ইমা(৩)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৬/০২/২০১৫ - ৮:২৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সাঁতারখেলা খেলতে খেলতে তখন আমরা দু'জনেই নদীর বেশ গভীর অংশে। রিমা আমার সামনেই। দূরের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিন্তে এগোচ্ছে। আমি ওর একেবারে কাছে চলে যাই। তারপরে দুই হাতের দশ আঙুল বাড়িয়ে চেপে ধরতে যাই ওর গলাটা।

ডুবিয়ে দিয়ে ধরে রাখতে হবে। কতক্ষণ? ও কি ছটফট করবে খুব? নিস্তেজ হয়ে যেতে কতক্ষণ লাগবে? ও নিস্তেজ হয়ে গেলেই ওকে ছেড়ে দিয়ে সাঁতরে ফিরে যাবো তীরে। আমাকে কেউ রিমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবো আমি তো জানি না রিমা কোথায়! ---মুহূর্তের ভগ্নাংশের ভিতরে এইসব চিন্তা মাথায় খেলে গেল আমার। এতকাল পরে এখন ভাবলে শিউরে উঠি।

আমার হাত রিমার গলা অবধি পৌঁছনোর আগেই হঠাৎ একটা বাধা। স্পষ্ট শুনলাম একটা জোরালো "না !!! " ঠাকুমার কন্ঠস্বর। বহুকালমৃতা ঠাকুমার গলা সত্যি সেদিন শুনেছিলাম বলেই মনে হয়েছিল, হয়তো আমার অবচেতনে সঞ্চিত ছিল সেই কন্ঠস্বর। কিন্তু এখনো মনে আছে কানে ধাক্কা মেরেছিল যেন সেই "না!" তীব্র একটা রাগ আর দুঃখ ছিল সেই নিষেধাজ্ঞায়।

সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো, কী করতে যাচ্ছিলাম আমি? মনে হলো আমারই গলা কেউ দুই হাতের দশ আঙুলে চেপে ধরেছে, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কোনোরকমে সাঁতার কেটে পাড়ে ফিরে লুটিয়ে পড়লাম পাথুরে ডাঙায়। ঠান্ডা, খুব ঠান্ডা লাগছিল। তারপরে আর কিছু মনে নেই।

যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমি বিছানায়, তিন স্তর কম্বলের নিচে। প্রচন্ড জ্বর।

জ্বরের ঘোরে দেখছিলাম নানা চেনা অচেনা মুখ। কখনো মায়ের মুখ ঝুঁকে পড়ে, কখনো দেখি রিমার মুখ। কখনো একজন গম্ভীর প্রৌঢ় মানুষের মুখ, পরে শুনেছিলাম তিনি ডাক্তার।

সময়ের কোনো বোধ ছিল না আমার, কেমন করে নির্ধারিত সময়ের আগেই সবাই মিলে ফিরে এলাম, ফিরে এসে আবার ভর্তি রইলাম হসপিটালে-এই পুরোটাই আমার কাছে ঘোরের মধ্যে দেখা দৃশ্যের মতন। বাস্তব কল্পনা সবই জট পাকিয়ে থাকতো সেই সময়।

ভালো হয়ে উঠে সব শুনেছিলাম বাড়ীর লোকেদের কাছে। রিমা নাকি নদী থেকে উঠে আমাকে পাড়ে পড়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে যায়। দৌড়ে গিয়ে বড়দের ডেকে আনে।

বড়রা এসে আমাকে হোটেলে নেবার ব্যবস্থা করে, তখনই নাকি খুব জ্বর ছিল। স্থানীয় ডাক্তারকে দেখানো হয়, তিনিই বলেন যেন দ্রুত শহরে ফিরে হসপিটালে ভর্তি করা হয়, জ্বর জটিল দিকে মোড় নিচ্ছিল নাকি।

হসপিটাল থেকে বাড়ী ফিরেও পুরোপুরি সেরে উঠতে কিছুদিন সময় লেগেছিল। দুর্বলতা আর অল্প অল্প জ্বর নিয়ে রোগশয্যায় শুয়ে থাকতাম সারাদিন। শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে দেখতাম আকাশ, দূরের মাঠের উপরে পড়ে থাকা একটা সরু পায়ে চলা পথ, এদিক ওদিক গাছপালা ঝোপঝাড়। মাঠে গরু ছাগল চরে বেড়াতো, মাঠের ওপার থেকে লোকেরা পায়ে চলা পথে ফিরে আসতো বা এদিক থেকে মাঠ পার হয়ে ঐদিকে যেত। অত কাছেই সব চেনা জিনিসগুলো ছিল, কিন্তু ঐভাবে তো দেখিনি আগে। সবসময়ই তো দৌড়ে দৌড়ে হয় স্কুলে যেতাম নয় খেলতাম নয় দুরন্তপনা করে বেড়াতাম। চুপ করে শুয়েবসে প্রকৃতিকে দেখা বোধহয় প্রথম সেই সময়েই, সেই অসুখ থেকে সেরে ওঠার ঐ কিছুদিন। মনে হয় সেই সময়টাই ছিল আমার বড় হয়ে ওঠার প্রথম মুহূর্তগুলো।

কোনো কোনোদিন রিমা চুপ করে বসে থাকতো আমার বিছানার পাশে। কোনো কথা হতো না আমাদের মধ্যে। আমি কখনো চোখ বুজে কখনো চোখ খুলে শুয়ে থাকতাম। মাঝে মাঝে দেখতাম রিমার মুখে কেমন অদ্ভুত করুণ একটা ভাব, কখনো ওর চোখে জল দেখতাম। ঐ দুর্বলতার মধ্যেও মাঝে মাঝে একটা ভয় ফিরে আসতো, রিমা কিছু বুঝতে পারে নি তো?

আর মাঝে মাঝে তীব্র একটা আতঙ্কের ঝটকা আসতো, মনে হতো যা করতে যাচ্ছিলাম তা যদি করে ফেলতাম তাহলে কী সর্বনাশই না হতো! আবার সেই আতঙ্কের আগুন ঘিরে ঘন বৃষ্টিধারার মতন নেমে আসতো অসহায় দুঃখ, মনে হতো ভালো হয়ে উঠলেই তো আবার শুরু হবে বাবামায়ের সেই কঠোর শাসন যা আসলে ওদের বিরক্তিরই প্রকাশ। আমি তো আসলে ওদের ঘাড়ের বোঝা যার থেকে উদ্ধার পেতে ওদের দমছুট অবস্থা হবে।

মাঝে মাঝে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখতাম। যেন বিপুল এক অন্ধকার আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরেছে, চারিদিকে কালো জল ছলছল করছে। ওর মধ্য দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে বেরিয়ে আসতে চাইছি আলোয়। কিন্তু কোথায় আলো? বিপুল অন্ধকার কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে? সুড়ঙ্গের শেষ কোথায়? কোথায় ঝিকমিক করছে জোরালো আলো? আমি প্রাণপণে সাঁতরাই, ডাইনে বাধা বাঁয়ে বাধা, ঠোক্কর খেতে খেতে এগিয়ে যেতে থাকি প্যাঁচালো সর্পিল পথ ধরে। ঠিক দিকে যাচ্ছি কি? কেজানে!

ঘুম ভেঙে যেত, উঠে দেখতাম ঘামে ভিজে গিয়েছে সারা গা। বারে বারে ফিরে ফিরে আসতো স্বপ্নটা।

আরো একটা স্বপ্ন দেখতাম মাঝে মাঝে। দেখতাম, হামাগুঁড়ি দিয়ে অন্ধকার গুহা থেকে বার হচ্ছি। বাইরে এসে দেখতাম উপরে আকাশ আর পায়ের নিচে পাহাড়ের পাথুরে গা। পাহাড় বেয়ে বেয়ে নেমে আসতাম, এখানে ওখানে পাথরের খাঁজে পা রেখে, এখানে ওখানে গাছ গাছড়া আঁকড়ে বা শক্ত লতা ধরে ধরে। পথ তো নেই সেই পাহাড়ে।

নামতে নামতে নীল সমুদ্রের কথা মনে পড়তো, অনেকদিন আগে যখন বেড়াতে গিয়েছিলাম সমুদ্রতীরের এক শহরে, সেই সমুদ্রের কথা মনে পড়তো। মনে পড়তো ফেনামাখা বালির উপরে ঝাঁক ঝাঁক সীগাল আর তাদের অদ্ভুত সুন্দর ডাক। পাহাড় বেয়ে নামতে নামতে হাঁপ ধরে যেত। একসময়ে গড়িয়ে পড়তে থাকতাম। সব অন্ধকার হয়ে যেত।

তারপরে চোখ খুলে দেখতাম পৌঁছেছি একটা বিরাট গাছের পাশে। কাছেই অজস্র লতাপাতা ঝোপঝাড়। নীল ফুলওয়ালা একটা লতা দুলছে হাওয়ায়। আশ্চর্য সুগন্ধে ভরে আছে বাতাস।

এইখানে এসে স্বপ্ন থেমে যেত, ঘুম ভেঙে উঠে বসতাম।

( চলছে )


মন্তব্য

মজিবুর রহমান এর ছবি

চলছে, চলুক চলুক

মজিবুর রহমান

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক চলুক পরের পর্বের প্রতীক্ষায়

মহাবিশ্বের পরিব্রাজক

অতিথি লেখক এর ছবি

ইমা'র সঙ্গে আছি।

স্বয়ম

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

দেবদ্যুতি

অতিথি লেখক এর ছবি

"গোধূলি লগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা।
ইমার যা কথা ছিল হয়ে যাচ্ছে সারা।।"

দারুনভাবে এগুচ্ছে! আমরা আছি অপেক্ষায় ।

-----------
রাধাকান্ত

এক লহমা এর ছবি

চলুক
চলছে, চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

পরের টার অপেক্ষায় আছি। কখন আসছে?
------------
রাধাকান্ত

তুলিরেখা এর ছবি

মাফ চাই। লিখতে পারছি না। সবরকম লেখালিখি ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। লিখে কী হবে?

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক এর ছবি

ধূর! এ কথা বলে না!
আমি সবসময় রবিকে আশ্রয় করে থাকি আর যখন হতাশ হই তখন রবির গান আমার শক্তি হয় । তাই দুটা লাইন বলি:-

"নিখিল ভুবনে তব যারা আত্মহারা
আধারের আবরনে খোজে ধ্রুবতারা,
তাহাদের দৃষ্টি আনো রুপের জগতে--
আলোকের পথে।।"

তুলিরেখা, থেমে যাওয়ার কথাও ভাববেন না । আমরা যদি হাতে হাত ধরে চলি তাহলে কার সাধ্য আমাদের আটকায় ।
মনে রাখবেন চক্রব্যুহ ভেদ করে আবার বের হয়ে আসতেই হবে আমাদের!

----------
রাধাকান্ত

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ রাধাকান্ত। এই গল্পটা আবার চালিয়ে যাওয়া শুরু করবো ভাবছি। মাঝে বেশ কিছুদিনের ছেদ পড়ে গিয়ে মুশকিল হয়েছে, তবু দেখি কবে আবার নতুন কিস্তি দিতে পারি।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।