পশুখামার (দশ), মূল: জর্জ অরওয়েল, অনুবাদ: তীরন্দাজ

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: শনি, ০৩/১১/২০১২ - ৪:০৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অষ্টম পর্ব:

হত্যাযজ্ঞে মর্মাহত বিমূঢ় ভাব কিছুটা কাটিয়ে উঠতে কয়েকদিন সময় লাগে পশুদের। কারো কারো মনে পড়ে বা মনে পড়েছে বলে বিশ্বাস করার চেষ্টা করে, ছয় নম্বর ধারাতে কী লেখা ছিল। “এক পশু কখনোই যেন অন্য পশুকে হত্যা না করে”! যদিও শুয়োরদের সামনে সেকথা বলার সাহস নেই কারো, তারপরও সবার মনে এই একটি কথাই বার বার ফিরে আসে। এই হত্যাকাণ্ড কোনো অবস্থাতেই এই ধারার সাথে মিলতে পারে না। তুলসীপাতা ধারাটি আরেকবার পড়ে দেখার জন্যে বেনজামিনকে অনূরোধ জানায়। কিন্তু বেনজামিন জানায়, এই ধরণের বিষয়ের সাথে নিজেকে জড়ানোর কোনো আগ্রহ তার নেই। মুরিয়েলকে ডাকে তুলসীপাতা। মুরিয়েল পড়ে শোনায়, “এক পশু কখনোই যেন অন্য পশুকে হত্যা না করে অকারণে”। কোনো না কোনো কারণে হয়তো শেষের শব্দটি নিজেরাই ভুলে গিয়েছে, ভাবে পশুরা। সেক্ষেত্রে ছয় নম্বর ধারা লঙ্ঘন করা হয়নি, সে কথা মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হয়। সেই সাথে তুষারবলের সহযোগী বিশ্বাসঘাতকদের মৃত্যুদণ্ডও ধারাসঙ্গত বলে মেনে নেয়।

এবছরের পুরোটা ধরে গতবছরের চাইতে কঠিন পরিশ্রম করে পশুরা। আগের চাইতে দ্বিগুণ চওড়া বাতাসকলের দেয়াল গাঁথা, সময়মত কাজ শেষ করা ও এর পাশাপাশি প্রতিদিনের রুটিন-মাফিক কৃষিকাজ। সব মিলিয়ে অস্বাভাবিক খাটুনি তাদের। মাঝে মাঝে এমনও কাটে দিন, মনে হয়, জোনসের সময়ের চাইতেও অনেক বেশি সময় ধরে কাজ ও বিনিময়ে সে সময়ের চাইতে অনেক কম খাবার পায় ওরা। প্রতি রোববারেই লম্বা এক তালিকা নিয়ে আসে চাপাবাজ। সেটি সামনের পায়ে চেপে ধরে লাইন করে লেখা বিভিন্ন সংখ্যা সবাইকে পড়ে শোনায়। বিভিন্ন ধরণের পশুখাবারের উৎপাদন শতকরা ২০০ ভাগ, ৩০০ ভাগ, ক্ষেত্র-বিশেষে ৫০০ ভাগ বেড়েছে বলে শোনায়। তাকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ খুঁজে পায় না পশুরা, কারণ বিপ্লবের আগে উৎপাদন কেমন ছিল, তার পুরোটাই স্মরণে নেই ওদের। তারপরও মাঝে মাঝে ভাবে, এসব সংখ্যার হিসেবের চাইতে মাঝে মধ্যে আরেকটু বেশি খাবার অনেক কাম্য।

সবরকম নির্দেশ আসে চাপাবাজ ও অন্য একটি শুয়োরের মাধ্যমে। নেপোলিয়ন নিজে প্রতি দুই সপ্তাহে একবার সাধারণ পশুদের সামনে দেখা দেয়। যখন সে আসে, শুধুমাত্র কুকুরের দলই নয়, আরেকটি কালো কমবয়সী মোরগও থাকে তার সাথে। মোরগটি থাকে সবার আগে বরকন্দাজের মতো। নেপোলিয়ন উঠে কিছু বলার আগে সে জোর আওয়াজে “কুক্কুরুকু” ডেকে মনোযোগ আকর্ষণ করে সবার। শোনা যায়, খামারবাড়ির ভেতরে আলাদা একটি কামরায় থাকে নেপোলিয়ন। বসার ঘরের আলমারিতে সাজান দামী সিরামিকের থালাবাসনে একা তার খাবার খায়, দুটো কুকুর সে খাবার পরিবেশন করে। বছরের অন্য দুটো আনুষ্ঠানিক দিনের পাশাপাশি নেপোলিয়নের জন্মদিনেও বন্দুকের গুলি ছোড়া হবে বলে জানান হয় সবাইকে। নেপোলিয়নকে শুধুমাত্র “নেপোলিয়ন” বলে ডাকা হয়না। তার কথা বলতে গেলে বলতে হয়, “আমাদের নেতা কমরেড নেপোলিয়ন”। শুয়োরেরা তার জন্যে মাঝে মাঝে নতুন উপাধি আবিষ্কার করতে ভালবাসে। সোগুলো হচ্ছে, “সব পশুদের পিতা”, “মানবজাতির যম” , “ভেড়ার পালের প্রতিপালক”, “হাঁসেদের বন্ধু” জাতীয় উপাধি। প্রতিবারই নিজের বক্তৃতার সময় অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে নেপোলিয়নের মহানুভবতা, তার সুদূরপ্রসারী বুদ্ধিমত্তা, এই খামার ও অন্য খামারের পরাধীন পশুদের প্রতি তার গভীর ভালবাসার কথা বলে চাপাবাজ। প্রতিটি সাফল্য ও প্রতিটি সৌভাগ্য নেপোলিয়নের অর্জন হিসেবে প্রকাশ করা সবার অভ্যাসে পরিণত হয়। প্রায়শই এক মুরগি আরেক মুরগিকে বলতে শোনা যায়, “আমাদের নেতা কমরেড নেপোলিয়নের নেতৃত্বের সৌভাগ্যে এবার ছয়দিনে পাঁচটি ডিম পেড়েছি”। দুটো গরু যখন খালে জল খায়, তখন বলাবলি করে, “আমাদের নেতা কমরেড নেপোলিয়নের নেতৃত্বের সৌভাগ্যে কি সুন্দর বাঁক নিয়েছে এই খাল”। সর্বসাধারণের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে “কমরেড নেপোলিয়ন” নামে একটি কবিতা সবার খুব পছন্দ হয়। মিনিমাস এই কবিতাটি রচয়িতা।

বুদ্ধিমত্তার পিতা,
আত্মিকতার আঁধার!
শুয়োরদের ওস্তাদ! আমার হৃদয়ের মতো।
আগুন, তোমার চোখে
সূর্যের মতো সুন্দর পবিত্র তুমিই মহান,
কমরেড নেপোলিয়ন!

তোমার প্রজার যা ভালো,
সে তোমারই দান।
দ্বিগুণ খাবার, সাথে খড়
প্রতিটি পশু ,বড় বা ছোট
প্রাসাদের মতো তোমার নির্ভয় আশ্রয়।
তুমি বিরতিহীন, তুমিই মহান,
কমরেড নেপোলিয়ন!

যদি শুয়োর-বাচ্চা থাকত আমার!
সে যতোই ছোট বা বড়ো,
পুরুষ কিংবা মাদী
তোমারই প্রতি বিশ্বাসে
শুধুমাত্র তোমারই একমাত্র,
তার প্রথম চীৎকার, তুমিই মহান,
কমরেড নেপোলিয়ন!

নেপোলিয়নের পছন্দ হয় কবিতাটি। বড় আস্তাবলের পেছনের দেয়ালে লিখিত সাতটি ধারার পাশে কবিতাটি লিখে রাখার ব্যবস্থা নেয় সে। তার পাশে সাদা রঙে চাপাবাজের আঁকা নেপোলিয়নের একটি বিমূর্ত প্রতিকৃতি সে কবিতাকে আরও বেশী অলঙ্করণ করে।

ইতিমধ্যে উইমপারের মধ্যস্থতায় নেপোলিয়ন পিলকিংটন ও ফ্রেডেরিকের সাথে বেশ জটিল ব্যবসায়িক আলোচনায় প্রবেশ করে। কাঠের স্তূপটি তখনও অবিক্রীত। সেটি কেনার জন্যে যদিও ফ্রেডেরিকই বেশী আগ্রহী, যথাযোগ্য দাম দেয়ার কোনো প্রস্তাব আসে না তার কাছ থেকে। একই সময়ে গুজবও শোনা যায় যে, ফ্রেডেরিক ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা পশুখামার আক্রমণ করে বাতাসকলটি ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছে। এই বাতাসকলের প্রতি নাকি তার প্রবল হিংসা! তুষারবল কোনাগড় খামারে লুকিয়ে, এটি সবারই জানা। গ্রীষ্মকালের মাঝামাঝি একটি নতুন খবরে আতঙ্কিত সবাই। তিনটি মুরগি জানায় ও স্বীকারও করে, তুষারবলের প্ররোচনায় নেপোলিয়নকে হত্যার ষড়যণ্ত্রে লিপ্ত হয়েছে তারা। তাদেরকে সাথে সাথে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে নেপোলিয়নের বাড়ির পাহারা আরও বাড়ানো হয়। রাতে তার বিছানার চারকোনে পাহারাদার হিসেবে নিযুক্ত করা হয় চারটি কুকুরকে। খাবারে বিষের ভয়ে আগে চেখে দেখার জন্যে, লালচোখ নামের এক কমবয়সী শুয়োরকে নিযুক্ত করা হয়। মোটামুটিভাবে একই সময়ে জানানো হয় কাঠের স্তূপটি পিলকিংটনের কাছে বিক্রি করাই নেপোলিয়নের সিদ্ধান্ত। এর পাশাপাশি পশুখামার ও শেয়াল-বনের মাঝে বিভিন্ন দ্রব্য আদান প্রদানে নিয়মিত ব্যবসায়িক সম্পর্কও স্থাপন করা হবে। ফ্রেডেরিককে দুজনেরই শত্রু হিসেবে ধরে নেপোলিয়ন আর পিলকিংটন এখন পরস্পরের বন্ধু-স্থানীয়। মানুষ শ্রেণীর একজন হেসেবে পিলকিংটনকে অবিশ্বাস করলেও ফ্রেডেরিকের তুলনায় তাকে অনেক এগিয়ে রাখে পশুরা। ফ্রেডেরিকের প্রতি সে তুলনায় তাদের একই সাথে প্রবল ঘৃণা ও ভয়। গ্রীষ্মকালে যখন বাতাসকলের কাজ সমাপ্তির পথে, তখন যে কোনো সময় পশুখামারে আক্রমণ হবার গুজব প্রবল হতে শুরু করে। কুড়ি-জন বন্দুকধারী লেলিয়ে দিয়ে ফ্রেডেরিক আক্রমণের জন্যে তৈরি। সরকার ও পুলিশকেও নাকি ঘুষ দিয়েছে সে, যাতে পশুখামারের দলিলপত্র নিয়ে কোনো প্রশ্ন না আসতে পারে। তাছাড়া কোনাগড় খামার থেকে সেখানকার পশুদের প্রতি ফ্রেডেরিকের নানা ধরণের বর্বর লোমহর্ষক আচরণের গুজব ভেসে আসে। সে একটি ঘোড়াকে চাবকিয়ে খুন করে, গরুদের না খাইয়ে মারে ও একটি কুকুরকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। এক মোরগের সাথে আরেক মোরগের লড়াই বাঁধিয়ে উপভোগ করে প্রতি সন্ধ্যায়। ভাঙ্গা ব্লেডের সূচালো কোনা নাকি মোরগদের আঙ্গুলে বেঁধে দেয়া হয় লড়াইয়ের আগে। স্বজাতির প্রতি এই অত্যাচারের কথা শুনে ক্ষোভে ফুটতে থাকে পশুখামারের পশুরা। সবাই মিলে একসাথে কোনাগড় খামারে আক্রমণ করে মানুষদের তাড়িয়ে সেখানকার পশুদের মুক্ত করার দাবী জানায় তারা। কিন্তু চাপাবাজ তাদেরকে নেপোলিয়নের কৌশলের প্রতি বিশ্বাস রেখে অনিয়ন্ত্রিত পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেয়।

তারপরও ফ্রেডেরিকের প্রতি পশুদের অসন্তোষ বেড়েই চলে। এক রোববার সকালে আস্তাবলে আসে নেপোলিয়ন। বলে, কখনোই এক মুহূর্তের জন্যেও ফ্রেডেরিকের কাছে কাঠ বিক্রি করার কথা ভাবে নি সে। এ ধরণের হৃদয়হীন মানুষের সাথে সম্পর্ক রাখা নিজের প্রতি অসন্মানেরই সামিল। অন্যান্য খামারের পশুদের কাছে বিপ্লবের খবর জানানোর দায়িত্ব এখনও কবুতরের ঝাঁকের। তাদেরকে এখন আর কোনাগড় খামারে নামতে দেয়া দেয়না ফ্রেডেরিক। তাদেরকে আদেশ দেয় নেপোলিয়ন, তারা যেন তাদের নতুন শ্লোগান “ফ্রেডেরিক মুর্দাবাদ” এর বিনিময়ে “মানবজাতি মুর্দাবাদ” শ্লোগানটি বাদ দিয়ে দেয়। গ্রীষ্মের শেষের দিকে তুষারবলের আরেকটি কুকর্মের খবর প্রকাশ পায়। গম-ক্ষেতে প্রচুর আগাছা জন্মায় এবার। পরে দেখা যায়, তুষারবল রাতে বীজের সাথে আগাছার বীজ মিশিয়েছে। এই বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত এক রাজহাঁস চাপাবাজের কাছে অপরাধ স্বীকারে করে বিষাক্ত চেরি-ফল খেয়ে আত্মহত্যা করে। পশুরা এও জানতে পারে যে, ওদের অনেকেই এ অবধি যা ধারণা করে এসেছে, সে অনুযায়ী “প্রথম শ্রেণীর বীর”খেতাবটি কখনেই তুষারবলকে দেয়া হয়নি। এটি ছিল গোয়ালঘরের যুদ্ধের পর তুষারবলের নিজেরই সাজান এক কাল্পনিক রূপকথা। তাকে কেন খেতাব দেবার প্রশ্ন-তো দূরের কথা, ওই যুদ্ধে তার কাপুরুষতার কারণেই অপমানিত হতে হয় তাকে। কয়েকটি পশু এ ধরণের বর্ণনায় বিস্মিত হলেও চাপাবাজ খুব সহজেই তাদেরকে তাদের ভুল ধরিয়ে দিতে সক্ষম হয়।

শরতে বাতাসকলের নির্মাণের কাজ অস্বাভাবিক কঠিন পরিশ্রম করে শেষ করা হয়। একই সময়ে শস্য কাটার কাজ করতে হয় বলে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে হয় সবার। যন্ত্রপাতি বসানোর কাজ তখনও বাকী। উইমপার সেসব সংগ্রহের জন্যে কথাবার্তা বলে। তারপরও নির্মাণের কাজ তো সমাপ্ত! নানা সমস্যা, অনভিজ্ঞতা, অতি সাধারণ যন্ত্রপাতি, নিজেদের দুর্ভাগ্য, তুষারবলের শয়তানি স্বত্বেও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় নির্মাণকাজ। গর্বে বুক ফুলিয়ে তাদের স্থাপত্যকর্মের চারপাশে ঘোরাফেরা করে পশুরা। আগের চাইতে আরও অনেক সুন্দর, দেয়ালও আগের চাইতে দ্বিগুণ পুরু। এটিকে ভাঙ্গতে হলে বোমা মারতে হবে। যদি পাখা ঘোরে আর তাতে ডায়নামো চালানো যায়, তাহলে তাদের সমস্ত পরিশ্রম, সব রকম প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম সার্থক হবে। এই ভাবনায় নিজেদের ক্লান্তি ভুলে স্তম্ভের চারপাশে ঘুরে ঘুরে আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে সবাই। সমাপ্ত স্থাপত্যকর্ম পরিদর্শনের জন্যে কিছুক্ষণ বাদে নেপোলিয়ন আসে তার কুকুরের দল ও মোরগকে সঙ্গী করে। সে পশুদের তাদের সাফল্যের জন্যে ব্যক্তিগত ভাবে অভিনন্দন জানায়। জানায়, এই বাতাসকলের নাম হবে নেপোলিয়ন বাতাসকল।

দুদিন পর এক বিশেষ সভায় ডাকা হয় পশুদের। তারা শুনে খুবই অবাক হয় যে, নেপোলিয়ন সে কাঠের স্তূপটি ফ্রেডেরিকের কাছে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাল ফ্রেডেরিকের গাড়ি এসে তুলে নিয়ে যাবে কাঠ। বাইরে বাইরে পিলকিংটনের সাথে বন্ধুত্বের ভাব করে আসলে ফ্রেডেরিকের সাথেই গোপনে একমত হয়েছে নেপোলিয়ন।

শেয়াল-বনের সাথে নাকি সবরকম সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়েছে। পিলকিংটনকে অপমান করে চিঠিও পাঠান হয়েছে। কবুতরের দলকে নাকি আদেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন কোনাগড় খামারে না যায়। তাদের শ্লোগান, “ফ্রেডেরিক মুর্দাবাদ” বদলে করা হয়েছে “পিলকিংটন মুর্দাবাদ”। একই সাথে নেপোলিয়ন জানায়, ফ্রেডেরিকের আসন্ন আক্রমণের খবর পুরোপুরি মিথ্যে। নিজের পশুদের প্রতি ফ্রেডেরিকের নির্দয় অত্যাচারের কথাও খুব বেশি অতিরঞ্জিত। তুষারবল আর তার গোয়েন্দারাই এধরণের মিথ্যে খবরের উৎস। তুষারবল কোনাগড় খামারে লুকিয়ে নয়, সে কস্মিনকালেও সেখানে ছিল না। খুব আরামেই শেয়াল-বন খামারে বাস করছে সে ও বহুবছর ধরেই পিলকিংটনের কেনা গোলাম।

শুয়োরেরা নেপোলিয়নের কূটনৈতিক চাতুর্যে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পিলকিংটনকে বাইরে বাইরে বন্ধু হিসেবে দেখিয়ে সে ফ্রেডেরিককে তার প্রস্তাবিত মূল্য বারো পাউন্ডে তুলতে বাধ্য করেছে। চাপাবাজের কথায় নেপোলিয়নের সব চাইতে বড়ো বুদ্ধির পরিচয় হল, সে কাউকেই বিশ্বাস করে না, এমন কি ফ্রেডেরিককেও নয়। ফ্রেডেরিক কাঠের দাম একটি চেকে লিখে দিতে চেয়েছিল। চেক একটি কাগজ বৈ তো নয়, যেখানে কোনো দাম পরিশোধের প্রতিশ্রুতি লিখিত দেয়া থাকে। কিন্তু নেপোলিয়ন খুবই চালাক। সে সত্যিকারের পাঁচ পাউন্ড নোটে মূল্য পরিশোধ দাবী করেছে। কাঠ নিয়ে যাবার আগে সেটি পরিশোধ করতে হবে। ফ্রেডেরিক সেটিই করেছে। পুরো টাকা শোধ করেছে সে ও বাতাসকলের বাকী যন্ত্রপাতি কেনার জন্যে সে টাকা মোটামুটি যথেষ্ট।

খুব দ্রুত গাড়ি করে কাঠ নিয়ে গেল ফ্রেডেরিক। সব কাঠ নিয়ে যাবার পর আস্তাবলের বড়ো ঘরে কাঠ বিক্রির টাকা সবাই যাতে পরখ করতে পারে, সেজন্যে এক বিশেষ সভা ডাকা হয়। তৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত নেপোলিয়ন তার দুটো পদক লাগিয়ে উঁচু খড়ের গাদায়, পাশে একটি খামারবাড়ির একটি সিরামিকের পাত্রে যত্ন করে রাখা নোটগুলো। প্রতিটি পশু এর পাশ ঘেঁসে যাবার সময় পরিতৃপ্তিতে দেখে সে নোট। বক্সার নাক বাড়িয়ে শুঁকতে গেলে মলিন সে কাগজের টুকরো তার নিঃশ্বাসের বাতাসে উড়ে যায় প্রায়।

তিন দিন পর প্রচণ্ড হৈচৈ শুরু হয়। সাদা রক্তশূন্য চেহারায় উইমপার সাইকেলে চড়ে তীরের গতিতে পথ বেয়ে এসেই সাইকেলটি ছুড়ে ফেলে সরাসরি ছোটে খামারবাড়ির দিকে। পর-মুহূর্তেই নেপোলিয়নের ঘর থেকে রক্ত হিম করা ক্রুদ্ধ চীৎকার শোনা যায়। নতুন কাহিনী বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ে পশুদের মাঝে। জাল টাকা দিয়েছে ফ্রেডেরিক। অর্থাৎ সে বিনে পয়সাতেই নিয়েছে কাঠগুলো।

সাথে সাথেই সমস্ত পশুদের ডাকে নেপোলিয়ন। জলদগম্ভীর আওয়াজে ফ্রেডেরিকের মৃত-দণ্ড ঘোষণা করে। যদি বন্দি করা যায়, তাহলে জ্যান্ত অবস্থায় রান্না করা হবে তাকে। এই বিশ্বাসঘাতকতার পর এর চাইতে খারাপ কিছুও ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে বলে একই সাথে সাবধান করে সবাইকে নেপোলিয়ন। ফ্রেডেরিক আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা যে কোনো মুহূর্তে পশুখামার আক্রমণ করতে পারে। পাহারাদার বসানো খামারের হয়েছে খামারের প্রতিটি দরজায়। তাছাড়া চারটি কবুতর পাঠিয়ে শেয়ালবনের পিলকিংটনের সাথে আবার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।

পরদিন সকালেই আক্রমণ শুরু হয়। সকালের নাস্তার সময়েই পর্যবেক্ষণ স্থান থেকে খবর আসে, ফ্রেডেরিক ও দলবল মূল দরজার পাঁচটি আড়াআড়ি শিক কেটে খামারে ঢুকেছে। খুব পরিকল্পিত ভাবে প্রত্যুত্তর দিলেও গোয়াল ঘরের যুদ্ধের মতো এবারের যুদ্ধ এতোটা সহজ হল না। প্রায় আধ ডজন বন্দুক হাতে পনেরো জনের একটি দল। খামারের ভেতরে পঞ্চাশ পা ঢুকেই গুলি চালাতে শুরু করে দলটি। বন্দুকের কান ঝালাপালা করা আওয়াজ আর ছড়রা গুলির তীব্র যন্ত্রণার সামনে দাঁড়াতে পারে না পশুরা। নেপোলিয়ন ও বক্সারের সবরকম প্রচেষ্টা স্বত্বেও ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মাঝেই অনেকেই আহত হয়। তারা পালিয়ে খামারবাড়ির ভেতরে লুকিয়ে বেড়া ও গাছপালার ফাঁক দিয়ে সাবধানে নজর রাখে বাইরে। বাতাসকল সহ বড় মাঠটি শত্রুদের দখলে। এমনকি নেপোলিয়নও এই মুহূর্তে কোনো উপায় খুঁজে পায় না। লেজ শক্ত করে কোনো কথা না বলে একবার এদিকে, আরেকবার ওদিকে আসাযাওয়া করে হতাশায়। প্রত্যাশার দৃষ্টিতে বারবার শেয়ালবন খামারের দিকে তাকায়। যদি পিকলিংটন ও তার সাথের লোকজন আসে, তাহলে হয়তো এই যুদ্ধে জেতা সম্ভবও হতে পারে। ঠিক সেই মুহূর্তে ফিরে আসে পিকলিংটনের খামারে পাঠানো চারটি কবুতর। তাদের একজনের ঠোঁটের ডগায় একটি কাগজ। তাতে লেখা, “মর হারামজাদার দল”!

ততক্ষণে বাতাসকলের কাছে এসে থামে ফ্রেডেরিক ও তার লোকজন। সেদিকে তাকিয়ে তাদের উদ্দেশ্য দেখে হতাশায় মুষড়ে পড়ে পশুরা। একটি বড় হাতুড়ি ও একটি শাবল নিয়ে এগিয়ে আসে দুজন। মনে হয়, বাতাসকল ধ্বংস করাই তাদের উদ্দেশ্য।

নেপোলিয়ন বলে, “অসম্ভব! দেয়াল এতো চওড়া যে, এক সপ্তাহেও ভাঙ্গতে পারবে না ওরা। তোমরা ভয় পেও না কমরেড!”

কিন্তু বেনজামিন তীব্র উত্তেজনা নিয়ে নজর রাখে ওদের কাজের দিকে। বাতাসকলের ভিত্তির প্রায় কাছাকাছি হাতুড়ি ও শাবল দিয়ে একটি গর্ত খোঁড়ে লোক দুজন। ধীরে ধীরে ও প্রায় সন্তুষ্টির ভঙ্গীতে মাথা নাড়ায় বেনজামিন।

“যা ভেবেছিলাম, তাই! দেখ না, কী করছে ওরা? দেখ, এক্ষুণি বারুদ ঠেসে বন্ধ করবে গর্তটি।”

সীমাহীন হতাশা নিয়ে অপেক্ষা করে পশুরা। বাড়ীর আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা একেবারেই অসম্ভব এখন। কয়েক মিনিট পরই বাতাসকলের গোঁড়া থেকে ছুটে এদিক সেদিক ছিটিয়ে পড়ে মানুষের দলটি। তারপর কান ফাটানো বিরাট এক বিস্ফোরণ! বাতাসে ঘূর্ণি খায় কবুতরের ঝাঁক, নেপোলিয়ন বাদে বাকী পশুরা পেটের উপর মাটিতে শুয়ে মুখ লুকোয়। আবার দাঁড়িয়ে দেখে, যেখানে বাতাসকল ছিল, সেখানে বিশাল এক কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। ধীরে ধীরে বাতাসে সরে যায় সে ধোঁয়া। কোনো চিহ্নই নেই বাতাসকলের!

এই দৃশ্য দেখে পশুদের ভেতরে আবার সাহস ফিরে আসে। মানুষের এই জঘন্য ও হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড দেখে তাদের ভেতরের ভয় আর হতাশা প্রচণ্ড ক্রোধে পরিণত হয়। প্রতিহিংসার আগুনে যেন জ্বলে ওঠে সবাই। কারো কোনো আদেশের তোয়াক্কা না করেই একসাথে ছোটে শত্রুদের দিকে। এবার চারপাশের ছড়রা গুলি-বৃষ্টির যন্ত্রণা একেবারেই তুচ্ছ তাদের কাছে! শুরু হয় এক বন্য আর প্রলয়ঙ্কর যুদ্ধ। বিরতিহীন গুলি চালিয়ে যায় মানুষেরা। কাছাকাছি আসার পরই লাঠি আর ভারি বুটজুতোয় লাথির আঘাতে আক্রমণ করে পশুদের। একটি গরু, তিনটি ভেড়া ও দুটো হাঁস নিহত হয়। প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভাবে জখম হয়। এমনকি পেছন থেকে যুদ্ধ পরিচালনার সময় নেপোলিয়নের লেজের ডগায়ও একটি গুলির আঁচড় লাগে। কিন্তু মানুষের দলও এই যুদ্ধে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়না। বক্সারের ক্ষুরের আঘাতে তিনজনের মাথা চুরমার, একজনের পেট গরুর শিঙ এর গুঁতোয় রক্তাক্ত! এমনকি জেসি আর তুলসীপাতা মিলে একজনের প্যান্ট ছিঁড়ে খুলে দেয়। নেপোলিয়ন তার ব্যক্তিগত পাহারাদার কুকুরের দলকে ঝোপের আড়াল থেকে শত্রুদের বিব্রত করার আদেশ দেয়। তারা যখন ক্ষিপ্ত চীৎকারে মানুষের একটি অংশে আক্রমণ চালায়, তখন ভয় পেয়ে যায় ওরা। ওদের ঘিরে ফেলা হচ্ছে বলে বুঝতে পারে। ফ্রেডেরিক চেঁচিয়ে তার লোকজনকে সময় থাকতে সরে পড়তে বলে। সাথে সাথেই জীবনের ভয়ে ছুটে পালায় কাপুরুষ মানুষ। তাদের পেছনে পেছন তাড়া করে পশুরা ও কাঁটাঝোপের ফাঁক দিয়ে পালানোর আগে শেষ লাথি চালায় মানুষের গায়ে।

যুদ্ধে জয়ী হয়েছে পশুরা। কিন্তু তারা ক্লান্ত ও তাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। টলতে টলতে ধীরে ধীরে খামারের দিকে এগোয় ওরা। ঘাসের উপর লুটিয়ে থাকা মৃত সাথীদের দেখে অনেকের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। বিষণ্ণ নীরবতায় আচ্ছন্ন হয়ে ওরা কিছুটা সময় সেখানে কাটায়, যেখানে একসময় বাতাসকল দাঁড়িয়ে ছিল। উড়ে গেছে বাতাসকল, তাদের সমস্ত পরিশ্রমের ফসল প্রায় একেবারে নিশ্চিহ্ন! এমনকি ভিত্তির বেশীরভাগ অংশই নেই আর। নতুন করে তৈরি করার জন্যে আগে পাথরগুলোও কাজে লাগান যাবে না। সেগুলোও নেই। বিস্ফোরণের প্রচণ্ডতা শতশত পাথরখন্ড অনেক দূরে উড়িয়ে ফেলেছে। মনে হয়, বাতাসকলের অস্তিত্বই ছিল না কখনও!

যখন খামারবাড়ির কাছাকাছি পশুরা, উল্টোদিক থেকে তাদের দিকে এগিয়ে আসে চাপাবাজ। যুদ্ধের সময় অজানা কারণে দেখাই যায়নি তাকে। আনন্দে উজ্জ্বল তার চেহারা, বাতাসে লেজ নড়ছে এদিক সেদিক। খামারবাড়ি থেকে গুলির আওয়াজ শোনে পশুরা, যেন আনন্দোৎসব!

বক্সার জিজ্ঞেস করে, “গুলি ছোড়া হচ্ছে কেন”?

“আমাদের বিজয়ের আনন্দে”, বলে চাপাবাজ।

“কোন বিজয়?”, বলে বক্সার। তার হাঁটু বেয়ে রক্ত ঝরে। একটি ক্ষুরের নাল হারিয়েছে, ক্ষুরটিও প্রায় চুরমার। তার পেছনের পায়ের পেশীতে এক ডজন ছড়রা গুলি ঢুকে আছে।

“কোন বিজয়, জানতে চাও কমরেড! আমরা না এইমাত্র শত্রুদেরকে আমাদের পবিত্র মাটি থেকে তাড়িয়ে দিলাম! এটা কি বিজয় নয়?”

“কিন্তু বাতাসকল ধ্বংস করে গেছে তারা! আমাদের দুই বছরের পরিশ্রম!”
“তাতে কী হয়েছে? আরেকটা বাতাসকল দাঁড় করাব। আমাদের যদি ইচ্ছে নয়, একটি নয়, ছয়টি বাতাসকল বানাতে পারি। আসলে আমাদের এই বিশাল অর্জনকে বড় করে দেখছ না তুমি কমরেড। শত্রুরা আমাদের মাটি দখল করেছিল। কমরেড নেপোলিয়নের নেতৃত্বে তার প্রতিটি ইঞ্চি আবার পুনর্দখল করেছি।“

“মালিক ছিলাম আমরা, আমরাই আবার দখল করেছি!“

“তারপরও এটা আমাদেরই বিজয়”, বলে চাপাবাজ।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খামারের উঠানে আসে পশুরা। চামড়ার নীচে ছড়রা গুলির ক্ষতে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে বক্সার। ভিত্তিপ্রস্তর থেকে শুরু করে বাতাসকল আবার গড়তে কতোটা পরিশ্রম দরকার, সে কথা ভাবে সে। মনে মনে পরিশ্রমের জন্যে নিজেকে তৈরি ও করে। তারপরও প্রথমবারের মতো টের পায়, এগারো বছর বয়েস তার। তার শরীরের শক্তিশালী পেশী হয়তো আর আগের মতো আর নয়।

তারপরও সবুজ পতাকা উড়তে দেখে, ও নেপোলিয়নের বক্তৃতা শুনে তাদের বিরাট বিজয়ের কথা বিশ্বাস করতে শুরু করে পশুরা। পর পর সাতবার বন্দুকের গুলি ছোড়া হয়। নেপোলিয়ন তার বক্তৃতায় সমস্ত পশুদেরকে এই অর্জনে তাদের অবদানের জন্যে অভিনন্দন জানায়। এই যুদ্ধে যারা প্রাণ হারায়, তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে কবর দেয়া হয়। একটি ঠেলাগাড়িকে বিজয়ের রথ হিসেবে টানে বক্সার আর তুলসীপাতা। নেপোলিয়ন নিজে সবার সামনে থেকে বিজয় মিছিলের নেতৃত্ব দেয়। বিজয়ের সন্মানে বারবার বন্দুকের গুলি, বক্তৃতা ও গানের মাঝে দুদিন ধরে চলে এই উৎসব। বিশেষ পুরস্কার হিসেবে প্রতিটি পশুকে একটি করে আপেল, পাখিকে তিন আউন্স গমের দানা ও কুকুরকে তিনটি করে পিঠে দেয়া হয়। এই যুদ্ধকে “বাতাসকলের যুদ্ধ” হিসেবে আখ্যা দেয়ার সিদ্ধান্ত জানান হয় সবাইকে। “সবুজ পতাকা পদক” নামে একটি পদক দান করার কথা ঘোষণা করে নিজেকেই সে পদকে ভূষিত করে নেপোলিয়ন। এই সামগ্রিক আনন্দ উল্লাসের মাঝে জাল টাকার কথা ভুলে যায় সবাই।

এর কয়েকদিন পরের ঘটনা। খামারবাড়ির নীচের একটি কামরায় হুইস্কির বোতলের একটি বাক্স খুঁজে পায় শুয়োরেরা। বাড়ি দখল করার সময় কারো চোখে পড়েনি আগে। সেই রাতেই খামার বাড়ি থেকে জোর গলায় গানের শব্দ ভেসে আসে। আশ্চর্যজনকভাবে হলেও সে গানের সাথে “ইংল্যান্ডের পশু” গানের সুরও শোনা যায়। রাত সাড়ে নটার দিকে নেপোলিয়নকে দেখা যায় জোনসের একটি পুরনো হ্যাট মাথায় চাপিয়ে পেছনের দরজায় বেরিয়ে দ্রুত উঠোনের চারপাশ ঘুরে আবার ঘরে ফিরে যেতে। পরের দিন সকালে খামারবাড়ি পুরো নিঃশব্দ। একটি শুয়োরেরও কোনো নড়াচড়া শব্দ শোনা যায়না। সকাল নটার দিকে চাপাবাজকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। খুব ধীর, নিস্তেজ তার চলা, খুবই ক্লান্ত মনে হয় সেকারণেই, চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, অবশ ঝুলন্ত লেজ। তাকে সত্যিকারভাবেই অসুস্থ মনে হয়।

সমস্ত পশুদের একসাথে করে এক ভয়ানক খবর জানায় সে। কমরেড নেপোলিয়ন মৃত্যুশয্যায়! বিলাপ করে কেঁদে ওঠে সমস্ত পশু। খামারবাড়ির দরজায় দরজায় খড় বিছানো হয়। পা টিপে টিপে হাঁটে পশুরা। তাদের নেতার মৃত্যু হলে কী হবে তাদের, অশ্রূভারাক্রান্ত চোখে এই প্রশ্ন পরস্পরের প্রতি। তুষারবল নেপোলিয়নের খাবারে বিষ মেশাতে সক্ষম হয়েছে অবশেষে, এই গুজব ওড়ে বাতাসে। বেলা এগারোটার দিকে নতুন বিবৃতি দিতে চাপাবাজ আসে আবার। মর্ত্যের পৃথিবীতে তার শেষ অবদান হিসেবে বিশেষ নির্দেশ দিয়েছে নেপোলিয়ন। “মদ্যপানের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড”।

বিকেলের দিকে নেপোলিয়নের শারিরীক অবস্থা কিছুটা ভালোর দিকে বলে খবর শোনা যায়। পরদিন সকালে নেপোলিয়ন আরোগ্যের পথে বলে জানায় চাপাবাজ। সেদিন বিকেলেই আবার স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করে নেপোলিয়ন। পরদিন জানতে পায় সবাই, সে উইমপারকে উইলিংডনে মদ চোলাই সম্পর্কিত কিছু বইপত্র জোগাড়ের নির্দেশ দিয়েছে। এক সপ্তাহ পরই ফলবাগানের পেছনে যে জায়গাটি বুড়ো পশুদের চারণভূমি হিসেবে নির্ধারিত, সে জায়গায় নতুন করে হালচাষ করার আদেশ দেয় নেপোলিয়ন। প্রথমে বলা হয়, মাঠটি শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নতুন চাষ জরুরী। কিন্তু পরে জানাজানি হয় যে, সেখানে যব চাষের পরিকল্পনা নেপোলিয়নের।

একই সময়ে এমন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, যার অর্থ কেউই বুঝে উঠতে পারে না। কোনো এক মধ্যরাতে উঠোনে এমন গোলমাল শোনা যায় যে, পশুরা ছুটে আসে আস্তাবল ছেড়ে। চাঁদের আলোয় আলোকিত একটি রাত। খামারের পেছনের বড় দেয়ালটিতে, যেখানে পশুতন্ত্রের সাতটি ধারা লেখা, তা গোঁড়ায় একটি বড় মই ভেঙ্গে দুই টুকরো হয়ে পড়ে। তার পাশে অচেতন চাপাবাজের দেহ, সামান্য দূরে একটি রঙের বালতি, ব্রাশ ও একটি হ্যারিকেন। সাথে সাথেই কুকুরের দল ঘিরে ফেলে চাপাবাজকে। জ্ঞান ফেরার পর কুকুরদের পাহারায় ধীরে ধীরে ফিরে যায় খামারবাড়িতে। ঘটনার কিছুই বুঝতে পারে না পশুরা একমাত্র বেনজামিন বাদে। তারপরও কিছুই বলে না সে।

তার কদিন পর মরিয়ম সাতটি ধারা পড়ে শোনায়। শুনে পশুরা তার একটি এতদিন ভুল জেনেছে বলে বুঝতে পারে। তারা জানে, পঞ্চম ধারাটি হবে, “কোনো পশু মদ্যপান করতে পারবে না।” কিন্তু লাইনটির সাথে যে আরও একটি শব্দ রয়েছে, সেটি ভুলে গিয়েছিল তারা। সঠিক ধারাটি হবে, “কোনো পশু অতিরিক্ত মদ্যপান করতে পারবে না ”!

চলবে………

পশুখামার (এক)
পশুখামার (দুই)
পশুখামার (তিন)
পশুখামার (চার)
পশুখামার (পাঁচ)
পশুখামার (ছয়)
পশুখামার (সাত)
পশুখামার (আট)
পশুখামার (নয়)


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।