আমি তাজ্জব বনে যাই

ঈয়াসীন এর ছবি
লিখেছেন ঈয়াসীন [অতিথি] (তারিখ: শনি, ২৩/০৩/২০১৩ - ১০:৫৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এমন উত্তাল মহালগ্নে দেশে ১৮ দিনের সফরে কি দেখলাম, তা নিয়ে কিছু লিখবো ভাবছিলাম; তার চেয়ে দেশ থেকে ফিরে এখানে যা দেখলাম সে প্রসঙ্গটিই আগে টানি। ফিনল্যান্ডে বসবাসরত বাঙ্গালীর সঠিক সংখ্যা আমার জানা নেই। বড়জোর ৪ হাজার হবে। তার মাঝে অনেকেই রাজধানী হেলসিঙ্কি থেকে অনেক দূর দুরান্তে অধ্যয়ন কিংবা চাকুরীর নিমিত্তে বসবাস করে। রাজধানীতে প্রবাসী বাংলাদেশের বাঙ্গালীর সংখ্যা খুব সম্ভবত হাজার দুয়েক। তাতে কি! এই হাতে গোনা দু’হাজারই বহু ভাগে বিভক্ত- আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জেলা ভিত্তিক বিভিন্ন সমিতি, কয়েকটি ছাত্র সংগঠন; আর গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতন জামাত ইসলাম। অতি দুঃখজনক এবং মর্মান্তিক হলেও সত্য যে অন্যান্য ফোঁড়ার মাঝে এই বিষফোঁড়ার স্থুলতাই সর্ববৃহৎ; তার কারণ বহু অনুসন্ধানে যা পেয়েছি তা পরে কখনও ব্যাক্ত করবো। আজকের এই লেখাটির উদ্দেশ্য ভিন্ন। যখন দেশ জুড়ে জামাত-শিবিরের তাণ্ডব চলছে, যখন ধর্মকে ঢাল বানিয়ে খুনি-ধর্ষকদের বাঁচাতে তারা এবং তাদের দোসর বিএনপি মরিয়া হয়ে উঠেছে; তখন এখানকার জামাত সমর্থকেরা ঘরে বসে চুপচাপ লাঠি লজেন্স চুষবে তেমনটা ভাবা অন্যায্য।

হেলসিঙ্কির বাঙ্গালী মসজিদ কে কেন্দ্র করেই জামাত-শিবিরের চর্চা হয়, এ কথা মসজিদ কর্তৃপক্ষ এতদিন মুখে স্বীকার না করলেও তাদের কর্মকাণ্ডে তা স্পষ্ট ছিল। কিন্তু এখন আর তাদের রাখঢাকের বালাই নেই; এখন তারা সরাসরি যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির লক্ষে মিথ্যা প্রচারে নেমেছে, বিভ্রান্তি ছড়ানো জামাতের একটি পুরনো কৌশল, আর সেই কৌশলই অবলম্বন করছে এখানকার মসজিদ কর্তৃপক্ষ। প্রথমে তারা সাঈদীর মুক্তির দাবীতে লিফলেট বিতরণ করলো; করতেই পারে, কিন্তু পীড়াদায়ক বিষয়টি হচ্ছে লিফলেটের কোথাও সাঈদীকে যে যুদ্ধাপরাধের হেতুতে বিচার করা হচ্ছে সে ব্যাপারে কোনো উল্লেখ নেই। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে শুধুমাত্র কোরআন ও ইসলামের সেবা করবার অপরাধে সাঈদীকে জালিম সরকার মিথ্যা হয়রানি করছে। এমন স্পর্শকাতর বিষয়টি হেলসিঙ্কিতে অবস্থানরত অন্যান্য মুসলিম বিশ্বের জনগনের মনেও প্রশ্নের ঝড় তোলে। বিভ্রান্তি ছড়ানোই যে জামাতের সনাতন ধারা! গেল সপ্তাহে মসজিদে সাঈদী সহ অন্যান্য রাজাকারদের মুক্তির দাবীতে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং তার দিন কয় বাদে স্থানীয় সংসদ ভবনের সম্মুখে তারা ‘সেভ বাংলাদেশ’ শীর্ষক ব্যানার হাতে নাস্তিক সরকারের হাত থেকে দেশ উদ্ধারে মানব বন্ধন জাতীয় কিছু একটা হযবরল উপস্থাপন করে।

এই মসজিদ সরাসরি ‘ইস্ট লন্ডন মস্ক’ এবং ‘আই এফ ই’ (ইসলামিক ফোরাম অব ইয়োরোপ)-এর সঙ্গে সংযুক্ত; যে ‘আই এফ ই’ সংগঠন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত আছে কুখ্যাত রাজাকার চৌধুরী মইন উদ্দিন। বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত এই রাজাকার ২০১০ সাল অবধি ‘ইস্ট লন্ডন মস্ক’ কর্তৃপক্ষের সহ-সভাপতির দায়িত্বে ছিল।

হেলসিঙ্কির বাঙ্গালী মসজিদে প্রায়ই ‘ইস্ট লন্ডন মস্ক’-এর প্রতিনিধিরা এসে ধর্মীয় আলোচনা করে, সেখানে অবশ্য দোষের কিছু নেই। প্রতিটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেই চাঁদা তোলা কিংবা মুক্ত হস্তে দান করবার একটি ব্যবস্থা থাকে, এখানেও আছে। কে কত চাঁদা দেবে স্বচ্ছতার খাতিরে তা একটি খাতায় দাতা স্বহস্তে লিখে দেন। কথিত আছে হেলসিঙ্কির এই মসজিদে চাঁদার খাতায় দুটি ঘর- একটি মসজিদ তহবিলের জন্যে, অন্যটি ‘আই এফ ই’-র জন্যে। অবাক হবার কি আছে? এই মসজিদ তো জামাত ইসলামেরই একটি অঙ্গসংগঠন!

আমি তাজ্জব বনে যাই তখন, যখন এত কিছু জানবার পরও সেখানে সর্বসাধারণ বাঙ্গালীদের সমাগম ঘটে, জুম্মা কিংবা ঈদের নামাজে যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসুল্লিদের সমাবেশ সেখানে ঘটে তাদের সবাই জামাত সমর্থক নয়, সেখানে যেসব বাঙ্গালীরা আখেরাতের সোয়াব কামানোর জন্যে হাজার হাজার ইয়োরো চাঁদা দেয় তারা অনেকেই জামাতিদের রাজাকার বলে গালাগাল করে, তারা আমাদেরই সঙ্গে জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানগুলোতে হাতে হাত ধরে ‘আমার সোনার বাংলা’ গান গায়, তারা আমাদেরই সঙ্গে মাঠে খেলতে যায়, দেশের ক্রান্তিলগ্নে তারা আমাদের সঙ্গেই গলাগলি ধরে কেঁদে ওঠে; তবু শুধুমাত্র ধর্মভীরুতার কারণেই তারা রাজাকার সমর্থকদের মেনে নিয়েছে। কেন? এতে করে কি জামাত সমর্থিত একটি সংগঠনকে শক্তিশালী করা হচ্ছে না? এই ধর্মভীরু মানুষগুলোকি নিজ বিবেকের দংশনে একটুও দংশিত হয় না? নামায রোজা ইবাদত-এর জন্যে নির্দিষ্ট একটি মসজিদই কেন বেছে নিতে হবে? অন্য মসজিদে গিয়ে নামায পড়লে আমাদের নামায কবুল হবে না? আমি তাজ্জব বনে যাই তখন, যখন আমার মা-বোনদের ধর্ষক, আমার বাপ-ভাইদের হত্যাকারী, আমার স্বদেশের বিরোধী কোনো শক্তিকে যারা পূজা করে আর সেই মস্তিস্ক প্রক্ষালিত পূজকদের যখন একপাল নির্বোধ লোক ধর্মের খাতিরে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে গ্রহন করে নেয়। আমি তাজ্জব বনে যাই।

ঈয়াসীন

পূর্বের লেখা-
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/44448
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/46667
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/46986
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/47945
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/47976


মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

দেখিয়ে দেব এ দেশ আমার, ঘাতক রাজাকারের না।

লেখাতে গুল্লি

জামাত মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করেই চলেছে এবং চলবে, কবে যে সাধারণ বুঝতে যে এটি একটি রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় দল নয় কে জানে। মিথ্যার নহর ছোটাতে তারা যেমন ওস্তাদ তেমনি ওস্তাদ মিষ্টি কথায় আখেরা গোছানোর জন্য বিভ্রান্তি ছড়াতে।

অতিথি লেখক এর ছবি

শুধু এ দেশ কেন? সসাগরা পৃথিবীর একটি টুকরোও ঘাতক রাজাকারের জন্যে না।

সত্যপীর এর ছবি

চমৎকার লেখা।

নামায রোজা ইবাদত-এর জন্যে নির্দিষ্ট একটি মসজিদই কেন বেছে নিতে হবে? অন্য মসজিদে গিয়ে নামায পড়লে আমাদের নামায কবুল হবে না?

জামাতি নাই এরকম বাঙ্গালি মসজিদ কি আছে? আমার মনে হয় নাই।

..................................................................
#Banshibir.

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল বলেছেন।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বাঙালী মুসলমানেরা অদ্ভুত একটা জাতি। তারা জানে জামায়াত ১৯৭১ সালে যা করেছিল সেটা ইসলাম বিরোধী, তবু দাড়ি-টুপি-নামাজ-রোজা-ইসলামী বোলচালের জন্য সেই রাজাকারদের বিরোধীতা করতে তাদের বাধে। তারা যে মুখে বলে 'যুদ্ধাপরাধের বিচার চাই', সেই মুখেই তারা বাচ্চু রাজাকার বা দেলু রাজাকারকে 'মাওলানা' (আমার নেতা) বলে সম্বোধন করে। শাহ্‌বাগের পক্ষে যে গণজোয়ার দেখেছি সেটা অভূতপূর্ব। আবার 'নাস্তিক ইস্যু'তে শাহ্‌বাগের বিপক্ষে গালাগালি করার যে জোয়ার দেখেছি সেটাও অভূতপূর্ব। এই ক্ষেত্রে সাক্ষর-নিরক্ষর বাঙালী মুসলমানে ভেদাভেদ নেই, উভয় পক্ষ সমান অশিক্ষিত। এই পর্যন্ত আমার বলা কথাকে কারো কাছে যদি sweeping comment বলে মনে হয় তবে তাকে বলবো বাংলাদেশে তৃণমূল পর্যায়ের বাঙালী মুসলমানের সাথে কথা বলুন, কাজ করুন তাহলে এই অসহনীয় সত্যটা টের পাবেন। বিভিন্ন ঘটনার ব্যাখ্যায় তাদের পরস্পর বিরোধী অবস্থান খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। এ'সব কারণে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে আমার কাছে বাঙালীর ইতিহাসের সবচে' আশ্চর্যজনক ঘটনা বলে মনে হয়। ইতিহাসে এর আগে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি, অদূর ভবিষ্যতে ঘটবে বলেও মনে হয় না।

জামায়াত এখন অতীতের যে কোন সময়ের চাইতে অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী। এরা জনগণের পার্টি না, সুতরাং ভোটে জিতে ক্ষমতায় যাবার স্বপ্ন তারা দেখে না। তারা অন্য কায়দায় ক্ষমতায় যাবে। ২০২৩ সালের দিকে এককভাবে বাংলাদেশের ক্ষমতায় বসার তাদের একটা পরিকল্পনার কথা শুনেছিলাম। এখন সেটাকে খুব অসম্ভব বলে মনে হয় না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রংতুলি এর ছবি

আমি তাজ্জব বনে যাই তখন, যখন আমার মা-বোনদের ধর্ষক, আমার বাপ-ভাইদের হত্যাকারী, আমার স্বদেশের বিরোধী কোনো শক্তিকে যারা পূজা করে আর সেই মস্তিস্ক প্রক্ষালিত পূজকদের যখন একপাল নির্বোধ লোক ধর্মের খাতিরে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে গ্রহন করে নেয়।

চলুক

স্বদেশ-বিরোধী শক্তির ক্ষমতা ও বিস্তৃতি দেখে, আর ধর্মভীরুদের নির্বুদ্ধিতা দেখে আসলেই তাজ্জব বনে যাই! রেগে টং

মাহবুব লীলেন এর ছবি

মাস ছয়েক আগে হেলসিংকিতে মাত্র দিন পাঁচেক ঢু মারার সময় তারেক অণুর কাছে জেনেছিলাম এই অস্বস্তিকর বিষয়টার কথা

মসজিদকে কেন্দ্র করে জামাতের সংগঠন সব জায়গাতেই তলে তলে ঘটে; যেখানে অন্যরা সংগঠিত হবার বিষযে প্রায় অপারগ

এর একটাই কারণ হতে পারে; তা হলো পুরোনো এই মসজিত প্রতিষ্ঠানটির বিপরীতে অন্য কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠান তৈরি হতে না পারা (মনে হয় না এটা খুব একটা সহজ কাজ)

০২

তাজ্জব বহু জায়গাতেই বনতে হয়। আরো বেশি তাজ্জব হতে হয় যখন আমাদেরই পাশের কেউ গিয়ে ওই দলে ভীড়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।