সাত্যকি(৩)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: মঙ্গল, ১২/০৫/২০০৯ - ১০:৫২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এখানে ১ম পর্ব
এখানে ২য় পর্ব


রাত্রে খুব জ্বর এলো রুবেনের৷ জ্বরের ঘোরে ছটফট করে কিসব বলে যায়, সত্যকের অচেনা একটা ভাষায়৷ কিছু বুঝতে পারে না সত্যক, কিন্তু প্রলাপের জড়ানো কথাগুলোর মধ্যে ভয়, কষ্ট আর ক্লিষ্ট আর্তভাব কানে ধরা পড়ে৷ পাশে বসে ওর কপালে বরফ দিতে দিতে সত্যকের দুশ্চিন্তা হয়৷

কাছেই রয়েছে সত্যকের ঘরের কাজে সাহায্যকারী রোবট থার্টিওয়ানএ, একে সত্যক তার্তিয়ানা বলে, থার্টিওয়ানএ কে নানাভাবে রিল্যাক্সড জিভে উচ্চারণ করে করে এই সুবিধেজনক ডাকনামটি পেয়েছে সে৷ তার্তিয়ানা দেখতে কিন্তু মানুষের মতন নয়, খুবই রোবটের মতন, সিলিন্ড্রিকাল ধাতব শরীরের উপরে গোল পলিমারমাথা, তা থেকে নানারকম এক্সটেশন কর্ড এদিক ওদিক বেরিয়ে আছে, হাতের মতন চারটে জিনিস আছে কিন্তু তার ডগায় আঙুল নেই, সরু হয়ে যাওয়া শুঁড়ের মতন ডগা, অথচ টুক করে সেই শুঁড়ে জড়িয়ে যেকোনো জিনিস তুলে আনতে পারে৷ সত্যকের নির্দেশ মতন কখনো ফ্রিজ খুলে বরফ, কখনো জল কখনো তোয়ালে এসব নিয়ে আসছে তার্তিয়ানা৷ তার্তিয়ানার চোখ কান ইত্যাদি সব কিছুর জন্যেই সূক্ষ্ম সেন্সর আছে, যাকিনা মানুষের চোখকান ইত্যাদির থেকে অনেক ভালো কাজ করে৷

পাশের ঘরে ক্যাবিনেট ভর্তি নানাধরনের ওষুধ, সত্যক একবার উঠে গিয়ে সেখান থেকে ওষুধ নিয়ে এলো,এসে দেখলো তার্তিয়ানা দিব্যি ওর কপালে বরফ বুলিয়ে যাচ্ছে! সত্যক আসতেই সরে গিয়ে জায়গা করে দিলো৷ সত্যক রুবেনকে অল্প জাগিয়ে ওষুধ খাওয়ানোর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই শান্ত ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেলো সে, আর ভুল বকছে না৷

জ্বর আসার আগে সত্যক ওকে জিগিয়েছিলো কাউকে খবর দিতে হবে কিনা,কোথায় আছে জানানোর জন্য, হয়তো তারা চিন্তা করবে৷ রুবেন খুব দীনভাবে বলছিলো তাহলে খুব ভালো হয়, টিনিয়ামের গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করে সে জানিয়ে দিতে চায় সত্যকের এখানে সে ভালো আছে, সত্যক যদি চান পুরো কথোপকথন শুনতে পারেন, কোনোকিছু গোপন করতে চায় না রুবেন, কোনোরকম ক্ষতিকর সংবাদও চালাচালি করতে চায় না৷ টিনিয়াম কখনোই পৃথিবীর প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বন্ধুত্ব চায়৷ কেন যে লড়াই শুরু হলো ...

সত্যক বাঁকা হেসে কইলো," দু'হপ্তা আগেও তো অন্যরকম কথা শুনলাম তোমার থেকেই৷ বাকীদের কথা তো বাদই দিলাম৷" সত্যকের মনে পড়ছিলো ওর হুমকী ধরনের কথাগুলো, ওদের টেকনোলজি পৃথিবীকে জলশূন্য বায়ুশূন্য করে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে ... এইসব৷

রুবেনের মুখ ধূসর হয়ে গেলো শুনে, এমন করে মাফ চাইতে লাগলো যে সত্যকের খারাপ লাগলো৷ বলছিলো,"আমি ... আমি আপনার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছি৷ আমি তখন বুঝতে পারিনি৷ দায় এড়াতে চাইছি না, অন্যেরা দায়ী নয়, সব দোষ আমার৷ আপনি যা শাস্তি দেবেন ... যা আপনার ইচ্ছা ... আমাকে যদি আপনি ক্রীতদাসও করে রাখেন, তাতেও কিছু ক্ষতি নেই৷ যা খুশী করবেন, যা আপনার ইচ্ছা ... শুধু তিনমাস পরপর গ্যালাক্টিক স্পনসরদের কাছে যেতে হবে এক হপ্তার জন্য, ঐটুকু সময় ছেড়ে দেবেন ... টিনিয়ামে আমার কাজ ইউনিক না, অন্যেরা করতে পারবে, কিন্তু যে চারজন প্রধান স্পন্সর, ওরা আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে নেবে না ... আহ, কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে ... " বলতে বলতে নীলচে হয়ে যাচ্ছিলো রুবেনের মুখ, কথা না শেষ করেই অচেতন হয়ে গেছিলো৷

তারপরে জ্বর৷ সত্যকের নিজেকে একটু দায়ী মনে হচ্ছিলো, তখন ঐভাবে না বললেই হতো ... দুর্বল শত্রুর উপরে অত্যাচার করার মধ্যে নিষ্ঠুরতা খুব বেশী৷ শত্রু? আহ, রুবেন কি সত্যকের শত্রু? যতবার ওর মুখের দিকে তাকায় ততবার তাহলে সত্যকের ভেতরটা এমন বৃষ্টিতে ভিজে যায় কেন?

টিনিয়ামে অবশ্য সত্যক এর মধ্যেই যোগাযোগ করে জানিয়ে দিয়েছে রুবেন এখানে আছে, ভাল আছে৷ ওর সহযোগী বন্ধুরাও যেরকম শোনা গেছিলো আগে আসলে সেরকম নয়, খুব সুন্দর ভদ্র গলায় কথা বললো, পোলাইট ব্যবহার৷ তবে এখন দয়ে পড়েছে তাই, পরে কি মূর্তি ধরে কেজানে!

পরদিন রুবেনের অবস্থা একটু ভালোর দিকে৷ সকাল বেলাতেই সত্যক টিনিয়ামে যোগাযোগ করিয়ে দিলো, ওর বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে রুবেন নিশ্চিন্ত হয়েছে৷ আর নিশ্চিন্ত হয়েছে বলেই খানিকটা কম বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে ওকে৷ যাই হোক, একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করার সময় সত্যক কথা বলতে বলতে ওর কাছে জানতে চাইছে গ্যালাকটিক স্পনসরদের ওখানে আসলে কিরকম কাজ করতে হয়, কেন ওকে ছাড়া অন্য কাউকে নেবে না প্রধান স্পনসরেরা৷ সত্যকের সন্দেহ হচ্ছিলো আগেরদিন রুবেনের ক্লান্ত নি:শেষিত অবস্থা ছিলো আসলে ওখানের কাজের জন্যই৷

রুবেন একদম অল্প খাবার নিয়েছে, সামান্য দুধ আর খই আর একটা কলা৷ আস্তে আস্তে খেতে খেতে বললো, ওখান থেকে ফিরে এসে দুদিন শুধু বিশ্রাম করি, অল্প কিছু খাই৷ টিনিয়ামে জানে ওরা, এই দুইদিন ছুটি দেয় আমায়৷ স্পনসরদের ওখানে কাজ খুব কড়া ধরনের, একবিন্দু শক্তি অবশিষ্ট থাকেনা, সব যেন নিংড়ে নেয়৷ সে হোক গে, একজনের এতটুকু দাম দেওয়ায় যদি এতটা সাহায্য পাওয়া যায়, সেইটুকু দেওয়াই উচিত্৷

সত্যকের মন আরো ভিজে আসে, না জেনে ঐ অবস্থায় ওর উপরে চোটপাট করেছে বলে আরো খারাপ লাগে৷ কিন্তু মাফ চাইতে গেলে রুবেন খুব অপ্রস্তুত হয়ে যায়, বলে, " না না না না, আপনি কেন মাফ চাইবেন? আপনার কাছে আমার অপরাধের সীমা নেই, ক্ষমার অযোগ্য সব ভুল, এরমধ্যে আপনি নিজে মাফ চেয়ে আমার অপরাধ আর বাড়াবেন না৷ আপনি এত দয়ালু বলে ভরসা হয় কম শাস্তিতেই হয়তো তরে যাবো৷ নাইন্টিটু আর হান্ড্রেডটেন যখন ধরে আনছিলো, আমার তখন এমনিতেই আধামরা অবস্থা, মনে হচ্ছিলো কিজানি কি হবে, কিন্তু আপনি এত যত্ন করলেন ... আমাদের ওখানে একবার যদি যান বেড়াতে, তাহলে আমার সাধ্যমত আতিথ্য করবো ... যাবেন কি?"

সত্যকের কেমন লাগছিলো, পাছে রুবেনের সামনে আবেগ প্রদর্শন করে ফেলে সেই ভয়ে ঠাট্টা করলো, "ও বাবা! আজ একি কথা! কাল যে বললে ক্রীতদাস হয়ে আমার এখানেই নাকি থেকে যাবে? এখন দেখি আবার আমাকেই নেমন্তন্ন করছো!" বলেই হো হো হো হো করে হেসে ফেললো সত্যক, রুবেনের কনফিউজড হয়ে যাওয়া মুখ দেখে৷

রুবেন কিন্তু হাসে না, সত্যক সত্যি কথাই বলছে মনে করে আস্তে আস্তে খুব বিনীত গলায় বলে, "ঠিকই তো! আপনি যদি আমায় রাখতে চান ... আমার তো কোনো আপত্তির কথাই ওঠে না, আপনার কাছে কাজ করতে পারলেই আমি ধন্য হই, কিন্তু ঐযে তিনমাসে একবার এক সপ্তাহের জন্য ..."

সত্যক হাসতে হাসতে বলে, "আরে রুবেন, কালকে যা বলেছ বলেছ, জ্বরের ঘোরে বলে সেসব কাটিয়ে দেওয়া যাবে৷ আজ আর এসব বোলো না, লোকে শুনলে কি ভাববে? ক্রীতদাস আবার কি কথা? এসব বর্বর প্রথা কবেই তো মানুষ কাটিয়ে উঠেছে৷ এসব প্রথা ট্রথা টানতে টানতে আদৌ এই মহাকাশজয়ী অবস্থায় পৌঁছানোর কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারতো? "

রুবেন অল্প হাসে, বলে, "না না তা তো বটেই৷ সেই পুরানো আমলের মতন না, এমনিই৷ সেই পুরানো আমলে তো খুব বীভত্স সব প্রথাট্রথা ... আমি সেসব ভাবিনি, এটা এখনকার মতন৷ কেউ আসলে তো জানবে না, বলবেও না, শুধু আপনি আর আমি জানবো৷ আমার লোকেদের বলবো এমনি আপনার কাছে কাজ করি৷"

সত্যক মিচকি হাসে, বলে, "ওরেবাবা, কত কায়দা৷ তা, পুরানো আমলের মতন হলেই বা আটকাচ্ছে কে? কেউ তো জানবে না! শুধু তুমি আর আমি৷ তখন কিরকম হতো বলে তোমার মনে হয়?"

রুবেন ঘাবড়ে গেছে, এমনিতেই বেচারা বোঝে না কখন সত্যক ইয়ার্কি করছে আর কখন সিরিয়াস নোটে কথা কইছে৷ খুব কনফিউজ্ড হয়ে গিয়ে বলে,"অ্যাঁ, আপনি সত্যি সেরকম করতে চান নাকি?"

"কিরকম করতে চাই?"

রুবেনের চোখ ঝাপসা হয়ে যায়, ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে,"ঠিক আছে যদি ওভাবে চাবকাতে চান ... তাও ঠিক আছে, বেশী কেটে দেবেন না, তাহলেই হবে৷ আর যদি খুব বেশীরকম কেটে যায়, তাহলে কিছু ওষুধ দেবেন৷" আরো কিসব বলে যায়, কথা অস্পষ্ট লাগে, সত্যক উঠে ওকে ধরে ফেলে বোঝে আবার জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে রুবেন৷ জড়ানো গলায় ভুল বকে যায়," ওরাও দিয়েছিলো ওষুধ, খুব অসুখ হয়েছিলো তো আমার! এত মারলো সবাই মিলে, আমি নিই নি, কত করে বললাম, বিশ্বাস করলো না৷ "

সত্যক রুবেনকে ধরে ধরে নিয়ে শুইয়ে দেয়, চিকিত্সক-রোবট বার্ডনকে সিগ্ন্যাল দিয়ে নিয়ে আসে৷ বার্ডন রুবেনকে পরীক্ষা করে ওষুধ্পত্র ইঞ্জেক্ট করে সত্যককে আশ্বস্ত করে যায় যে আশু বিপদের সম্ভাবনা নেই৷ কিন্তু আসলে রুবেনের জন্য কোনো মনোবিদ প্রয়োজন, ওর কোনো একটা গভীর মানসিক সমস্যা আছে যেটার মূল আসলে হয়তো ওর খুব ছোটোবেলার কোনো ঘটনা৷ এর বেশী বার্ডনের ক্ষমতায় নেই, মন-বীক্ষণে ওর বিশেষ প্রশিক্ষণ নেই৷

সত্যক পরেরদিনের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট করলো মনোবিদ হুয়ান জো এর সঙ্গে, তিনি এসে পরীক্ষা করবেন রুবেনকে৷ ইনি রোবট নন, মানুষ৷ হুয়ান জো প্রথিতযশা মনোবিদ, এর সার্ভিস পাওয়া সোজা নয়৷ কিন্তু সত্যকের সঙ্গে পরিচয় ছিলো বলে পরদিন ই পাওয়া গেলো৷

ডক্টর হুয়ান এসে রুবেনের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করে নিজেকে সত্যকের বন্ধুস্থানীয় পরিচয় দিয়ে ঘন্টাদুই গল্প করে চলে গেলেন৷ এটাই ওনার স্টাইল, ডাক্তার হিসাবে বিশেষ করে মনোবিদ হিসাবে এলে নাকি পেশেন্ট ডিফেন্সিভ হয়ে পড়ে, তাই উনি অন্য পরিচয়ে প্রথমদিন গল্পগাছা করে পেশেন্টের কাছের মানুষ হয়ে নেন৷ তারপরের সিটিংএ আরেকটু গভীরে যান, এটা দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপার৷ তবে রুবেন যেহেতু এখন অনেকদিন সত্যকের এখানে থাকবে, তাই অসুবিধা কিছু নেই৷

(চলিষ্ণু হাসি )


মন্তব্য

শামীম রুনা এর ছবি

চমৎকার,অসাধারণ।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

মূলত পাঠক এর ছবি

এইটা এখনো পড়ি নি, মিলেনিয়া নিয়ে জানিয়ে যাই। ভালো তো বটেই, তবে শেষের ঐ না-ঘটা-ইতিহাসের বর্ণনা গল্পের পরিসরের তুলনায় বেশি দীর্ঘ মনে হচ্ছিলো, ধরুন অমিতা'চ্চনের সিনেমায় মাস্টার ময়ূরের এপিসোডটা বেশি লম্বা হলে যেমন মনে হয় আর কি। হাসি শেষটাও পুরো যে বুঝলাম জোর দিয়ে বলতে পারি না। তবে আপনি লিখলে হাতের গুণেই সুপাঠ্য হয়ে যায়, বুঝি না বুঝি আটকায় না কিছু।

আকাশজাতক'টা কিন্তু আবার লিখুন, ওটার পূর্ণ পোটেনশিয়ালের ব্যবহার করতে হবে। একটা তিন চার শো পাতার বই হওয়া উচিত।

তুলিরেখা এর ছবি

এই সিরিজ হয়তো অনেকেই পড়েন না, কিন্তু আমি দিয়ে যাচ্ছি ঠিকই। যদি সত্যিই বিরক্তিকর হয়, প্লীজ বলবেন কেউ, আমি এই সিরিজ বন্ধ করে উপকথা টুপকথা দিবো। হাসি
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।