ফ্রান্সের পাহাড়ী নদী টার্ন ও কয়েকজন দুরন্ত অভিযাত্রী

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: শনি, ২০/০৬/২০০৯ - ৭:০৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মিউনিখ ইউনিভার্সিটির সামনে ছোট একটি ক্যাফেতে বসে অংকের একটি কঠিন বিষয় নিয়ে কসরতে কারিন আর আমি। তখন গ্রীস্মের শুরু মাত্র। আর দুসপ্তাহ পর আমাদের তিনমাসের ছুটি। সফল সেমিষ্টার শেষের প্রস্তুতি চলছে জোরেসোরে। তার সাথে ছুটির পরিকল্পনা। এসময়টাতে পরের সেমিষ্টারের খরচের জন্যে কাজ আর পাশাপাশি ছুটিতে বেড়ানোর পরিকল্পনাও চলে। একটু পরই সিগারেট ফুকতে ফুকতে টুলিও ঢুকলো। জড়িয়ে ধরে কারিনের ঠোঁটে আদরের চুমু খেয়ে বসলো আমার পাশে।

- তোমাদের অংক কেমন হচ্ছে?
- ভালো, উত্তর দিল কারিন।
- তিনটে অংক বাকী আছে আর। কালই জমা দিতে হবে, বল্লাম আমি।
- আমাকেও দিতে হবে। চলো, সবাই মিলে শেষ করে ফেলি।

ওয়েটারকে ডেকে একগ্লাস বিয়ারের অর্ডার দিল টুলিও। বিয়ারের সাথে সাথে ওর অংকের মাথাও খোলে ভালো। আমরা আমাদের কফিতেই রইলাম।

তিনজনই ঘনিষ্ট বন্ধু আমরা। ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর ক্লাশ শুরু হবার প্রথম দিনই থেকেই পরিচয় আর বন্ধুত্ব আমাদের। দু’দিন পরই টুলিও আর কারিন জুটি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কারিনের প্রতি আমারও একটি পছন্দ ছিল বটে! কিন্তু কেন জানি কোন কষ্ট হলোনা। সানন্দে ওদের ঘনিষ্ট বন্ধুই রয়ে গেলাম।

কিছুক্ষন পর মার্টিনও এলো। কিছুদিন আগে ওর সাথেও ঘনিষ্ঠতা হয়েছে আমাদের। পড়াশোনায় আমাদের চেয়ে ভালো। ব্ল্যাক ফরেষ্টের পাশে এক শহরে ওর বাবা-মা থাকেন। সেটা সোয়াবেন নামে একটি এলাকার আওতায় পড়ে। লোকজন নাকি বেশ হিসেবী আর অধ্যাবসায়ী হয় সেখানে। অধ্যাবসায়ের প্রশ্নে মার্টিনের বেলাতে কথাটি ঠিক হলেও খুব হিসেবী ও একেবারেই নয়। মার্টিনও একটি বিয়ারের অর্ডার দিল।

- এবারের ছুটিতে কি করবে? জানতে চাইলো মার্টিন।
- রোলের সাথে সিলভিও কথা হয়েছে গতকাল। এবার দলবল নিয়ে ফ্রান্সের ফ্লোরাকে যাবার পরিকল্পনা করেছে রোলে। টার্ন দীতে ভেলা বাইতে চাইছে সবাই মিলে। তোমাদেরকেও জিজ্ঞেস করতে বলেছে।

বেশ গুরুত্বের সাথে খবরটি জানালো টুলিও। সিলভিও টুলিওর বড় ভাই। আমাদের সাথে একই ক্লাশে পড়ে। অংকে আমাদের সবার চেয়ে অনেক অনেক ভালো। কিন্তু কোন এক ক্যাম্পিং প্লেসেকোন এক ক্যাম্পিং প্লেসেকাউকে কিছু বোঝাতে গেলে বিষয়বস্তুর গভীরে ঢুকে এতো বেশী কথা বলে যে, নিজেই খেই হারিয়ে ফেলে একসময়। আমাদের মাথা আরো বেশী খারাপ হয়ে যায়। রোলে আমাদের সাথে না পড়লেও টুলিও ও সিলভিওর বন্ধু হিসেবে চিনি। প্রতি ছুটিতেই অদ্ভুত সব পরিকল্পনা তার।

পরুকল্পনাটি আমাদের চারজনেরই মনে ধরলো। লিজা নামে আরেক বান্ধবী আছে। সে ও টুলিওর বোন রোমানা ও তার বন্ধু ক্রিষ্টিয়ান আগে থেকেই দলের সদস্য। ক্রিষ্টিয়ান রোলের মতোই দলে অপরিহার্য। তবে ওর দক্ষতা টেকনিক্যাল, আর রোলের দক্ষতা সাংগঠনিক বিষয়ে।

ষাটের দশকের হিপ্পিজমের হাওয়া এই আশির দশকে মিলিয়ে গেলেও তার ছাপ রেখে গেছে ইউরোপীয়ান যুবক সমাজে। কিছুটা হিপ্পিজম আর কিছুটা গতানুগতিক আমাদের পথআমাদের পথসমাজব্যবস্থার মশলা মিলিয়ে মিশিয়ে তৈরী হয়েছে আরেকটি সমাজ। আটষট্টির রুডি ডুচকের সরাসরি অনুসারী না হলেও সে ধারাটি কব্জা করে চলে অনেকেই। এরা সমাজ নিয়ে ভাবে, পরিবেশ নিয়ে ভাবে। এরা নিজেরা এই ভোগী ইউরোপীয়ান সমাজের সবরকম সুবিধা গ্রহন করলেও ওদের নীতিবাদী চিন্তার প্রভাবে পরক্ষণেই এই ভোগীবাদী সমাজেরই সমালোচনায় মুখর হতেও দ্বিধা করে না। পরিবেশের সাথে নিজেদেরকে একাত্ব করে চলতে ভালোবাসে, আবার প্রয়োজনে আপোষও করে। অনেকটা সুবিধাবাদী, তারপরও এদের সাথে সাচ্ছ্যন্দে চলা যায়। বিদেশীদের বিরুদ্ধে বিদ্ধেষ বাহ্যত এদের নেই, বরং বিদেশীদের জন্যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন উদারপন্থী নীতির প্রনয়ণে ওদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অবদান রয়েছে। বিশেষ করে আমার মতো বিদেশী, যার বাংলাদেশী গেটোভুক্ত জীবনের প্রতি পুরোপুরি অনীহা, তার জন্যে এরচেয়ে ভাল সঙ্গ আর হতো পারে না। এরা বেশীভাই এখানকার গ্রীন দল ও সোস্যালিষ্ট দলের সমর্থক যদিও রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের বেলায় ওদের অনেকেই রক্ষণশীল দলকেই যোগ্য মনে করে। হয়তো লুকিয়ে নিজের ভোটটিও দেয়। আমার বন্ধুরা মোটামুটিভাবে এই ধাঁচেরই। তবে যাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বেশী, তাদের ভেতরে এই সুবিধাবাদী চরিত্র কম বলেই এতোটা ঘনিষ্টতা সম্ভব হয়েছে।

দু’সপ্তাহ পর রওয়ানা হলাম। নিজেদের পরিবেশবাদী চিন্তার ফসল হিসেবে ফ্রান্সে তৈরী ‘সিট্রোয়ন’ গাড়ী চালায় আমার বন্ধুরা। এ গাড়ী হর্সপাওয়ার কম, দেখতে হালকা পাতলা, পরিবেশের জন্যে এতোটা ক্ষতিকর নয়, এটাই যুক্তি। পরিবেশের শুরুতেই ক্লান্তি!শুরুতেই ক্লান্তি!কথাটি যৌক্তিক হলেও সে সময়ের তথাকথিত ‘অল্টারনেটিভ’ ছাত্রসমাজের জন্যে এই গাড়ী চালানোই ‘ইন’। পোট্রোল কম লাগে বলে খরচও কম। আমার ‘ফোর্ড কাপরি’ দেখে সবাই হাহা করে উঠলো। আনিসের কাপ্রি নিয়ে একটি কবিতাও লিখে ফেললো একজন। আমার তাতে মজাই লাগলো, কারণ জানি এই বন্ধুরা আমাকে ভালোবাসে। এমন কোন অনুষ্ঠান নেই, যা আমাকে বাদ দিয়ে পালন করে ওরা। ওদের অনেকেই আমাদের গড়া সমিতি “ফ্রয়েন্ডেসক্রাইজ বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের বন্ধুচক্র”র সদস্য। সমিতির অনুষ্ঠান পালনে ওরা চাঁদা দেয়, পোষ্টার বিলি করে, চেয়ার টেবিল টেনে সাহায্য করে। আমাদের বক্তৃতা ও গানের জার্মান অনুবাদও স্টেজে শুনিয়ে দেয়।

চারটি গাড়ীতে আমরা আটজন। আমার সাথে মার্টিন। প্রতিটি গাড়ীই ভেলা বানানোর নানা সরন্জামে বোঝাই। ফ্রান্স আর সুইজারল্যান্ডের সীমান্তবর্তী শহর ফ্রাইবুর্গ থেকে আমাদের সাথে যোগ দিল আরো পাঁচজন। এদের দু’জন ছাত্র হয়েও গ্রীণদলের পক্ষ থেকে এই শহর পার্লামেন্টের সদস্য। দুপুরের খাবার সারলাম টুলিওর আরেক বোনের বাড়ীতে। আগে থেকেই দাওয়াত ছিল। বারবারই টুলিওর ভাই বোনের কথা উঠছে, তাই একটু খোলাসা করার দরকার মনে করছি। এরা সাত ভাইবোন। ইউরোপীন সমাজে সাধারনত: এতো ভাইবোন খুব কমই থাকে। টুলিওর বাবা ইটালীয়ান, মা যুগোশ্লাভিয়ায় বংশোদ্ভুত জার্মান। সব ভাইবোন বড় হয়েছে জার্মান সীমান্তবর্তী ফ্রাইবুর্গে। সীমান্তবর্তী আরেক ফরাসী শহর এলসাসে ছিল ওদের স্কুল। তাই বাড়ীতে ওদের ভাষা ফরাসী, বাইরে বন্ধুদের সাথে জার্মান। বাবার জাতীয়তার কারণে ওদের ইটালীয়ান পাসপোর্ট, যদিও সে ভাষা ওদের জানা নেই বললেই চলে। একটি সাধারণ জার্মান পরিবার হলে এতো লোককে দাওয়াত করে খাওয়ানোর কথা ভাবাই যেতো না, কিন্তু টুলিওর পরিবারের যাদেরকে চিনি, আতিথেয়তার প্রশ্নে তারা জার্মানদের থেকে অনেক আলাদা।

খাওয়া দাওয়া সেরে রওয়ানা হলাম সবাই মিলে। এবার গাড়ীর সংখ্যা ছয়। সন্ধ্যা হতে হতে ফ্রানসের অনেকটা ভেতরে ঢুকে পড়েছি ততক্ষণে। এক চাষীর ‘মারাবেল’ গাছের নীচে রাত কাটানোর জন্যে তাবু গাড়লাম। ‘মারাবেল’ অনেকটা আমাদের দেশের কুলের মতো একটি ফল। আকারে কিছুটা বড় আর ভেলার কাঠামোস্বাদেও আলাদা। গাছের নীচেও পড়ে ছিল অনেকগুলো। অনেকের সাথে সাথে আমিও খাওয়া শুরু করলাম। কিন্তু একটাতে একটি পোকা দেখেই বিকৃত করলাম চেহারা। আমারা চেহারা দেখে হেসে উঠলো আমার পরিবেশবাদী জার্মান বন্ধুদের একজন। “তুমি ভয় পাচ্ছ! আসলে পোকারই তোমার আগে ভয় পাবার কথা! তাছাড়া পোকাটির অস্তিত্ব প্রমাণ করছে যে, এখানকার ফলগাছে বিষাক্ত কীটনাশক স্প্রে করা হয়না”! তারপরও আমার আর খাবার রুচি হলো না। এভাবে রাত কাটানো আইনসঙ্গত নয়। কিন্তু এই এলাকায় জনবসতি এতোই কম যে, কেউ টের পেলোনা। স্লিপিং ব্যাগে শুয়ে রাতে ঘুম হলোনা। সকালে চা বানাতে গিয়ে দেখি, বিয়ার ও নানা ধরনের ফলের রস থাকলেও পানির বোতল একটিও নেই। চায়ের বাতিকটি বেশ কঠিন বলেই অরেন্জজুস গরম করে টি-ব্যাগ ডুবালাম। সে চায়ের কথা মনে হলে এখনো বিকৃত হয়ে যায় মুখ।

বিকেলে পৌঁছলাম টার্ন নদীর পার্শবর্তী পাহাড়ের উপর ফ্লোরাক নামের একটি শহরে। সেখান থেকে গাড়ী চালিয়ে প্রায় পাঁচশো মিটার আঁকাবাঁকা পথ নীচে নেমে একটি ক্যাম্পিং প্লেস। পাশেই বয়ে গেছে টার্ন নদী। সে ক্যাম্পিং প্লেসে রাত কাটানোর কথা স্থির হয়ে ছিল আগে থেকেই। রাতে খোলা আগুনে নানা ধরণের সসেজ পোড়ানো হলো। সাথে ফরাসী রুটি ‘বাগেট’ আর লাল ওয়াইন। রোলের পরিকল্পনায় ফ্লোরাকেই এসব যোগারযন্ত্র করা হয়েছে। ফরাসী সজেজ, বেশ ঝাল, আমার জন্যে মুখরোচক তো বটেই। পরে শুনলাম, আমার কথা ভেবেই এগুলো কিনেছে রোলে।

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে নাস্তার পরই শুরু হলো ভেলা তৈরীর কাজ। এই কর্মে অগ্রনী ক্রিষ্টিয়ান আর ফ্রাইবুর্গ থেকে দলে যোগ দেয়া ষ্টেফান। স্টেফান একটি ইলেক্ট্রিক্যাল পাম্প নিয়ে এসেছিল, যা গাড়ীর ব্যাটারী বিদ্যুতে চলে। মালবাহী ট্রাকের বড় বড় টিউব ফোলানো হলো। সেগুলোকে রশি দিনে বেঁধে সাইজে এনে ভেলার আকারে সাজানোয় হাত দিলাম আমরা সবাই। তারপর তেরপল দিয়ে পেঁচানো হলো পুরোটাকে। রশির শক্ত বাঁধনে পুরো আকৃতিটিকে মজবুত করে বেঁধে কাজ শেষ করতেই দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেলো। সবাই ঠিক করলাম, খেয়ে দেয়ে রওয়ানা হবো।

স্পাগেটি আর টম্যেটোর সস মেশানো কিমা দিয়ে সারা হলো দুপুরের খাবার। সাথে রেড ওয়াইন। রান্না করলো স্টেফানের বান্ধবী লিজা। তারপর একটু বিরতি নিয়েই দিয়ে ভেলা ভাসালাম নদীতে। মালপত্র সাজানো হলো উপরে। তেরপলে জড়িয়ে শক্ত করে বাধা হলো ভেলার সাথে। নদীর কোন কোন জায়গায় স্রোত বেশী, ওটা উল্টে গেলেও মালপত্র যাতে রক্ষা পায়, সেজন্যেই এই সাবধানতা। তবে উল্টে গেলে সামান্য আঘাত, আর শীতের কাঁপুনি ছাড়া তেমন ভয়ের কারণ নেই। যেখানে স্রোত, সেখানকার পানি সত্যিই অগভীর। আমাদের ছয়টি গাড়ী পড়ে রইল ক্যাম্পিং প্লেস এর জিম্মায়, আর আমরা তোরেজন স্রোতের অনুকুলে ভেলা ছাড়লাম। একটি কুকুর আমাদের চৌদ্দ নম্বর সঙ্গী।

বেশ ভালোই এগিয়ে চল্লাম আমরা। কয়েকটা পাথুরে স্রোতের জায়গাতে বেশ কয়েকবার লাগামছাড়া অবস্থা হলেও ডিগবাজী খেতে হলোনা একবারও। দাঁড় বাওয়া, বিপদের সময় দরকারে নদীতে লাফিয়ে নেমে ভেলাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, এসব সমস্ত ব্যাপারে ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সবাই সহযোগিতা করলো শুধুমাত্র একজন বাদে। ওর নাম ক্লাউস পেটার। ফ্রাইবুর্গ থেকে যোগ দিয়েছে দলে। ওর নড়াচড়াই এতো ধীরে ধীরে যে, জরুরী সময়ে অন্যকেই এগিয়ে এসে হাত দিতে হয়। ক্লাউস বন্য দিনের অবসরেবন্য দিনের অবসরেপেটার থেকে সহজেই ওর নাম হয়ে গেলো “ফাউল পেটার”। জার্মান ভাষায় “ফাউল” মানে অলস। তবে কিছুক্ষণ পর ক্লাউস পেটারকে ছেড়ে দিয়ে সবাই আমাকে নিয়ে ব্যাস্ত হতে বাধ্য হলো। শুনেছি, এই নদীতে অনেক মাছ। দেখতেও পেলাম কয়েকটা। একটি বড়শীও নিয়ে এসেছিলাম সাথে। সেটা ফেললাম। কিন্তু আমার বড়শী আর তার খাবার দেখলে সব মাছই উল্টোদিকে পালায়। কি জানি! বাংলাদেশীর হাতের খাবারও হয়তো এদের পছন্দ নয়। সুতরাং নতুন বুদ্ধি করতে হলো। তিনটে কাটাচামচ একটি বাঁশের ডগায় শক্ত করে বেধে বর্শা বানালাম। কয়েকবার ছুড়লামও পানিতে। মাছ তো একটিও ধরতে পারলাম না, বিপত্তিই হলো তারচেয়ে বেশী। সবাই পেটারকে ছেড়ে এবার আমাকে নিয়ে পড়লো। ভয়, যদি আমি এই বর্শা দিয়ে মাছের বদলে ভেলাটাই গাঁথি! সবার বাগড়ায় মাছ ধরায় ক্ষান্ত দিলাম। সবাই আবার পেটারকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।

সন্ধ্যা হবার সামান্য আগে নদীর পাথুরে পাড়ে একটি প্রসশ্ত জায়গা দেখে সেখানে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। পাশেই খাড়া উঁচু পাহাড়। শুকনো কাঠ জমিয়ে আগুন জ্বালিয়ে উপর থেকে ঝুলিয়ে দেয়া হলো আস্ত এক খরগোস। রোলে ক্যাম্পিং প্লেসের কাছেই একটি গ্রাম থেকে কিনে রেখেছিলো। একঘন্টা ধরে রোষ্ট করা হলো সেটি। আমরা তার চারপাশে ঘিরে হইচইয়ে ব্যাস্ত হয়ে রইলাম। মশলা বলতে শুধুমাত্র লবন আর গোলমরিচের গুড়োয় মাখানো হলেও বেশ ভালো লাগলো খরগোসের মাংশ। সাথে রুটি। সিলভিও এটাকে বিড়ালের মাংস বলে ঠাট্টা করায় একটু থমকে গেলেও খাওয়া ছাড়লাম না। খাওয়ার পালা দ্রুত শেষ হলেও রেড ওয়ান চললো গভীর রাত অবধি। স্লিপিং ব্যাগে খোলা আকাশের নীচেই রাত কাটাবে বলে ঠিক করলো ক’জন। আমিও ওদের দলে যোগ দিলাম। পাহাড়ের গা ঘেসেই একটি অপেক্ষাকৃত সমতল জায়গা বের করলাম। কিন্তু এমনি খোলা আকাশের নীচে ঘুমোনোর অভ্যাস ছিল কি কখনো? ভয়ে ঘুম হলোনা রাতে। সকালে উঠে আমার একহাত দুর দিয়েই বিশাল এক সাপ পাহাড়ের গায়ের এক গর্তে ঢুকে যেতে দেখে সে ভয় আতংকে পরিনত হলো। একজন বললো এখানে নাকি মাঝে মাঝে ভাইপার দেখা যায়। আমাকে আরো বেশী ভয় পাওয়ানোর জন্যেই হয়তো, একজন সে কথায় সমর্থনও জানালো। সবার প্রাতকর্ম শেষ করাও একটি সমস্যা বটে। একটি খুন্তি দিয়ে গর্ত খুড়ে কাজটি সেরে সে গর্ত বুজে দেয়ার সমাধান মেনে নিল সবাই। এরই মাঝে একজনের করা গর্ত অরেকজন নতুন করে খুড়েছে বলে গুজব ছড়ানো হলো। সবার মাঝে হাসির ঢেউ বইলো। সে ঢেউয়ে আমার রাতের আতঙ্ক তরল হয়ে গেলো অনেকটাই।

সকালের নাস্তা সেরে লটবহর সাজিয়ে আবার ভাসানো হলো ভেলা। প্রখর রোদের একটি দিন শুরু হলেও তখনো গরম পড়েনি তেমন। ‘নাইয়ারে’ বলে হালের দ্বায়িত্ব অনেকটা জোর করেই আমিই নিলাম। বেশ কয়েকটা স্রোত বেশ ভালোভাবেই পার সিলভিওর কাজ ও আমার ঘুম!সিলভিওর কাজ ও আমার ঘুম!করা গেলো। আমাদের ভেলার পাশাপাশি অনেকে কানু (প্লাষ্টিকের তৈরী সরু নৌকা) নিয়েও নদীতে নেমেছে। বেশীভাগ ক্ষেত্রেই একজন বা দু’জন মাত্র যাত্রী। তাদের গতি অনেক বেশী। স্রোতের গায়ে শরীর এলিয়ে তরতর এগিয়ে যায়। এসবের মাঝে আমাদের ভেলাই লোকজনের মনযোগ আকর্ষন করলো সবচেয়ে বেশী। এমন কিম্ভুতকিমাকার বাহন প্রতিদিন চোখে পড়ার কথা নয়। সেই সাথে তেরোজন যুবক যুবতী আর একটি কুকুর। অনেককেই দেখলাম হন্তদন্ত হয়ে ক্যামেরা বের করতে।

ঘন্টা পাঁচেক চললাম এভাবে। দুপাশে পাহাড়কে ভাগ করে আঁকাবাঁকা পথ করে নিয়েছে এই নদী। যেখানে পাহাড় একটু দূরে, সেখানেই জনপদ। এমনি কোন এক জনপদে আমাদের প্রতিদিনের রসদ জোগাড় হয়। তারপর আবার খানিকটা এগিয়ে কখনো পাহাড়ের ভেতরেই সুড়ঙ্গ করে নিয়েছে টার্ণ। অদ্ভুত সুন্দর এই এলাকাটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অফুরন্ত ভান্ডার। কখনো কখনো শুধুই পাহাড় আর পাথর, কোথাও শুধু সবুজের গালিচা পাতা। এমনি এক সবুজের গালিচায় রাতের আস্তানা গাড়বো বলে ঠিক হলো। ঝটপট সাজানো হলো তাবু। দুপুর আর রাতের খাবার একবারেই, সন্ধ্যার একটু আগে। আজকের মেনু চীজের ফন্ড্যু। ফরাসী খাবার। একটি পাত্রে বিশেষ ধরণের চীজ চুলোর উপর গলানো হয়। সাথে থাকে সাদা ওয়াইন। টুকরো টুকরো রুটি কাটা হয়। সে রুটি কাটাচামচে (ফন্ড্যুর জন্যে আলাদা ফর্ক থাকে, আমাদের ছিলনা) গেঁথে সেই গলানো পনিরে ডুবিয়ে খেতে হয়। সবাইকে একই পাত্র থেকে খেতে হয় বলে সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে ফন্ড্যুর মর্যাদা অনেক। যার রুটি কাটাচামচ থেকে খুলে পাত্রে হারিয়ে যায়, তাকে একচুমুক স্ন্যাপস্ (শষ্যদানা থেকে বানানো কড়া মদ) টানতে হয়। খাবার শেষ হবার পর আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে নানা গান ও হইহল্লা চললো খুব। রাতে ঘুমোনোর সময় তাবুর বাইরে থাকার সাহস হলো না আর। একটি বড় তাবুতে নিজের স্লিপিং পাহাড় আর টার্নব্যাগে নিয়ে ঢুকলাম। তারপরও ঘুম হলোনা রাতে। কারণ একটি নয় দু’টো। প্রথমত: এই তাবুতে অনেকেই ঘুমিয়েছে। কোন এক স্লিপিং ব্যাগে রাতের অন্ধকারের সুযোগে কোন এক যুগলের নিয়ন্ত্রিত, বিরামহীন শারিরীক কসরত রাতের ঘুম হারাম করে দিল। দ্বিতীয় কারণ, এক ধরণের শামুক। দেখতে জোকের মতো হলেও কামড়ানোর ক্ষমতা নেই তাদের। এই সবুজের গালিচায় তাদের অতি আরামের বাস। সেটা ছেড়ে কেনো যে ওরা তাবুর শরীর বেয়ে বেয়ে উপরে উঠে আমাদের উপরই ছিটকে পড়ে, তা বলতে পারবো না। একটি পড়তেই স্পিপিং ব্যগের চেইন টেনে লুকিয়ে রইলাম ভেতরে। কিন্তু এই দমবন্ধ অবস্থায় ঘুম সহজ কর্ম নয়!

এভাবে নয়দিন চললো আমাদের অভিযান। প্রতিদিন পাঁচ ছয় ঘন্টার মতো নদীতে ভাসা, স্রোতের সাথে যুদ্ধ করা বাকী সময়টা খোলা আকাশের নীচে আড্ডা, ঘুম, হইহই আর আনন্দ। কিন্তু আমার ঘুমের সমস্যা রয়েই গেলো। একরাতে চেষ্টা করলাম ভেলার উপর ঘুমোনোর। কিন্তু পানির উপরে ঘন জলীয়বাষ্পের স্তর থাকে। তাতে ঠান্ডা লেগে গেলো। আরেকবার স্লিপিং ব্যগের ভেতরে গড়াগড়ি দিতে দিতে পানিতেই পড়ে যাচ্ছিলাম প্রায়। সলিল সমাধি ঘটতে দেরী হতোনা!

নয়দিনে প্রায় পয়ত্রিশ কিলোমিটারের মতো ভাসলাম আমরা। শেষ হবার ঘন্টাখানেক আগে দু’জন বাসে চড়ে সে ক্যাম্পিং প্লেসে গিয়ে দু’টো গাড়ী নিয়ে এলো। দু’জন ফিরে এসে সাথে নিয়ে গেলো আরো ক’জনকে, যাতে বাকী গাড়িগুলো আনা যায়। গাড়ী চালাতে যে এতো ভালো লাগে, সেটা কে জানতো! কিন্তু বিপত্তি ঘটলো গাড়ী নিয়ে ফিরে আসার পর। ততক্ষণে অনেকটা এগিয়ে গেছে ভেলা। যাবার সময় সমতলে ছিলাম। তখন পায়ে ছিল স্যান্ডেল। এবার গাড়ী নিয়ে আমরা উঁচুতে। নদী অনেক নীচে। স্যান্ডেল পায়ে পাহাড় বেয়ে নামতে গিয়ে এমনি জায়গায় এসে আটকে রইলাম, সেখান থেকে ফেরত যাওয়া, নীচে নামা বা বেশীক্ষন ঝুলে থাকে কোনটাই সম্ভব নয়। বাকীরা জুতো পায়ে তরতর করে নেমে গেলো নীচে। টুলিও আর মার্টিন পাহাড় বেয়ে উঠলো আবার। দু’জনে দু’পাশ থেকে ধরে নামালো নীচে।

যেখানে এসে সমাপ্ত হলো আমাদের স্রোতে ভাসা, সেখানেই আরেকটি ক্যম্পিং প্লেস। সেদিনই পুরো ভেলাটি ভেঙ্গে আলাদা আলাদা করে গাড়ীতে তোলা হলো। তারপর একটি ফরাসী রেষ্টুরেন্টে সমাপ্তির আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে বেশ ভালো খাওয়া দাওয়া করলাম সবাই মিলে। পানের পরিমানও কম হলোনা। আর সেকারণেই হয়তো মিউনিখে বান্ধবীর সাথে সদ্য ছাড়াছাড়ির শোকটি উথলে উঠলো আরো বেশী। কারিন আদর করে স্বান্তনা না দিলে কি হতো কে জানে! রাতে তাবুতে না গিয়ে গাড়ীতেই ঘুমোবো বলে ঠিক করলাম। আর সে রাতেই প্রথমবারের মতো মুষলধারে বৃষ্টি এসে ভাসিয়ে দিল সব। মার্টিন তাবু ছেড়ে ছুটে এলো আমার কাছে গাড়ীতে। সারারাত বৃষ্টি আর ঝড়ের তান্ডব চললো বাইরে। সকালে দেখি প্রতিটি তাবুর ভেতরেই সবকিছু ভিজে একাকার। এবার দলছুটের পালা। যে যার মতো বাড়ীর পথে রওয়ানা হয়ে গেলো। আমার সাথে রইলো মার্টিন। অনেকদিন খরার পর বৃষ্টিতে মাটি আনন্দের সোদা গন্ধ ছড়ায় চারপাশে। আমাদের অভিযানের আনন্দ আর সে গন্ধ গায়ে মেখে আমরা সবাই বাড়ী ফেরার পধ ধরলাম।


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

অনেক আগের ছবি মনে হয়। গাড়ীর মডেল দেখেও তা আন্দাজ করি। একজন ছাড়া কারো গায়েই তো পোষাক নেই; সেটাই কি আপনি?

পড়ে ভাল্লাগলো। ভেলাটা দেখে একটু ভয় লাগছে, এই যা।

বাগেট খাওয়ার কোন বিশেষ নিয়ম আছে নাকি? একবার কিনে আর খেতে পারিনি। কী দিয়ে খায় ওটা?

তীরন্দাজ এর ছবি

অনেক আগের ঘটনা তো বটেই!
না ভাই! অল্প সল্প হলেও সবারই কিছু পোষাক ছিল। আমার গায়েও।

'বাগেট' এক ধরণের লম্বা একটি ফরাসী রুটি। ওটা না হলে ওদের চলেনা একেবারেই। এইতো, গতকাল ফ্রান্স থেকে ফিরলাম। দুসপ্তাহ ধরে বাগেট খেতে খেতে হদ্দ। ওরা অনেকসময় বিশাল কাপের কফিতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে খায়।

**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

অল্প সল্প হলেও সবারই কিছু পোষাক ছিল। আমার গায়েও।
গড়াগড়ি দিয়া হাসি
না ভাই, তা মিন করিনি, কথা প্রসঙ্গে অমন বলেছি।

তীরন্দাজ এর ছবি

আর গাড়ীগুলো তখনও পনেরো কুড়ি বছরের পুরোনো হয়ে আমাদের হাতে এসেছে। ছাত্র মানুষ! নতুন গাড়ী কেনার পয়সা পাবো কোথায়!

পোষাক দেখে আমিও সেসময় ভ্যাবাচেকা খেয়েছিলাম! এখন আর পরোয়া করি না।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

চলুক

তীরন্দাজ এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

মূলত পাঠক এর ছবি

দারুণ বেড়ালাম আপনার সাথে।

তীরন্দাজ এর ছবি

লিখতে লিখতে আমি নিজেও বেড়ালাম। অনেক আগের কথাতো, তাই! ভালো থাকবেন!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

শাহীন হাসান এর ছবি

অনেকদিন খরার পর বৃষ্টিতে মাটি আনন্দের সোদা গন্ধ ছড়ায় চারপাশে। আমাদের অভিযানের আনন্দ আর সে গন্ধ গায়ে মেখে আমরা সবাই বাড়ী ফেরার পধ ধরলাম।
.... পেছনের পথ, স্মৃতিময় সময় হাতছানিতে ডাকে?

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

তীরন্দাজ এর ছবি

ভালো আছেন শাহীন? কাল ফিরলাম।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

সাইফ এর ছবি

যেমন অসাধারণ আপনার অ্যাডভেঞ্চার, তেমনই আপনার লেখনি, মনে হল যেন, আমরাও ঘরে আসলাম ভেলায় করে আপনার সাথে টার্নে।

কোন এক স্লিপিং ব্যাগে রাতের অন্ধকারের সুযোগে কোন এক যুগলের নিয়ন্ত্রিত, বিরামহীন শারিরীক কসরত রাতের ঘুম হারাম করে দিল।

জার্মানদের মনে হয় চেচামেচি করার অভ্যাস বিশেষ সময়ে, আমার এমন একটা অভিজ্ঞতা ছিল

http://saifmanna.blogspot.com/2009/05/blog-post.html

তীরন্দাজ এর ছবি

হতে পারে! তবে ওরা কিন্তু চেচামেচি করেনি একেবারেই!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

হিমু এর ছবি
s-s এর ছবি

জ্বরের ঘোরে পড়ে আছি তীরুদা, তারপরও ভাল্লাগলো আপনার ভ্রমন্থন।

পুতুল এর ছবি

তীরুদা,
আশা করছি জার্মানের জীবন নিয়ে একটা ধারাবাহিক রচনা শুরু হল।
সেক্ষেত্রে শুরুর দিকটা আসা দরকার মনে করছি। যেমন ভর্তি, ভাষা শেখা এবং এর মাধ্যমে প্রথম বন্ধু সার্কেল তৈরী ইত্যাদি। ছাত্র জীবনে অর্থে যোগার করার কাজও কিন্তু খুব কঠিন ছিল!
দেখেন আর একটা সিরিজ হয় কিনা?

এই পর্বটা একটু বড় বলেই মনে হয় সংক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করেছেন!

**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

যাযাবর জীবন সিরিজে মাঝখানে থেমে গিয়েছিলাম, এটা রেগুলার পড়বো; এ আশা রাখি।

তানবীরা এর ছবি

তীরুদার সাথে ঘুরে এলাম ঠিক কল্পনায় যেমনি ঘুরি তেমনি

---------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।