছিলেন পড়ার জন্য, সে সময় কোন্ দেশে যাবার দস্তুর ছিলো বাঙালিদের, মানে পুপলার চয়েস জাতীয় কিছু ছিলো কি? থাকলেও তা আপনার সিদ্ধান্তকে আদৌ প্রভাবিত করেছিলো কি?

তীরন্দাজ এর ছবি

আমাদের কোথাও ইউরোপে পড়াশেনার উদ্দ্যেশ্য ছিল। কোন বিশেষ দেশ ঠিক করা ছিল না। অনেকের কাছে নানা কথা শুনে অষ্ট্রিয়া আগেই বাদ দিয়েছিলাম। হয়তো সেটা ঠিক ছিলনা। পরে তো দেখলাম, ওখানে অনেক বাংলাদেশীই পড়াশোনা করলো। এখন অনেকেই স্থায়ী। তবে আমার নিজের '৭২ এর অলিম্পিকের পর জার্মানীর মিউনিখের প্রতিই দূর্বলতা তৈরী হয়। পরে সেখানেই যাই। পরের পর্বটি পড়লে হয়তো বিষয়টি পরিস্কার হবে আপনার।

এখনকার মতো তখনও ইংল্যান্ড, আমেরিকার দিকে বাঙ্গালীদের নজর ছিল বেশী। তর পরই হয়তো জার্মানীর স্থান। তারপর অষ্ট্রিয়া। তখন ইটালীতে তখনও আমাদের বসবাস শুরু হয়নি। এখন আমার জানামতে প্রথম দুটো দেশ ছাড়া ইটালীতেই এখন বাঙলাদেশীদের বেশী বাস।

**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

মূলত পাঠক এর ছবি

এগুলো কোন সালে ঘটেছিলো? ৭২'এর কাছাকাছি?

তীরন্দাজ এর ছবি

না। '৭৮ এ।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

অমিত এর ছবি

মানে আপনি যে বছরে ইউরোপ ভ্রমণে বের হলেন আমি সেই বছর পৃথিবী ভ্রমণ শুরু করলাম !

তীরন্দাজ এর ছবি

এক্কেবারে ঠিক বলেছেন। কোথায় পৃথিবী আর কোথায় ইউরোপ! আমার চাইতে অনেক এগিয়ে আছেন ভাই!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

মুস্তাফিজ এর ছবি

অনেকদিন পর এলেন, কেন যে আপনার মত সাহস হলোনা আমার

...........................
Every Picture Tells a Story

তীরন্দাজ এর ছবি

আপনারও অনেক সাহস! সেখানে আমি হয়তো একেবারেই নবীস!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

চলুক

তীরন্দাজ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

কীর্তিনাশা এর ছবি

তীরু'দা আপনার এই সিরিজটা আমার কাছে আরেক ওডেসি'র মতো মনে হয়। মুগ্ধ হয়ে পড়ি। পড়ার পরে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি কিছুক্ষণ আর অনুধাবন করার চেষ্টা করি কী দিনগুলোই না পার করেছেন আপনি।

আপনাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি আবারো। আপনার এই অতুলনীয় কাহিনী আমাকে জীবনের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে স্থির থাকতে সাহস জোগায়। আপনার সর্বাঙ্গীন শুভকামনা রইলো গুরু। গুরু গুরু

আর পরবর্তি পর্বগুলো যদি একটু তাড়াতাড়ি ছাড়তেন তবে আমাদের প্রতিক্ষার কষ্ট কিছুটা লাঘব হতো হাসি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

তীরন্দাজ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। সময় নিয়ে যুদ্ধ করতে হয় ভাই। আমার আমার আগ্রহও এতো বেশী বিভিন্নমুখী যে, একটা কিছুতে আটকে থাকতে পারিনা বেশীদিন! পরের পর্ব দেবো দ্রুতই।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

তানবীরা এর ছবি

হইয়া আমি দেশান্তরীইইই, দেশ বিদেশে ভিড়াই তরীইইইইইইইই, নোঙর ফেলি ঘাটে ঘাটে বন্দরে বন্দরে

কিছু বলার ভাষা নেই, পরের পর্বের অপেক্ষা ........................

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

তীরন্দাজ এর ছবি

ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

খারাপ সময়ের বন্ধুত্বের বাঁধন ইস্পাতের মতো শক্ত হয়।- সত্যি কথা।
ভালো লাগছে আবার...

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

তীরন্দাজ এর ছবি

আসলেই হয়! আপনাকে ধন্যবাদ!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

নিবিড় এর ছবি

ভাল ভাল কথাগুলো সবাই উপরে বলে ফেলল তাই শুধু বলি দেখা হবে পরের পর্বে হাসি


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

তীরন্দাজ এর ছবি

পরের পর্ব দিয়ে দিলাম!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

ভীষন রকমের ভাল লাগল তীরুদা।

খারাপ সময়ের বন্ধুত্বের বাঁধন ইস্পাতের মতো শক্ত হয়।

কথাটায় কেমন যেন থমকে গেলাম।
আসলেই সত্যি হয়?

তীরন্দাজ এর ছবি

অন্ততপক্ষে আমাদের বেলায় হয়েছিল। তবে আপনার থমকে যাওয়াটি অযৌক্তিক নয়, সেটা জানানোর জন্যে একটি কথা জানিয়ে দিলাম। আমাদের চারজনের মাঝে একজনের বন্ধুত্ব আসলেই ইস্পাতের মতো শক্ত নয়।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

শাহীন হাসান এর ছবি

সুলিখিত লেখা পড়ার অনন্দ অন্যরকম, সেটাই অনুভব করলাম...।
মাহবুব লীলেন-এর ইচ্ছাটাকে অভিনন্দন, (অবশ্য লেখক তীরন্দাজই
চূড়ান্ত করবেন বিষয়টি)।
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

তীরন্দাজ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ শাহীন। ভালো থাকবেন!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

সিরাত এর ছবি

বাহ, ভাল সিরিজ তো। সেরকম রোমান্টিক একটা লেখা আছে এরকম লেখায় ভাইয়া! পড়বো নে সামনেও।

সিরাত এর ছবি

বাহ, ভাল সিরিজ তো। সেরকম রোমান্টিক একটা ভাব আছে এরকম লেখায় ভাইয়া! পড়বো নে সামনেও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।