হাজার বছর পার হয়ে(১)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: সোম, ২৯/০৩/২০১০ - ৪:২৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চিলেকোঠা ঘরে একইরকম একটা নীল রঙের মোমবাতি জ্বলছিলো, শুধু জ্ জ্‌ জ্ জ্ জ্‌ শব্দ করে উড়ে বেড়ানো সেই পোকাটা নেই, এখন ঘোর শীত৷ গত গ্রীষ্মের শেষে প্রথম যখন এসেছিলো মিশেল, তখন অমন একটা পোকা উড়ে বেড়াচ্ছিলো মোমবাতির শিখাটা ঘিরে৷ তা ছাড়া অন্যসব একই আছে এই ঘরে-টেবিল, টেবিলের উপরে নানা আকৃতির রঙীন পাথর, মুদ্রা, পুরানো পুঁথি, হাড়, আরো কত চেনা অচেনা জিনিস এলোমেলোভাবে ছড়ানো৷

মিশেল খুব আশ্বস্ত করা হাসি হাসে মাইকেলের দিকে তাকিয়ে, কিন্তু মাইকেল রীতিমতন কাঁপছে ৷ শীতে বা ভয়ে বা উত্তেজনায় ৷ মিশেল আবার হাসে, কিন্তু মাইকেলের মুখে সে হাসির প্রতিবিম্ব পড়ে না৷ ত্রস্ত চোখে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাইকেল৷

বেশ কিছুক্ষণ মনের মধ্যে শব্দগুলো নাড়াচাড়া করে বাক্যগুলো সাজিয়ে নেয় মিশেল৷ পুরানো ভাষা আয়ত্ত করা খুব কঠিন, যদিও অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে পুরানো ভাষাটা শেখার চেষ্টা করেছে মিশেল, তবু৷ আয়নার সামনে বহুবার প্র্যাকটিস করেছে দৈনন্দিন কথাবার্তা, কিন্তু চেক করবে কার সঙ্গে? সেখানে তো এ ভাষা বলার মতন কেউ নেই৷

গত গ্রীষ্মে প্রথমবার এসে মাইকেলকে নানাভাবে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করতে করতেই তো কেটে গেছিলো প্রায় পুরো সময়৷ তারপরে আবার আসবে বলে চলে গেছিলো৷ তাছাড়া আর কীই বা করতে পারতো মিশেল? আস্তে আস্তে মাইকেলের দিকে এগিয়ে গেলো মিশেল, মাইকেল অপলকে চেয়ে আছে, দাঁড়িয়ে আছে শক্ত পাথরের মূর্তির মতন, মিশেলের মনে হলো লোকটা বুঝি নি:শ্বাসও নিচ্ছে না৷

মাইকেলের হাত দু'খানা অস্বাভাবিক ঠান্ডা, নিজের উষ্ণ হাতের উপরে সেই ঠান্ডা হাত দুটো নিয়ে ভাঙা ভাঙা বাক্যে মিশেল ওকে বলে," আচ্ছা, এত ভয় ... এত ভয় পাচ্ছ কেন? এত ভয় পাবার ... এত ভয় পাবার কি আছে? আমি ... আমি তোমার কোনো ক্ষতি করতে চাই না ... আমি তোমার বন্ধু বন্ধু বন্ধু ৷"

মাইকেলে শুকনো ফাটা ঠোঁটের ওপরে জিভ বুলিয়ে নিয়ে অত্যন্ত কাঁপা গলায় বলে, " আমি ... আমি জানি৷ আমি ভয় পাই না৷ শুধু আপনাকে দেখলে অন্য একটা কথা ... অন্য একটা কথা মনে হয়৷"

"কী কথা মনে হয়?" মিশেলের গলায় আগ্রহ৷

"সে কথা থাক৷" মাইকেলের স্বর ভাঙা ভাঙা, ডুবে যাওয়া৷

"বলতে ইচ্ছে না হলে ... বলতে না চাইলে বোলো না৷ কিন্তু ... কিন্তু আমার শুনতে ইচ্ছে ছিলো৷" মিশেল চাইছে যথাসম্ভব আশ্বস্ত করতে৷

মাইকেল খুব আস্তে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে," আপনাকে দেখলে ... আপনাকে দেখলেই আইরিনকে মনে পড়ে৷ আইরিন চলে গেলো, আমি নিজে ডাক্তার, কিন্তু আমি ওকে বাঁচাতে পারলাম না৷ আমি চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমি এতই হতভাগ্য ... " মাইকেলের স্বর পুরো ডুবে গেলো, কান্না গোপণের আর কোনো চেষ্টা এখন সে করছে না৷

মিশেল যতটা সম্ভব সান্ত্বনা দিতে চায়, " মাইকেল, মাইকেল, সেটা ছিলো মহামারী, প্লেগ৷ তোমার কীই বা করার ছিলো ঐ ঝড়ের মুখে? হাজারে হাজারে মানুষ সেসময় .... তুমি তবু তোমার যথাসাধ্য করেছিলে৷ কেন শুধু শুধু নিজেকে দোষ দিচ্ছ? "

মাইকেল সান্ত্বনা পায় কিনা বোঝা যায় না, সে বলে," ঝড়ের মুখে আমার সব ভেসে গেলো৷ আইরিন চলে গেলো, ওর সঙ্গে চলে গেলো আমার ... আমাদের অনাগত সন্তান৷"

মিশেল মাইকেলের হাতের উপরে আঙুল বোলাতে বোলাতে কিছু বলবে ভাবে, কিন্তু কথা খুঁজে পায় না৷ ঠিক ঠিক শব্দগুলো মনে পড়ে না, নাকি আসলে এসব সময়ে কি বলতে হবে সেটাই জানে না সে, মিশেল বুঝতে পারে না৷ এরকম পরিস্থিতি আগে কখনো হয় নি মিশেলের, সে যে সময়ে আর সমাজ ব্যবস্থায় থাকে, সেখানে সব অন্যরকম৷

মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্য মিশেলের মনের মধ্যে ঝলকে উঠলো রবার্টের মুখ, কত অন্যরকম! বব কি কোনোদিন মিশেলের সামনে এরকম করে কথা কয়েছে? মিশেল নিজের মনের ভিতরেই মনকে ধমক দেয়, সেখানে সবকিছু অন্যরকম, নিখুঁত জেনেটিক হিসেব মিলিয়ে তৈরী মানুষ, সমস্ত উত্কৃষ্ট গুণকে বাড়িয়ে তোলা মানুষ, তাদের বেড়ে ওঠা যুক্তিনিষ্ঠ পরিমন্ডলে, শিক্ষায় ... সেখানে এরকম প্রাচীন যুগের দুর্বলতা থাকবে কেন?

মিশেল নিজেও তো সেইভাবেই তৈরী, সেইভাবেই বড়ো হয়ে ওঠা, কিন্তু কেন ওর তবে এরকম লাগছে এখন? এটা ওর কাছে কাজমাত্র ছিলো, ইতিহাসের প্রোজেক্ট শুধু, অনেকের মধ্য থেকে সিলেক্টেড হয়েছিলো সে, বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়ে, ট্রেনিং পিরিয়ডেও খুব নিঁখুত পারফর্ম্যান্স ছিলো, কেউ কোথাও খুঁত পায় নি বলেই তো ওকে এখানে আসার অনুমতি শেষ পর্যন্ত দিয়েছে টেম্পোরাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশান--সেলিব্রেশানের দিনটাও মনে পড়ছে-বব সেদিন সঙ্গে ছিলো পার্টিতে ...

নিজের মুখের উপরে একবার হাত বুলিয়ে হঠাৎ জেগে ওঠা স্মৃতিকে মুছে দিলো মিশেল, বললো, "মাইকেল, এসো আমরা বসি৷ তোমার কথা অনেক শুনতে ইচ্ছে হয়৷ তোমার সেই দেশভ্রমণের কথা, তোমার সেই পুরানো চার্চ, সেই বুড়োমানুষটা, যে কিনা তোমাকে সব শেখালো হাতে ধরে ... বলবে মাইকেল?"

মাইকেল জামার ঢোলা হাতায় মুখচোখ মুছে সুস্থির হয়ে নিয়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে, "আসুন, দয়া করে বসুন৷"

মিশেল বসে পড়ে চেয়ারে, চেয়ারে পুরানো দিনের গন্ধ, সমস্ত ঘরটাতেই তাই৷ বন্ধ জানালার বাইরে পুরানো পৃথিবী ছড়িয়ে আছে যতদূর দু'চোখ যায়, ঐ পথ দিয়েই তো একটু আগে হেঁটে এসেছিলো মিশেল৷ এইখানেই ভেসে উঠতে পারতো ইচ্ছে করলে, কিন্তু তাতে মাইকেল আরো অনেক বেশী ভয় পেতো৷

ঐটুকু পথ হেঁটে আসতে আসতে সর্বাঙ্গ শিরশির করছিলো মিশেলের, একই জায়গায় সব কত অন্যরকম এখন, বাড়ীঘর অন্যরকম, গাড়ীগুলো অন্যরকম, গাছপালাদের রোপণ করা হয়েছে অন্যভাবে ... শুধু ঐ রাত্রির আকাশের তারাগুলি শুধু একই আছে৷

মাইকেলও বসে পড়েছে উল্টোদিকের চেয়ারে, অন্যমনস্কভাবে একটা রঙীন পাথর তুলে হাতে নেয়৷ হয়তো ভাবছে ওর সেই ভবঘুরে সময়ের কথা৷ মাইকেল আস্তে আস্তে বলতে শুরু করলো ওর ভবঘুরে জীবনের গল্প, জীবনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও সবচেয়ে কঠিন সময় সেটা তার৷ দিনের পর দিন, অনাহারে অর্ধাহারে পথ চলা, দিনের শেষে কোনোদিন আশ্রয় জোটে, কোনোদিন গাছতলা সার৷ তবু এক অদম্য অস্থিরতা ওকে ছুটিয়ে নিয়ে চলতো গ্রাম থেকে গ্রামান্তর,শহর থেকে অন্য শহর, এক চার্চ থেকে অন্য চার্চ, এক অ্যাপোথেকারি থেকে অন্য খান, এক জ্ঞানী ভিষকের কাছ থেকে অন্যজনের কাছে৷ ওর মেডিকেল স্কুলের সঙ্গীসাথীরা যারা নির্দিষ্ট সময়েই ঠিকঠাক পাশ্টাশ করে বেরিয়ে চিকিত্সা-ব্যবসা খুলে বসেছিলো প্রচলিত পদ্ধতিতে, তারা ওর সে অদ্ভুত অস্থির জীবনের মানে বুঝতে পারতো না, ঐ জীবনকে ওরা পছন্দও করতো না৷ কিন্তু মাইকেলের কিছুই করার ছিলো না, ওকে যেতেই হচ্ছিলো, ভিতর থেকে কিছু একটা ওকে ঠেলে নিয়ে চলছিলো, যখনি ও কোথাও থিতু হতে চাইতো, হয়তো সুযোগও পেয়ে যেতো, হয়তো বৃদ্ধ প্রতিষ্ঠিত চিকিত্সক ওকে পরবর্তী উত্তরধিকারী নির্বাচিত করতে চাইতেন নিজের কাজে, কিন্তু মাইকেল থাকতে পারতো না৷ শেষ মুহূর্তে দুর্বলতা ছিন্ন করে বেরিয়ে পড়তো পথে, চরৈবেতি চরৈবেতি৷

ছেলেবেলা থেকে যে নিষ্ঠুর কালোমৃত্যুর থাবার মধ্যে বারে বারে মানুষকে অসহায় হয়ে মরতে দেখেছে সে, মহামারী তাকে বারে বারে রেহাই দিয়ে গেছে, কেন? মাইকেল জানে না, শুধু জানে ওকে কিছু একটা করতে হবে, কিছু একটা করতে হবেই৷ কিভাবে করবে সে জানে না, শুধু অন্ধ অসহায় ক্রোধ ও ছটফটানি দেশ দেশান্তরে ওকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়৷

এই ঘূর্নী হাওয়ার মতন ঘুরবার দিনগুলোর মধ্যে দুটো সময় ওর কাছে খুব স্মরণীয়৷ একটা হলো বৃদ্ধ ভিষক অ্যারনের কাছে কিছুদিন শিক্ষানবিশী করা, বুড়োমানুষটার কথা বলতে বলতে শ্রদ্ধায় কোমল হয়ে আসে মাইকেলের মুখ, উনিই ওকে প্রায় হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন ভেষজবিদ্যার অন্ধিসন্ধি, শিখিয়েছিলেন কিকরে চিন্তা করতে হয় নতুন পথে, মৃত্যুবেষ্টিত এই দুনিয়ায় কিকরে ভালোবাসতে হয় জীবনকে৷

মগ্ন হয়ে শুনছিলো মিশেল গালে হাত রেখে, ওর চোখ মেলা ছিলো মাইকেলের মুখের উপরে অপলক, যেন সামান্য চোখের ফোকাস নড়ে গেলেই ঘটনামালা ছিঁড়ে এলোমেলো হয়ে যাবে, টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো মালাছেঁড়া মুক্তোদানার মতন টর টর টর শব্দ করতে করতে মেঝে জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বুঝি হারিয়ে যাবে৷ আচ্ছন্নের মতন চুপ করে শুনছিলো মিশেল৷

অ্যারনের কথা বলতে বলতে যখন মাইকেলের মুখ আলো ছলছল হয়ে এলো, জীবনের প্রতি ভালোবাসা শেখার কথা বলতে বলতে যখন মাইকেল মুখ তুলে মিশেলের চোখে চোখ রাখলো, তখন আর থাকতে না পেরে ফিসফিস করে মিশেল বললো,"তবে? এসব কথা তো তোমায় তোমার স্যর আগেই বলেছেন, তুমি নিজেও সব জানো৷ তবে তুমি কেন মোহগ্রস্তের মতন এত দু:খ পাও?"

মাইকেল নীরবে হাসলো, বললো,"জেনেও দু:খ পাই, মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার ঋণশোধ বোধহয়৷"

হঠাৎ অদ্ভুত শীতে কেঁপে ওঠে মিশেল, বাইরের শীত না, বন্ধ জানালা এই ঘরে উজল মোমবাতির শিখার পাশে শীত নেই৷ কিন্তু এ অন্য শীত, ভয়ের শীত৷ মানবজীবনের ঋণশোধের তো করা হয় নি মিশেলের, সে এখনো আউটসাইডার মাত্র৷ কত উন্নত প্রযুক্তির ও প্রসারিত জ্ঞানবিজ্ঞানের দূর ভবিষ্যত্কালে তার ঘরবাড়ী, আপনজন, কাজকর্ম সব৷ কিন্তু সত্যি কি কিছুই আছে তার? মোহগ্রস্ত হওয়া জ্ঞানসংগ্রহের পথে অন্তরায়, সে জানে, সে যুক্তির কড়াপাকে আঁট করে বাঁধা পথে চলেছে এতদিন, কিন্তু কি বলছে এই প্রাচীন মানুষটা? মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার ঋণশোধ দু:খদহনে?

*****

টাইমপোর্টের রিসিভিং কমপ্লেক্সের মাঝখানে ঘোরানো বেগুনী-নীল স্পাইরালের মধ্যবিন্দুতে ঝলকানো আলো, নিজস্ব সময়ের সিঁড়িতে পা রেখে সবসময়েই পিছনে ঘুরে একবার দেখে মিশেল৷ঐ আলোটুকু থেকে যায়, আসা-যাওয়ার পথটা কোনোদিন বুঝতে পারে নি মিশেল, ঘন ঘুমের আবরণে সে পথ ঢাকা৷ এসে পৌঁছে গেলে তৃষ্ণায় গলা কাঠ হয়ে যায়, অথচ জলপান করার উপায় নেই৷

ঘোরালো প্যাঁচালো সর্পিল সিঁড়িগুলো পার হয়ে বিরাট কোয়ারান্টাইন৷ স্নিগ্ধ আকাশী রঙের দেয়াল এসব ঘরে, জানালাগুলো পান্নার মতন উজল সবুজ, ছয়কোণা চেহারার, দরজাগুলো উপবৃত্তাকার, হাল্কা সবুজ রঙের৷ সমস্ত ঘর অপূর্ব আলোয় ধোয়া৷ পুরোটা বন্ধ, কিন্তু বোঝা যায় না৷ কল্পবাস্তব এখানে এত উচ্চতায় পৌঁছেছে যে বন্ধ ঘরের মধ্য থেকেও মনে হচ্ছে যেন সে আছে শরতের স্নিগ্ধ নদীতীরে, আবার কিছু পরেই সেটা বদলে হয়ে যাচ্ছে সমুদ্রবেলা, আকাশে উড়ছে সীগাল, সে আকাশ ইন্দ্রনীলমণির মতন ঝলমলে নীল৷

তিন থেকে চারদিন কোয়ারান্টাইনে থাকতে হয় মিশেলকে, এসময় বেশ অনেক মেডিকেল টেস্ট হয়, বেশীরভাগই মিশেলের অলক্ষ্যেই হয়ে যায় নানাধরনের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সেন্সরের দ্বারা, কিছু টেস্ট এসে করেন মানুষ বা রোবট ডাক্তারেরা৷ একদম শেষে মনোবিদ এসে পরীক্ষা করে সব "ওকে" বলে দিলেই তারপরে মিশেল কোয়ারান্টাইন থেকে ছাড়া পায়৷

রবার্ট রিসিভ করতে আসে ওকে, কপালের উপরে এসে পড়া ওর এলোমেলো বাদামী চুলগুলো একইরকম ভাবে হাওয়ায় ওড়ে, আঙুল দিয়ে সামলাতে সামলাতে অপ্রস্তুত হাসে, মিশেলের দিকে একটু এগিয়ে এসে বলে," সুপ্রভাত, মিশেল৷ তোমার নিজের সময়ে স্বাগত৷" মিশেলও বলে, "সুপ্রভাত,বব", যদিও কালযাত্রার ঐ বিপুল তরঙ্গে প্রভাতই বা কী সন্ধ্যাই বা কী মধ্যরাতই বা কি?

ববের উড়নযানটা ছোট্টো কিন্তু খুব আরামদায়ক৷ সীটে এলিয়ে বসে আলতো হাসে মিশেল, চালকের আসনে বসে বব নব ঘুরিয়ে চালু করে উড়নগাড়ী, মসৃণভাবে উপরে ওঠে যায় যান, গন্তব্য উত্তরদিকে, সেখানে টেম্পোরাল-অ্যাডমিন এর আপিসে কিছু কাজ সেরেই বাড়ী৷

মিশেলের চোখেমুখে হাল্কা অবসাদ, অথচ কোয়ারেন্টাইনে খুব আরামেই থাকার ব্যবস্থা, মনেও হয় না কনফাইনমেন্ট, এত ভালো সব ভার্চুয়াল এনটারটেইনমেন্ট এর ব্যবস্থা, খাবার দাবার আর পানীয়ও ভালো দেয়-তবু এই কোয়ারেন্টাইন থেকে বেরিয়ে সময়টা দ্রুত বাড়ী ফেরার জন্য মনকেমন করে মিশেলের, সেই ব্যালকনির বাগানে ছোট্টো ছোট্টো টবে গাছগুলো, ছাদের লতাপাতাওলা জালের ঘরের ছোট্টো ছোট্টো পাখিরা ... এমনকি ছয়কোণা বিশাল টবে লালনীল মাছগুলো ... বাড়ীর বাগানে পোষা প্রাণীরা ...

বব আর মিশেল এখনো অনুমতি পায় নি সন্তান দত্তক নেবার, আরেকটু প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিয়ে অনুমতি চাইবে৷ মিশেলের মনে হয় ওরা নিশ্চয় অনুমতি পেয়ে যাবে, আর অনুমতি পেয়ে গেলে কয়েক মাসের মধ্যেই দত্তক সন্তান পাওয়ার কথা৷ মিশেলের ইচ্ছে মেয়ে দত্তক নেয়, ববের ইচ্ছে ছেলে ... দেখা যাক, সে অনেক দূরের ব্যাপার৷

মাঝে মাঝে ইতিহাসের লাইব্রেরীতে বসে ক্রিস্টাল লিংকে পুরানো ঘটনাবলীর রিকনস্ট্রাকশন দেখতে দেখতে মিশেল ভাবতো পুরানো সেইসব সময়ে যখন কিনা মানুষের প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সন্তান জন্মাতো ... কি বিপদ আর অনিশ্চয়তায় ভরা ছিলো মনুষ্যজন্ম ...এখন তো সব জেনেটিক ইন্সটিটিউটে, হিসেব মিলিয়ে তৈরী নিঁখুত মানুষ, সুস্থ সবল নীরোগ শিশুরা প্রস্ফুটিত হয় জেস্টেশান চেম্বারের নিরাপদ আশ্রয়ে ...আচ্ছন্নতা ভেঙে যায় মিশেলের, এসে গেছে টেম্পোরাল অ্যাডমিন অফিস, বব আস্তে আস্তে নামাচ্ছে উড়নযান৷

টেম্পোরাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশানে লাগলো প্রায় ঘন্টাখানেক, কৃস্ট্যাল-ডকুমেন্ট সব জমা নিয়ে দেখেটেখে সব "ওকে" করতেই এতটা সময় লাগলো৷ মিশেল ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিলো ওর নির্দিষ্ট আসনে, খুব আরামদায়ক চেয়ার, মৃদু তরঙ্গ প্রবাহিত হচ্ছে শরীরের মধ্য দিয়ে, মন ভালো করে দিচ্ছে৷ মিশেল ওর প্রিয় অতি স্নিগ্ধ সুরের গান ও তার সঙ্গে সঠিক ম্যাচ করা বাজনা ও শুনতে পাচ্ছিলো৷ ওদের তথ্যাবলীতে মিশেল সম্পর্কিত ফাইলে এই প্রিয় গানের লিস্ট রয়েছে৷ কাছেই আরেকটি আসনে ববও অপেক্ষা করছিলো, মিশেলকে রিসিভ করে নিয়ে যেতে যেদিন আসে, সেদিন পুরোসময়ের ছুটি পায় বব৷

সুদৃশ্য গোল জানালার বাইরে ছড়িয়ে আছে সুন্দর সবুজ পৃথিবী, ধোঁয়া ধুলাহীন নীল আকাশ, সেই আকাশে ঝলমলে সূর্য, নি:শব্দ দ্রুতগতি উড়নযানেরা উড়ছে বাতাসে, সুক্ষ্ম তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গ দ্বারা ওদের গতিপথ নিয়ন্ত্রিত৷ ক্যালেন্ডারে ২৩২১ সাল৷

উড়নযানগুলোর দিকে চেয়ে হঠাৎ ইতিহাস-গবেষক মিশেলের মনের মধ্যে ভেসে ওঠে পুরানো একটা সময়৷ সে সময় শক্তিসমস্যা ছিলো মারাত্মক, সমস্ত ফসিল ফুয়েল শেষ হয়ে আসছিলো,ওদের ভান্ডার তো সীমিত, সেই নিয়ে লাগাতার লড়াই চলছিলো দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে, এদিকে ক্রমশ দূষিত হয়ে পড়ছিলো পৃথিবীর বাতাস-জল-মাটি৷

তারপরে মানুষ একসময় সফল হলো নিউক্লীয় সংযোজন কে কাজে লাগাতে, একই প্রক্রিয়া যার দ্বারা সূর্যকেন্দ্রে শক্তি তৈরী হয়৷ অথচ পৃথিবীতে কিছুতেই এটাকে নিয়ন্ত্রিত আকারে আয়ত্ত করা যাচ্ছিলো না৷ অবশেষে একসময়-আজ থেকে তিনশো বছর আগে ... মানুষ পেরে গেলো সেটা, ফিউশন টেমড হয়ে গেলো---চিরকালের মতন শক্তিসমস্যা ঘুচে গেলো, পলুশন ঘুচে গেলো-শক্তির বিপুল মহাসমুদ্র এসে গেলো মানুষের আয়ত্তে৷ গত কয়েক শতকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সবচেয়ে বেশী ইম্প্যাক্টওলা আবিষ্কার বোধহয় সেটাই৷

টেম্প-অ্যাডমিন থেকে বেরিয়ে ফের উড়নযানে উঠে বসতেই বব জিগালো, "সোজা বাড়ী তো? নাকি কোনো খাবারের দোকানে থামবো?"

মিশেলের কিন্তু একটুও থামতে ইচ্ছে করছে না কোথাও, কতক্ষণে বাড়ীতে পৌঁছবে সেই অপেক্ষায় অধীর৷ কিন্তু ববের হয়তো কোনো খাবারের দোকানে থামার ইচ্ছা, ও ববের দিকে চেয়ে বললো, "তুমি কি কোথাও খেতে চাও? কি দরকার এখন? বাড়ীতে গেলে নিজেরাই কিছু তৈরী করে নেওয়া যেতো-ডিনারে নাহয় বেরুবো দুজনে!”

বব মাথা নেড়ে সায় দেয়, "সেই ভালো৷ সোজা বাড়ী৷ সল আর নিফি ও তোমায় মিস করছে৷"

সল আর নিফি-দুখানা পোষা খরগোস, বাগানে থাকে৷ ওদের কথা মনে হতেই মনটা কোমল হয়ে এলো মিশেলের৷

বাড়ীতে পৌঁছে ভালো করে কুসুম কুসুম গরম জলে নেয়ে হাল্কারঙের নরম পোষাক পরে নিতেই মনটার অবসাদ অনেকখানি ঘুচে গেলো মিশেলের৷ ওদিকে বব ততক্ষণে ওদের রোবট অম্বটের সাহায্যে তৈরী করে ফেলেছে ভালো শক্তিবর্ধক পানীয় আর কুড়মুড় ভাজা কাহাইফ্রিল, লোক্যালোরি কর্ণমিল, চাট্টি প্লেন রিসিয়ুম আর মিডি ক্যালোরি কুরিয়াম তো আছেই৷

অম্বট বাগানে ফোল্ডিং টেবিল নিয়ে পেতে আম্বেল্রা আর চেয়ার অন করতেই, বিশাল ফুলের পাপড়ির মতন মাথার উপরে ছাতা খুলে গেলো, টেবিলের চারপাশে চাট্টি চেয়ার বেরিয়ে এলো, সুগন্ধি হাওয়া আর গানের সুরও চালু হয়ে গেলো৷

মিশেল বব সেখানে গিয়ে মুখোমুখি দুটি চেয়ারে বসতেই অম্বট টেবিলে খাবারদাবার সাজিয়ে দিয়ে চলে গেলো৷ অম্বট চলে যেতেই বাগানের ফুলগাছের ঝোপের পেছন থেকে গুটি গুটি সল আর নিফি এসে মিশেলের কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়লো৷ ঝুঁকে পড়ে ওদের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মিশেল খানিকক্ষণ অদের সঙ্গে কথা কইলো, তারপরে ওদের খেতে দিলো, তারপরে নিজে ফর্ক তুলে খেতে শুরু করলো৷ এতক্ষণ বব শুধু পানীয়ে চুমুক দিচ্ছিলো, মিশেল খাওয়া শুরু করতে বব ও শুরু করলো খেতে৷

নীরবে খাচ্ছিলো দুজন, মাঝে মাঝে ঠোঁট মুছছিলো মসৃণ নরম ওমেগা-পলিমারের এর ন্যাপকিনে৷ এগুলো একদম নতুন প্রোডাক্ট, ব্যবহার করতেও যেমন সুবিধে, রিসাইকল এর ক্ষেত্রেও তেমন ভালো৷ পুরানো জিটা পলিমারের জিনিসও এখনো কেউ কেউ ব্যবহার করে, তবে এগুলোই বেশী জনপ্রিয়৷ ওমেগাক্রন গোষ্ঠী সমস্ত ধরনের নতুন পলিমারের ক্ষেত্রে প্রায় একচ্ছত্র-পোশাক থেকে আরম্ভ করে পর্দা বেডকভার সমস্ত ধরনের টিসু তো এদেরই সাপ্লাই, এমনই এই যে ফোল্ডিং টেবিল চেয়ার ছাতা প্লেট কাপ ফর্ক নাইফ সবই এদের তৈরী৷

আস্তে আস্তে কুড়মুড়ে কাহাইফ্রিলে কামড় দিয়ে দিয়ে কারিউম খাচ্ছিলো মিশেল, বব একবার ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো "মিশেল, প্রত্যেকবার ট্রিপের পরেই তুমি বেশ বদলে যাও৷ প্রথম কয়েক ঘন্টা এত কম কথা বলো!"

মিশেল হাসে, বলে,"সত্যি? তোমার তাই মনে হয়? আসলে তা কিন্তু নয়৷ একটা খুব অন্যরকম অভিজ্ঞতা তো! হয়তো ধাতস্থ হতে খানিকটা সময় লাগে৷"

বব হাসে,"তাই? কিন্তু গল্প বলতে হবে৷ খাবার পরেই বলবে তো? এবারে কেমন দেখলে মাইকেলকে? "

"বলবো বব৷ আজ তো তোমার পুরোদিনের ছুটি, আস্তে আস্তে বলবো৷ মাইকেল ভালোই আছে,কিন্তু এখনো ভীষণ আড়ষ্ট৷ আমাকে রিয়েল মনেই করতে পারে না৷ ভাবে আমি ওর স্বপ্ন বা কল্পনা৷" কথা শেষ না করেই জোরে হাসে মিশেল৷

বব বলে,"তোমাকে স্বপ্ন ভাবে? ওয়েল ... একদিক দিয়ে তো ঠিকই৷ ভেবে দ্যাখো৷ তুমি ওর সময়ে তো আসলে নেই৷ আমার মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছে করে মিশেল, তুমি ঐ লোককেই কেন বাছলে তোমার প্রজেক্টের জন্য? "

প্রশ্নটা শুনে মিশেল খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বলে, "কেন বাছলাম? কেজানে! কেন জানি চরিত্রটা খুব আকর্ষণ করলো, ইতিহাসের অন্য বিখ্যাত চরিত্রদের মতন নয়, একটা কেমন রহস্যাবরণ ওর চারপাশে জড়ানো ... একটা অচেনা সময় ... ওর সম্পর্কে পরবর্তীকালে আমরা যা জেনেছি তাতে পরিষ্কার করে কিছুই বোঝা যায় না, মানুষটাকে কিছুতেই ধরাছোঁয়া যায় না,তাই হয়তো ... তবু এরকম চরিত্র তো আরো ছিলো ... তাদের কাছে তো যাবার কথা ভাবিনি ... কিজানি বব, কেন এঁকে ঠিক করলাম, বলতে পারিনা ... " মিশেলের চোখজোড়া আচ্ছন্ন হয়ে এসেছে, বব ওকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে," আরে, খাওয়া বন্ধ করে দিলে কেন? খাও৷ খাওয়ার পরে গল্প বোলো৷"

খাওয়ার পরে ঘরে এসে বিশ্রাম৷ মিশেল ববকে বলে যায় মাইকেলের ওখানে পৌঁছানো, ত্রাসবিমূঢ় মাইকেলকে যথাসাধ্য সাহস ও আশ্বাস দিয়ে মোটামুটি কাজ চলার মতন অবস্থা তৈরী করা, চিলেকোঠা ঘরে যেখানে ও রাতের বেলা কাজ করে সেখানে বসে ওর সঙ্গে গল্প করা, ওর জীবনের গল্প শোনা-আস্তে আস্তে সব বলে যায় মিশেল৷

বলতে বলতে অনুভব করে সেসময়ের পৃথিবীর আশ্চর্য অনুভবটা কিছুতেই কথায় বলতে পারছে না৷ হয়তো সম্ভবই নয়৷ যেমন সম্ভব হয়নি এই সময়ের কথা মাইকেলকে বোঝানো, মিশেল বলে গেছে, মাইকেল শুনে গেছে অবাক হয়ে, মেনে নিয়েছে স্বপ্নাচ্ছন্নের মতন-কিন্তু বিশ্বাস করেছে বলে মনে হয় না৷ গল্প শুনে বব খুশী, খানিকক্ষণ পরে বব চলে গেলো ওর কাজের ঘরে কিছু কাজকর্ম করতে৷

ক্রিস্টাল লিংক চালিয়ে দিয়ে থ্রীডি টিভিতে মিশেল দেখতে লাগলো খবর, প্লেনিকন কোম্পানীর আন্তর্গ্রহ যাত্রী পরিষেবায় কি একটা গন্ডগোল হয়েছে, সে নিয়ে খবরে দেখাচ্ছে৷ আবার! মিশেল একটু বিরক্ত৷ এই কোম্পানী পৃথিবীর কাছাকাছি গ্রহ উপগ্রহের উপনিবেশে-এই যেমন চাঁদ, মঙ্গল, কয়েকটা অ্যাস্টরেয়েড, বৃহস্পতির কয়েকটা বড়োসড়ো উপগ্রহ- এইসবে যেসব উপনিবেশগুলো আছে, সেখানে নিয়মিত যাত্রী আনা নেওয়া করে৷ এদের প্রতি নানা অভিযোগ সবসময়েই যাত্রীরা করে থাকে, হয় যাত্রাপথে খাবার ভালো দেয় না, নয়তো মালপত্র ঠিকমতো দেয় না, হারিয়ে ফেলে, এসব নিয়ে প্রায় সারাবছরই কিছু না কিছু লেগে থাকে৷

অথচ লোকের উপায় খুব একটা নেই, আরেকটা কোম্পানীর লিমিটেড পরিষেবা আছে বটে, সে কোম্পানীর ইন্টার প্ল্যানেটারি ফ্লাইটে টিকিটের দাম অনেক বেশী৷ এ খবর দেখতে দেখতে চ্যানেল ঘুরিয়ে অন্যটায় চলে গেলো,নেপচুনের উপনিবেশে লো টেম্পারেচার ল্যাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা আবিষ্কার হয়েছে কদিন আগে, সেই নিয়ে উত্তেজক ডকু দেখাচ্ছে৷

হাল্কা সুরে ফোন বেজে ওঠে মিশেলের লকেটে, তুলে সে অবাক৷ লিজি কথা বলতে চায়! কতকাল ওর সঙ্গে কথা হয় নি, সেই যে ও যখন ইউরেনাসের ল্যাবে চলে গেলো, তিনবছর আগে, সেই শেষ দেখা৷ ভিশন বাটন অন করতেই লিজির ত্রিমাত্রিক ছবি ফুটে উঠলো মিশেলের সামনে, সোনালীরুপালী আলোর ঘেরের মধ্যে লিজি, এইসব অপ্টিকাল ইলুশন কিছু থাকলেও চেহারা মোটামুটি ঠিকই আসে থ্রীডি প্রোজেকশানে৷ লিজি একইরকম আছে দেখতে, ছোটো করে ছাঁটা চুল, ছটফটে নীল চোখে দুষ্টুমী-মিশেলের সামনে ভিসুয়ালাইজ করেই হেসে বললো, " হ্যাঁরে মিশেল, খুব তো একাল ওকাল ঘুরে বেড়াচ্ছিস, আমার সঙ্গে একবার কন্ট্যাক্ট করার কথা তিনবছরে একবারও মনে পড়লো না?"

মিশেল লিজিকে জানে সেই স্কুলের দিনগুলো থেকে, ও এরকমই, সবসময় ছটফটে৷ তবে খুব চটপটেও বটে৷ সকলেই জানতো প্রথম সুযোগেই ও দূরবর্তী কোনো গ্রহের ল্যাবে চলে যাবে৷ তাই গেছেও৷

মিশেল হাসে, বলে," তুই ব্যস্ত ল্যাবে৷ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা৷ এর মধ্যে বিরক্ত করবো? তাই কন্ট্যাক্ট করিনি৷"

"ওরে মেয়ে! কি কায়দা করা কথা!" লিজি গলা ছেড়ে হাসে৷

মিশেল এবারে পাল্টা চাল দেয়,"লিজি, আমিও তো বলতে পারি,তুই কেন কন্ট্যাক্ট করিস নি?"

"হ্যাঁ, আমারও তো করা হয় নি৷ শোধবোধ৷ এবারে বল, কেমন ঘুরলি৷"

দুই বন্ধু গভীর আলাপে জমে যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই৷ ঘুরে ঘুরে মিশে কুশে আসতে থাকে লিজির ল্যাবের গল্প, মিশেলের ইতিহাস গবেষণার কাজে অতীতযাত্রা, অতীতের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা-শীঘ্রই আবার যেতে হবে ওকে, সেকথা, লিজির সামনের অ্যাসাইনমেন্ট পড়েছে প্লুটোতে, এটা অল্প কদিনের৷ তারপরে সেখানে থেকে ওর যাত্রা শুরু আরো দূরের দিকে, অনেক দূরে,অন্য নক্ষত্রের গ্রহজগতের দিকে৷তার আগে হাইবারনেশনের দীর্ঘ ট্রেনিং৷ ওদের এত কথা জমেছে এত কথা জমেছে, দীর্ঘ আলাপেও কিছুতেই শেষ হচ্ছে না৷বব একবার এ ঘরে আসতে গিয়েও দরজা থেকে ফিরে গেলো৷ বিকেলের স্ন্যাকস এর সময়ও এদিকে হয়ে গেছে৷

*****

হাল্কা নীল চোখের এক কিশোর প্রদীপ্ত চোখ মেলে চেয়ে আছে মিশেলের দিকে-ওর সোনালী আভা লাগা লম্বা বাদামী চুল এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে কপালে, ঘাড়ে, কাঁধে৷ মস্ত বড়ো নীল জোব্বা ধরনের পোষাক ওর, হাতে পুরানো এক পুঁথি, ও কি যেন বলছে মিশেলকে, মিশেল কিচ্ছু বুঝছে না, সমস্তটা জলের মধ্যে ডুবে থাকা কোনো ছবির মতন কাঁপছে৷ মিশেলের হাতে নীল মোমবাতি, অন্যহাতে ফুলের সাজি, বনের মধ্যে ওরা দুজন--দূরে গাছের মাথাগুলোর মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে এক গীর্জের চূড়া, অন্ধকার হয়ে আসছে, মিশেলের খুব শীত করছে খুব ভয় করছে, মোমবাতিটা জ্বালাতে গিয়ে মিশেলের মস্ত ঝোলা নীল ঘাঘড়ায় আগুন লেগে দাউ দাউ করে পুরোটা জ্বলে উঠলো৷ সমস্ত চারিদিক আলো, ছেলেটা এগিয়ে এসে ওকে ধরতেই ওর বইটা প্রথমে ধরে উঠলো, তারপরে ওর কাপড়ে আগুন লেগে গেলো৷ মিশেলের চোখের সামনে কাগজের মতন পুড়ে যাচ্ছে সেই নীলচোখ কিশোর,তবু চোখে মেলে চেয়ে আছে একইভাবে৷

আর্তচিত্কার করে জেগে উঠলো মিশেল-গভীর রাত্রির নৈ:শব্দ চারিদিকে৷ পাশে বব গভীর নিদ্রামগ্ন৷ অনেকক্ষণ উঠে বসে রইলো মিশেল চুপ করে, তারপরে নেমে গিয়ে জল খেয়ে এলো৷ ঘুম আর হবে না, বাকী রাত্রিটা জেগেই কাটাতে হবে৷

কাউকে কি জানানো উচিত? মনোবিদেরা কিছু ধরতে পারে নি, যন্ত্রপাতিতেও কিছু ধরা পড়ে নি, ওর গোপন কথা গোপনই হয়ে আছে সময়ের ভাঁজে৷ শুধু এই ... এই স্বপ্ন ... এই মধ্যরাত্রির অসহায় জেগে বসে থাকা ...কিন্তু কি করবে মিশেল? ওর আর কী ই বা করার ছিলো? যা করেছে তা ওকে করতেই হতো৷ আজ না হোক কোনো না কোনোদিন ধরা পড়তেই হবে ... সেদিন ... এই যান্ত্রিক দুনিয়ায় এসবের কোনো ক্ষমা নেই, ক্ষমা ব্যাপারটাই অজানা ... হয় "ওকে" অথবা "নট ওকে", এর মাঝখানে আর কিছু নেই৷ জানে মিশেল৷ জানে৷ সব জেনেশুনেই করেছে৷

ববের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে কোমল হয়ে আসে মিশেলের মুখ, এই এত কাছের মানুষটার সঙ্গেও কি বিরাট দূরত্ব তার! আর ঐ লিজি, টিমি, অ্যাঞ্জি-ওরা যারা নির্বিকারে চলে যায় শত শত বছরের অভিযানে-দীর্ঘ নিদ্রায় বরফশীতল হয়ে জমে থেকে, যারা জেগে উঠবে অন্য সময়ে, দূর ভবিষ্যতে-ফিরে এসে দেখবে সব বদলে গেছে---ওদের সঙ্গে ওর আরো কত লক্ষ আলোকবর্ষের অলঙ্ঘ্যনীয় দূরত্ব! দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিশেল, যা করেছে সে ঠিকই করেছে, ওর মনে কোনো দ্বিধা নেই৷

(চলবে?)


মন্তব্য

পথেপথিক এর ছবি

দুই বার পড়লাম তবুও লেখার মূল ভাবনার কাছাকাছি পৌছাঁতে পারি নাই ।
যা বুঝাতে চেয়েছেন তা জটিল থেকে গেছে, জটিলই থাক । হাজার বছর পরের সৌরজগতের বর্ণনা ভালই লেগেছে ।

তুলিরেখা এর ছবি

শেষাংশ দিলাম, এবারে হয়তো মূল ভাবনা বুঝতে পারবেন।
মাইকেলের থেকে ১০০০ বছর দূরে হলেও সৌরজগতে ঐ আন্ত:গ্রহ যাত্রীপরিষেবা আমাদের থেকে মাত্র ৩০০ বছর দূরে। এমনকি তার চেয়েও তাড়াতাড়ি হতে পারে। হাসি
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তাহসিন আহমেদ গালিব এর ছবি

লেখাটা একটু বড় হয়ে যাওয়ায় মাঝের কয়েকটা প্যারা বাদ দিয়ে পড়লাম।

"সাবধান: হাতি পোস্ট" দারুণ মজার শব্দ প্রয়োগ হয়েছে।
হা! হা! হা!

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ।
এ হাতীর পরের হাতী বিষয়েও সাবধান। হাসি
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

স্নিগ্ধা এর ছবি

চলবে তো অবশ্যই! না চললে মাইকেলের 'ত্রাসবিমূঢ়' হওয়ার ব্যাপারটা বুঝবো কী করে? এই পর্বে বুঝিনি। মানে আশংকা, বা উদ্বেগ বা স্মৃতিআক্রান্ত হওয়া ঠিকাছে, কিন্তু ত্রাস এর ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারি নি হাসি

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ স্নিগ্ধাজী।
আরে, এরকম একজন টাইম ট্রাভেলার রাতবিরেতে হঠাৎ আমার চিলেকোঠায় উঠে এলে অবস্থাটা কী হবে? ভয়ে ত্রাসে একেবারে ফ্যাকাশে মেরে যাবো না? হয়তো চেঁচিয়ে মেচিয়ে এক কান্ড করে বসবো! বিশ্বাস ই তো করবো না কোনো কথা! হাসি
তবু তো মাইকেল তেমন কিছু করে নি, সে বরং যা হয়েছে তার সবই স্বপ্নের মত কিছু বলে মেনে নিয়েছে।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

কারুবাসনা এর ছবি

হাতি পুষা যাইতে ফারে:)


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।

তুলিরেখা এর ছবি

ফারে?
হাসি
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।