বেগুনটিলার পানি ও ওয়াসা-র বিবেক

??? এর ছবি
লিখেছেন ??? (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৮/১১/২০০৭ - ১২:৪১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto
১৩ অক্টোবর ২০০৫ ঢাকার পল্লবী থানাস্থিত বেগুনটিলা বস্তিতে পানির সন্ধানে ১৫০ ফুট গভীর একটা কুয়ায় নামার ফলে দু'জন বস্তিবাসীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। যে দেশে বেশিরভাগ মৃত্যুই অপঘাতে মৃত্যু, সে দেশে মাত্র দুইজন গরিব মানুষের মৃত্যুর ঘটনা এমনকি পত্রিকার পাতায়ও দুইবার মুদ্রিত হবার ধৃষ্টতা রাখে না। কিন্তু, বেগুনটিলার সাথে ব্যক্তিগত সংশ্লিষ্টতার কারণে এই সামান্য মৃত্যুকে কার্যকারণসমেত পাঠ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। সে বিষয়টিই সংক্ষেপে বলছি।

ইংলন্ডের সাদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা প্রকল্পের কাজে আমি ২০০৩ সালে বেগুনটিলা যাই। মিরপুর-১২ থেকে দশমিনিটের রিকশাপথ। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে একটা বিশাল শূন্য ল্যান্ডস্কেপ, ঠিক মাঝখানে এই বস্তি। একপাশে মিরপুর মেইনল্যান্ড, দূরে অন্যপাশে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা। মাঝখানের এই জায়গাটুকু কোনো এক আবাসন প্রকল্প ঢাকাই মধ্যবিত্তের জন্য ভরাট করে ফেলেছে ইতোমধ্যে, কিন্তু আইনী জটিলতায় নির্মাণকাজ শুরু হয় নি।

জায়গাটার স্থানীয় নাম "কালাপানি"। নামকরণের ইতিহাসটাও মজার। ১৯৯৭ সালে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ১০/১২ টা উচ্ছেদকৃত বস্তির অধিবাসীরা তাদের পুনর্বাসনের দাবিতে হাইকোর্টের সামনে অবস্থান গ্রহণ করলে হাইকোর্ট তাদের অস্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য এই স্থানটিকে নির্বাচন করে। ট্রাকে করে লোকজনকে এখানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। গোটা এলাকাটা ছিল জলাভূমি, মাঝখানে প্রায় ডুবু-ডুবু একটা টিলা, জংলা আগাছা আর সাপখোপে ভরা। মিরপুর থেকে তখন নৌকা দিয়ে এসে এখানে পৌঁছায় ঐ ভাগ্যাহত মানুষেরা। সেই থেকে এই জায়গার নাম তারাই দিয়েছে "কালাপানি", যেটা হয়ত তাদের এই সফরেরও নাম। মূল ঢাকা থেকে টেনে হিঁচড়ে এনে এমন একটা জলাভূমিতে ফেলে রেখে যাওয়ার এই প্রক্রিয়া তাদের হয়ত মনে করিয়ে দেয় বৃটিশ শাসনামলের দ্বীপান্তরের কথা। অবধারিত ভাগ্যের সাথে গরিব মানুষের একটু মশকরা আর কি!

আমাদের গবেষণাটি ছিল গরিব মানুষের স্যানিটেশন-অভ্যাসের জেন্ডার প্যাটার্ণ বিষয়ে। সাদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পই পই করে বলে দিয়েছে যাতে স্যানিটেশন-গবেষণা কোনোভাবেই পানি-গবেষণা না হয়ে যায়। ভারতে তারা এমনটা হতে দেখেছে, কেনিয়ায়ও দেখেছে। এটা তাদের কাম্য নয়, পানি-গবেষণার "দাপট" থেকে স্যানিটেশন-গবেষণাকে আলাদা করতে চান তারা। গরিব মানুষেরা পানি ছাড়া স্যানিটেশন করতে পারুক কি না-পারুক সেটা ধর্তব্য নয়!

অথচ সেটাই দেখলাম আমি। পুরো বস্তিতে সারাক্ষণই পানির জন্য হাহাকার। টিউবওয়েলগুলো সবই নষ্ট, যেহেতু পানির লেয়ার অনেক নিচে। একটামাত্র ওয়াসার লাইন আছে যেটা "অবৈধ", সেখানে পানি আসে খুবই অল্পসময়ের জন্য, রাত আড়াইটা থেকে ভোর চারটার মধ্যে কোনো এক সময়ে। ফলে, নগরবাসী যখন তাদের সবচেয়ে নিচ্ছিদ্র ঘুমটুকু ঘুমিয়ে নিচ্ছে, তখন বেগুনটিলা বস্তিতে অন্য দৃশ্য। ওয়াসার ঐ লাইনটির সামনে সার বেঁধে কলসি, ডেকচি ইত্যাদি রাখা। গানে আর আলাপে সময় পার করছে বেগুনটিলাবাসী। এদিকে আবার মশার প্রচন্ড উত্ পাত। কখন যে পানি আসে! পানি ঘরে তুলে তারপর ঘুমাতে যাবে তারা।

auto
(মসজিদের অজুখানার ট্যাপ, পেছনে পানিহীন বেগুনটিলা)




বস্তির অনতিদূরে একটা মসজিদ আছে, ওয়াসা সেখানে অকৃপণ। অজুখানার ট্যাপ দিয়ে অবিরত পানি ঝরছে। কিন্তু যতই ঝরুক, এখান থেকে একফোঁটা পানিও নিতে পারে না প্রতিবেশী বস্তির মানুষেরা। ছোট শিশুরা অনেক সময় খেলতে খেলতে গলা শুকিয়ে গেলে মসজিদের ট্যাপে মুখ লাগায়। অতি গোপনে। ইমাম সাহেব দেখলে রক্ষা নাই।

মসজিদের পাশ দিয়েই হাঁটাপথ। সেই পথ দিয়ে বস্তির মহিলারা কলসিভরা পানি নিয়ে আসে মিরপুর মেইনল্যান্ড থেকে। মাগনা নয়, প্রতি কলসি দুই টাকা দরে। তারপর কাঁখে ভরা-কলসি আর ঘাড়ে দুধের বাচ্চা নিয়ে পৌনে এক মাইলের হাঁটাপথ। গনগনে দুপুর রৌদ্রে। কারণ, বেলা পড়ে এলে জায়গায় জায়গায় আবার যৌন হয়রানির ভয়।

ভোরবেলার দৃশ্য আরো ভয়াবহ। নগরবাসী তখনও আড়মোড়া ভাঙ্গে নি, কিন্তু বেগুনটিলা সচল হয়ে ওঠে। বস্তির চার কোনায় চারটা বাথরুম-কমপ্লেক্স আছে, প্রতিটাতে দুটা করে টয়লেট। সর্বমোট আটটা টয়লেট, চার হাজার মানুষের জন্য। এদের মধ্যে সাত-আটশ' মানুষের দিনের কাজ শুরু হয় অতি প্রত্যুষে। ফলে টয়লেটের সামনে লম্বা লাইন। কোনো কারণে, টয়লেটবাসীর স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে একটু বেশি সময় লেগে গেলে বিড়ম্বনার সীমা নাই। শাপশাপান্ত মাথায় নিয়ে টয়লেট ছাড়তে হয় তাকে, কখনো কখনো তুমুল ঝগড়াও হয়ে যায়। সরকারের ঘোষণার কথা মনে পড়ে, ২০০৮ সালের মধ্যে সবার জন্য স্যানিটেশন!

বস্তিতে গিয়ে লোকজনের আগ্রহ এবং কথাবার্তা শূনে বুঝলাম তারা ভাবছেন, এই গবেষণার ফলে তাদের পানিসমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কেউ কেউ আমাকে জিজ্ঞেসও করেছেন। আমি তখন উন্নয়ন-নীতিবিদ্যার ছাত্র, ঘাড় গোঁজ করে "না" বলেছি। বলেছি, এই কাজ আপনাদের নয়, বড়জোর আমাদের ভাগ্য বদল করতে পারে। আপনাদের কিছুই হবে না। অন্ধ একজন মানুষ ছিলেন, নাম কুদ্দুস। তিনি বললেন, ঠিক আছে ভাই। আপনের ভাগ্য বদলাইলেও আমাগো লাভ। কেমনে? ঐ যে, রিকশাঅলারে দশটাকার ভাড়া পাঁচ টাকা দিবেন না! স্পিলঅভার ইফেক্ট!

একসময় আমার খুব পীড়ন হতে লাগল। আমি ও আমার মুখ্য গবেষক মিলে সাদাম্পটনকে বললাম, দেখো, স্যানিটেশন থেকে পানিকে আলাদা করা আমাদের এখানে রীতিমত অবাস্তব। বেগুনটিলার লোকজন আমাকে নির্দ্বিধায় বলেছে, পানি নাই, আমাদের আবার স্যানিটেশন কি? একজন তো আরো এগিয়ে এসে বলে দিয়েছে, আগে পানি দেন, আমরাই আপনেগো স্যানিটেশন শিখায়া দিমু। ইত্যাদি ইত্যাদি।

একদিন তারা আমাকে একটা দরখাস্ত দেখাল। ঐ দরখাস্তে মাননীয় মেয়র বরাবর পানির জন্য আবেদন করা হয়েছে। সবাই দারুণ আশাবাদী, দরখাস্তের ওপর রীতিমত হামলে-পড়া অবস্থা । দরখাস্তের ওপর এমপি রিকমেন্ড করেছেন। ফলে অচিরেই তাদের পানির সমস্যা আর থাকছে না। বস্তির প্রতিটি মানুষের মুখে একই আলাপ। ২০০৩ সালের অক্টোবর মাসের-ই কোনো একদিন, ঠিক দুইবছর আগে। বেগুনটিলা বস্তিতে আমার গবেষণার শেষ দিন ছিল সেটা। প্রীতিকর একটা অনুভূতিসহ ফিরে এসেছিলাম, মনে পড়ে।

আজকের এই দুর্ঘটনায় বোঝা গেল, তাদের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছিল। জানি না, মেয়র পর্যন্ত তাদের দরখাস্ত পৌঁছেছিল কি না? ভাগ্যবদলের জন্য শহরে আসেন তারা, এসে বিত্তবানদের জীবনকে সহজতর করেন, কিন্তু নিজেদের জীবনের ভার দুর্বহই থেকে যায়। এইসব মানুষের শ্রমের খুব স্বীকৃতি আছে, কিন্তু অধিকারের একদম নাই। তাই নিজেরা-নিজেরা মিলে টিউবওয়েল বসিয়ে কুয়া খুঁড়েছিলেন। ১৫০ ফুট গভীরে গিয়েও পানির নাগাল পান নি ঠিকমত। দুজন রিকশাচালক মারা গেছেন কুয়ার ভিতরে নেমে।

কী খুঁজছিলেন তারা কুয়ার ভিতরে? ওয়াসা-র বিবেক?


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

কালাপানির পাশেই ইটের ভাটা, তার সামনেই পানির একটা ট্যাঙ্কি। ওখান থেকে সাপ্লাই হয় আমাদের পানি। আর তার পাশে থেকে পানি পায় না কালাপানিবাসী। ইনফ্যাক্ট আমাদের পানি পেতে সমস্যা হত প্রায়ই।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

ভাস্কর এর ছবি

অন্ধ একজন মানুষ ছিলেন, নাম কুদ্দুস। তিনি বললেন, ঠিক আছে ভাই। আপনের ভাগ্য বদলাইলেও আমাগো লাভ। কেমনে? ঐ যে, রিকশাঅলারে দশটাকার ভাড়া পাঁচ টাকা দিবেন না! স্পিলঅভার ইফেক্ট!

এই রিয়েলাইজেশন দেখলে আসলেই তব্দা খাইতে হয়! শ্রেণী
বৈষম্যের কারনে তৈরী হওয়া দূরত্ব মানুষের উপলব্ধি অবাক করা ঢঙে পাল্টাইয়া দ্যায়!


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...

হাসিব এর ছবি

দৃষ্টিভঙ্গিটা ভাল্লাগছে ।

??? এর ছবি

একই প্রেক্ষিতে/ল্যান্ডস্কেপে একটা গল্প লিখেছিলাম। এই লেখাটা এক অর্থে ঐ গল্পের পূর্বসূরী। যদিও গল্পটার বিষয় কিছু ভিন্ন, এবং অনেক বেশি সাম্প্রতিক, তবু এই দুয়ের তুলনায় হয়ত ফ্যাক্ট আর ফিকশনের তফাত্ বিষয়ে আমার পজিশন বোঝা সম্ভব। মাহবুব মুর্শেদ, তার আশৈশব সংশ্লিষ্টতার কারণে, আমার পর্যবেক্ষণের ফাঁকফোকড়গুলো ভাল বুঝবেন হয়ত।

বাদবাকিটা, ভাস্কর আর হাসিব যেমন বলেছেন, দৃষ্টিভঙ্গির বিষয় এবং সেখানে উন্নয়ন নীতিবিদ্যার ছাত্র হয়ে আমার এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

কিন্তু বস, আমি ঢাকা প্রথম আসি আশির দশকের শেষের দিকে। তখনো কিন্তু কালাপানি নামটা শুনেছি। সসময় আমি থাকতাম সাড়ে এগাড় ঢালের নিচে একটা বাসায়। সেখান থেকে তো কালাপানি বেশী দূরে নয়। তাই বলছিলাম নামকরণের ব্যাপারটা মনে হয় অনেক আগেই হয়েছিল।

??? এর ছবি

তাই নাকি? তাহলে হয়ত আমার ডাটায় ভুল আছে। ধন্যবাদ প্রকৃতিপ্রেমিক, আমি এবার দেশে গিয়ে ভেরিফাই করে নেবো।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।