তুই ফেলে এসেছিস কারে মন...

নিঘাত তিথি এর ছবি
লিখেছেন নিঘাত তিথি (তারিখ: মঙ্গল, ২৮/০৮/২০০৭ - ১:২৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শেকড় গজিয়ে যায় মাঝে মাঝে--যখন পুরনো কিছু হাতে নি। ডেস্কের মাঝে এলোমেলো পড়ে থাকা অজস্র প্রায় মূল্যহীন কাগজ, টুকরো-টাকরা ছবি নিজস্ব শেকড় ছড়িয়ে শক্ত করে গেড়ে বসে পড়ে আমার মস্তিস্কে। স্মৃতি--এর'চে সুন্দর কোন অনুভব কি আছে মনুষ্যজীবনে?

স্মৃতির জাল ছড়ানো সে ডেস্ক-ও নেই আর আমার কাছে--পড়ে রয়েছে তেমনি করে রোকেয়া হলের বহু পুরনো মেইল বিল্ডিং-এর কোন এক রুমে,আমিই চলে এসেছি তাকে ফেলে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে। কিন্তু ডেস্ক খালি করে সেই টুকরো-টাকরা মূল্যহীন অজস্র কাগজ সাথে করে আনতে ভুলিনি। সবাই হেসেছে, বেধে দেয়া ওজনের মাঝে কত গুরুত্বপূর্ণ কিছু আনা যাচ্ছে না, কিন্তু আমি আমার টুকরো কাগজ কিছুতেই ছাড়ব না, অন্য কিছু বাদ দিয়ে হলেও বিশাল প্যাকেট ভরে স্মৃতিগুলো সগর্বে আমার সাথে সাগর পাড়ি দিলো।

মাঝ দুপুরে আজ আমি আমার স্মৃতির ঝাঁপি খুললাম। চিঠি, চিরকুট, লিখে রাখা মুঠোফোনের মেসেজ,আঁকাআঁকি,কার্ড--আমার কাছে কেমন আমার জীবনের দলিল মনে হয়। বন্ধুর ঝাঁপিতে হাত বাড়িয়ে অনেক আগের নিজের লিখা একটা চিঠি সলজ্জে খুলি, একটা জায়গায় চোখ আটকে যায়--

"বুয়েটে কিসব হচ্ছে রে। এতগুলো ব্রিলিয়ান্ট ছেলে সাতটা দিন ধরে না খেয়ে- কারো কিছু আসে যায় না। দিলো বন্ধ করে। অদ্ভুত, হাস্যকর যুক্তিতে আমাদের ইউনিভার্সিটি আবার বন্ধ করে দিলো। .........ভার্সিটি খুলছে না, আমাদের স্বপ্নগুলো অপেক্ষা করতে করতে স্থির হয়ে যাচ্ছে।"

কত আগের এই চিঠি! ২০০২-এর সম্ভবত। তখন শামসুন্নাহার হলে পুলিশী হামলার প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বুয়েটে চলছিলো সনি হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলন। একগাদা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী হাত থেকে বই ফেলে মুষ্ঠিবদ্ধ করেছিলো। সেই হাতে পড়েছিলো আট ক্লাস পাস পুলিশের লাঠির বাড়ি। মিছিলে ছুটে বেড়ানো আমাদের শুনতে হয়েছিলো পুলিশের মুখ থেকে "পতিতা" উপাধি!

মাত্র ৫ বছর আগের কথা। পার্থক্য,তখন দেশে গনতন্ত্র(!) ছিলো, আর ক্যাম্পাসে ছিলো পুলিশ। এখন গনতন্ত্রের বদলে নারিকেল সরকার,বাইরে তত্ত্বাবধায়কের খোলস, ভেতরে সুমধুর মিলিটারী রস। আর ক্যাম্পাসে পুলিশের বদলে আর্মি।

আজ এক ছোটবোনের মেইল এলো। "আপু,আমাদের থার্ড ইয়ার ফাইনাল চলছে। তবু এই রকম একটা ঘটনা,আমি আন্দোলনে ছিলাম। কিন্তু এখন দেখো, আমাদের পরীক্ষা আটকে গেছে। প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা কবে হবে, আদৌ হবে কিনা, জানি না। ক্লাস বন্ধ, কারফিউ, এমনি বাড়ি বসে থাকি, কিছু ভালো লাগে না।" কি পরিবর্তন হলো তাহলে দেশে? কিছু ঘটলো তো ইউনিভার্সিটি বন্ধ করো, হল ভ্যাকান্ট করো। ছাত্রদের ক্যারিয়ারের চৌদ্দটা তখনও বাজতো, এখনও বাজলো। জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। ক্রমাগত জরুরী অবস্থায় সাধারণ মানুষের রুচি-রোজগারের সংস্থান বন্ধ। খুব ভালোত্বের মুখোশ পড়ে, দুর্ণীতি দমনের শো-ডাউন করে কি দেশ উদ্ধার করছে তাহলে এই ছাতামাথা সরকার?

ভাবতে ভাবতে আমার শান্ত মাথার রক্ত হঠাত কেমন টগবগ করে উঠলো। পুরনো চিঠিগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি দু'হাতে মাথা চেপে বসে থাকি। সমস্ত স্মৃতি ম্লান হয়ে আবছায়া এক স্নেহময় জননীর ছবি ভেসে ওঠে যেন চোখের সামনে। তার মমতাময় চোখের দিকে আমি বেশীক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারি না...। চোখ ভরে আসে নোনাজলে। হায় আমার দেশমাতা, নিজের মা আমাকে ছেড়ে গ্যাছে, তুমি তো ছাড়ো নি। আমিই ছেড়ে এলাম তোমায়। তুমি সেই অবিচল দাঁড়িয়ে আছো তোমার জন্মেরও আগে থেকে অত্যাচারিত হয়ে, আজ অবধি। রাজা বদলেছে নানারূপে, তুমি সব সয়ে গেছো সন্তানদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায়। আমি বড় ছোট্ট, ক্ষুদ্র, তুচ্ছ মানুষ মা, অসীম ভালোবাসায় তোমায় আগলে রাখব বুকের ভেতর। সাত সমুদ্রের ওপার থেকে নতজানু হয়ে আমার নিগৃহীত মায়ের মঙ্গল কামনা ছাড়া আর কিই বা করতে পারি আমি?


মন্তব্য

অমিত এর ছবি

বুয়েটের সেই সব দিনের কথা মনে পড়ে গেল। অনশনরত ছাত্রছাত্রীদের উপর বিএনপি জামাত ক্যাডারদের হামলা এবং যখন সাধারণ ছাত্ররা তাদের ঘিরে ফেলে, তখন ঠোলা বাহিনীর ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া এখনও চোখের সামনে ভাসে।
রাজা যায় রাজা আসে।

______ ____________________
suspended animation...

শ্যাজা এর ছবি

অনেকদিন পর তিথি...


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

আরিফ জেবতিক এর ছবি

-----------------------------------
ঢাকার ভূমে ফিরেছে একাত্তর/প্রস্তুতি নে,সময় হলো তোর..

আপন এর ছবি

হু ,ইদানিং আপনার মতোই নিজেকে অসহায় মনে হয় খুব। এখন কী করতে পারি আমরা! দম বন্ধ করা সময়ে ভাল নেই বললেও তো বিপদ!

নীলের সঙ্গে পথ চলা,ভুল পথে
অথবা তারপরও ভালো আছি ...

নজমুল আলবাব এর ছবি
আরিফ জেবতিক এর ছবি

আমি জানি না কেন সবাই খুব হতাশা প্রকাশ করছে বারবার।
হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
বাংলাদেশ মরে নি।
বাংলাদেশ আগে কখনো মরে নি।
বাংলাদেশ আগামীতেও মরবে না।

-----------------------------------
ঢাকার ভূমে ফিরেছে একাত্তর/প্রস্তুতি নে,সময় হলো তোর..

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

হতাশা ফুঁড়ে বের হয়ে আসবেই জনমানুষের বিজয়।
টুকরো টুকরো চিরকুট জমিয়ে রাখার অভ্যেসটা আমারও ছিলো। বেশিরভাগই অবশ্য কলেজ জীবনের। ওগুলোতে চোখ বুলিয়ে তখনকার জীবনকে স্পর্শ করা যায়, মমতায়।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

মাশীদ এর ছবি

দেশ ছেড়ে চলে এসেছিস তবে? খুব ভাল আর খুব খারাপের মধ্যে আছিস নিশ্চয়ই? যতদিন থাকবি আর অন্য দেশের খুব নিয়মমাফিক অগ্রগতি দেখবি, ততই নিজের মার্তৃভূমির হোপলেস অবস্থার জন্য হতাশ হবি। আমি হই। কেমন করে সবাই শুধু এগিয়ে যায় আর আমরা শুধু পিছিয়েই যাই - সেটা চোখের সামনে দেখি আর হতাশ হই।

যাক, শুধু হতাশার কথা ভাবলেই হবে না। তোর জীবনের একটা নতুন অধ্যায় শুরু হল। সেইজন্য অনেক শুভ কামনা। ভাল থাকিস। ইমেইলে তোর নাম্বার আর ঠিকানা দিস।


ভাল আছি, ভাল থেকো।


ভাল আছি, ভাল থেকো।

নিঘাত তিথি এর ছবি

না মাশীদাপু, আমি হতাশ না আমার দেশ নিয়ে। যখন যতই খারাপ অবস্থা সৃষ্টি হয়, তত আরো বেশি নতুন করে আশাও জন্ম নেয় বরং। কিন্তু, খুব কষ্টও হয় বুকের ভেতর। যখনই ভাবি, এই মুহুর্তে দেশের কি অবস্থা, তখনই মনে হয়, আসলে কবে খুব ভালো ছিলো, কবে শান্তিতে, নির্বিঘ্নে ছিলো আমাদের দেশ'মা?

সবাইকে মন্তব্যের কৃতজ্ঞতা।

জেবতিক ভাই, না হতাশ নই তো! কিন্তু কষ্টগুলো তো আটকে রাখতে পারি না।

--তিথি

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

পরবাসী মন; চন্দ্রে না পাক, জলজোছনায় পাক সামান্য ঠাঁই।

সৌরভ এর ছবি

তিথি,
জানো, দেশ ছাড়লেই ভাললাগা, কষ্ট সব কেমন যেন ওই সময়টাতেই থেমে যায়। তারা আর বড় হয় না।

স্মৃতিদের ওই জায়গাটুকু খুব যত্নে থাকে, স্যুটকেসে তুলে রাখা - পরা হয় না এরকম জামাকাপড়ের মতো।
রিনরিন মন কাঁদে যখন, তখন বের হয়ে আসে সেইসব স্মৃতি পোকামাকড়ের মতো, জড়িয়ে ধরে পরবাসী মনকে।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

নিঘাত তিথি এর ছবি

স্মৃতির তো ওই গৌরব সৌরভ, বয়স বাড়ে না তার। "পনেরোতে এসে গ্যাছে আটকে"!

অলৌকিক, কি জানি...

শিমুল,
হুমম। পায় যেন।

--তিথি

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।