নৈরঞ্জনা(৮)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: সোম, ০৮/১০/২০১৮ - ৩:১৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৮। দীর্ঘ যাত্রার শেষপ্রান্তে পৌঁছলাম অবশেষে। এসে গেল আমাদের গন্তব্য। ট্রেন থামলে ধীরেসুস্থে সব গুছিয়ে যখন প্ল্যাটফর্মে নেমে এলাম, তখন চারিদিকে শেষ বিকেলের মায়াবী আলো।

অচেনা সুন্দর শহরটি সেই প্রহরশেষের আলোয় রাঙা হয়ে আছে । আমরা স্টেশন থেকে বেরিয়েই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ঢেউখেলানো খোলা জমি চলে গেছে যতদূর চোখ যায়। একটু রুক্ষ, একটু শুকনো। গাছপালা বেশ কম, যেসব আছে, সেগুলো জল-উৎসের কাছে কাছে। বাকী জমি হয় পাথুরে, নয়তো বালি-বালি, নয়তো শক্ত শক্ত একরকম গুল্মে ঢাকা। আকাশ একেবারে নীল,পরিষ্কার। মরুপ্রায় শহরটি তার অনাবিল সুন্দর খোলামেলা চেহারা নিয়ে আমাদের স্বাগত জানালো।
"ওহ, অবশেষে এলাম! "
উস্কোখুস্কো চুলগুলো কপাল থেকে সরাতে সরাতে বললো কাশ্মীরা। এই দীর্ঘ ভ্রমণের ছাপ আমাদের সর্বাঙ্গে, একেবারে ঝোড়ো কাকের মতন অবস্থা। হোটেলে চেক ইন করেই সর্বপ্রথমে একটি চমৎকার স্নানের ব্যবস্থা করতে হবে।

আমাদের হোটেল আগেই ঠিক করা রয়েছে। জহীরও আমাদের হোটেলেই উঠবে, এও জানা ছিল। ও হয়তো পৌঁছবে আগামীকাল। ডক্টর আদিত্য আর অসিতদেবলবাবু উঠবেন অন্য আরেক হোটেলে। রুদ্রদীপ আর ওর বন্ধুরা উঠবে অন্য আরেক হোটেলে। এই ছোটো শহরে ভালো হোটেল মাত্র কয়েকটাই। আমাদের চারটে দল ছড়িয়ে ছিটিয়ে তিনটে হোটেলে উঠবে, শুরু থেকেই এই প্ল্যান ছিল। অবশ্য এই হোটেলবাস মাত্র দিন পাঁচেকের জন্য, তারপরেই আমাদের রওনা হতে হবে সবাই মিলে। ইতিমধ্যে মীটিংগুলো সব হবে ডক্টর আদিত্যদের রুমে।

চারিদিক এত খোলামেলা যে আমরা স্টেশন চত্বর থেকে বাইরে এসে কয়েক মিনিট কেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশ বাতাসকে অনুভব করি। বুক ভরে শ্বাস টানি।

কাশ্মীরা হোটেলে ফোন করে। একটু কথা বলেই আমায় জানায় যে সব ঠিকঠাক।আমাদের রিজার্ভ করা রুম দুটো তৈরী। এখন শুধু গিয়ে আমাদের চেক-ইন করার অপেক্ষা। ডক্টর আদিত্যকে কন্ট্যাক্ট করি ফোনে। ওঁরা এখনো ট্রেনে, ট্রেন কয়েক ঘন্টা লেটে চলছে, তবে মনে হচ্ছে ভোরে পৌঁছে যাবে এখানে।

স্টেশনের পাশেই ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, সেখান থেকে ট্যাক্সি ধরে সো ও ও জা হোটেলে। খোলা প্রান্তরের বুক চিরে রাস্তা, হু হু হু হু হাওয়া। দিগন্তের কাছে সূর্যাস্তমেঘেরা অপরূপ রঙে সেজেছে। বাকী আকাশ নীল, এই আকাশ ভরে তারারা যখন ফুটবে সে যে কী অপূর্ব একটা ব্যাপার হবে সে কল্পনা করেই মন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। কাশ্মীরা গভীর একটা তৃপ্তির ভঙ্গী করে সীটে মাথা এলিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে গুন গুন করে, "তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা আমার সাধের সাধনা---"। দেখতে দেখতে এসে পড়ে আমাদের গন্তব্য। নেমে, জিনিসপত্র নামিয়ে, ভাড়া মিটিয়ে তারপরে হোটেলে চেক-ইন। দোতলার দুটো ঘর, দক্ষিণে ব্যালকনিওয়ালা, আমাদের জন্য।

আনন্দে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে উঠতে থাকে কাশ্মীরা, বলে, "আহ, এখন একটা ভালো স্নান হলেই বেহেস্ত হামীনস্ত। "

আমি হেসে বলি, "আমিও স্নান টান করে তারপরে তোমায় ফোন করবো। রাতে খেতে যাবো এখানের স্থানীয় কোনো রেস্তরাঁতে। স্থানীয় খাবার না খেলে আমার কেমন যেন অসম্পূর্ণ লাগে কোথাও যাওয়া।"

কাশ্মীরা হাসে, বলে, "আমিই তোমায় ফোন করবো আমার হয়ে গেলেই। ওহ,এক্ষুনি স্নানটা করতে পারলে বাঁচি।" তারপর ওর ঘরের দরজা খুলে ঢুকে যায় নিজের মালপত্র সামলে নিয়ে। আমিও আমার ঘরের দরজা খুলে ঢুকে পড়ি।

মালপত্তর সব একপাশে রেখে আগে ধরাচূড়ো খুলে খানিকক্ষণ এলিয়ে পড়ে থাকি সোফাতে। তারপরেই স্নান, আহ, এই স্নানটুকুর জন্য সর্বদেহমন তৃষ্ণার্ত হয়ে ছিল যেন।

স্নানটান সব সেরে বেরিয়ে পাটভাঙা নতুন পোশাক পরে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই। আকাশ ভরে আছে তারায় তারায়। এত তারা এত তারা, যেন তারায় তারায় ঠাসাঠাসি। অবিশ্বাস্য লাগে তাকালে। মরু অঞ্চলের রাত্রির আকাশ একেবারে বিশুদ্ধ ম্যাজিক।

ঝিঁ ঝিঁ করে কোথা থেকে যেন আওয়াজ আসছে। প্রথমে ঠিক বুঝেই উঠতে পারিনি, তারপরে দৌড়ে ঘরে এলাম। বালিশের পাশে ভাইব্রেশন মোডে রাখা ছিল ফোনটা, সেটাই ঝিঁ ঝিঁ করছে। তুলে দেখি কাশ্মীরা। বললাম, "হ্যাঁ, বলো মীরা। রেডি? খেতে যাবে এখন?"

কাশ্মীরা বললো, "হ্যাঁ চলো, আজ তাড়াতাড়িই ডিনার সেরে আসি। এমনিতেও এত লম্বা জার্নির ধকল,আজ ভালো করে ঘুম হওয়া দরকার। তবে নতুন জায়্গায় ঘুম হয়তো আসবে না সেভাবে ।"
আমি হাসলাম, "আমার তো সারারাত ব্যালকনিতে কাটাতে ইচ্ছে করছে। একসঙ্গে এত তারা আগে আর কখনো দেখেছি বলে মনে করতে পারি না।"

কাশ্মীরা হাসলো, বললো, "তোমার কবি বা শিল্পী হওয়াই উচিত ছিল। এখন চলো যাই খেয়ে আসি। হেঁটে যাই চলো, চারিদিক একটু ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে ।"

এবারে আমার পালা, হাসতে হাসতে বলি, "তবে? কবি বা শিল্পী হবার ক্ষেত্রে তুমিই বা কম কী?"

দু'জনে বেরিয়ে পড়লাম হোটেল থেকে। চমৎকার শারদ-সন্ধ্যা, হাওয়ার স্পর্শ হাল্কা, নরম। না-শীত না-গরম। আরো রাত বাড়লে হয়তো ঠান্ডা বাড়বে। আমাদের দু'জনেরই হাল্কা সুতীর পোশাক, তবে ভাঁজ করা শাল আছে সঙ্গে। ঠান্ডা পড়ে গেলে গায়ে জড়িয়ে নেওয়া যাবে।

কাশ্মীরা বলে, " হোটেলে খোঁজ নিয়েছি। ঐদিকে একটু দূরে একটা ছোট্টো লেক আছে। চলো লেকের পাড়ে একটুখানি বসি গিয়ে। ঐ লেকের কাছেই একটা ভালো রেস্তরাঁ আছে। ওখান থেকেই খেয়ে নেবো, চলো।"

আমি কথা না বলে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে চলতে থাকি ওর পাশে পাশে।এমন অদ্ভুত মরুরাত্রিতে অসংখ্য নক্ষত্রের আলোর নিচে যত কম কথা বলা যায়,ততই যেন ভালো।

লেকের চারপাশে পাথরের পাড়, একপাশে ঘাট, ধাপে ধাপে সাদা পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে জলের দিকে। ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে নেমে জলের একেবারে ধারে গিয়ে দাঁড়াই। অজস্র নক্ষত্রের প্রতিবিম্ব টলটল করছে আয়নার মতন শান্ত জলে। ঐখানেই বসে পড়ি আমরা, মাথার উপরে নক্ষত্রঠাসা আকাশ আর সামনে জলে সেই আকাশের প্রতিবিম্ব নিয়ে। চারিদিক একদম শান্ত, নির্জন। মাঝে মাঝে দূর থেকে রাতচরা পাখির ডাক ভেসে আসে।

কাশ্মীরা আস্তে আস্তে গান ধরে, "মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে / আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে ভ্রমি বিস্ময়ে", ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইতে থাকে ও, আমি আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে শুনতে শুনতে ডুবে যেতে থাকি অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে।

কতক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিলাম জানিনা, একসময় কাশ্মীরা গান থামিয়ে দিয়েছিল,কিন্তু সুরের রেশ রয়ে গিয়েছিল। ঘোর ভাঙে নি, আমরা আবিষ্টের মতন বসে ছিলাম নক্ষত্রময় অন্ধকারে। যেন সারা দুনিয়াতে মাত্র দু'জন রয়েছি আমরা, আমাদের সামনে শান্ত হয়ে আছে অনন্ত সময়ের ঐশ্বর্য। একটাও কথা বলিনি দু'জনের একজনও, কথা দিয়ে কি সবকিছু প্রকাশ করা যায়? কথার অতীত এক অলৌকিক সেতু আমাদের মধ্যে সংযোগসাধন করছিল।

ঠান্ডা হঠাৎ বেড়ে যেতে হুঁশ ফিরলো। কাঁধের ভাঁজ করা শাল খুলে জড়িয়ে নিলাম। কাশ্মীরা উঠে দাঁড়ালো, বললো, "চলো খেয়ে নিয়ে ঘরে যাই। রাত বেড়ে যাচ্ছে।" দূরের এক রাতচরা পাখি অদ্ভুত আওয়াজে ডেকে উঠে যেন সায় দিল ওর কথার।

আমিও উঠে পড়লাম। তারপরে রেস্তরাঁর দিকে হাঁটা। স্থানীয় খাবার বেছে বেছে অর্ডার করলাম। চাপাটি, আচার, ডাল, আমিষ তরকারি এইসব। এসে গেল খাবার, মুখে দিয়ে দারুণ লাগলো। চমৎকার খাবার সব। একটু বেশি ঝাল, তবে সে আমাদের আগে থেকেই অনুমানে ছিল। টকমিষ্টি আচার দিয়ে ঝাল ম্যানেজ করে আয়েস করে খেতে লাগলাম।

এক চুমুক জল খেয়ে কাশ্মীরা বললো, "ঝাল জিনিসটা আমার এত ভালো লাগে! সহ্য তেমন হয় না, তবু ভালো লাগে। কষ্ট-কষ্ট সুখের মতন এই স্বাদ।" হাসছিলো ও, ঝালে নাকমুখ লালচে দেখাচ্ছিল।

ঝালে হু হা করতে করতে আমিও জল খাই। তারপরে হেসে বলি, "ঝাল জিনিসটাই এরকম। বুক পোড়ানো সুখ।"

কাশ্মীরা হি হি করে হাসতে থাকে, চাটনিতে ডুবিয়ে চাপাটির টুকরো মুখে পোরে। খাওয়া শেষ করে বলে, "স্কুল-কলেজের দিনগুলোর ফুচকা খাওয়া মনে পড়ে যায়। আচ্ছা করে ঝাল দিতে বলতাম সবাই। তারপরে ঝালে হু হা করতে করতে খেয়ে কী আনন্দ। অভিভাবকেরা ফুচকা খেতে বারণ করতো বলে আরো বেশী যেন আনন্দ। নিষেধের বেড়া ডিঙিয়ে আনন্দ আরকি। "

খাওয়া শেষ হলে মৌরী দিয়ে গেল মুখশুদ্ধি হিসেবে। দাম মিটিয়ে আস্তে আস্তে হোটেলে ফিরলাম আমরা। এইবার শুধু নিটোল বিশ্রাম। ঘুম, আহ, ঘুম। আড়াইদিনের ঝক্কর ঝক্কর চলন্ত সময়ের পরে স্থির বিছানায় একটি শান্তির ঘুম।

ঘুমিয়েই পড়েছিলাম শান্তিতে। ঘুম ভেঙে গেল ফোনের ঝিঁঝিঁ তে। ঘুমজড়ানো চোখ কোনোরকমে খুলে দেখি কাশ্মীরা। সেকি? ওর আবার কী হলো? এই তো পাশের ঘরেই ও।

"হ্যালো " বলেই শুনতে পাই ওপাশ থেকে কেমন একটা অদ্ভুত ফোঁপানি, অবাক হয়ে ওঠে বসি। কাশ্মীরা কাঁদছে নাকি?

"মীরা, কী হয়েছে? কী হয়েছে তোমার?"

"আবীর, আমার খুব ভয় করছে, কান্না পাচ্ছে। জানি না কেন। তোমাকে বিরক্ত করছি হয়তো, কিন্তু সত্যি আমি আর পারছি না, চারপাশটা যেন আমায় গিলে খেতে আসছিল। তাই তোমায় ফোন করলাম।"
আমি বিছানা থেকে নামতে নামতে বললাম, "আমি আসছি, আসছি। তুমি উঠে দরজা খুলে দিতে পারবে?"
ও বলে, "হুঁ, পারবো। তুমি এসো।"

নিজের ঘরের চাবি রাতপোশাকের পকেটে নিয়ে দরজা লক করে বেরোই। কাশ্মীরা রুম পাশেই, নক করি। ও দরজা খুলে দেয়। আমি আস্তে আস্তে দ্বিধাজড়িত পদক্ষেপে ওর ঘরে ঢুকি।

ঘরে হাল্কা নীল আলো জ্বলছে। সেই আলোতে রেশমী রাতপোশাক পরা খোলা চুলের কাশ্মীরাকে অদ্ভুত লাগছে। যেন নীল এক মানুষী, কীসের অব্যক্ত বেদনায় নীল হয়ে আছে যার সর্বাঙ্গ। বুকের ভিতরটা কেমন উথালপাথাল করতে থাকে আমার।প্রাণপণ চেষ্টায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করি।

সোফার সামনে দাঁড়াই, কাশ্মীরা খাটের কোণায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তখনও ফোঁপাচ্ছে সে। ওকে এত অসহায় আর অবিন্যস্ত আগে কোনোদিন দেখিনি। অবশ্য এর আগে কোনোদিন এইভাবে এইরকম সময়ে ওকে দেখিনি।

উদ্বেগ গোপণ করতে পারি না, বলি,"মীরা, কী হয়েছে, মীরা? শান্ত হও, বসো।"

ও শুনতে পায় বলে মনে হয় না, একইভাবে ফোঁপাতে থাকে। ওকে ধরে ধরে এনে সোফাতে বসাই। তারপরে আস্তে আস্তে বলি, "শান্ত হও, শান্ত হও। কিচ্ছু বলতে হবে না, চুপ করে বসে থাকো কিছুক্ষণ। রিল্যাক্স। গভীর করে শ্বাস নাও, শ্বাস ছাড়ো, আবার গভীর করে শ্বাস নাও। মনটাকে শিথিল করে দাও।"

ও আমার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে বোবার মতন, নীল ঘুমবাতির আলোয় ওকে অপার্থিব বলে মনে হয়। ওর চোখ দুটোর মধ্যে চকচক করে জল, যেন কতযুগের না-ঝরা অশ্রু সেখানে জমে আছে।

আমি খুব মৃদুস্বরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মন্ত্রের মতন বলে যেতে থাকি, "শান্ত হও, শান্ত হও। রিল্যাক্স। গভীর করে শ্বাস নাও, শ্বাস ছাড়ো, আবার গভীর করে শ্বাস নাও। মনটাকে শিথিল করে দাও।"

আস্তে আস্তে টের পাই ওর শ্বাসপ্রশ্বাসের ছন্দ শান্ত হয়ে আসছে, ফোঁপানি কমতে কমতে থেমে যাচ্ছে। ওর দেহ শিথিল হয়ে আসছে ঘুমের স্নিগ্ধ স্পর্শে।

একসময়ে ও এলিয়ে পড়ে সোফার গায়ে, প্রলাপ বকার মতন জড়ানো গলায় বলে,"আবীর, আবীর, ওরা ---ওরা আমাকে ---ওরা আমাকে ওহ, ওরা আমাকে খুব কষ্ট দিল।ওরা---আমাকে---মেরে ফেলতে চাইছিল---আমি পালিয়ে গেলাম বলে পারে নি---কিন্তু ওরা খুঁজছে---ওরা খুঁজছে----"

ওর মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আমি ফিসফিস করে বলতে থাকি, "ভয় নেই, কোনো ভয় নেই। ওরা কেউ নেই, কেউ নেই এখানে। শুধু আমি আছি মীরা, শুধু আমি আছি। তুমি ঘুমোও, তুমি ঘুমোও।"

আস্তে আস্তে শান্ত ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যায় কাশ্মীরা। আমি ওকে সোফাতেই ভালো করে শুইয়ে দিয়ে খাট থেকে বালিশ আর চাদর এনে মাথার নিচে বালিশ আর গায়ের উপরে চাদর ঢাকা দিয়ে আস্তে আস্তে চলে আসি নিজের ঘরে। দরজাগুলো বাইরে থেকে টেনে দিলে লক হয়ে যায়, তাই দরজা বন্ধের অসুবিধা ছিল না।

ঘরে এসে হাল্কা আলো জ্বালিয়ে জল খাই বোতল খুলে, একঘুম ঘুমিয়ে উঠে আবার এইরকম সময়ে চট করে ঘুমিয়ে পড়া শক্ত। তারচেয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বসি।

মোটা চাদর দিয়ে ভালো করে মুড়িসুড়ি দিয়ে চেয়ার নিয়ে গিয়ে বসি ব্যালকনিতে। তারপরে তারাদের দিকে চেয়ে চেয়ে কেটে যেতে থাকে নির্জন নিস্তব্ধ নৈশ প্রহরগুলো। আহ, শান্তি, শান্তি।

আজকে কিন্তু মনাই আর আসে না। সে হয়তো এতদিনে সেই ফুলের প্রান্তরে শান্তির সন্ধান পেয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমার তো সেই শান্তির অনেক দেরি। আমি তো ক্ষমার যোগ্য না, প্রায়শ্চিত্ত শেষ হলে তবে মুক্তি।

আজকে কেবলই কাশ্মীরাকে মনে পড়তে থাকে। কী অসহায় আর আর্ত দেখাচ্ছিল ওকে! ওর জীবনের কতটুকুই বা জানি! কথাপ্রসঙ্গে টুকরোটাকরা যতটুকু শুনেছি, তার বেশী না। একটা আবছা আভাস পেয়েছি যে নানা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল ওকে, কিন্তু সে তো প্রায় সব মানুষের জীবনেই অল্পবিস্তর হয়। আজ মনে হলো ওর হয়তো কোনো সাংঘাতিক কঠিন অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা আছে, কোনো ট্রমা আছে, যা ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের চেষ্টার আড়ালে সাবধানে গোপণ করে রেখেছে। আজ কোনো কারণে হয়তো আর পারে নি সহ্য করতে, তাই প্রকাশ করতে চেয়েছে । কিন্তু এ নাও হতে পারে, হয়তো ওর মনে অন্য কোনো কষ্ট বা অবসাদ থাকতে পারে, যা বলেছে হয়তো সবই সেই অবসাদ থেকে উত্থিত প্রলাপ মাত্র।

মাথার উপরের তারাগুলো পশ্চিমে ঢললো, পুবে কত নতুন তারা উঠলো। আমার আর উঠে ঘরে যেতে ইচ্ছে করছিল না। স্বচ্ছ রাত্রের ঐ টলটলে তারাগুলোকে যেন না ঝরা অশ্রু বলে মনে হয়, পৃথিবীর উপরে ঝুঁকে পড়ে যেন ওরা খুঁজছে মায়াময় ভালোবাসায়। আমরা কি সেই ভালোবাসার যোগ্য হতে পেরেছি এখনও?

ঐ সব দূর নক্ষত্রের কারুর কারুর চারিপাশে গ্রহজগৎ আছে, হয়তো পৃথিবীর মত গ্রহ আছে, এমনই জলে বাতাসে উদ্ভিদে প্রাণীতে পরিপূর্ণ অপূর্ব এক গ্রহ। হয়তো আমাদের মতন প্রাণীও আছে, আমাদেরই মতন হয়তো যারা গড়ে তুলেছে সভ্যতা। হয়তো তারা দেহে মনে বুদ্ধিতে হৃদয়বৃত্তিতে আমাদের চেয়ে বেশি উন্নত। একদিন হয়তো আমাদের দুই দলের দেখা হবে। যদি আমরা উপযুক্ত হই ওদের সঙ্গে মিলবার, তবেই। নিজেদের এই ছোট্টো পৃথিবীতে নিজেদের মধ্যেই এখনও মারামারি কাটাকাটি শেষ হলো না আমাদের, মহাপৃথিবীর আহ্বানে সাড়া দিতে পারি সেই যোগ্যতা কোথায়?

এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন চোখ লেগে গেল, চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

বেশ আরামেই ঘুমিয়েছিলাম, জাগলাম সুন্দর সুরেলা পাখির ডাকে। চোখ মেলে দেখ্লাম অন্ধকার কেটে গিয়ে এক অপূর্ব মুক্তোরঙের ভোর বার হয়ে আসছে। মণিকণার মতন যে তারাগুলো জ্বলছিলো, ওরা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে।

নির্জন বিস্তীর্ণ ঢেউখেলানো প্রান্তর ও ও ও ও ই দূর দিগন্ত অবধি বিছিয়ে পড়ে আছে। পুব আকাশের কপালে লাগছে গোলাপী স্পর্শ। কী পবিত্র এক মুহূর্ত! একেই মনে হয় ঊষামুহূর্ত বলে! এই রকম শেষ কবে দেখেছিলাম মনে করতে পারি না। এত ভোরে ওঠা তো হয় না!

সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকি পূর্বাস্য হয়ে। মনের মধ্যে কেবলই উপনিষদ ভেসে উঠতে থাকে, "তমসো মা জ্যোতির্গময়/ মৃত্যোর্মা অমৃতম গময়/আবীরাবীর্ম এধি", কোথায় যেন শুনেছিলাম এই মন্ত্র, কে যেন গানের মতন গাইছিল, কে সে, মনে করতে পারি না। কিংবা হয়তো শুনিনি কারুর গলায়, কোথাও পড়েছিলাম, বাকীটা কল্পনা করে নিয়েছি।

ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ করে ঘর থেকে ফোনটা ডেকে ওঠে এইসময়। বালিশের পাশে রেখেছিলাম ফোনটা। এত সকালে কে ফোন করতে পারে? তাহলে ডক্টর আদিত্যরা হয়তো পৌঁছে গেলেন।

ঘরে গিয়ে ফোন তুললাম। হুঁ, যা ভেবেছিলাম। ফোনের অন্যপ্রান্তে ডক্টর আদিত্য।

"হ্যালো, ডক্টর আদিত্য। সুপ্রভাত।"

"সুপ্রভাত আবীর। আমাদের ট্রেন এইমাত্র পৌঁছলো। আমি আর অসিতদা দুজনেই বহাল তবিয়ৎ। যদিও এত লম্বা জার্নিতে একেবারে যাকে বলে দুমড়েমুচড়ে ল্যাগব্যাগ হয়ে পড়া অবস্থা।" উনি হাসতে হাসতে বললেন।

"আপনারা সরাসরি হোটেলেই যাচ্ছেন তো? "

"হুঁ, একেবারে সোজা হোটেল। আজকে আর আগামীকাল কোনো কিছু না, শুধুই বিশ্রাম করবো দুই বুড়ো। আগামী পরশু থেকে আমাদের মীটিংগুলো শুরু হবে। ঠিক আছে?"

"একদম ঠিক আছে। জহীর আর রুদ্ররাও মনে হয় আজকে কালকের মধ্যেই সবাই পৌঁছে যাবে।"

"হ্যাঁ, রুদ্র আমাকে ফোন করেছিল, ওরাও কাছাকাছি এসে পড়েছে। আজকে দুপুর কি বিকেলের মধ্যে চলে আসবে। তোমরা তো গতকাল সন্ধ্যেতেই মনে হয় পৌঁছেছ। কেমন বুঝছো ব্যব্স্থা?"

আমি হেসে বলি, "ব্যবস্থা দারুণ। থাকার পক্ষে আমাদের এই হোটেলটা বেশ ভালো হোটেল। স্থানীয় খাবার চেখে দেখলাম কাল রাত্রে। বেশ ভালো, একটু ঝালের দিকেই, তবে আমাদের দারুণ লেগেছে।"

"চমৎকার। আমরাও এবারে এসে গেলাম। এই দুদিন জিরেন নেবো আর স্থানীয় খাবার চেখে দেখবো। যদিও বুড়ো হাড়ে সব সইবে না, রয়ে সয়ে দেখেশুনে চাখবো আরকি। হা হা হা। রাখছি এখন। পরে আবার কথা হবে।"

ফোন রেখে দিলেন উনি। আমি ফোনটা আবার বালিশের পাশে রেখে আড়মোড়া ভাঙলাম। সূর্যোদয় হয়ে এখন নতুন দিন শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রস্তুত হতে হবে দিনটার জন্য । নতুন শহরকে সকালের আলোয় কেমন লাগে সেটাও দেখার। স্নানটান সব সেরে তৈরী হতে থাকি নতুন দিনের জন্য।

কাশ্মীরা যখন দরজায় টোকা দিল তখন আমি একেবারে তৈরী। সকালের ঝকঝকে আলোয় সদ্যস্নাত ও অল্প সাজগোজ করা কাশ্মীরাকে দারুণ লাগে। গত রাত্রের ঐ আর্ত অসহায় মেয়েটিকে আর কোথাও দেখা যায় না। হাল্কা সবুজরঙের রেশমী চুড়িদার পরা ঝকঝকে হাসিমুখের কাশ্মীরাকে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি মনে মনে। কাল রাত্রে ওকে ঐ অবস্থায় দেখে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম সত্যি।

হেসে বলি, "মীরা, সুপ্রভাত, সুপ্রভাত। এসো, ভেতরে এসে একটু বসো। আমি এই কয়েকটা জিনিস গুছিয়ে নিয়েই বেরোচ্ছি।"

কাশ্মীরাও হাসে, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, " সুপ্রভাত আবীর। আজকে লোকাল কোনো দোকানে ব্রেকফাস্ট করে নিয়ে শহর দেখতে বেরোবো। সকালের আলোয় কেমন লাগে এই জায়্গা, সেটা তো দেখতে হবে। কী আবীর, রাজি?"

আমি ক্যামেরা বাইনোকুলার ডাইরি ইত্যাদি আরো নানা জিনিসপত্র ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলি, "হ্যাঁ অবশ্যই। এক্জ্যাক্টলি আমিও এই কথাগুলোই বলতে যাচ্ছিলাম।"

এবারে আরো জোরে হেসে ফেলে কাশ্মীরা বলে, "দ্যাখো কেমন মাইন্ড রিড করতে শিখে ফেলছি।"

আমার সব নেওয়া হয়ে গিয়েছিল, দু'জনে বেরিয়ে দরজা টেনে লক করে দিয়ে হাঁটতে থাকি করিডর ধরে। করিডরে ভারী সুন্দর নকশা করা গালচে পাতা।

হাঁটতে হাঁটতে আবার সেই লেকটার কাছে। কাল রাত্রে দেখেছিলাম, সে ছিল আভাস মাত্র। আজকে সকালের আলোয় কী অপূর্ব লাগছে হ্রদের শান্ত জলতল! অন্য পাড়ের টিলাটাকে ম্যাজিকদেশের পাহাড়ের মতন লাগে, যার ছায়া পড়েছে জলে। হ্রদ ঘিরে গাছপালা রয়েছে নানারকম, চারিদিকের বালি-বালি ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে এই সবুজ বড় শান্তি দেয়। কাশ্মীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাকিয়ে থাকে লেকের দিকে। আমি ক্যামেরা বার করে কয়েকটা ছবি তুলি, দুটো ছবিতে কাশ্মীরাও থেকে যায় লেকের সঙ্গে।

এবারে প্রাতরাশ করে নেবার জন্য রওনা। কাল রাতে যেখান থেকে খেয়েছিলাম সেখানে রান্নাবান্না এখনো শুরু হয় নি, ওরা মধ্যাহ্নভোজ আর নৈশাহারের দোকান। একটু এগিয়ে একটা ছোট্টো চায়ের দোকান পাওয়া গেল, ওখান থেকেই চা আর বিস্কুট খেয়ে নিই আমরা। চা বেশ ভালো, প্রচুর দুধ আর হাল্কা এলাচ দেওয়া মশলা চা, চমৎকার স্বাদ।

তারপরে শহর দেখতে বেরোনো। চায়ের দোকানেই জিজ্ঞেস করে জেনেছিলান আজ এখানে হাটবার। একটু এগিয়েই সেই হাট। হাট বসে গেছে ভোর থেকেই। চলবে সারাদিন। পসরার পর পসরা সাজাচ্ছে দোকানীরা। দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে নানা জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে ব্যাপারীরা, ক্রেতারাও অনেকেই এসেছে দূর থেকে।

একটা রঙচঙে মেলার মতন ব্যাপার। ভারী ভালো লাগলো আমাদের। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম দোকানে দোকানে। এগুলো সব অস্থায়ী দোকান, তাঁবুর মতন। কিন্তু সব লাল সবুজ হলুদ নীল নানা রঙের তাঁবু, কোনো কোনোটায় আবার রেশমী ঝলমলে সব ঝালর ঝুলছে। যথেচ্ছ ছবি তুলতে লাগলাম।

অপূর্ব সব জিনিসপত্র দোকানে দোকানে। এক দোকানে নানা রঙের পাথরের গয়না দেখে কাশ্মীরা ওখানেই মজে গেল, আমি পাশের দোকানে সূচীশিল্পের অপূর্ব সব কাজ দেখছিলাম। রেশমী আর সুতীর কাপড়ের উপরে নানা রঙের সুতো দিয়ে সূচীকর্ম।কয়েকটা টানটান করে ঝোলানো। একটা কাজ অপূর্ব, এক সারি সাদা হাঁস উড়ে যাচ্ছে কালো ব্যাকগ্রাউন্ডের উপর দিয়ে। নীচে জল, সেই জলে হাঁসেদের উল্টো ছায়া। পুরো ব্যাপারটা একেবারে রূপকথার ছবির মতন। নানা অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুলে নিলাম কয়েকটা।

ছবি তুলে বেরোচ্ছি, তখনই ফোন এলো। জহীরের ফোন। ওর ট্রেন এসে পৌঁছেছে । এখন ও স্টেশনে, একটু বাদেই হোটেলে আসছে। আগে থেকেই জানা ছিল জহীর আমাদের হোটেলেই চেক-ইন করবে।

গয়নার দোকানে কাশ্মীরা তখনো পাথরের দুল পছন্দ করছিল। একজোড়া ঝিকিমিলি লাল পাথরের দুল কিনে তখনই পরে নিল। সত্যি সুন্দর দুল।

দোকান থেকে বেরিয়ে আবার আমরা হাঁটতে থাকি হাটের মধ্য দিয়ে। আস্তে আস্তে বললাম, "জহীর ফোন করেছিল, পৌঁছেছে ও। হোটেলে আসছে কিছুক্ষণ বাদে।চলো আমরা গিয়ে অপেক্ষা করি, ওকে ওয়েলকাম জানানোর জন্য। "

কাশ্মীরা হাসে, মৃদুস্বরে বলে, "দলের সবাই এক হোটেলে না উঠে তিন চারটে হোটেলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ওঠা হচ্ছে যেন আগে থেকেই চেনা বেরিয়ে না পড়ে সেটার জন্য। ভুলে গেলে আবীর? জহীর আসুক না নিজের মতন, হোটেলের ঘরে গিয়ে জিরিয়ে টিরিয়ে ধাতস্থ হোক। পরে না হয় ফোন করে আবার সংবাদ নেবো। আর, এই দু'দিন তো বিশ্রাম আর নিজেদের মতন ঘোরাফেরা ছাড়া কিছুর প্ল্যান করা হয় নি। তাই না?"

আমি মাথা নেড়ে সায় দিই। তারপর বলি, "তাহলে কী করবে এখন?"

ও বলে, "চলো কোনো ভালো খাবার জায়গা থেকে ভালো করে ব্রেকফাস্ট করি। ঐ এক কাপ চা আর একটা কুড়কুড়ে বিস্কুটে কিছুই হয় নি। "

"হ্যাঁ, তাই ভালো। চলো লোকাল কোনো ভালো খাবারের দোকান খুঁজি।"

লোকাল খাবারের দোকান পাওয়া গেল। ছোটো দোকান, অস্থায়ী, তাঁবুর মতন গড়ন এরও। ভেতরে বসার জায়্গা অবশ্য আছে কাস্টমারদের। সেখানে স্থানীয় ঝাল ভুজিয়া আর পানীয় হিসেবে ঠান্ডা দইয়ের সরবৎ খেতে খেতে হঠাৎ রাস্তায় দু'জনকে দেখে বেশ চমকে উঠে কাশ্মীরাকে দেখালাম সাবধানে। ডক্টর প্রতাপ পালচৌধুরী আর ডক্টর পুরঞ্জয় ক্ষেত্রী, শেষজন জহীরের বস।

এঁরা এখানে? আর ডক্টর পালচৌধুরীর সঙ্গে ক্ষেত্রী ? অদ্ভুত ব্যাপার! পালচৌধুরী তো অনেকদিন অবসর নিয়েছেন! শেষ দেখা হবার সময় তো বললেন উনি এখন কোন্ মিশনারী স্কুলে পড়ানোর কাজ করেন, স্বেচ্ছাশ্রম । নিজের সমস্ত সঞ্চয় নাকি সেখানেই দিয়ে সেখানেই আছেন!

প্রথমে মনে হল ভুল দেখেছি। কিন্তু দুজনেই ভুল দেখলাম? কাশ্মীরার ভুরু কুঁচকে গেছিল, খাওয়ার বাকী সময়টা জুড়ে কুঁচকানো ভুরু সোজা হল না। খাওয়া শেষ করে দাম মিটিয়ে হোটেলে ফিরে চললাম।

কাশ্মীরা একদম চুপচাপ পুরোটা রাস্তা। হোটেলের একেবারে কাছে এসে বললো,"এখন গিয়ে একটু বিশ্রাম নেবো। দুপুরের খাওয়ার সময় আবার ডেকো। ঐ লেকের ধারের রেস্তরাঁ তেই সেরে নেওয়া যাবে। জহীর যদি ইতিমধ্যে হোটেলে এসে গিয়ে থাকে, তবে ওকেও সঙ্গে নেওয়া যাবে।"

আমার কিছুই বলার ছিল না, মৌন থেকে সম্মতি জানালাম মাত্র।

হোটেলে ফিরে ঘরে বসে স্কেচ করতে করতে মনে হল, ঈশ, সঙ্গে ক্যামেরা ছিল, ঐ দুজন অপ্রত্যাশিত কিন্তু পরিচিত আগন্তুকের ছবি তুলে এভিডেন্স রাখা যেত। তখন মনেই হয় নি! আসলে শকটা বেশি ছিল, চিন্তাভাবনা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য এখন আবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে মনে হল কাকতালীয়ও হতে পারে পুরো ব্যাপারটা। হয়তো ওঁরা এখানে বেড়াতে এসেছেন ছুটিতে।

জহীর আবার ফোন করলো, বললো হোটেলে চেক ইন করেছে। আমি ওকে বললাম, "বাহ, বেশ। শোনো জহীর, তুমি স্নানটান সেরে বিশ্রাম করে নাও। কাশ্মীরা আর আমি দুপুরের খাবার খেতে যাবো এখানের একটা বেশ পছন্দসই রেস্তরাঁতে, এই ধরো আন্দাজ সাড়ে বারোটা নাগাদ বেরোবো আমরা। তুমি আমাদের সঙ্গে যোগ দিলে খুশি হব। আসবে খেতে?"

জহীর বললো, "হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই অবশ্যই। এখানের খাবারের দোকান টোকান কিছু সম্পর্কেই তো আমার আইডিয়া নেই। তোমাদের সঙ্গে খেতে যাওয়ার সুযোগ আমার পক্ষে গ্রহণ করা ছাড়া উপায় কোথায়? হা হা হা।"

"ঠিক আছে, তাহলে এখন রাখি। আবার এই ধরো সোয়া বারোটা নাগাদ ফোন করবো। তুমি তৈরী থেকো।"

ফোন রেখে আবার বিছানায় আধশোয়া হয়ে স্কেচবুকে হিজিবিজি টানতে থাকি। যত রাজ্যের এলোমেলো চিন্তা মাথায় আসে আর ভেসে চলে যায়, স্থায়ী হয় না। কেমন একটা অদ্ভুত মনের অবস্থা। সামনে সবকিছুই অজানা, সাহস করে সেই অজানার অন্ধকারেই ঝাঁপ দিয়ে পড়তে হবে জানি, তবু অতীতের সুখদুঃখগুলো ছায়ার মতন ফিরে ফিরে আসছে। তাই মনটা কেমন বোবা হয়ে আছে, হাত এলোমেলো রেখা টেনে চলেছে স্কেচখাতায়।

এই রকম শান্ত আর অন্যমনস্ক অবস্থার মধ্যে পড়লেই ভয় হয় আমার, এই বুঝি কোন্ অতল থেকে মনাই ভেসে ওঠে। কিন্তু আজ সে আসে না, তাহলে কি আর সে আসবে না? আগে বারে বারে ফিরে ফিরে আসতো। ভয় লাগতো কষ্ট লাগতো বিরক্তও লাগতো ওর স্মৃতিগুলো ভেসে উঠলে, এখন মনে হল হয়তো সেইসব কষ্টের ভিতরে কোনো গোপণ সুখও ছিল। নইলে আজ তার স্মৃতি ভেসে উঠে না দেখে এমন আশ্চর্য ফাঁকা ফাঁকা কেন লাগে?

সময় কেটে গেল স্কেচবুকের পাতা ভরাতে ভরাতে। এক সময় কেমন একটা ক্লান্তিতে ঘুম ঘুম এসে গেল, শারীরিক ক্লান্তি না, মানসিক শিথিলতা। ঘোরের মধ্যে নিঃশব্দে আমার ভিতর থেকে কে যেন বলতে লাগলো, "মনাই, মনাই,আমার উপর রাগ করলি তুই? আর আসবি না? "

সেই ফুলের প্রান্তরে আবার দেখতে পাই নিজেকে, এক দিশাহারা এলেমেলো একলা মানুষ, যার কাছে যোগাযোগের উপায় কিছু নেই, দিক চেনার কোনো উপায়ও নেই। দূরভাষ কোথায় পড়ে গিয়েছে, কম্পাস কোথায় হারিয়ে গিয়েছে, আকাশের নক্ষত্র দেখে দিকনির্ণয়েরও উপায় নেই, নক্ষত্র কিছু দেখা যাচ্ছে না, দিনের আকাশ। সূর্যও ধোঁয়াটে মেঘের আড়ালে। কোন্ দিকে যাবো? কোনটা উত্তর, কোনটা দক্ষিণ? কোনো হদিশ নেই।

একঝাঁক কমলা রঙের প্রজাপতি উড়তে উড়তে চলে যাচ্ছে মাঠের উপর দিয়ে। আকাশে উড়ে যাচ্ছে একদল হাঁস। ওরা যেদিকে যাচ্ছে সেইদিকে যাবো?

হঠাৎ দেখি একটা ফড়িং বসে আছে ঘাসের উপরে পড়ে থাকা একটা কীসের উপর, ফড়িং এর ডানা কাঁপছে, তাতে কত রঙ ঝলকাচ্ছে! কাছে গিয়ে দেখি ওটা আমার মুঠোফোনটা। ঘাসের উপরে পড়ে আছে।

এইসময়েই রিংটোন, কে ফোন করেছে। জেগে উঠে বাস্তব আর স্বপ্নের মধ্যে পার্থক্য করতেই খানিকটা সময় গেল। সত্যি সত্যি মুঠোফোনে রিংটোন, জহীর অথবা কাশ্মীরা। দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেল তাহলে। এতক্ষণ ঘুমালাম নাকি?

(চলমান)


মন্তব্য

আয়নামতি এর ছবি

বাহ্! বেশ জমে ওঠছে ধীরে ধীরে। মনে হচ্ছে ডক্টর প্রতাপ পালচৌধুরী আর ডক্টর পুরঞ্জয় ক্ষেত্রী ভালো গিট্টু লাগাবেন। একটা নিপাট ভালো মানুষ, থুড়ি গল্প যেন রহস্য কাহিনিতে মোড় নিতে যাচ্ছে... অন্যদিকে কাশ্মীরার ক্ষতময় অতীতের সামান্য উঁকি দিয়ে যাওয়া। কী হবে? কী হতে পারে! হ্যাঁ ভাই, কাহিনি ক্রমশ জমজামট হচ্ছে...গ্যাঁট হয়ে বসুন, আগামি পর্বের জন্য.. দোহাই আল্লার পরের পর্বের জন্য বেশি অপেক্ষায় রেখো না দিদি। হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

হাসি হাসি হাসি হাসি
প্রথম পাতা থেকে এটা চলে গেলেই নতুন পর্ব দেবো । সেইভাবেই তো দিয়ে যাচ্ছি ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আপনার গদ্যের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর কাব্যময়তা। একটু একটু করে পাঠক সেই কাব্যের ছন্দে ঢুকে পড়েন। কাহিনীটাকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিন, তাতে উপন্যাসের এই জমাট ভাবটা শেষ অবধি টিকে থাকবে। এতে উপন্যাসের দৈর্ঘ্য বাড়ুক বা কমুক ক্ষতি নেই।

ফরম্যাটিংটা একটু কেমন যেন, ঠিক স্বস্তি পাই না। মনে হয় প্যারা ভেঙে ভেঙে দিলে চোখের আরাম হতো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তুলিরেখা এর ছবি

হ্যাঁ, ফর্ম্যাট টা ঘেঁটে গিয়েছে । দেখি সম্পাদনা করে খানিকটা ঠিক করা যায় কিনা ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

হ্যাঁ, এখন ঠিক লাগছে। তবু রাতে খেতে বাইরে যাবার শুরুর অংশটুকু এখনো একটু কেমন যেন হয়ে আছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তুলিরেখা এর ছবি

ওখানটাও ফর্ম্যাট ঠিক করে দিলাম।
আপনার মন্তব্য পেয়ে একটু সাহস পাই। তার আগে এই কাহিনি জমছে কিনা সেটা বুঝেই উঠতে পারছিলাম না। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার কমিটমেন্ট আমাকে অনুপ্রাণিত করে তুলিরেখা। আমার 'চলবে' গুলোকে চলমান করার সাহস পাই।

---মোখলেস হোসেন

তুলিরেখা এর ছবি

কমিটমেন্ট আর কী? একটা লেখা আদৌ পাঠযোগ্য হচ্ছে কিনা সেটা বোঝার চেষ্টামাত্র । হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সোহেল ইমাম এর ছবি

পড়লাম, চলুক লেখা। পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

তুলিরেখা এর ছবি

পড়ছেন বলে অনেক ধন্যবাদ । কেমন হচ্ছে সেটা তো বলবেন!হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।