মঙ্গলকাব্যে রান্নাবান্না

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৪/০১/২০১৯ - ৮:০৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কিছুদিন আগে হাতে পেলাম বইটা। বিজয়গুপ্ত রচিত পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গল। এতদিন নাম শুনেছি শুধু। আর স্কুলে একাদশ দ্বাদশ শ্রেণীর বাংলা পাঠক্রমে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়ার সময় এই কবির বিষয়ে বিস্তারিত পড়তে হয়েছিল।

এতদিন বাদে বইটি পেয়ে তো মহা উৎসাহে শুরু করলাম। মূল আখ্যানভাগ অর্থাৎ চাঁদ সদাগরের কাহিনি তো শৈশব থেকে শুনে আসছি মা ঠাকুরমার মুখ থেকে। এইবারে পড়তে গিয়ে দেখি রত্নখনি। একজায়গায় এত হরেক রকমের রান্নাবান্নার কথা পড়লাম যে সব ছেড়ে সেইটা নিয়েই একেবারে আটকে গেলাম।

সনকার( লক্ষ্মীন্দর হবার সময়ে) পঞ্চামৃত(সাধ) ভক্ষণের সময়ের রান্নাবান্নার বৈচিত্র আর অদ্ভুতধরণের পাকপ্রণালী দেখে তো আমি একেবারে অবাক। এমনকি স্লো কুকিং এর ধারণাও আছে !

খানিকটা তুলে দিচ্ছি নিরামিষ রান্নার জায়গা থেকে।

"তেঁতুল চলার অগ্নি জ্বলে ধপ ধপ ।
নারিকেল কোরা দিয়া রান্ধে মুগের সূপ।।
ধীরে ধীরে জ্বলে অগ্নি একমত জ্বাল ।
কড়ির বেগেতে রান্ধে কলাইর ডাল।।
ঝিঙ্গা পোলাকারী রান্ধে কাঁঠালের আঁঠি।
নারিকেল কোরা দিয়া রান্ধে বটবটি।।
আনিয়া বাথুয়া শাক করিল লেচাফেচা।
লাড়িয়া চাড়িয়া রান্ধে দিয়া আদা ছেঁচা।। "

নারকেল কোরা দিয়ে মুগডাল, কলাইয়ের ডালের স্লো কুকিং, ঝিঙা আর কাঁঠালবিচির তরকারি, বটবটি (বরবটি?) নারকেল কোরা দিয়ে, আদাছেঁচা দিয়ে বাথুয়া শাক।
কড়ির বেগেতে (শম্বুক গতিতে?) কলাইয়ের ডাল একদিন রেঁধে দেখতে হবে তো!

নিরামিষ পর্বের পরে আসছে মাছের নানারকম রান্না। সে বিশাল বৈচিত্রময়। কোনো কোনো মাছের নামই প্রথম শুনলাম, আর রন্ধনপ্রণালী তো আরো বিচিত্র!

খানিকটা তুলে দিচ্ছি মৎস্যরন্ধনের জায়্গা থেকে।

"চেঙ্গ মৎস্য দিয়া রান্ধে মিঠা আমের বৌল।
কলার মূল দিয়া রান্ধে পিপলিয়া শৌল ।।
কৈ মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল ।
জিরামরিচে রান্ধে চিথলের কোল ।।
উপল মৎস্য আনিয়া তার কাঁটা করে দূর।
গোলমরিচে রান্ধে উপলের পুর ।।
আনিয়া ইলিশ মৎস্য করিল ফালাফালা।
তাহা দিয়া রান্ধে ব্যঞ্জন দক্ষিণসাগর কলা।।"

এই দক্ষিণসাগর কলা দিয়ে ইলিশ রাঁধার কথা পড়ে এইখানে ধক্কাৎ করে থেমে গেলাম একটু। ওরে বাবা, এ কী বস্তু? ইলিশ মাছ ছোটো ছোটো টুকরো করে কাটলো সেটা বুঝতে পারলাম, কিন্তু দক্ষিণসাগর কলা (কাঁচকলা অবস্থায় কি?) দিয়ে যে সেই ইলিশ কেমন করে রাঁধল সে বুঝে উঠতে পারলাম না।

চেঙ্গ (টাকী)মাছ আর মিঠা আমের বৌল (মুকুল?) দিয়ে কী করে যে কী রাঁধল সেও বুঝতে পারলাম না। আমের মুকুল দিয়ে মাছ রান্না করা যাবে নাকি? তাহলে কি কচি আমের টুকরো দিয়ে রাঁধার কথা বলেছে? পিপলিয়া শৌল মাছও চিনতে পারলাম না, কলার মূল (ভাড়ালির কথা বলছে কি?) দিয়ে সে কীভাবে রান্না হল সে তো আরো দূরের কথা। কৈ মরিচ আর জিরামরিচে চিতলের পেটি রাঁধা অবশ্য তেমন অচেনা নয়।
সবচেয়ে অচেনা লাগল উপল মাছ। এর কাঁটা ছাড়িয়ে গোলমরিচ দিয়ে ঝুরা করে উপলের পুর রেঁধেছিল মনে হয়। কিন্তু এটা কী মাছ?

"শৌল মৎস্য কাটিয়া করিল খান খান।
তাহা দিয়া রান্ধে ব্যঞ্জন আলু আর মান।।
মাগুর মৎস্য আনিয়া কাটিয়া ফেলে ঝুরি।
তাহা দিয়া রান্ধে ব্যঞ্জন আদামাগুরী ।। "

কোন মাছে কি সব্জি বা কি মশলায় রাঁধছে সেটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আর কাটার কায়্দাও, একই জিনিস বড় বড় টুকরো করে রাঁধলে একরকম, আবার সরু সরু করে কেটে রাঁধলে অন্য স্বাদ।

শাক তোলার বর্ণনায় পাই লাউয়ের ডগা, কুমড়ার ডগা, পুঁইশাক, সোনাকচু, পানিকচু, তেলাকচু, গিমা,ওকরা, বাথুয়া, থানকুনি, ঘিলা লতা, গৈনারি, খাসিয়া, পোলতা। এর মধ্যে অনেকগুলো চিনতে পারলাম না, বিশেষ করে ঘিলা লতা, গৈনারি, খাসিয়া, পোলতা।

আরো একটা ব্যাপার, নিরামিষের মধ্যে বেগুণ, টম্যাটো, কপি এইসব অধুনাপ্রচলিত আনাজপাতির নাম পেলাম না। এগুলো কি সেইসময়ে আসে নি আমাদের দেশে?


মন্তব্য

 এরিক এর ছবি

তখনও মনে হয় টমাটো আসেনি। বিদেশিদের হাত ধরে আসতে আসতে আরও কয়েকশ বছর।

তুলিরেখা এর ছবি

হ্যাঁ, টোম্যাটোকে এখনও অনেক জায়্গায় বিলাতী বেগুন বলে শুনেছি।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বাংলাদেশের বহু লোকে এখনো টমেটোকে 'বিলাতী বেগুন' বলেন। এই বলাটা ঠিক আছে। কারণ, বেগুন আর টমেটো দুটোই Solanum গণের অন্তর্ভুক্ত ভিন্ন প্রজাতি। তবে উৎস বিচারে একে 'বিলাতী বেগুন' না বলে 'হার্মাদী বেগুন' বললে আরও ঠিক হতো। মিষ্টি আলুর মধ্যে যেটার চামড়া সাদা সেটাকে অনেকে 'বিলাতী আলু' বলেন। এটা ঠিক না। ছয় মাস আগের স্টাডি বলে, ইউরোপ মিষ্টি আলু দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এনে থাকলেও ভারতবর্ষে (মেঘালয়) মিষ্টি আলু আছে ৫ কোটি ৭০ লাখ বছর ধরে। অবশ্য ঐ সময়ের মিষ্টি আলুর চেহারা আজকের মতো ছিল না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সোহেল ইমাম এর ছবি

হার্মাদী বেগুন

বাহ্, যথার্থ বলেছেন। চলুক

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সোহেল ইমাম এর ছবি

তুলিরেখা, এই চমৎকার রচনাটা আরো একটু দীর্ঘ করে ফেলেননা, চলুক আরো কয়েক পর্ব। মঙ্গলকাব্যের রান্নাবান্নার হাঁড়ি এতো তড়িঘড়ি চুলেঅ থেকে নাহয় নাই নামালেন।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

তুলিরেখা এর ছবি

দেখি আরও পর্ব দেওয়া যায় কিনা। এত বড় মঙ্গলকাব্যে বহু উপকাহিনী রয়েছে, তার মধ্যে কোথায় কোথায় যে রান্নার বর্ণনা রয়েছে সেইসব খুঁজে বার করতে হবে।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সত্যপীর এর ছবি

খালি রান্নাই দিতে হবে এমন কোন কথা নাই।

..................................................................
#Banshibir.

তুলিরেখা এর ছবি

রান্নাবান্না ছাড়া তো আর যা আছে বড়ই জটিল ব্যাপারস্যাপার। এ ওকে কামড়ায়, ও তাকে খামচায়, এ চক্রান্ত করে, ও ষড়যন্ত্র করে --বাপরে! হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

জিভে তো জল এনে দিলেন, এর নিবারণ বিদেশ বিভুঁইয়ে দু:সাধ্য। বেগুন, টমোটে, কপি সম্ভবত: পরবর্তীতে বঙ্গদেশে আমদানী হয়েছে।

স্নেহাশিস রায়।

তুলিরেখা এর ছবি

আরে ন্না, দুঃসাধ্য কেন হবে? স্লো কুকারে বসিয়ে দিন কিছু একটা রান্না, দেখবেন অতি চমৎকার হবে। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সত্যপীর এর ছবি

একশোতে একশো পোস্ট। কিন্তু, মাঝপথে হুড়া করে থামায় দেওয়ার অপরাধে পঁচিশ টাকা জরিমানা করলাম।

কলীন টেইলর সেনম্যাডাম কইছেন মনসামঙ্গলে ডুবাতেলে ভাজা বেগুনের রেসিপি আছে। খুঁইজা দেখেন। কপি টমেটো অবশ্য থাকার কথা না, সেগিলি বিটিশ বিজিনেছ।

আদাছেঁচা দিয়া শাক উত্তম টেশ হওয়ার কথা, কিন্তু নারিকেল কোরা দিয়া বটবটি তো আচানক তরিকা! দক্ষিণ ভারত/ শ্রীলংকায় পচুর নারিকেল দেয়, অঢেল সাপ্লাই তাই। বাংলা এলাকাতেও পচুর নারিকেল ছিল নাকি?

..................................................................
#Banshibir.

তুলিরেখা এর ছবি

হুঁ, আমি লক্ষ্মীন্দরে চলে গেছি পাতা উল্টে, এখন ফিরে শুরুর দিকে দেখলাম আরো ব্যাপক সব রান্নাবান্নার বর্ণনা আছে, সেখানে আমিষ রান্নার জবর সব বর্ণনা আছে।

একজায়গায় আছে-
"মাংসেতে দিবার জন্য ভাজে নারিকেল
ছাল খসাইয়া রান্ধে বুড়া খাসির তেল।
ছাগ মাংস কলার মূলে অতি অনুপম
ডুম ডুম করি রান্ধে গাড়রের চাম।
একে একে যত ব্যঞ্জন রাঁধিল সকল
শৌল মৎস্য দিয়া রান্ধে আমের অম্বল।। "

বিজয়গুপ্তদের দেশে মাছ দিয়ে টক রাঁধতে মনে হয় খুব ভালবাসতেন লোকেরা। হ্যাঁ বেগুনের ব্যঞ্জন ও আছে। একজায়্গায় আছে, "বারোমাসি বেগুনেতে শৌল মৎস্যের মাথা"

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সত্যপীর এর ছবি

হোয়াট ইজ গাড়রের চাম ডুম ডুম রান্না? ছাগলের চামড়া রেসিপি? চামড়া কি রান্ধা যায়?

বিস্তারিত বুঝায় পুস্ট দেন। চিপা মন্তব্যের পরিসরে পুষায় না।

..................................................................
#Banshibir.

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গাড়র হচ্ছে গাড়ল বা গড্ডল বা ভেড়া। কিন্তু ভেড়ার চামড়া ক্যাম্নে রান্ধে? এইটা ক্যাম্নে সুম্ভাব?

নারকেল ভাজা দিয়ে রান্না করা বুড়া খাসির চর্বি খেলে হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগে স্থায়ীভাবে সিট বুকিং দিয়ে রাখতে হবে।

শোল মাছ আর তার কাটাকুটি-মাথা দিয়ে ডাল (বিশেষত মাসকলাইয়ের ডাল), অম্বল সবই রান্না করা যায়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সত্যপীর এর ছবি

খাবারের যে তালিকা লম্বা হইতেছে সেইমত আপনের ঘরে রেগুলার পাকশাক হইলে আপনেই এযুগের চাঁদ সদাগর। পিতার স্মরণে পাণ্ডু হার্ট ইন্সটিট্যুট একটা খোলেন আর সিট বুকিং দিয়া নারিকেল ভাজা সহকারে বুড়া খাসির তেলে রান্না ছাগমাংস খাইতে থাকেন। সাথে ডুম ডুম করে রান্ধা চামড়া...

..................................................................
#Banshibir.

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমি নিজে বাজার করি, নিজে কাটাকুটি করি, নিজে রান্ধি, নিজে হাড়িপাতিলথালাবাটিচামচহাতা ধুই। ১০ বারের রান্নার মধ্যে দিশা ৩/৪ বার খায় আর বাবান ২/১ বার খায়। বাকিটা আমি হফতাভর খাই। প্রথম দিন যেটা উপাদেয় বলে মনে হয় সপ্তম দিন সেটাকে পঁচা খবরের কাগজের মতো লাগে। আমি মেডিকেল স্কুল পলাতক, পাণ্ডু হার্ট ইনস্টিটিউট খোলা আমার কর্ম না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তুলিরেখা এর ছবি

এটা আমিও বুঝলাম না। ভেড়ার মাংসের কথাই হয়তো বলছে। ডুমা ডুমা করে কেটে রাঁধতো হয়তো।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সত্যপীর এর ছবি

শুঞ্ছি মনসামঙ্গলে মাংসের রেসিপিও আছে। ছাগল আর হাঁস। মাছ নিরামিষের পরে আমিষ নিয়াও তো বিস্তারিত পুস্টাইতে হবে।

..................................................................
#Banshibir.

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

মেঘনা নদীর পূর্ব পাড় আর দক্ষিণবঙ্গে মাংস খাওয়া নিয়ে বিশেষ কোন সংস্কার ছিল না। ফলে তারা পানির নিচের সাবমেরিন, মাটিতে চলা ট্যাংক আর আকাশে ওড়া হেলিকপ্টার - সবই খেতেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

এক লহমা এর ছবি

জব্বর পোস্ট হৈছে একখান। হাততালি

"আরো একটা ব্যাপার, নিরামিষের মধ্যে বেগুণ, টম্যাটো, কপি এইসব অধুনাপ্রচলিত আনাজপাতির নাম পেলাম না। এগুলো কি সেইসময়ে আসে নি আমাদের দেশে?" - এই ধরণের বই কালের দলিল, ইতিহাসের মশলা।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তুলিরেখা এর ছবি

ঠিকই। এইসব মঙ্গলকাব্যগুলো সময়ের দলিল।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বাকি আলোচনার সুবিধার্থে প্রথমে দুয়েকটা তথ্য বলে নেই। বিজয়গুপ্ত পঞ্চদশ শতকের বাকেরগঞ্জ বা বরিশাল অঞ্চলের কবি। তাঁর জন্ম সম্ভবত রাজা গণেশের আমলে আর মৃত্যু সম্ভবত হুসাইন শাহী আমলে। অর্থাৎ, মাঝের সাত/আট বছরের হাবসী শাসনামল বাদ দিলে বিজয়গুপ্তের সময়কালে বাংলাদেশ স্বাধীন ছিল। পঞ্চদশ শতকের একেবারে অন্তিমে এসে ইউরোপীয়দের মধ্যে পর্তুগীজরা কেবল ভারতের পশ্চিম উপকূলে হাজির হয়, বাকিদের আসতে আরও অনেক সময় বাকি। বাংলাদেশে তখন বিদেশী মানে জলপথে আরব, চীনা বা ইন্দোচীনা বণিক আর স্থলপথে পারস্য, মধ্য এশিয়, তুর্কী বা তিব্বতী বণিক। আমাদের আজকের নিত্যপ্রয়োজনীয় ও নিত্যব্যবহার্য অনেক বস্তু, ফল, সবজী, মশলা, শব্দ, বাক্‌ধারা তখনো হাজির হয়নি।

প্রথম কাব্যাংশ — নিরামিষ পর্বঃ

তেঁতুল চলা = তেঁতুল গাছ থেকে পাওয়া চ্যালাকাঠ।

সূপ = এই শব্দটা ইউরোপীয়দের কাছ থেকে প্রাপ্ত নয়। ধর্ম্মশাস্ত্র অনুযায়ী সূপ হচ্ছে আজকের খিচুরী ধরনের খাবার। আয়ুর্ব্বেদ অনুযায়ী যে কোন ডালের খোসা ছাড়িয়ে নুন-জলে ফুটিয়ে বানানো ঝোল হচ্ছে সূপ। আদি পালি ভাষায় সূপ হচ্ছে ঝোল (broth/curry/soup)। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায়, পালি শব্দ সূপ্পা’র মানে হচ্ছে চালুনী।

কড়ির বেগ = এই পদটির অর্থ নিয়ে কিঞ্চিৎ সন্দেহ হচ্ছে। কড়ি মানে conch বুঝিয়ে থাকলে থাকলে সেটা ধীররন্ধন বোঝাবে, কিন্তু বাংলা ভাষায় কড়ি sharp অর্থেও বোঝায়। সেক্ষেত্রে এর অর্থ দ্রুতরন্ধন বোঝাবে। কাঠ অথবা কয়লার ধিকি ধিকি আগুনে রান্না, মূল রান্না শেষ হবার পর নিভন্ত আগুনে রান্না, ছাইচাপা তুষের আগুনে রান্না — এসব হচ্ছে ধীররন্ধনের দেশীয় পদ্ধতি। মাস কলাইয়ের ডাল রান্না করতে ধীররন্ধন পদ্ধতি আবশ্যকীয় নয়।

পোলাকারী = এই শব্দটির মানে কী? ঝিঙ্গা দিয়ে কাঁঠালের বিচীর চচ্চড়ি রান্না করা যায় বটে তবে তাতে কুঁচো চিংড়ি অথবা শুঁটকি অথবা মুরগীর মাংস না দিলে পদটা জুতের হবার কথা না।

বটবটি = এটা বরবটিই বটে। কথ্য ভাষায় বটবটি এখনো প্রচলিত।

নারকেল কোরা = বাকেরগঞ্জ উপকূলীয় এলাকা, সেখানে নারকেল গাছের অভাব নেই। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় রান্নায় নারকেলের ব্যবহার ব্যাপক।

শাকে আদা = এখনকার বাঙালী কায়দায় শাক রান্নায় রশুনের ব্যবহার থাকলেও আদার ব্যবহার নেই বললেই চলে। বথুয়া শাক একটু দীর্ঘ সময় ধরে অল্প আঁচে রান্না করতে হয়। তাতে আদা ছেঁচা দিলে কেমন হবে বুঝতে পারছি না। সেই আদা কি ফোড়ণে হবে নাকি বাগারে হবে?

দ্বিতীয় কাব্যাংশ — মৎস্য পর্বঃ

চেঙ্গ = এটা হচ্ছে টাকি মাছের (Channa punctata) একটা ভ্যারাইটি। পূর্ব বঙ্গের কোথাও কোথাও একে রাগা মাছও বলে। আকারে টাকি মাছের চেয়ে একটু ছোট, মাথাটা তুলনামূলকভাবে বড়। পুড়িয়ে ভর্তা খাওয়ার জন্য জনপ্রিয়। ‘আমের বৌল’ মানে আমের মুকুল, কিন্তু কোন রান্নায় আমের মুকুলের ব্যবহারের কথা শুনিনি। রান্নায় খোসাসুদ্ধ খুব কচি আমের ব্যবহার অবশ্য আছে। সেটাকেই বোঝাচ্ছে কিনা কে জানে!

পিপলিয়া শৌল = শোল মাছের ভ্যারাইটি বলে মনে হচ্ছে, আগে নাম শুনিনি। কলার মূল বলতে সম্ভবত কলাগাছের vascular bundle বা ভাড়ালিকে বোঝাচ্ছে।

মরিচ = পঞ্চদশ শতকের লেখায় মরিচ মানে ‘গোলমরিচ’। কাঁচামরিচ বা কাঁচালঙ্কা বাংলাদেশে আসতে তখনো বছর পঞ্চাশেক বাকি আছে।

চিথল = জিরা ও গোলমরিচ সহযোগে চিতল মাছের পেটি রান্না করার ব্যাপারটা জুতের লাগলো না। এখনকার বাকেরগঞ্জ অঞ্চলে চিতল মাছ রান্নায় গোলমরিচ দূরে থাক, জিরাও ব্যবহৃত হয় না।

উপল = এটা বাংলাদেশের হাওড় অঞ্চলের বিলুপ্ত একটি মাছ।

দক্ষিণসাগর কলা = এমন কলার নাম শুনিনি। এখনকার রান্নায় ইলিশের সাথে আলু, পটল, বেগুন, ঝিঙ্গা, ধুন্দল ধরনের হাতেগোনা কয়েকটা সবজী ছাড়া অন্য কিছু ব্যবহৃত হয় না। তবে কষছাড়ানো কাঁচাকলা দিয়ে ইলিশের পানিখোলা ধরনের ঝোল রান্না করা হলে তা উপাদেয় হবার কথা।

আলু আর মান = পঞ্চদশ শতকে বাংলাদেশে আলু আসলো কোথা থেকে? আলু তো তারও বছর পঞ্চাশেক পরে এসেছে। আর তার ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছে আরও কয়েকশ’ বছর পরে। ভুলটা কে করলেন, যিনি মঙ্গলকাব্য আধুনিক বাংলায় রূপ দিয়েছেন তিনি? তরকারীতে ‘মান’ বা ‘মানকচু’ দিলে তাতে তো আর আলু দেবার দরকার পড়ে না!

মাগুর = মাগুর মাছের ঝুরিতে আদা দেবার ব্যাপারটা কেমন যেন লাগলো। মাছের ঝুরিতে পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা, ধনেপাতা, রশুনপোড়া, সরষের তেলের ব্যবহার থাকলেও আদার ব্যবহার দেখিনি।

শাক পর্বঃ

গিমা শাক = ওরফে ঢিমা শাক (Glinus oppositifolius)। খুব ছোট, পুরু পাতা ও টসটসে ডাঁটার শাক। স্বাদে তেতো।

ওকরা শাক = ওরফে ঘাগরা শাক (Xanthium strumarium)। এককালে জনপ্রিয় এই শাকের কচি পাতা, ডগা ও ফলে Carboxyatractyloside থাকায় ইদানীং কালে বিষাক্ত বিবেচনায় বর্জিত।

ঘিলা লতা = এক প্রকারের সীম (Entada rheedii)। এর পাতা বিশেষ সুস্বাদু হবার কথা না।

গৈনারি শাক = এই শাকটাকে চিনতে পারলাম না। মঙ্গলকাব্যে এই শাককে গর্ভবতী নারীর পছন্দ বলা হয়েছে।

খাসিয়া শাক = এই শাকটাকেও চিনতে পারলাম না।

পলতা শাক = ওরফে পটল শাক (Trichosanthes dioica)। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথি যা ভূতচতুর্দশী নামে পরিচিত সেদিন ঊর্ধ্বতন চৌদ্দ পুরুষের আত্মার তুষ্টির জন্য চৌদ্দটি প্রদীপ জ্বালাতে হয় এবং চৌদ্দ প্রকারের শাক খেতে হয়। এতে ঋতু পরিবর্তনজনিত কারণে যেসব রোগ হয় সেগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এই চৌদ্দ শাক হচ্ছে — এক মতে ওল, কেও, বেতো, কালকাসুন্দা, নিম, সরিষা, হেলেঞ্চা, জয়ন্তী, গুলঞ্চ, পলতা বা পটল, ঘেঁটু বা ভাঁট, বাহিঞ্চে, শুষনি ও শুলকা বা বচ্‌। আবার অন্য মতে পালং, লাল, শুষনি, পাট, ধনে, পুঁই, কুমড়া, গিমা, মুলা, কলমী, সরিষা, নটে, মেথি ও লাউ। সুতরাং বাজারে সাধারণত পলতা শাক পাওয়া না গেলেও চৌদ্দ পুরুষের ভূতের হাত থেকে বাঁচার জন্য সেটা খুঁজে বের করতে হবে।

বেগুন = বার্তাকু ওরফে বেগুন বাংলাদেশে ছিল তবে Solanum melongena কম ছিল, Solanum torvum বা তিতবেগুন বেশি ছিল। কোন কারণে লোকে বেগুনটাকে জংলী সবজী হিসাবে বিবেচনা করতো।

টমেটো = এটা New World Vegetables গোত্রে পড়ে। সুতরাং পঞ্চদশ শতকে বাংলাদেশের খাদ্যতালিকায় টমেটো নেই।

ফুলকপি = ১৮২২ সালে সাহেবরা বিলাত থেকে এই ভূমধ্যসাগরীয় সবজীটি ভারতে নিয়ে আসে। সুতরাং পঞ্চদশ শতকে বাংলাদেশের খাদ্যতালিকায় ফুলকপি নেই।

বাঁধাকপি = ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকের কোন এক সময়ে ইউরোপীয়রা ভারতে বাঁধাকপি নিয়ে আসে। সুতরাং পঞ্চদশ শতকে বাংলাদেশের খাদ্যতালিকায় বাঁধাকপি নেই।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মনসুর এর ছবি

পঞ্চদশ শতাব্দীর আলু = আলুবোখারা বা প্লাম। তবে এই রান্নায় যেহেতু মানকচু ব্যাবহার করা হয়েছে, তাই মুল কাব্যে "ওল" থেকে পরবর্তীতে রুপান্তর হয়ে "আলু" আসতে পারে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পঞ্চদশ শতকে বাংলা ভাষায় 'আলু' বা 'আলু বোখারা' বলে কোন শব্দ থাকার কথা না। প্লাম/প্রুনকে বলা হতো আলুঙ্ক। বাংলা ভাষায় আলু বোখারা শব্দটি ফার্সী বা মধ্য এশীয় কোন ভাষা থেকে নেয়া। শোল মাছে আলু বোখারা দেবার মতো অসৈরণ কাণ্ড বাকেরগঞ্জের লোকজন করার কথা না। আর যে তরকারীতে মানকচু দেয়া হবে সেটাতে ওলকচু দেবারও কথা না। 'আলু' শব্দটা কোন পর্যায়ে এসে এই কাব্যে ঢুকলো সেটা খতিয়ে দেখা দরকার।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তাহসিন রেজা এর ছবি

গৈনারি শাক সম্ভবত গনিয়ারি বা অগ্নিমন্থ( Premna integrifolia)।
ওই সময় কি রান্নায় মরিচের পরিবর্তে পিপুল ব্যবহার হত?

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

অগ্নিমন্থ'র বাংলা নাম কি 'গনিয়ারি'? জানতাম না। অগ্নিমন্থের পাতা শাক হিসাবে রান্না করা সম্ভব না। কারণ, শাক হতে গেলে পাতাকে নমনীয় হতে হয়। অগ্নিমন্থের পাতা 'collenchyma' ধরনের কলা দিয়ে গঠিত ও পাতার উপরিভাগে 'cuticle' বিদ্যমান। এই পাতা সেদ্ধ করলে রস বের হবে, কিন্তু চিবিয়ে গেলার মতো নমনীয় হবে না।

ভারতবর্ষে পিপুলের ব্যবহার কয়েক হাজার বছর ধরে চলছে। ভারতীয় রান্নায় পিপুল এখনও ব্যবহৃত হয়। তবে আমরা মরিচ/লঙ্কা আস্ত বা গুড়ো করে যে বিপুল পরিমাণে ব্যবহার করি পিপুল ঐ পরিমাণে ব্যবহৃত হয় না। তাছাড়া পিপুল মশলা কষানোর সময় দেবার কথা না, পরে দেবার কথা।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তুলিরেখা এর ছবি

এই আলু মেটে আলু অথবা গেছো আলু হতে পারে কি? সেগুলো তো মনে হয় ছিল বাংলায়।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গাছ আলু ওরফে মেটে আলু ওরফে পেস্তা আলু ওরফে চুপরি আলু ওরফে মাচা আলু ওরফে গজ আলু ওরফে মোম আলু ওরফে মাছ আলু ওরফে প্যাচড়া আলু ওরফে Dioscorea alata একেবারে লোকাল জিনিস। সুতরাং আলু বললে সেটাকে (লতারটা বা মূলেরটা) বোঝাতেও পারে। এই আলু দিয়ে শোল মাছ রান্না করা সম্ভব। ভালোই লাগার কথা। তবে তার সাথে মানকচু যায় না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তুলিরেখা এর ছবি

এই পোলাকারী আরও নানা জায়গায় আছে। ছয় ছেলের জন্য সনকা রাঁধছেন, সেইখানে একজায়গায় আছে(এখানে পোলাকড়ি বলেছে),
"বেতাগ বেগুন কাটি থুইল বাটী বাটী।
ঝিঙ্গা পোলাকড়ি ভাজে আর কাঁঠাল আঁঠি।।"

এটা মনে হয় কোনো শুকনো-শুকনো ভাজি ধরণের জিনিস ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ঘ্যাচাঙ


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আয়নামতি এর ছবি

চলুক

তুলিরেখা এর ছবি

গুরু গুরু

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মাহবুব লীলেন এর ছবি

চেঙ্গ = ১০০% টাকি মাছ।
‘আমের বৌল’= আমের মুকুল। সিলেটেও বৌল বলে। মাছের সাথে দারুণ টক রান্না হয়। খাইলে কনুই পর্যন্ত চাটবেন
পিপলিয়া শৌল = পিপল মাছ। পাহাড়ি ছড়াগুলোতে পাওয়া যায়। ইংরেজি নাম Barca snakehead
উপল = নিজে খাইছি। বড়শি দিয়া ধরছি। সিলেটে উপলই বলে। টাকি মাছ থেকে একটু ছোট; সাদা রংএর হয় সাধারণত। তরকারি সুবিধার না। তবে ভর্তায় দারুণ

তুলিরেখা এর ছবি

তাহলে বিজয়গুপ্তও নির্ঘাত আমের বৌল দিয়ে মাছের টকই বলেছেন । একবার রেঁধে খেতে হবে । হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মাহবুব লীলেন এর ছবি

পদ্মপুরাণের এই পারফরমেন্স আমি সরাসরি দেখছি। ৩৬ পদের রান্নার বর্ণনা শুইনা রীতিমতো জিবে পানি আইসা যায়

০২
বিদ্র: চেঙ্গ মৎস্যরে আমরা সিলটিরা চ্যাং মাছ বলি। নোয়াখাইল্লারা খালি কথার মইদ্যে অশ্লীলতা খোঁজে; প্রমাণিত

তুলিরেখা এর ছবি

সত্যিই তাই। গোটা মঙ্গলকাব্য ভরে কত রকমের যে ব্যাপার সে মানে ---আমার ঠাকুমা যাকে বলতেন "হবরে পড়া"। হাসি না হলে কে জানতো এখানে এতরকম রান্নাবান্নার কথা পাওয়া যাবে?

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

চেঙ্গ মৎস্য হচ্ছে বাবুলোকের ভাষায় বলা। আসলে নাম চ্যাং মাছ ওরফে চ্যাং টাকি মাছ ওরফে রাগা মাছ। টাকি জাতীয় মাছ (ল্যাটা মাছ) যেটা দেখতে অনেকটা 'চ্যাং'-এর মতো তাই নাম চ্যাং টাকি। এই নামটা কমবেশি সারা বাংলায় প্রচলিত। সুতরাং অশ্লীলতার দায় শুধু নোয়াখাইল্লাদের ওপর বর্তায় না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

এটাকে তো বাংলার প্রাচীনতম রান্নার বই হিসেবেও অভিহিত করা যায় অনায়াসেই।

তুলিরেখা এর ছবি

পুরানো বাংলার রান্নাবান্না বিষয়ে খোঁজ করতে করতে দেখি মঙ্গলকাব্যেই এত আছে! হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

আয়নামতি এর ছবি

চলুক

কত্ত খানাখাদ্যের হদিশ পাওয়া গেলো। বেশির ভাগই অচেনা। তবে কাঁচ কলা দিয়ে মাছের তরকারি খেয়েছি। ইলিশ কিংবা শিং মাছ দিয়ে রেঁধে দেখতে পারো। কলাটা একটু কষিয়ে নিতে হবে তারপর মাছ দেয়া লাগবে। আর বথুয়ার শাক মাংস দিয়ে খেয়েছি। দারুণ লেগেছিল। আদাবাটা দেয়া হয়েছিল তাতে। মাশকলাইয়ের ডাল রান্নার আগে সামান্য টেলে নিয়ে যদি কফি গ্রাইন্ডারে আধভাঙা করে নেয়া যায় তাইলে ঘুটাঘুটি ঝামেলায় যেতে হয় না। একেবারে পাউডার করে নিলে তো কথাই নাই। আধভাঙা করে মানকচুর মালিশ বলে এক জাতীয় রান্না উত্তর বঙ্গের ইলিশের মাথা দিয়ে আহা খেলে বলতে কী খাইলাম! নিজেই রান্নার গপ ফেঁদে বসলেম দেখি। হেহেহে... পোস্টটাই এমন যে রান্ধনপ্রিয় না হয়েও কত কথা কয়ে নিলাম দেঁতো হাসি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ইলিশ মাছের মাথা ও কাটাকুটি দিয়ে ছোট কচুর (দেশী বা দস্তর বা জঙলা বা কালো বা দুধ কচুর যে কোন একটা হলেই চলবে) পাতা-ডগা দিয়ে একটা ঘ্যাঁট মতো রান্না করা হয়। সামান্য পাতিলেবুর রসসহযোগে গরম ধোঁয়াওঠা ভাতের সাথে সেই ঘ্যাঁট অমৃতসমান।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তুলিরেখা এর ছবি

ওহ, মাষকলাই আধভাঙা করে নিয়ে মানকচুর মালিশ আর ইলিশ দিয়ে ---ওরে ন্না, এটা খেতেই হবে। উত্তরবঙ্গে যাবার একটা প্ল্যান করে রাখলাম এখনই। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

আয়নামতি এর ছবি

হাসি হাসি

Rajib Goswami এর ছবি

কলার মূল জিনিসটা খুব সম্ভবত ফল দেয়া কলাগাছ কেটে নিয়ে খোল বা খোসা ছাড়াতে থাকলে একদম ভেতরে যে শাদা দণ্ডের মত পাওয়া যায় সেটা। এটা দিয়ে নিরামিষ রাঁধতে দেখেছি অনেক মহোসৎব এর অনুষ্ঠানে, বারোয়ারি ভোজের জন্যে। খেতে ভালোই, কুমড়ো কুমড়ো স্বাদ। বারোয়ারী ভোজে এটা ব্যবহারের বোধহয় বেশকিছু কারণ আছে। একটা ফলদেয়া কলাগাছ যেটা আসলে একসময় কেটে ফেলতেই হতো, সেটাকে কেটে সেটা থেকে খোলগুলো নিয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় আচারের কাজে লাগানো হয়(যেমন পাত্র বা ডুমা বানানো), আর একদম ভেতরে শ্বাসের মত এই শাদা দণ্ড নিতান্তই ফেলে না দিয়ে(যেহেতু খাওয়ার যোগ্য জিনিস) তরকারির একটা ভালো উৎসও হিশেবে কাজে লাগানো হত। একটা লম্বা কলাগাছ থেকে পাওয়া এই দণ্ডের আয়তন নেহাৎ কম না, আর বারোয়ারী ভোজের নিরামিষে অনেক সবজি/তরকারি লাগে, সেই থেকেই এই ব্যবস্থা।
-রাজীব গোস্বামী

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আজ্ঞে, আমরা সবাই ওটার কথাই বলছি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তুলিরেখা এর ছবি

কলাগাছের মতন দাতা আর কেউ না। মোচা, কলা, ভাড়ালি সব খাদ্য হিসেবে লাগে। পাতা দিয়ে থালার কাজ হয়, খোলগুলো চৌকো চৌকো করে কেটে পাত্র বানানো, প্রদীপ বানানো---এত কোনো গাছই দেয় না। সাধে কি আর খনা বলেছেন, "কলা রুয়ে কেটো না পাত/ তাতেই কাপড় তাতেই ভাত"
একবার মাত্র ফল দিয়ে মরে যায় কলা গাছ, অথচ কত কী দিয়ে যায় ! আর রেখে যায় ছোটো ছোটো অনেক নতুন কলাগাছ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

শুকনো কলাপাতা দিয়ে অস্থায়ী বেড়া বাঁধা হয়, কলাগাছের ফাত্‌রা দিয়ে হালকা কাজের দড়ি হয়, আবাকা জাতের কলাগাছের দড়ি দিয়ে জাহাজ বাঁধা যায়, ফাঁসির দড়ি হয়, মশলামাখানো মাছ কলাপাতা দিয়ে মুড়িয়ে ঘ্যাম সব আইটেম রান্না হয়, খোল পুড়িয়ে যে ছাই হয় তাতে উত্তম ক্ষার হয়, কলাগাছ ছাড়া গণেশ অচল, কলাগাছ ছাড়া বাঙালী হিন্দুর বিয়ে অচল, কলাগাছেরর ভেলা ছাড়া হঠাৎ বর্ষায় গ্রামবাঙলার মানুষ অচল .......... কলার গুণ বলে শেষ করা যাবে না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তুলিরেখা এর ছবি

কলাগাছের আঁশ বার করে বেণী পাকিয়ে তাই দিয়ে স্যান্ডেল ধরণের চটি ---দক্ষিণ ভারতে বেড়াতে গিয়ে এই জিনিস দেখে তো কিনেই ফেল্লাম আমরা কয়েক জোড়া। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তামান্না রিনি এর ছবি

এতো দেখি এই অঞ্চলের খাদ্য সংস্কৃতির দলিল।

তুলিরেখা এর ছবি

হুঁ, এই অঞ্চলের নানারকম নিরামিষ আমিষ রান্নার দলিল বলা যায়। পিঠা পায়েস ইত্যাদি মিষ্টি খাবারের তালিকাও আছে।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

কনফুসিয়াস এর ছবি

"তেঁতুল চলার অগ্নি জ্বলে ধপ ধপ ।
নারিকেল কোরা দিয়া রান্ধে মুগের সূপ।।"
-
এই সূপ- এর মানে কী?

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

তুলিরেখা এর ছবি

ষষ্ঠ পান্ডবের কমেন্টে এই "সূপ" বিষয়ে বলা আছে। তুলে দিচ্ছি।

সূপ = এই শব্দটা ইউরোপীয়দের কাছ থেকে প্রাপ্ত নয়। ধর্ম্মশাস্ত্র অনুযায়ী সূপ হচ্ছে আজকের খিচুরী ধরনের খাবার। আয়ুর্ব্বেদ অনুযায়ী যে কোন ডালের খোসা ছাড়িয়ে নুন-জলে ফুটিয়ে বানানো ঝোল হচ্ছে সূপ। আদি পালি ভাষায় সূপ হচ্ছে ঝোল (broth/curry/soup)। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায়, পালি শব্দ সূপ্পা’র মানে হচ্ছে চালুনী।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তুলিরেখা এর ছবি

ছয় ছেলেকে খাওয়াবার জন্য সনকা বিশেষ আয়োজনে রাঁধছেন,
"পাটায় ছেঁচিয়া নেয় পোলতার পাতা।
বেগুন দিয়া রান্ধে ধনিয়া পোলতা।।
জ্বরপিত্ত আদি নাশ করার কারণ।
কাঁচা কলা দিয়া রান্ধে সুগন্ধ পাঁচন।।
জমানী পুড়িয়া ঘৃতে করিল ঘন পাক।
সাজ ঘৃত দিয়া রান্ধে গিমা তিতা শাক।।
নারিকেল দিয়া রান্ধে কুমারের শাক।
ঝাঁঝ কটু তৈলে রান্ধে কুমারের চাক।।"

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পাটায় ছেঁচিয়া নেয় পোলতার পাতা = পটলের পাতা বেটে ভর্তা বানানো হলো।

বেগুন দিয়া রান্ধে ধনিয়া পোলতা = ধনে অথবা ধনেপাতা দিয়ে বেগুন আর পটল রান্না করা হলো (এই বস্তু খেতে কি বিকট লাগবে!)।

জ্বরপিত্ত আদি নাশ করার কারণ। কাঁচা কলা দিয়া রান্ধে সুগন্ধ পাঁচন = কাঁচাকলাতে কী দিয়ে রাঁধলে সুগন্ধী ঝোল তৈরি হবে?

জমানী পুড়িয়া ঘৃতে করিল ঘন পাক। সাজ ঘৃত দিয়া রান্ধে গিমা তিতা শাক = ঘিয়ে জোয়ান/যোয়ান/জৈন পোড়া-ভাজা করে তাতে আরও উপরি ঘি দিয়ে গিমা শাক রান্না করা হলো (বাপরে! এক আনা সেরের শাক আশি টাকা সেরের ঘি দিয়ে রাঁধা!)।

নারিকেল দিয়া রান্ধে কুমারের শাক। ঝাঁঝ কটু তৈলে রান্ধে কুমারের চাক = 'কুমার' মানে কী? কুমড়ো নাকি? 'ঝাঁঝ কটু তেল' মানে কি সর্ষের তেল? রান্নার আর কোন তেলে তো ঝাঁঝ নেই।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তুলিরেখা এর ছবি

জমানী মানে যোয়ান? আরে !!!! আমি আগেও এই জমানী দেখেছি, কিন্তু অর্থ বুঝিনি। ঘীয়ের মধ্যে যোয়ান ফোড়ন দিলে খুব সুন্দর গন্ধ হয়। আজকেই দেখতে হবে করে। হাসি

কুমার মানে কুমড়োই মনে হচ্ছে। মিষ্টি কুমড়ো না চাল কুমড়ো তা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না। সর্ষের তেলই ঝাঁঝ তেল মনে হয়। অন্যসব রান্নার তেল, তিল তেল, বাদাম তেল সবই তো ঝাঁঝহীন!

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তুলিরেখা এর ছবি

সোমাই পন্ডিতের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে ছেলেরা বাড়ি এসেছে। ছেলেদের জন্য সনকার মাছের নানাবিধ রান্না।

"মৎস্য মাংস কাটিয়া থুইল ভাগ ভাগ।
রোহিত মৎস্য দিয়া রান্ধে কলতার আগ।।
মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে গিমা গাছ গাছ।
ঝাঁঝ কটু তৈলে রান্ধে খরসুল মাছ ।।
ভিতরে মরিচ গুঁড়া বাহিরে জড়ায় সুতা
তৈল পাক করি রান্ধে চিংড়ীর মাথা।।
ভাজিল রোহিত আর চিতলের কোল ।
কৈ মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল ।।
ডুম ডুম করিয়া ছেঁচিয়া দিল চৈ
ছাল খসাইয়া রান্ধে বাইন মৎস্যের খৈ ।।

মাছের কত রকমের পদ যে বলা আছে! বিজয়গুপ্তের দেশ মাছের দেশ মনে হয়। ভাজা, ঝোল, এটা দিয়ে, সেটা দিয়ে বহু ধরণের মাছ রান্না।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

'কলতা'টা কী গাছ/লতা সেটা বুঝতে পারলাম না। খরসুল/খরসুলা/খল্লা/উড়ুক্কু মাছ হচ্ছে Rhinomugil corsula, খুব সহজে মেলে না তবে বিলুপ্ত নয়। চৈ হচ্ছে Piper chaba যা বর্তমানে বাংলাদেশে 'চুই ঝাল' নামে পরিচিত। বিশেষত মাংসে চুই ঝালের ব্যবহারের জন্য বৃহত্তর খুলনা অঞ্চল বিখ্যাত। খুলনা এবং ঢাকায় শুধু চুই ঝাল দিয়ে রান্নাভিত্তিক রেস্তোরাঁ আছে। মাছের খৈ হচ্ছে সেদ্ধ মাছের চামড়া ও কাঁটা ছাড়িয়ে শুকনো শুকনো করে রান্না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তুলিরেখা এর ছবি

এটা তো দুর্দান্ত ব্যাপার! চুই ঝাল দিয়ে রান্না!

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

'সূপ' শব্দের উপস্থিতি দেখে অবাক হলাম। ব্যবহার দেখে তো soup বলেই মনে হল! কেউ কি এই শব্দের উৎস নির্দেশ করতে পারেন?

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

তুলিরেখা এর ছবি

সূপ কথাটা মহাভারতেও পাওয়া যায়। বিরাট রাজার প্রাসাদে ছদ্মবেশে থাকার সময় ভীম বল্লভ নাম নিয়েছিলেন আর পেশা হিসেবে বলেছিলেন তিনি সূপকার অর্থাৎ রন্ধনকারী। বোঝা যাচ্ছে সূপ অর্থাৎ ঝোল/ডাল জাতীয় খাবারই তখনকার দিনেও প্রধান খাবার ছিল।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।