অমৃতের হরিণীরা

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৪/০৯/২০০৯ - ১০:০৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।

হাল্কা নীল ভোর, খুব মৃদু একটা আভা শুধু দেখা দিয়েছে। এখনও সূর্য উঠতে অনেক দেরি, পুবের আকাশে এখনো লাল রঙই লাগে নি। হাওয়ায় হাল্কা শীত-শীত ভাব। একটা ভোরজাগা পাখি সুরেলা গলায় ডেকে উঠলো, গানের প্রথম আখরটির মতন বাধো-বাধো ডাক।

সুজাতা জেগে গেছিল আগেই, অনেককাল ধরেই শেষরাতে ঘুম ভেঙে যায় তার। সেই স্কুলে থাকার সময় সে রাত জাগতে পারতো না বলে শেষরাতে মা ডেকে দিতো, সে উঠে পড়তে বসতো, সেই অভ্যাস রয়ে গেছে। এখন যদিও আর দরকার নেই অত তাড়াতাড়ি ওঠার, কিন্তু সুজাতার ভালোই লাগে। মনে হয় এই শেষরাত বা প্রথম ভোর, যখন বেশীরভাগ মানুষই ঘুমিয়ে আছে, চারিদিক খুব নির্জন আর শান্তিময়, এই সময়টা তার কাছে একটা গোপণ উপহারের মতো, সেই ছোটোবেলার জন্মদিনের সময়কার বালিকা সুজাতা হয়ে সে মোড়ক একটুখানি খুলে চুপিচুপি দেখে নেয় কি আশ্চর্য জিনিস আছে ভিতরে। আরেকটু বেলা বাড়লে যখন একে একে সবাই উঠে পড়ে, আওয়াজ আর তাপ বাড়তে থাকে, তখন সেই লুকিয়ে উপহার দেখে নেবার নিষিদ্ধ রোমাঞ্চকর আনন্দ সে আর পায় না।

এখন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সুজাতা চুপ করে দেখছে একটু একটু করে আকাশের গায়ে আলোর তুলি বুলিয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য শিল্পী, ঐ অনেক উপরের মেঘগুলোয় কেমন আশ্চর্য রঙ! সেই পাখিটা এখন কেমন ছন্দবাঁধা ধ্বনিতে সুরেলা গান গেয়ে যাচ্ছে-সুজাতা কান পেতে শোনার চেষ্টা করে। হঠাৎ আরেকটা পাখি সাড়া দিয়ে ডাক দেয়। দু'জনে মিলে এখন যুগলবন্দী গাইছে তারা। নিজের অজান্তে একটা ছোট্টো শ্বাস পড়ে সুজাতার। আর একেবারে হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় সুপ্রতীকের মুখ।

শেষবার দেখা তার সেই খরগ্রীষ্মের রোদেপোড়া, ভাঙাচোরা, আহত, যাতনাবিদ্ধ মুখ নয়- প্রথম দেখা অমল কিশোরমুখ, অপরিচয়ের লজ্জা আর দ্বিধার সঙ্গে সেখানে প্রথম ভোরের আলোর মতন দীপ্তি তিরতির করে কাঁপছে। সুপ্রতীক প্রথমে খুব লাজুক ছিল, আস্তে আস্তে তাদের পরিচয় গাঢ় হলো, সুপ্রতীকের সঙ্কোচ কাটতে লাগলো। প্রথমে সে পড়াতে আসতো সপ্তাহে দু'দিন, তারপরে তিনদিন। বন্ধুত্ব পেরিয়ে সম্পর্কটা যখন আরো গভীর কিছুর দিকে মোড় নিচ্ছে, তখনই সুজাতা বুঝতে পেরেছিল এইবারে শেষ হয়ে আসছে সব। সুজাতার আজও দৃঢ় বিশ্বাস সুপ্রতীক যদি আরেকটু বয়সে বড় হতো, যদি ওর একটা স্থায়ী জীবিকা থাকতো বা অন্য কোনো সঙ্গতি থাকতো, ও ওভাবে হাল ছেড়ে দিত না। ও সুজাতাকে কষ্টে ফেলতে চায় নি, ও চেয়েছিলো সুজাতা সুখে থাক, আর্থিক সাচ্ছল্যের মধ্যে বড় হওয়া সুজাতাকে সে অভাব-অনটনের অনিশ্চয়তার মধ্যে টেনে নিয়ে যেতে চায় নি।

সুখ? হাহ। সুখেই তো আছে সুজাতা, ধনী স্বামী, ছেলেমেয়েরা নামীদামী আবাসিক স্কুলে মানুষ হচ্ছে, সে এখানে ঝাড়া হাতপা, শুধু সাজগোজ আর শপিং করা আর স্বামীর সঙ্গে পার্টিতে যাওয়া বা বাড়ীতে পার্টি হলে সেজেগুজে ঘুরে বেড়ানো আর খেজুরে আলাপ করা ছাড়া আর কাজই তো বলতে গেলে নেই! মাঝে মাঝে বিদেশ যায় তারা, সেখানেও তো সেই শপিং! এই সুখের জীবনই কি সে চেয়েছিলো? হয়তো চেয়েছিলো। নইলে বারো বছর তাদের বিয়ে হয়েছে, স্বামীর সম্পর্কে বিশ্বাসভঙ্গের গুজবই শুধু না, প্রমাণও সে পেয়েছিলো। কিছুই সে বলেনি। কেন?

কেন যেন মনের মাঝখান থেকে কোনো তাগিদ আসে নি। স্বামী তাকে ঠকাচ্ছে জেনেও সে এমন ঠান্ডা হয়ে রইলো কেন? তরুণী বয়সে যে তীব্র আত্মমর্যাদাবোধ তার ছিলো, তার শতাংশের একাংশ অবশিষ্ট থাকলেও তার তীব্রভাবে জ্বলে ওঠার কথা। একেকবার মাঝে মাঝে যে ইচ্ছে যে করেনি জ্বলে উঠতে, সাজানো সংসার ভেঙে চুরমার করে পথে বেরিয়ে পড়তে, তা নয়। কিন্তু শেষ অবধি অদ্ভুত এক অবসাদ জড়িয়ে ধরেছে তার সমস্ত অস্তিত্ব।

কখনো খুব মগ্ন একলা দুপুরে উত্তরের ব্যালকনিতে বসে উল বুনতে বুনতে তার মনে হয়েছে স্বামীই কি শুধু ঠকাচ্ছে তাকে? সমস্ত সমাজ কি তাকে ঠকায় নি? রীতিনীতিই কি তাকে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিতে বাধ্য করেনি? সে নিজে কি নিজেকে ঠকাচ্ছে না? মনের খুব গভীরের তন্তুগুলি খুলেমেলে দেখলে সেখানে কি স্বামীকে খুঁজে পাবে সে কোথাও? সেই হিসাবে তারই বা কি অধিকার আছে স্বামীর কৈফিয়ত দাবীর?

মাঝে মাঝে মনে হয় এই যে ঘড়ির টিক্‌ টিক্‌ টিক্‌ টিক্ এর মতন নিয়মিত ছন্দে তার জীবনটা চলে যাচ্ছে, অবসন্ন নদীধারার মতন, এরকমই কি যাবে চিরকাল? এইভাবেই একসময় বয়স বাড়তে বাড়তে জরাজীর্ণ বার্ধক্য ও মৃত্যু? পছন্দের মানুষকে হারিয়ে সেই তীব্র বেদনা বুকের ভিতরে কবর দিয়ে অন্য মানুষের সঙ্গে মানিয়ে চলতে চলতে জীবন পরিক্রমা? কিন্তু ...কিন্তু সেই হারানোর বেদনা? সেইসব অন্ধকার দিনরাত? কোনো মূল্যই কি ছিলো না সেই দুঃখদহনের? সেটা শুধুই এক অবুঝ বালিকার ভুল ?

সুজাতার মনে হয় তার জীবনটা কুয়াশায় ঘিরে আছে, নজর চলে না বেশী দূরে। শুধু মাঝে মাঝে নিমপাতা স্বাদ জিভে জড়িয়ে যায়, ভিতর থেকে একটা কী যেন ঝমঝম করে ওঠে বন্ধ ঘরের ভিতরের রহস্যময় শব্দের মতন। অর্ধেক রাতে জেগে উঠে তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে যেন, ছুটে সে ব্যালকনিতে বেরিয়ে আসে খোলা বাতাসের জন্য। জ্বলজ্বলে তারাগুলোর দিকে চেয়ে তার মনে হয় কী যেন তার করার ছিলো?

(চায়ের বিরতি)


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আপনেরেও চা খাওয়ার রোগে ধরছে? কেম্নে কী? জলদি ফেরতাসেন
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তুলিরেখা এর ছবি

আর ফেরত!
ভালা আছেন নি? আপনের ছোটো নাটক একটা কেন সচলে দেন না? -----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

চা কী একা খাবেন? আমাদের দিবে না। ভালো লাগল।

দলছুট।

তুলিরেখা এর ছবি

না না একা না! আপনেরাও খান চা, লোটা লোটা চা আছে। হাসি
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

এটা কি ধারাবাহিক? ধারাবাহিক লেখা পড়তে ক্লান্তি লাগে, আগে জানলে পাঠই করতাম না!
এক পর্বে দিলে স্রোত থাকে। আরাম পাই।
----------------------------------------
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
----------------------------------------
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ

তুলিরেখা এর ছবি

কন কি? পাঠই করতেন না?
আসলে এইটাও একটু এগিয়ে থেমে যাওয়া এক লেখা। কিছু কিছু লেখা খানিকটা হয়ে অচল হয়ে যায়। মাঝে মাঝে এর কোনোটা তুলে সচলে দিই যাতে কমেন্টীয় ধাক্কায় সচল হয়। হাসি
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তুলিরেখা এর ছবি

মাঝে মাঝে পাঠকদের ব্যাপার ভেবে বিস্ময় লাগে, পোস্টে না ঢুকেই তারা বোঝেন কিকরে কোন্‌ লেখাটা পড়লে পস্তাতে হবে? চিন্তিত
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।