অমরতার চেয়ে সত্য

??? এর ছবি
লিখেছেন ??? (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৭/০৯/২০০৭ - ৮:৪৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তোমার অন্তর্ধান সকাল দশটার যাদুকরী রোদের ভেতর
অতএব মেনে নিই এই বিরহ মাত্র কয়েক ঘণ্টার

এটুকু সময়ের মধ্যে ঘুরে আসতে হবে অনেকগুলো উপদ্বীপ
অনেকগুলো পাহাড়ি খাড়ির তলদেশের মাটির নমুনা পাঠে
জেনে নিতে হবে কেন মহাদেশগুলো পরস্পরের কাছে ক্রমশই
অসহনীয় হয়ে উঠছে
জানতে হবে ঝাউয়ের একটিমাত্র প্রজাতিই কেন ক্রন্দনশীল!

এসব প্রশ্নের তাপমাত্রা ছিল হিমাঙ্কের অনেক নিচে, ফলত বাতাসমাত্রই শৈত্যপ্রবাহ, আমরা নৈকট্য বোধ করতাম। অর্থাৎ আমার মহিষের চামড়া-টানানো-আকাশের নিচে তোমার চকিত লাবণ্য! আমাকে জানতে হত যা কিছু ঘটেছে এবং যা কিছু ঘটে নি, তাই আমি জানতাম কার্যকারণ হচ্ছে যাবতীয় অভিজ্ঞতার প্রধান মুদ্রাদোষ। তবু যখন:

দেশান্তরী তুতসীদের দেখে তোমার কান্না পেত, আমি আশ্বাস দিতে গিয়ে
বলেছিলাম, দশ হাজার বছর আগে মহাসমুদ্রে ভেসে-বেড়ানো এক ছন্নছাড়া
মহাদেশের নাম আফ্রিকা।

বিচ্ছিন্নতাবাদ তোমার পছন্দ নয়, কিন্তু চাঁদের বিচ্ছেদ কি তোমাকে উপহার
দেয় নি একটি অতলান্তিক সমুদ্র!

তাছাড়া, অনেকবার বলেছি, তালব্য-শ’ লিখতে গিয়ে তুমি কতটা যত্নশীল,
এ থেকে বোঝা যায় তোমার যৌবন ঠিক কতখানি ফুটেছে!

আমি ভয় পাই সেসব কথা যা তোমাকে বলা হয় নি, এরা আমাকে দিয়েছে
অনিদ্রা আর আনন্দ, খুব সপ্রতিভ কোন আড্ডার মর্মমূলে এরা থেকে গেছে
পিত্তথলির পাথরের মত নীরব ও বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে...

যেমন, ধরা যাক, ভেড়াদের আমি ভালবাসি তাদের পর্যটকসুলভ পেশাদারি
নির্লিপ্তির জন্যে, এবং জেনেছি হস্তীছানার জলক্রীড়া নিজ-প্রতিবিম্ব-দর্শনে
অনীহা ছাড়া আর কিছু নয়।

এসব বিষয়ে নিশ্চিত হতে গেছি। সেখানে দেখেছি
গোলকধাঁধা তৈরি করেছে তোমার চক্ষুজোড়া
আহ্লাদী হয়ে উঠেছে তোমার স্তনবৃন্ত
তোমার কুন্তলরাশি ঝপাৎ বৃষ্টিপাতের মত
আমাকে লুকিয়ে ফেলেছে
যাবতীয় চিন্তাশীলতার কাছ থেকে

ভাবলাম, আমি বোধ হয় সূর্যকলসের ফাঁদে-পড়া দার্শনিক পতঙ্গমাত্র
জানা নেই ভূবনচিলের পা কেন খুঁজে ফেরে গগনশিরীষ শাখা
মফস্বলী কাকের কেন চাই এলুমিনিয়ামের এণ্টেনা

অনিবার্য এবং অবোধ্য, স্বাভাবিক কিন্তু গাণিতিক নয়

বরং জরুরি বেলা একটায় তোমার ফিরে আসা
মিনিট-স্থায়ী পুনর্মিলন, সমগ্র জীবনের
যৌথতার চেয়ে সত্য
অমরতার চেয়ে সত্য অমরতার দিকে যাওয়া

১৯৯৬


মন্তব্য

জিফরান খালেদ এর ছবি

এটুকু সময়ের মধ্যে ঘুরে আসতে হবে অনেকগুলো উপদ্বীপ
অনেকগুলো পাহাড়ি খাড়ির তলদেশের মাটির নমুনা পাঠে
জেনে নিতে হবে কেন মহাদেশগুলো পরস্পরের কাছে ক্রমশই
অসহনীয় হয়ে উঠছে
জানতে হবে ঝাউয়ের একটিমাত্র প্রজাতিই কেন ক্রন্দনশীল!

দেশান্তরী তুতসীদের দেখে তোমার কান্না পেত, আমি আশ্বাস দিতে গিয়ে
বলেছিলাম, দশ হাজার বছর আগে মহাসমুদ্রে ভেসে-বেড়ানো এক ছন্নছাড়া
মহাদেশের নাম আফ্রিকা।

বিচ্ছিন্নতাবাদ তোমার পছন্দ নয়, কিন্তু চাঁদের বিচ্ছেদ কি তোমাকে উপহার
দেয় নি একটি অতলান্তিক সমুদ্র!

আমি ভয় পাই সেসব কথা যা তোমাকে বলা হয় নি, এরা আমাকে দিয়েছে
অনিদ্রা আর আনন্দ, খুব সপ্রতিভ কোন আড্ডার মর্মমূলে এরা থেকে গেছে
পিত্তথলির পাথরের মত নীরব ও বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে...

অনিবার্য এবং অবোধ্য, স্বাভাবিক কিন্তু গাণিতিক নয়
বরং জরুরি বেলা একটায় তোমার ফিরে আসা
মিনিট-স্থায়ী পুনর্মিলন, সমগ্র জীবনের
যৌথতার চেয়ে সত্য
অমরতার চেয়ে সত্য অমরতার দিকে যাওয়া

ইমরুল ভাইয়ের মন্তব্যটির পর কিছু বলাটাই অর্থহীন মনে হলো বড়ো।

আমি চুপ করে থেকেই ভাবি -

কি অসাধারণ! কি অসাধারণ!

কারুবাসনা এর ছবি

হাওয়া পেলাম। বিচ্ছেদের।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।

জিফরান খালেদ এর ছবি

দু'টো এমন দুর্দান্ত কবিতা পড়ানোর জন্যে ধন্যবাদ।

??? এর ছবি

ধন্যবাদ ইমরুল, জিফরান খালেদ ও কারুবাসনা। হাসি

..............................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

ভাস্কর এর ছবি

অমরতার চেয়ে সত্য অমরতার দিকে যাওয়া

১৯৯৬

সুমন ভাই আপনেতো অমরতার দিকে চইলা যাইতেছেন মনে হয়...অমর সব লাইন...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...

??? এর ছবি

যাওয়াটাই হৈল কথা। প্রেজেন্ট কন্টিনিউয়াস টেন্স। পাস্ট পারফেক্ট হওনের চান্স নাই, ভাস্কর! হাসি

....................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

এক্কেবারে ভরাট কবিতা। ৫।
পুরোটা পড়ার পর কবির চিন্তার প্রতিধ্বনি ছাড়া নিজের কোনো ভাবনার নড়াচড়া টের পাওয়া যায় না।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

সুমন চৌধুরী এর ছবি

খাসা।



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

??? এর ছবি

"পুরোটা পড়ার পর কবির চিন্তার প্রতিধ্বনি ছাড়া নিজের কোনো ভাবনার নড়াচড়া টের পাওয়া যায় না"
এক্সপ্রেশন অব দ্য ডে! ধন্যবাদ শোমচৌ, সুচৌ!!

.......................................................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

শেখ জলিল এর ছবি

ভাল্লাগছে।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

??? এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি
....................................................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

ধ্রুব হাসান এর ছবি

“ঝাউয়ের একটিমাত্র প্রজাতিই কেন ক্রন্দনশীল!” অথবা “আমার মহিষের চামড়া-টানানো-আকাশের নিচে তোমার চকিত লাবণ্য!”...এই পর্যন্ত পাঠক হিসেবে আমি পাই, বাস্তবের উপাদানের উপর দাড়িয়ে থাকা বাস্তব-অতীত চিত্রায়িত দৃশ্যায়ন! এরপর যেন কবি নেমে আসেন আমাদের চেনা জগতের টানাপোড়নের মাঝে “আমাকে জানতে হত যা কিছু ঘটেছে এবং যা কিছু ঘটে নি, তাই আমি জানতাম কার্যকারণ হচ্ছে যাবতীয় অভিজ্ঞতার প্রধান মুদ্রাদোষ"...বুঝতে পারি কবি ইতিহাস সচেতন, এমনকি ইতিহাসের ভিন্নপাঠও যার জানা “......দশ হাজার বছর আগে মহাসমুদ্রে ভেসে-বেড়ানো এক ছন্নছাড়া মহাদেশের নাম আফ্রিকা”

তাছাড়া কবি কি ভালোবাসেন তার একাকীত্মবোধ বা নির্লিপ্ততা? এই নির্লিপ্ততা হয়তো বা তাকে কষ্ট দেয়, কিন্তু তবুও একটু বেশীক্ষন যেন থাকতে কি চান তোমাকেহীন সময়ের ভেতর (অবশ্যই তোমাকে ছাড়া নয়)“আমি ভয় পাই সেসব কথা যা তোমাকে বলা হয় নি, এরা আমাকে দিয়েছে অনিদ্রা আর আনন্দ, খুব সপ্রতিভ কোন আড্ডার মর্মমূলে এরা থেকে গেছে পিত্তথলির পাথরের মত নীরব ও বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে...” নির্লিপ্ততার উপমাটা বড় দারুন,“ যেমন, ধরা যাক, ভেড়াদের আমি ভালবাসি তাদের পর্যটকসুলভ পেশাদারি নির্লিপ্তির জন্যে, এবং জেনেছি হস্তীছানার জলক্রীড়া নিজ-প্রতিবিম্ব-দর্শনে অনীহা ছাড়া আর কিছু নয়”......যখনি এই লাইনটা পড়েছি,মনে হলো ভেড়াগুলো যেন নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে কোন এক ধূ-ধূ প্রান্তরে। তার আগের প্যারাতেই আবার কবির বুদ্ধিদীপ্ত পর্যবেক্ষণে মোহিত হই “তাছাড়া, অনেকবার বলেছি, তালব্য-শ’ লিখতে গিয়ে তুমি কতটা যত্নশীল,এ থেকে বোঝা যায় তোমার যৌবন ঠিক কতখানি ফুটেছে!”

শেষ পর্যন্ত যেন কবি হয়ে উঠতে চান আবারো চিন্তাশীল এবং বাস্তববাদী, সমস্ত বাস্তব-পরাবাস্তব মোহ ভেঙ্গে; কিন্তু হয়ে কি উঠে শেষ পর্যন্ত,“এসব বিষয়ে নিশ্চিত হতে গেছি। সেখানে দেখেছি গোলকধাঁধা তৈরি করেছে তোমার চক্ষুজোড়া, আহ্লাদী হয়ে উঠেছে তোমার স্তনবৃন্ত তোমার কুন্তলরাশি ঝপাৎ বৃষ্টিপাতের মত আমাকে লুকিয়ে ফেলেছে যাবতীয় চিন্তাশীলতার কাছ থেকে” তারপর হয়তো আবারো আত্মপক্ষ সমর্থন,“ভাবলাম, আমি বোধ হয় সূর্যকলসের ফাঁদে-পড়া দার্শনিক পতঙ্গমাত্র, জানা নেই ভূবনচিলের পা কেন খুঁজে ফেরে গগনশিরীষ শাখা, মফস্বলী কাকের কেন চাই এলুমিনিয়ামের এণ্টেনা অনিবার্য এবং অবোধ্য, স্বাভাবিক কিন্তু গাণিতিক নয়”......হা হা হা, তারপর আবারো যেন একাকীত্মের অসহায়তার প্রকাশ, খুব দ্রুত যেন কবি যাদুকরী রোদের ভেতর অন্তর্ধানে চলে যাওয়া তার প্রিয়াকে ফিরে পেতে চান “বরং জরুরি বেলা একটায় তোমার ফিরে আসা” হোক সে পূনর্মিলন মিনিট-স্থায়ী কিন্তু তবুও যেন কবি তাতেই খুঁজতে চান স্বস্থি “ সমগ্র জীবনের যৌথতার চেয়ে সত্য, অমরতার চেয়ে সত্য অমরতার দিকে যাওয়া”......ধন্যবাদ সুমন রহমান, একটি অপূর্ব কবিতার পড়তে দেয়ার জন্য।

??? এর ছবি

ধন্যবাদ ধ্রুব, আপনার পঠন এবং দীর্ঘ আলোচনার জন্য।
.....................................................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।