২৯ ডিসেম্বর- গণতন্ত্রের অভিযাত্রা

ঈয়াসীন এর ছবি
লিখেছেন ঈয়াসীন [অতিথি] (তারিখ: সোম, ৩০/১২/২০১৩ - ২:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজ একঝাক সুশীল গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হওয়াতে মুখে ফেনা তুলতে ব্যস্ত। মানবাধিকার কর্মীরা রিপোর্ট লিখতে লিখতে কলম ভাংছে শত শত। দেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী একটি রাজনৈতিক দলকে তার আন্দোলনের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বঞ্চিত করা হয়েছে তার সহিংস কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতাকে। বাসের ভেতর গন্তব্যগামী মানুষ পুড়ুক, বাসটি পুড়ুক, রাস্তার উপর কর্তিত গাছেরা কাঁদুক, ট্রেন পুড়ুক, মনির নাহিদ সিদ্ধার্থদের মনুষ্যমেদ যজ্ঞে বিকষিত হোক শুদ্ধ গণতন্ত্র।

সুশীলের গাল আজ অকাট্য যুক্তিতে ভরা। অনৈতিক একপেশে নির্বাচন, মানবতাবিরোধী বিচারের নামে প্রহসন, ফ্যাসিজম, দমন পীড়ন গ্রেফতার, সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা হরণ, প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সুশীলেরা আজ সোচ্চার। হোক সে নির্বাচন সংবিধান সম্মত, হোক সেই বিচার মানবতার ইতিহাসের জঘন্যতম অপরাধে অপরাধী রাজাকারের, তবু দুষ্টের মানবাধিকার যেন ক্ষুণ্ণ না হয়। বাবা আওয়ামীলীগ সমর্থক হবার দায়ে সাতক্ষীরার নয় বছরের বালকটি শিবিরের ষণ্ডাদের হাতে প্রাণ দেয় দিক, নিরীহ পথচারী আর কর্তব্যরত পুলিশেরা পুড়ে যতই কয়লা হোক, তবু আমাদের মা-বোনের ধর্ষকেরা মুক্তি পাক, আমাদের বাপ-ভাইয়ের খুনিরা মুক্তি পাক, তাদের বিচার স্বচ্ছ হোক, তারা রিভিউ করবার সুযোগটি অন্তত পাক; মানবাধিকার শিশ্নের মত ক্ষেত্রবিশেষে হ্রেষা ধ্বনি সমেত সরব হয়ে উঠুক।

আমরা ভাই ডাল-ভাত খাওয়া বকলম বাঙ্গালী, সুশীলের মত যুক্তির ফুলঝুরি ফোটাতে পারি না। আর যুক্তি! লক্ষ লক্ষ মানুষকে ঠাণ্ডা মস্তিস্কে চুল্লিতে পুরে পুড়িয়ে মারবার ক্ষেত্রে হিটলারেরও নিজস্ব যুক্তি ছিল, ত্রিশ লক্ষ বাঙ্গালী নিধনে পাকিস্তান সরকারের রাজনৈতিক যুক্তি ছিল, যুক্তি ছিল গনিমতের মাল আখ্যা দিয়ে দুই লক্ষাধিক বাঙ্গালী নারীকে ধর্ষণ করবার, যুক্তি আছে জর্জ বুশের, যুক্তি ছিল লাদেনের, যুক্তি আছে তালেবানের, যুক্তি সর্বদাই সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান; যার যার আপন আদর্শের ভিত্তিতে রচিত হয় যুক্তি, তবে সব যুক্তিতে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় না।

তাই, আজকের দিনটিও ব্যক্তিভিন্নে ভিন্ন হওয়া অবান্তর নয়। যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করণার্থে শেষ প্রচেষ্টায় আজকে যাদের বাড়া ভাতে ছাই পড়েছে তাদের কাছে আজকের পরাজয় একরকম, অন্যদিকে প্রশাসন ও দলীয় কর্মী সমন্বয়ে রাজপথ ও ক্ষমতা দখলে রাখবার বিজয়টি একটি দলের কাছে অন্যরকম।
আমাদের কাছে কিরকম? কমলাপুর রেলস্টেশনের নিরাপত্তা প্রহরী আবুল কাশেম, বয়েস ত্রিশের এদিক ওদিক। আজ বেলা আড়াইটার দিকে কর্তব্যপালনকালে সন্দেহভাজন দুই যুবককে দাঁড় করিয়ে সে জানতে চায় তাদের ব্যাগের ভেতর কি আছে। ধরা পড়া যুবকেরা দৌড়ে পালানোর আগে আবুল কাশেমের মুখে বোমা মেরে জানিয়ে যায় ব্যাগের ভেতর কি ছিল। আবুল কাশেম অবহেলা করে যদি তাদের না আটকাতো, তবে হয়তো আজ উড়ে যেত কোনো একটি ট্রেনের কোনো একটি বগি, হয়তো নিহত হত আরো অনেকে। পত্রিকাগুলো খবর প্রকাশ করছে বিভিন্ন ভাবে- আবুল কাশেমের বীরত্বে কি করে নাশকতা ভেস্তে গেল, কি করে আত্মত্যাগের মাধ্যমে আবুল কাশেম বৃহত্তর ক্ষতি থেকে আমাদের বাঁচালো, ইত্যাদি। ঐ যে বলেছিলাম আমরা ভেতো আর অল্পজ্ঞানী বাঙ্গালী, অত তত্ব কথা বুঝি না; আমরা শুধু বুঝি আবুল কাশেম চোখে আঙ্গুল দিয়ে সুশীলগুলোর কানে ধরে দেখিয়ে দিয়ে গেল তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিকল্পনা কতটা অহিংস ছিল!

এবার আসি একটি ভিন্ন বিষয়ে; আজকে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অনেকগুলো পীড়াদায়ক ঘটনার মাঝে বিশেষ তিনটি হচ্ছে :

- আদালত প্রাঙ্গনে বিরোধী দল সমর্থনকারী মহিলা আইনজীবীর উপর সরকারী সমর্থনকারী কিছু নপুংসকের হামলা। হামলাকারীরা আসলেই ছাত্রলীগের কর্মী নাকি ভাড়া করা পিকেটার, তাতে কিচ্ছু আসে যায় না। এ দায় সরকারের। আইনজীবীরা কতটা উত্যক্ত করায় ছাত্রলীগ বাধ্য হয়েছে হামলা করতে, সেটিও এক্ষেত্রে কোনো বিচার্য বিষয় নয়। একজন মহিলাকে রাস্তায় ফেলে পিটানো হয়েছে; না, এতে কোনোভাবেই শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাবে না। হেফাজতের সমাবেশে মহিলা সাংবাদিক লাঞ্ছনার কথা উল্লেখ করেও আজকের এই অপরাধকে কখনই উপেক্ষা করা যাবে না।

- গণমাধ্যমের সম্মুখে সাংবাদিক ও প্রশাসনের সমাবেশে বক্তব্য প্রদানকালে একজন মহিলা নিরাপত্তা কর্মীকে বিরোধীদলীয় নেত্রীর ‘বেয়াদব’ বলে সম্বোধন এবং যাচ্ছেতাই ব্যবহার। তার জন্মস্থান সম্পর্কে জানতে চাওয়া আর ক্ষমতায় গেলে পরে প্রতিহিংসাস্বরূপ সেই স্থানের নাম পাল্টে দেবার হুমকি প্রদান এবং স্পর্ধা দেখানো। সেখানে অনেক পুরুষ পুলিশও উপস্থিত ছিল, তাদের উদ্দেশ্যে মাননীয় নেত্রীর ব্যবহার মোটেও অশালীন ছিল না। অপমানিত ঐ নারী নিরাপত্তা কর্মীটি হয়তো ভবিষ্যতের আশংকায় আর বাদানুবাদে জড়ায়নি।

- রাজশাহীর ভাটপাড়ায় ২৫ বছর বয়েসী রুবেল হোসেনকে বিয়ে করবার অপরাধে ৪০ বছর বয়েসী নিলুফা বেগমকে তার স্বামীসহ বেদম পিটিয়ে অতঃপর জুতোর মালা পড়িয়ে সমস্ত এলাকায় ঘুরানো। অসম বয়েসী বিবাহ ধর্মীয়, সামাজিক এবং আইনগত কোনো দিক থেকেই নিষিদ্ধ নয়। তবুও ওয়ার্ড কাউন্সিলর-এর উপস্থিতিতে এই লজ্জাজনক ঘটনাটি ঘটে। ধুলোয় মিশে যায় সভ্যতা।

না, কোনটিই কোনোটির সম্পূরক নয়। তিনটি ঘটনার আপেক্ষিকতা সম পর্যায়েরও নয়। তবে একটি বিষয়ে কোথায় যেন মিল খুঁজে পাই; সেটি হল আবহমান কাল থেকে এই বাংলায়, এই পৃথিবীতে ঘটে আসা নারী জাতির প্রতি অবহেলা, নারীর প্রতি বল প্রদর্শনের হীন মন মানসিকতা। সমাজে সংসারে যে জাতটির থেকে আমরা সবচেয়ে বেশী স্নেহ, মমতা, ভালবাসা পেয়ে থাকি সেই তাদের প্রতিই আমাদের রুঢ়তা সবচেয়ে বেশী। আমাদের মা, আমাদের বোন, আমাদের স্ত্রী, আমাদের কন্যারা যখন লাঞ্ছিত হয় তখন সে দায় কেবল লাঞ্ছনাকারীর প’রেই বর্তায় না, আমাদের সকলকে লজ্জায় ন্যুজ করে দেয়।

- আমি চাই আদালত প্রাঙ্গনের ঐ নপুংসক ছাত্রলীগের ছেলেগুলো অচিরেই গ্রেফতার হোক,
- আমি চাই ভাটপাড়ার ঐ অসভ্য মানুষগুলো গ্রেফতার হোক
- এবং আমি চাই মানহানি মামলা ঠুকে দেয়া হোক বিরোধীদলীয় নেত্রীর নামে।

সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।

সমালোচকেরা বলতে পারেন- আরে ভাই, নারীদের এত জয়গান গাচ্ছেন, কিন্তু ঐ বিরোধী দলীয় নেত্রীওতো একজন নারী। নারী অত্যাচারে পুরুষের পাল্লায় তাকেও কেন ওজন দিচ্ছেন?

- পাপ যে, শয়তান যে, নর নহে নারী নহে,
ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ধারালো লেখা। হাততালি

শব্দ পথিক এর ছবি

পাপ যে, শয়তান যে, নর নহে নারী নহে,
ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।

চলুক

----------------------------------------------------------------
''বিদ্রোহ দেখ নি তুমি? রক্তে কিছু পাও নি শেখার?
কত না শতাব্দী, যুগ থেকে তুমি আজো আছ দাস,
প্রত্যেক লেখায় শুনি কেবল তোমার দীর্ঘশ্বাস!''-সুকান্ত ভট্টাচার্য

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

গুরু গুরু উত্তম জাঝা!

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

একজন মহিলাকে রাস্তায় ফেলে পিটানো হয়েছে; না, এতে কোনোভাবেই শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাবে না। হেফাজতের সমাবেশে মহিলা সাংবাদিক লাঞ্ছনার কথা উল্লেখ করেও আজকের এই অপরাধকে কখনই উপেক্ষা করা যাবে না।

সে 'মহিলা' হওয়ার জন্য তাকে পিটানো হয় নি; রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য পিটানো হয়েছে। অন্যদিকে হেফাযতের সমাবেশে 'মহিলা সাংবাদিক'কে পেটানো হয়েছিলো সে 'মহিলা' হওয়ার কারণে, তার সাংবাদিক পরিচয়ের কারণে না। পার্থক্যটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

এই পেটানোটা অপরাধ হলে সেটা লৈঙ্গিক পরিচয়নির্বিশেষেই 'সমান' অপরাধ।

এই অংশটুকুকে আরোপিত ব্যালেন্সিং মনে হয়েছে। বাকিটা ধারালো। শেয়ার দিলাম।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

এক লহমা এর ছবি

অত্যন্ত সময়োপযোগী, ধারালো লেখা। চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারন। চলুক

মাসুদ সজীব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।