নৈরঞ্জনা (৭)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: শনি, ১৫/০৯/২০১৮ - ৬:৫৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৭।
দিন গুনতে গুনতে একদিন এসে গেল দিনটা। রওনা দিলাম আমরা। এখান থেকে আমি আর কাশ্মীরা। আমাদের সহকর্মী ও বন্ধু জহীর আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে। সে ওর গ্রাম থেকেই রওনা হচ্ছে। কিছুদিন
আগেই দীর্ঘ ছুটি নিয়ে ওর গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। আদিত্যনগর থেকে রওনা হচ্ছেন ডক্টর আরুণাংশু আদিত্য আর অসিতদেবল বসু। রুদ্র আর ওর সহকর্মীরা রওনা হচ্ছে আরেকটা দলে। এই চারটি দল ট্রেনে করে গিয়ে যে স্টেশনে নামবো একদিন দু'দিন আগে পরে, সেটা সকলের জানা।

আমাদের এমনি ছুটির সঙ্গে আরো দিন আঠেরোর ছুটি মঞ্জুর হয়েছিল। ঐ হরেদরে মাসদেড়েকের মতন হাতে রইলো আমাদের। রওনা হবার দিনটা তো অনেক আগের থেকেই জানা ছিল, তাই টিকিট বুক করা, কনফার্ম করা সবই একদম হাতে সময় রেখে করা হয়েছিল। ফার্স্ট ক্লাসের রিজার্ভেশনই পাওয়া গিয়েছিল।

রওনা হবার আগের দিন কথা হয়েছে ডক্টর আদিত্যের সঙ্গে আর জহীরের সঙ্গেও। ডক্টর আদিত্য আর অসিতদেবলবাবু একদম রেডি। পরদিন ট্রেনে রওনা দেবেন। রুদ্ররা আগেই একটা ফিল্ড ট্রিপে আমাদের গন্তব্যের দিকে একটু এগিয়েই ছিল। ডক্টর আদিত্য বললেন ওরা ঐখান থেকেই রওনা হচ্ছে আমাদের গন্তব্য শহরের দিকে। জহীর জানিয়েছে সেও রওনা দিচ্ছে পরদিন। জহীরের কথা ডক্টর আদিত্যকে আগেই জানানো হয়েছিল, উনি সাগ্রহে সম্মতি দিয়েছেন।

দীর্ঘ ট্রেনযাত্রা। প্রায় আড়াইদিনের। সেইমতন মানসিক প্রস্তুতি আর লটবহর সব নিয়ে রওনা হলাম স্টেশনের দিকে। ট্রেনে উঠে নিজেদের রিজার্ভড কামরা খুঁজে জিনিসপত্তর সব বাংকে তুলে নিচের প্রশস্ত সীটে গুছিয়ে বসে কাশ্মীরা হাঁপ ছেড়ে বললো, "ওফ, তাহলে সত্যি সত্যি রওনা হলাম! " তারপরে মিনারেল ওয়াটারের বোতল খুলে ঢকঢক করে জল খেয়ে ওড়নায় মুখ মুছতে মুছতে কিশোরীর মতন হাসলো। সেই হাসি দেখে আমার বুকের মধ্যে কেমন যে করে! বারে বারে কেন যে মনাইকে মনে পড়ে কেজানে!

মন হাল্কা করতে হেসে বললাম, "এখনো হইনি টেকনিকালি। ট্রেন এখনো চলতে শুরু করেনি।" ট্রেন ছাড়ার সিগ্ন্যাল দিয়ে দিয়েছে তখন, ট্রেন নড়ে উঠতেই কাশ্মীরা হাসতে হাসতে গান করে উঠলো, "আমাদের যাত্রা হলো শুরু, ওগো কর্ণধার ---"

চারিদিকে ঝকঝকে সকাল, সুন্দর শরতের দিন। তেমন গরমও না তেমন ঠান্ডাও না যাকে বলে নাতিশীতোষ্ণ। সুন্দর ঝলমলে রোদ্দুর্র চিরে, সবুজ মাঠ আর পদ্মফুলে ভরা দিঘি পাশে রেখে ছুটে চললো আমাদের লৌহশকট, কু উ উ ঝিকঝিক করে।

ট্রেনের গতি কেমন একটা ছন্দোময় আরাম এনে দেয় শরীরে। আর ছুটন্ত জানালার ভিতর দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চোখ পায় বিচিত্র দৃশ্যের আশীর্বাদ। কাশ্মীরা দেখলাম একটা গল্পের বই খুলে বসেছে। পড়ছে আর মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে। আমি কেবলই দৃশ্যই দেখছি, ব্যাগে স্কেচখাতা আর বেশ কিছু গল্পের বই থাকলেও বার করতে মন লাগছে না।

জানালা দিয়ে ফুরফুর করে হাওয়া আসছে, কপালে, গালে, চুলের মধ্যে হাওয়ার স্পর্শ ভারী চমৎকার লাগে। মাঝে মাঝে ঘটাং ঘটাং করে ট্রেনটা যখন ছন্দ বদলায়, তখনও দারুণ লাগে।

প্রথম ট্রেন থামলো চলা শুরুর দু'ঘন্টা বাদে। বেশ বড়ো স্টেশন। এইখানে অনেক নতুন দূরপাল্লার যাত্রী উঠলেন। ট্রেনে দাঁড়িয়েছিল প্রয় মিনিট কুড়ি, সেই অবসরে স্টেশনে নেমে চা আর স্ন্যাকস কিনে আনলাম।

এতক্ষণ আমাদের কামরায় আমরা দু'জনই ছিলাম, এখন আমাদের সঙ্গী হলো একটি ছোটো পরিবার। মধ্যবয়সী বাবামা আর তাদের কিশোরী মেয়ে, মেয়েটি সম্ভবতঃ স্কুল-ছাত্রী।

এরপরে ঝমঝম ঝিকঝিক করে ট্রেন চলে আর চলে। লাঞ্চের জন্য অর্ডার নিতে এলে কাশ্মীরা না করে দিল, আমাকেও বললো না করে দিতে। সে নাকি আজকের জন্য অনেক খাবার বাড়ী থেকেই তৈরী করে এনেছে।

আমাদের সঙ্গী পরিবারটি বেশ চুপচাপ, কিশোরী মেয়েটি উপরের বাঙ্কে শুয়ে আছে ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকা দিয়ে, হয়তো ঘুমোচ্ছে। ওর মা আর বাবাও খুব গম্ভীর, দুজনেই চুপচাপ বই পড়ছেন, মাঝে মাঝে মৃদুস্বরে নিজেদের মধ্যে সামান্য কথা বলছেন। মনে হলো কোনো কারণে ওঁরা দু'জনেই চিন্তিত।

চলিষ্ণু ট্রেনের দুলুনিতে কেমন ঘুম ঘুম লাগে। ঘুম তাড়াতে এদিক ওদিক তাকাই। আলগা চোখ চলে যায় উপরের বাঙ্কে শুয়ে থাকা কিশোরীর দিকে, হাল্কা সবুজ রঙের সালোয়ার-কামিজের উপরে হাল্কা সবুজ ওড়না, সেই ওড়না দিয়ে মুখ মাথা ঢেকে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে মনে হয় আসলে ঘুমের ভান করে আছে, নিঃশব্দে কাঁদছে। কেজানে হয়তো আমার কল্পনা।

মনাইকে যতবার ভুলতে যাই ততবার নানা অনুষঙ্গে মনে পড়তেই থাকে, পড়তেই থাকে। আমাকে তাড়িয়ে দেবার পর মনভাঙা মনাইকে নিয়ে ওর বাবা-মা পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিল। আমি অনেক পরে শুনেছিলাম ওদের এক আত্মীয়ের কাছে, তারাও সঙ্গে গিয়েছিলেন।
সহযাত্রী পরিবারটির কিশোরী মেয়েটিকে দেখে সেই কতকাল আগের পাহাড়ে বেড়াতে যেতে থাকা মনাইকে মনে পড়ে। সেও হয়তো এইভাবে নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে চলেছিল, সাবধানে লুকিয়ে রেখেছিল নিজের সেই শোকসন্তপ্ত মূর্তিটা। প্রথম প্রেমের মৃত্যু হয়তো ওর কাছে প্রায় সত্যিকার মৃত্যুর মতই ভয়ানক ছিলো। কে খোঁজ রেখেছিল ওর মনের মধ্যে কী হচ্ছে?

আস্তে আস্তে চারিদিক মুছে যায়, ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যাই। একটা নির্জন মাঠে রাশি রাশি সোনালী ফুল দুলছে, ছোট্টো ছোট্টো সূর্যমুখীর মতন ফুল, বুকের মধ্যে উজ্জ্বল খয়েরী রঙের ছোঁয়া। একটা কুলকুল শব্দ শুনছি, হয়তো কোনো নদী বা ঝর্ণা আছে কাছে। আন্দাজ করতে চেষ্টা করছি কোনদিকে সেই শব্দের উৎস। কিন্তু বুঝতে পারছি না, একবার মনে হচ্ছে ডানদিক থেকে আসছে, একবার মনে হচ্ছে সামনের দিক থেকে, একবার মনে হচ্ছে তাও না, আসছে বাঁদিক থেকে।
হঠাৎ খিলখিল করে একটা হাসি শুনি, মনাইয়ের হাসি। তারপর ওকে দেখতে পাই, সেই ক্লাস ইলেভেনের মেয়েটিই আছে সে, আজ তার হাল্কা সবুজ শাড়ী পরা, উজ্জ্বল খয়েরী কারুকার্যময় পাড় সেই সবুজ শাড়ীর।

সে বলে, "দাদাই, তুই বুঝতে পারছিস না বুঝি কোথা থেকে ঝর্ণার শব্দ আসছে? ঐ তো ঐদিকে। আমি চিনি। চল না, যাই ওদিকে।" সে হাত বাড়িয়ে দিগন্তের দিকে নির্দেশ করে। তাকিয়ে দেখি ঐদিকে নীল পাহাড়ের ঢেউ।

"মনাই, তুই এখানে কেমন করে? ভালো আছিস তুই? সেই যে তোকে শেষবার দেখেছিলাম, তুই সেইরকমই আছিস, তোর একদম বয়স বাড়েনি। " আমি অবাক-খুশি হয়ে বলি।

মনাই খিলখিল করে হেসে বলে, "এখানে কারুর বয়স বাড়ে না। সবাই থেকে যায় একই রকম। ভালো আছি রে দাদাই, খুব ভালো আছি। সেই যে তুই আমায় ফেলে চলে গেলি, তখন আমি শুধু দিনরাত ---শুধু দিনরাত---কুয়াশা কুয়াশা ---কিছু মনে পড়তো না, কারুকে চিনতে পারতাম না। তারপরে অনেকদিন ---অনেকদিন পরে--ওষুধ খেয়ে ওষুধ খেয়ে ---একটু যখন ভালো হলাম, মা বাবা আমায় নিয়ে পাহাড়ে বেড়াতে গেল।"

আমার হঠাৎ খুশিটুকুর উপরে এসে পড়ে ছুরির মতন তীক্ষ্ণ কষ্টের আঘাত, বুকভাঙা কাতর গলায় বলি, "আমি তোকে ফেলে চলে যাই নি মনাই, তোর বাবা-মা আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন। আমি কী করতে পারতাম বল, নিজের বাবা নেই মা নেই, তোর বাবামায়ের দয়ায় আমি মানুষ। ওঁরা যা চাইলেন, তার বিরুদ্ধে কী করে যেতে পারতাম আমি?"

খিলখিল করে হাসতে হাসতে মনাই বলে, "মিথ্যুক, মিথ্যুক, মিথ্যুক, তুই একটা আস্ত মিথ্যুক। আসলে তুই কেবল নিজের কথা ভেবেছিলি, তোর কেরিয়ার, তোর সাফল্য, এইসব। তুই আমার কথা কোনোদিন ভাবিস নি। আসলে আমি একা একাই ভালোবাসতাম তোকে, তুই কোনোদিন আমায় ভালোবাসিস নি। "

এই বলে সে দৌড়ে চলে যেতে থাকে সোনালি ফুলগুলোর ঝোপের মধ্য দিয়ে, জোর হাওয়ায় উড়তে থাকে ওর সবুজ আঁচল আর খোলা লম্বা চুল।

আকুল গলায় আমি বলতে গেলাম, "না না মনাই, এ সত্যি না, আমি তোকে ভালোবাসতাম, এখনও বাসি।" কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না।

হাল্কা ধাক্কায় জেগে যাই। কাশ্মীরা ডাকছে। দুপুর গড়িয়ে গেছে, লাঞ্চ খেতে ডাকছে ও। উঠে বসি, চোখে ডলা দিয়ে ঘুম মুছি। কামরায় আর কেউ নেই। কাশ্মীরার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাই। ও নিজের ব্যাগ থেকে টিফিনবাক্স বার করতে করতে বলে সহযাত্রী পরিবারটির তিনজনে মিলে লাঞ্চ খেতে চলে গেছে ডাইনিং কার এ।

কাগজের প্লেটে আমার খাবার সাজাচ্ছিল কাশ্মীরা, কয়েকটা লুচি, একটু তরকারি, দুটো সন্দেশ। এগিয়ে দিতে দিতে বললো, "বাপরে, দিনেদুপুরে কী ঘুম তোমার! দূরপাল্লার ট্রেনে করে যাচ্ছি এমন সুন্দর দিনে, কোথায় দৃশ্য দেখতে দেখতে গপ্পো করতে করতে যাবো, তা না ঘুমিয়ে রইলেন ইনি।"

লুচি ছিঁড়ে তরকারি জড়িয়ে মুখে দেবার জন্য রেডি করে রেখে ভালোমানুষের মতন বললাম, "সকালের দিকে তো ঘুমাইনি। কিন্তু তখন তো তুমি গম্ভীর হয়ে গল্পের বই পড়ছিলে। আর আড়চোখে মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে দৃশ্য দেখছিলে। গল্প করবে তাতো কই বলো নি!"বলেই নির্বিকারে খেতে শুরু করে দিলাম মন দিয়ে। ওফ্ফ, কী চমৎকার স্বাদ! কতদিন পরে আবার লুচি তরকারি!

কাশ্মীরা মনে হয় একটু রেগে গিয়েছিল আমার কথা শুনে, তারপরে হেসে ফেললো। ধরে ফেলেছে যে ওকে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করছি।

খেতে খেতে বললাম, "আমাদের সহযাত্রী পরিবারটির ব্যাপারটা কী বলো তো মীরা? মেয়েটা শুরু থেকেই মুখ ঢেকে ঘুমাচ্ছে বাঙ্কে, বাবা মা কেউ কথাই বলেন না নিজেদের মধ্যে আস্তে আস্তে দরকারী কথা বলা ছাড়া! কিছু বুঝতে পারলে?"

কাশ্মীরা আস্তে আস্তে বলে, "মেয়েটি অসুস্থ। ওরা বেড়াতে যাচ্ছে না, মেয়েটির চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে। মেয়ে ভালো হলে একসঙ্গে তিনজনে ফিরবে। আজ সন্ধ্যের মুখে ট্রেন যে স্টেশনে থামবে, সেখানে নামবে ওরা। সেখান থেকে অন্য লাইনের ট্রেন ধরতে হবে ওদের। "

কাশ্মীরার গলার স্বরে কী যেন ছিল, আমি আর কিছু বলতে পারি না। নীরবে খাওয়া সেরে নিই। বোতল থেকে জল খাই খানিকটা। তারপরে ব্যবহৃত প্লেটগুলো মুড়িয়ে সুড়িয়ে ঠোঙাতে ঢুকিয়ে রাখি, বড়ো স্টেশনে গার্বেজ বিন পাওয়া গেলে সেখানে ফেলে দিতে হবে।

আমাদের খাওয়া হয়ে যাবার খানিকক্ষণ পরে ফিরে আসে আমাদের সহযাত্রী পরিবারটির মেয়ে, মা আর বাবা। মা মেয়েকে প্রায় জড়িয়ে ধরে আনছেন, মেয়েটি কাঁদছে। মা অস্ফুটে মেয়েকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন কী যেন বলতে বলতে। এসেই চাদর টাদর বিছিয়ে মেয়েকে শুইয়ে দিলেন বাঙ্কে। মেয়েটি ফোঁপাতে ফোপাঁতে ঘুমিয়ে পড়লো।

আবার কামরায় নীরবতা, মেয়েটি ঘুমোচ্ছে, কাশ্মীরা বই পড়ছে, অসুস্থ মেয়েটির চিন্তিত বাবা-মা পাশাপাশি বসে আছেন, ভদ্রলোক খবরের কাগজ খুলেছেন আর ভদ্রমহিলা কখন জানি নিজের বটুয়া থেকে উলের গোলা আর কাঁটা বার করে খানিকটা হওয়া একটা মাফলার আবার বুনতে শুরু করেছেন।

আমি এইবারে স্কেচবুক বার করে এলোমেলো রেখা টানতে থাকি, টানতে থাকি।হিজিবিজির ভিতর থেকে বার হয়ে আসতে থাকে একটি মুখ, এলোমেলো চুলে যে মুখের প্রায় সবটাই ঢাকা, শুধু অশ্রু টলটল দুটি চোখ দেখা যায় একটু একটু। ওহ্হ,আবার সেই ছবি!

পাতা উল্টে নতুন সাদা পাতা বের করি, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি।কী অপূর্ব এক শরতের বিকেল আস্তে আস্তে সন্ধ্যের দিকে চলেছে। আদিগন্ত মাঠের উপর দিয়ে রেললাইন ছুটেছে ট্রেন। মাঠভর্তি কাশফুল কাশফুল কাশফুল। সূর্য ঢলে পড়েছে দিগন্তের কাছে, সেখানে মেঘগুলো কমলা হয়ে উঠছে। এই দৃশ্য আঁকা যায় না?

একঝাঁক পাখি মস্ত এক মালার মতন দল বেঁধে ফিরে চলেছে ওদের আশ্রয়বৃক্ষে।আরো একদল আসছে ওদের পরে পরে। আহ, টুকরো টুকরো দাগ দিতে থাকি স্কেচখাতা,পাখিদের ঐ নীড়ে ফেরার দৃশ্য কি আর ধরা দেয় আমার হাতের আঁকায়? ওটা তো শুধু দৃশ্য না, ওর মধ্যে যে অনুভব লুকিয়ে আছে! কবিতার মতন ঐ দৃশ্য।

দেখতে দেখতে সূর্য নামলো পাটে, বিকেল গড়িয়ে গেল আবীর রঙা সন্ধ্যায়, আদিগন্ত খোলা মাঠে এমন মহামহিম সূর্যাস্ত কবে শেষ দেখেছিলাম মনে করতে পারি না। এমনকি কাশ্মীরাও দেখলাম বই মুড়ে রেখে জানালা দিয়ে চেয়ে আছে বাইরে।

সন্ধ্যেবেলা ট্রেন থামলো মস্ত বড়ো এক জংশন স্টেশনে। হৈ চৈ আর ভীড়ে ভর্তি এক স্টেশন। এইখানেই আমাদের সহযাত্রী পরিবারটি নেমে পড়লো আমাদের বিদায় জানিয়ে। ওদের এইবারে অন্য লাইনের ট্রেন ধরতে হবে।

জানা ছিল ট্রেন দাঁড়াবে অনেকক্ষণ এখানে। আমি আর কাশ্মীরাও পালা করে নেমে মিনারেল ওয়াটার স্ন্যাকসের প্যাকেট এইসব কিনে টিনে আবার উঠে এলাম।

ট্রেন ছাড়ার আগে হৈ চৈ করতে করতে আমাদের নতুন সহযাত্রীরা উঠে এলো আমাদের কামরায়। চারজন তরুণ তরুণী, কলেজের ছাত্র ছাত্রী। এই চারজন প্রাণবন্ত ছেলেমেয়ে মাতিয়ে তুললো কামরা, আমাদের এতক্ষণের প্রায় নীরব বিষন্ন যাত্রাপথের পরে এ যেন আকাশপাতাল পার্থক্য।
উঠে এসেই জিনিসপত্র সব রেখে টেখে নিজেরাই পরিচয় করে নিল আমাদের সঙ্গে। একদম কোনো জড়তা নেই, অপরিচয়ের সঙ্কোচ নেই।
মেয়ে দুটির নাম শম্পা আর অপরাজিতা, ছেলে দুটির নাম নীলাদ্রি আর রূপম।কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে বর্ষে পড়ে চারজনেই, চারজনেরই হিস্ট্রি অনার্স। এই সময়ে একটা লম্বা ছুটি, তেমন বড়ো পরীক্ষা টরীক্ষার প্রস্তুতির চাপ নেই সামনে, তাই বেরিয়ে পড়েছে।
অপরাজিতা হেসে বললো, "ইতিহাস কি আর বই পড়ে তেমন বোঝা যায়? ঘুরে ঘুরে দেখলে তবেই ইতিহাস জ্যান্ত হয়ে ওঠে? তাই না? আপনাদের কী মনে হয়?"
কাশ্মীরা মৃদু হেসে মাথা দোলায়, বলে, "হ্যাঁ, তাই তো! পুঁথিগত ইতিহাস আসল ইতিহাসের ছায়া কেবল। ঘুরে ঘুরে দেখলে তবে সত্যিকারের ইতিহাসের তবু কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।"
ট্রেন চলতে শুরু করেছে, বাইরে তখন অন্ধকার, দেখা যাচ্ছে না কিছু। আলোকিত কামরায় আমাদের নতুন সহযাত্রীরা জমিয়ে গান গান ধরলো, সমবেত সঙ্গীত। দেখতে দেখতে আমরাও মেতে উঠলাম, গানের পর গান চলছে, শুনতে শুনতে উৎসাহ দিচ্ছি আর ভালোলাগা জানাচ্ছি ।
ওদের মধ্যে নীলাদ্রি একটু শান্ত, কবি কবি চেহারা। সে যে সত্যি সত্যি কবিতা লেখে সেটা জানা গেল, যখন শম্পা ওকে হাল্কা ঠেলা দিয়ে বললো, "এই নীল, তোর লেখা কবিতা পড়ে শোনা না!"
নীলাদ্রি একটু লজ্জারুণ হয়ে উঠেছিল, বললো, "যাঃ, সেসব শোনানোর মতন না।"
অপরাজিতা ঝাঁপিয়ে পড়লো, "শোনানোর মতন কিনা সে তো পরে বোঝা যাবে। আগে শোনা তো!"
সবাই চাপাচাপি করতে থাকায় শেষে নীলাদ্রিকে বার করতেই হল কবিতার খাতা, পড়ে শোনাতে শুরু করতে হল। দেখা গেল কবিতাগুলো বেশ ভালো আর ওর কবিতা পড়াও চমৎকার, আবৃত্তি করতো মনে হয় আগে।
নীলাদ্রি একের পর এক কবিতা পড়ে আর অন্যেরা সাজেশন দিতে থাকে, এইসব কবিতায় সুর দিয়ে গাইলে কেমন হয়?
রূপম একসময় গিটার বার করে আনে, কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে বাজাতে শুরু করে, অন্য তিনজন গাইতে থাকে প্রচলিত এক জনপ্রিয় ব্যান্ডের গান।
তারপরে ঘন্টার পর ঘন্টা যে কোথা দিয়ে পার হয়ে গেল কেজানে! খাওয়া ঘুম কোনোকিছুরই যেন দরকার বোধ ছিল না কারুর। একসময় ঘড়ির দিকে চোখ গেলে দেখা গেল প্রায় মাঝরাত। তখন সবার খেয়াল হলো বেজায় খিদে পেয়েছে।
আমাদের খাবার আর ওদের খাবার সব বের হলো। কামরার মেঝেতে খবরের কাগজ বিছিয়ে সবাই গোল হয়ে বসে পিকনিকের মতন করে খাওয়া হলো সবার খাবার ভাগযোগ করে। এত আনন্দ বহুদিন পাইনি, নিজের স্কুলের সময়ের কথা মনে পড়ছিল। তখন বন্ধুরা কয়েকজন মিলে টিফিনের খাবার ভাগযোগ করে খেতাম প্রত্যেকদিন।

খাওয়াদাওয়া আর গল্প চললো আরো অনেক্ক্ষণ। সেসব শেষ হলে ঘুমের বন্দোবস্তো যখন হলো, তখন রাত শেষ হবার আর বেশী বাকী নেই। ওরা বললো পরদিন দুপুর নাগাদ নেমে যাবে ওদের গন্তব্য স্টেশনে। আমাদের যাত্রা যদিও তখনও অর্ধেকের বেশী বাকী থাকবে।

দুপুরে এই চারটি ছেলেমেয়ে নেমে গেলে কামরা কেমন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেল। এর মধ্যে ফোন এলো ডক্টর আদিত্যের, ওঁরা ঠিকমতই রওনা দিয়েছেন, এখন ট্রেনে আছেন আমাদেরই মতন। জহীর ফোন করলো ডক্টর আদিত্যের ফোনের কিছুটা পরেই, সেও এখন ট্রেনে।

আমাদের কামরায় এখন কেবল আমরা দু'জন, হয়তো সন্ধ্যের স্টেশনে নতুন সহযাত্রীরা উঠবেন আবার কেউ। কাশ্মীরা কেমন অদ্ভুত মগ্ন গলায় বলে, " এই দূরপাল্লা অভিজ্ঞতায় কেমন যেন "পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী" ধরণের অনুভব হচ্ছে, এক বিষন্ন ভগ্নহৃদয় পরিবার কয়েক ঘন্টার সঙ্গী হল, তারপরে তারা বিদায় নিয়ে চলে গেল। তারপর এলো হাসিখুশী হুল্লোড়ে ভরা তরুণদল। তারা আরো কয়েক ঘন্টার জন্য সঙ্গ দিয়ে নিজেদের গন্তব্যে নেমে গেল।
জলের আল্পনা যেন, হাসি কান্না সুখ দুঃখ আনন্দ বিষাদ কোনোকিছুরই আর চিহ্ন থাকে না। নিরাসক্ত শকট ছুটে চলে শেষ লক্ষ্যের দিকে। মানুষের জীবনও কি এইরকমই না?"

আমি চোখ বিস্ফারিত করে কাশ্মীরার দিকে চেয়ে থাকি, তারপরে হো হো করে হেসে বলি, "ঐ নীল, নীলাদ্রি বলে ছেলেটি মনে হয় ওর কবিতা দিয়ে তোমাকে কন্টামিনেট করে গিয়েছে। এইরকম দার্শনিক হয়ে পড়লে যে!"

"কবিতাগুলো ভালো ছিল কিন্তু, যাই বলো আবীর। ভালো কবিতা শুনলে আমার সত্যিকার একটা আনন্দ হয়। দিদির কথা মনে পড়ে। দিদির লেখা কবিতাগুলো---এখনও আগলে রেখেছি---তোমাকে তো শুনিয়েছিলাম---ভালো লাগে নি তোমার?"
ওর গলার স্বর থেকে মগ্নতা দূর হচ্ছে না, আমার হাসিঠাট্টার চেষ্টায় কাজ হবে বলে মনে হয় না। বললাম, "তোমার সঙ্গে আছে সেই ডাইরিটা? যেখানে তোমার দিদির লেখা কবিতাগুলো রয়েছে? শোনাবে এখন? খুব ভালো লেগেছিল সেইদিন।"
কাশ্মীরা কীরকম সুদূরমগ্ন বিষন্ন স্বরে বলে, "আছে, আছে, সেই ডাইরি সবসময়েই আমার সঙ্গে থাকে। দিদি যদি ফিরে আসতো---তাহলে---কেজানে তাহলে ভালো হতো না মন্দ হতো। হারানো ছেলেরা ফিরে আসতে পারে, সংসার তাদের ফিরিয়ে নেয় সমাদরে, কিন্তু হারানো মেয়েরা কি সেইভাবে ফিরে আসতে পারে? তাদের কি ফিরিয়ে নেয় সংসার?"
কাশ্মীরার চোখ ভিজে উঠেছে, গলার স্বরেও ভেজা ছোঁয়া লেগেছে। বললাম,"এখন তো দিনকাল অনেক বদলেছে, মানুষ একটু বেশি সভ্য হয়েছে আগের থেকে। এখন হয়তো সমাজের ঐসব পুরনো অর্থহীন নানা কুসংস্কার আর নেই। এখন হয়তো ফিরিয়ে নেয় সমাদরেই।"
"তাই? সভ্য হয়েছে এখন মানুষ? আগের থেকে সভ্য? কই, আমার তো মনে হয় না! মানুষ হাতিয়ার আর যন্ত্রপাতি বানানোর ব্যাপারে উন্নত হয়েছে দিনে দিনে,কিন্তু বেশি সভ্য? সেটা হয়েছে কী?"
"মীরা, থাক এসব কথা। এসব কথার কোনো শেষ নেই কোনোদিনই। তুমি বরং তোমার দিদির কবিতাগুলো পড়ে শোনাও।"
"না, এখন দিদির কবিতা পড়তে ইচ্ছে করছে না। তার জন্য অন্যরকম একটা সময়---অন্যরকম একটা আলো---থাক আবীর, পরে আবার কোনোদিন তোমায় পড়ে শোনাবো ঐ
কবিতা। এখন বরং তুমি একটা গান শোনাও। ঐ যে "জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে"-শোনাবে?"
আমি মাথা হেলিয়ে জানাই হ্যাঁ, তারপরেই শুরু করে দিই গাইতে। এই গানের মধ্যে যে স্নিগ্ধ শান্তি, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তা জুড়িয়ে দিতে থাকে ভিতরটা। সমস্ত অস্থিরতা ও মনস্তাপ জুড়িয়ে যায়।
ছোটোবেলা কোনোদিন গান শিখতে পারিনি, কিন্তু পরে মাস্টার্সের সময় আমাকে অনেক রবীন্দ্রগান শিখিয়েছিল আমার এক বন্ধু। গাইতে গাইতে তার কথাও মনে পড়ে যায়। এইরকম কত মানুষের কত স্মৃতি দাঁড়িয়ে থাকে জীবনের ছোটো ছোটো বাঁকে! কেউ হারায়, কেউ না। তবে এত বেদনা, এত বিষাদ কেন?

সন্ধ্যেবেলা আবার ট্রেন থামে বড়ো জংশন স্টেশনে। এবারে আমাদের নতুন সহযাত্রী হিসেবে উঠে আসেন এক প্রৌঢ়বয়সী দম্পতি, হাসিখুশি, শক্তসমর্থ। ওঁরা তীর্থে যাচ্ছেন। ওঁদের ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিল একদল মানুষ, ওঁদের নিজেদের ছেলেমেয়ে আর জ্ঞাতিসম্পর্কীয় অন্য তরুণ তরুণীরাও। কিছুক্ষণের জন্য কামরার জানালা ভরে গেল অজস্র মানুষের কলকল কলকল কথার স্রোতে। ওঁরা ঠিকঠাক জিনিসপত্র গুছিয়ে বসে পড়ার পর ট্রেনের নড়ে ওঠার লক্ষণ দেখা দিল। হাসিমুখে জানালা দিয়ে হাত নাড়ছেন প্রৌঢ় প্রৌঢ়া, প্ল্যাটফর্ম থেকে হাত নাড়ছে বিদায় দিতে আসা যুবক যুবতীরা। চমৎকার লাগছিল। এই প্রথম এইরকম বিদায় দিতে আসা দেখলাম আমরা।

ট্রেন চেলতে শুরু করে, আস্তে আস্তে দূরে চলে যায় অপেক্ষমাণ মানুষের দল। প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে ট্রেন বেরিয়ে পড়ে, গতিময় শরীরে ঝঙ্কার তুলে ছুটতে থাকে আঁধার মাঠের মধ্য দিয়ে, ঝমঝমঝমঝম করে। আকাশে হয়তো এখন ফুটেছে কত তারা।
আমাদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে তোলেন ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা। নিজেরাই পরিচয় দেন,ওঁদের নাম সুমন্ত মিত্র আর অনুরাধা মিত্র। সারাজীবন দু'জনেই স্কুলে পড়িয়েছেন। ভদ্রলোক অবসর নিয়েছেন তিন বছর আগে আর ভদ্রমহিলা এই বছরেই। আগে থেকেই প্ল্যান করে রেখেছিলেন, দু'জনের অবসর নেওয়া হলেই বেরিয়ে পড়বেন দেশের কোণে কোণে ঘুরতে। আপাতত তীর্থেই যাচ্ছেন, তবে তীর্থের টানে নয়,ভ্রমণের টানে।
এই প্রৌঢ়- প্রৌঢ়া আমাদের সঙ্গে জার্নি করলেন রাত্রিটা। অনেক গল্পও হলো। রাত্রে খাওয়ার সময় ওঁদের খাবার থেকে আমাদের ভাগ দিলেন আর আমরাও আমাদের খাবারের ভাগ দিলাম। ওঁদের দেওয়া খাবার খুব চমৎকার লাগছিল।নারকেলের সন্দেশ, নাড়ু, কুচো নিমকি, মালপোয়া, নারকেলের বরফি এইসব খাবার কতকাল পরে আবার। বিজয়ার মিষ্টিমুখ মনে পড়ে যাচ্ছিল। সে যে কতকাল আগের কথা! জীবনের লড়াইতে বেরিয়ে পড়ার পর থেকে আর তো বিজয়ার মিষ্টিমুখ এর সুযোগ আসে নি।
খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে অনেক রাত অবধি সুখ দুঃখের গল্প করলেন ওঁরা, আমরা দুজনে প্রধানতঃ শ্রোতা। ওঁরা যে সারাজীবন শিক্ষকতা করেছেন সেটা বোঝা যায়,দুজনেই কথা বলেন খুব সুন্দর করে গুছিয়ে।
ওঁদের কাহিনিটি আশ্চর্য, ওঁদের একটি ছেলে আর একটি মেয়ে ছিল, যমজ । দু`জনেই ছিল সুস্থসবল বুদ্ধিমান। ওঁদের স্কুল ছিল কোএডুকেশন, ওখানেই পড়তো দুজনেই। ক্লাস ফোরের বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে গেলে স্কুল থেকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হলো সমুদ্রতীরের এক শহরে। সেইখানেই দুর্ঘটনায় ভাইবোন মারা গেল একসঙ্গে, অন্য আরো চারজন ছাত্র-ছাত্রীও মারা গিয়েছিল।
অনুরাধা বলছিলেন, "ঐ ঘটনার পর আঁধার নেমে এসেছিল জীবনে, সবকিছু অর্থহীন লাগতো, কাজকর্ম সব ছেড়ে অন্ধকারে পড়ে থাকতাম দিনের পর দিন, নাওয়াখাওয়া পর্যন্ত বিরক্তিকর বাধ্যবাধকতা বলে মনে হতো। কিন্তু সেই শোকও তো একসময় কাটলো। উঠে দেখলাম যাদের হারিয়ে এত শোক করছি, তারা তো হারায় নি! কিছুদিনের জন্য তারা আমার কাছে ছিল মাত্র, যেখান থেকে এসেছিল, সেখানেই ফিরে গিয়েছে আবার। তারপর অনাথ আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত হলাম দু'জনেই, আজও সেখানে যথাসাধ্য দিই। আমাদের কাছ থেকে যে দু'জন চলে গিয়েছিল তারা আজ শত শত হয়ে ফিরে এসেছে। হারায় না, কিছুই হারায় না। তোমরা যদি কখনো কোনো প্রিয়জনকে হারাও, ভেঙে পড়ো না, তারা হারায় নি, তারা তোমাদের কাছেই আছে।
চোখ মেলে খুঁজলেই পাবে। "
কথা শেষ করে উনি চুল করে রইলেন, কাশ্মীরার চোখ দিয়ে টপ টপ করে অশ্রু ঝরছিল। তারপর মৃদুস্বরে অনুরাধা গান শুরু করলেন, "তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতদূরে আমি ধাই", শুনতে শুনতে আমার মনটা স্নিগ্ধ বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিল। সেই ছোট্টো থেকে আজ পর্যন্ত সব প্রিয়জনই তো আমাকে ছেড়ে গিয়েছে,বুকের মধ্যে শুধুই রেখে গিয়েছে খরার ফুটিফাটা মাঠ। আজ যেন অলৌকিক এক বৃষ্টিতে ভিজে সেই মাঠ সজীব হয়ে উঠছে, আর কারা যেন হাসিমুখে আমার দিকে চেয়ে বলছে, আমরা যাই নি, যাই নি, আমরা আছি, আছি, আছি। আমরা আছি এইখানেই এইখানেই এইখানেই।

গান শুনতে শুনতে একসময় ঘুমের মধ্যে ডুবে গেলাম। তারপরের সকালে উঠেছিলাম বেশ দেরি করে, উঠে দেখি ওঁরা দুজনে গোছগাছ শুরু করে দিয়েছেন। দুপুরেই নাকি ওঁদের নেমে যাওয়া।

দুপুর এগারোটা নাগাদ ওঁরা নেমে গেলেন ওঁদের গন্তব্যে। এই দু'জন প্রৌঢ় মানুষ আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করে গেলেন অদ্ভুত এক সাহস আর ভালোবাসা, যা আমাদের মন থেকে কখনোই মুছে যায় নি। কয়েকটা ঘন্টার মাত্রসহযাত্রী ছিলেন তাঁরা, কিন্তু তাঁদের প্রভাব ছিল অনেক গভীরে।

আমাদের তখনো বাকী আরো ঘন্টা কয়েক। আমাদের গন্তব্য স্টেশন আসবে প্রায় সন্ধ্যেবেলা।

(চলমান)


মন্তব্য

আয়নামতি এর ছবি

পড়ে নিলাম এ পর্বটাও।।যথারীতি ভালো লাগলো পড়ে। হয় কী জানো, সিরিজের এক পর্বের পর পরেরটা আসতে বেশ সময় নেয়। এভাবে ফাক পড়ে যাওয়ায় আগের কিছু কিছু ঘটনা মনে থাকে না(বয়স হইছে গো দিদি!)। যদি সময় সুযোগ হয় সিরিজটা শেষ হলে পুরোটা একসাথে পড়ে ফেলবার চেষ্টা নেবো। গল্পের পরের পর্ব আসুক। হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

হ্যাঁ, ধারাবাহিক পড়তে মজা হয় যদি ছাপা পত্রিকায় হয়, হয়তো মাসে দুইবার বের হয়। ওই নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে নিশ্চিত বের হবার যে ব্যাপারটা, তার জন্যই আকর্ষণটা থাকে। ব্লগে সেই সুবিধা নাই। ব্লগ অনিয়মিতও বটে, অনিশ্চিতও বটে। তাই ধৈর্য্য থাকে না।
এই দ্যাখো না, সেই রুদাই এর অপেক্ষা করতে করতে সব ভুলেই গেলাম কী হল না হল। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সোহেল ইমাম এর ছবি

পড়ছি, ভালো লাগছে। আচ্ছা নৈরঞ্জনাতো এখানে একটা নদীর নাম, আর সেই নদীটাই খুঁজতে চলেছে সবাই। কিন্তু এই অভিযাত্রীদের কথা যখন আসছে তখন ফাঁকে ফাঁকে সেই নদীটা বা কেন সেটা খোঁজা জরুরি বা সেই প্রসঙ্গেই এই অভিযাত্রীদলের সদস্যদের মনোভাব, অবসেশন এসবকি একটু একটু আসা স্বাভাবিক ছিলোনা। অনেক কয়টা পর্ব এলো অভিযাত্রী দলের ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা যেভাবে আসলো নদীটার কথা এখনও সেরকম শুনলামনা। এই অভিযাত্রী দলের অন্য অভিযান সম্পর্কেও কথা আসতে পারতো। লেখক তার মতই এগোবেন এটাই আশা করি, আমার কথা গুলো আমলে নেবার দরকার নাই। পড়তে পড়তে কিছু জিজ্ঞাসা এলো তাই বলা। লেখা চলুক, দারুন লাগছে। চলুক

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

তুলিরেখা এর ছবি

পড়ার জন্য আর কমেন্টের জন্য ধন্যবাদ। এখন ওরা নদীর কথা বলছে না বটে, দলের সবাই একত্রিত হলে তখন বলবে।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।