একজন হিটলারের গল্প-২।

জাহিদ হোসেন এর ছবি
লিখেছেন জাহিদ হোসেন (তারিখ: শুক্র, ১৯/০৬/২০০৯ - ৯:৫০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সেইদিনের সন্ধ্যাবেলার কথা আমার আজো পরিষ্কার মনে আছে। বন্ধুটি ততক্ষণে চলে গেছে। আমি আর বাবা চুপচাপ রাতের খাবার খেয়ে নিলাম হোটেলে। আমার খিদে বলতে গেলে তেমন ছিলইনা, তবু কষ্ট করে গিললাম। সেই রাতে বাবার সাথে আমার বেশী কথা হয়নি। বাবাও বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন যে আমি মন খারাপ করে আছি। তাই তিনিও আমাকে তেমন বেশী কিছু বলেননি।

আসলে আমার সে দিন মন খারাপ ছিলনা। আমার মনে ছিল প্রচন্ড রাগ। আশ্চর্য্যের ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে প্রথমে আমার রাগ হয়েছিল আমার নিজের প্রতি। কেন আমি আমার বন্ধুটির কথায় নেচে উঠলাম? আমি কি জানতাম না যে বাবা কোনভাবেই এই রকম একটি প্রস্তাবে রাজী হবেন না।
রাগটা তারপর গিয়ে গড়ালো আমার বন্ধুর প্রতি। আমি নাহয় একটা ভুল আশা করলাম, কিন্তু সেও তো জানে আমার বাবা কি রকমের লোক। কিভাবে সে আমার মনে এইরকম একটা মিথ্যে আশার আলেয়ার আলো জ্বালিয়ে দিলো?
রাত বাড়ার সাথে সাথে রাগের পরিমানটিও বাড়তে থাকে ভিতরে। এবং সেটা আস্তে আস্তে গড়িয়ে যায় বাবার দিকে।

যখন আমরা স্টেশনে গিয়ে পৌঁছুলাম, তখন আমার সারা শরীর রাগে কেঁপে উঠছে। চিটাগং ভ্রমনের যাবতীয় আনন্দ ততক্ষনে কর্পূরের মতো উবে গেছে। আমার নজরে তখন শুধু আমি বন্ধুটির সাথে কি কি আনন্দ করতে পারলাম না, তাইই শুধু ভাসছে। অথচ প্রথম থেকেই তো আমি জানতাম যে আমরা দুদিনের জন্য চিটাগং যাচ্ছি। যা দেখেছি সেটুকুও যে দেখতে পারবো তারও কোন প্ল্যান ছিলনা।

সেই রাতে আমি জীবনের একটি মহা সত্যকে আবিষ্কার করেছিলাম। আমাদের জীবনের সুখ বা দুঃখ আমরাই নির্ণয় করে থাকি। এবং সেটি নির্ণিত হয় আমাদের আশা দ্বারা। আশার অধিকই সুখ, আর আশার কমতিই দুঃখ।

তারপরেও মানুষের মন অবুঝ। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। রাগে দুঃখে তখন মনে হচ্ছে আমি স্টেশন থেকে দৌড়ে কোথাও চলে যাই। বাবার দিকে তাকাতেও আমার ইচ্ছে করছিল না।
রেলগাড়ীতে আমরা দু বাংকের একটি কামরায় উঠলাম। বাবা তো উপরের বাংকে উঠবেননা, তাই আমিই উঠলাম সেখানে। স্টেশন থেকে কিনেছিলাম ম্যাক্সিম গোর্কির "মা" উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ। তাই পড়েই রাত কাটিয়ে দেবো, এই প্ল্যান।

রাগে তখনো মাথা দপ দপ করছে। বইয়ের পাতায় মন বসছে না কিছুতেই। একটু পরে বাবা ঘুমিয়ে গেলেন। আমি জোর করে বইয়ের দিকে মনোনিবেশ করতে চাইছি। আস্তে আস্তে মনটা শান্ত হয়ে আসতে থাকে। কেন কে জানে? হয়তো ম্যাক্সিম গোর্কি পড়ার সুফল। হয়তো আমি নিজেই ততক্ষণে বুঝে গেছি যে এই রাগ করার কোন মানে হয়না।

শেষ রাতের দিকে চোখে ঘুম এলো বটে কিন্তু তখন আবার অন্য সমস্যা এসে ভর করলো। তখন ছিল শীতকাল, আর আমি রাগের মাথায় কোন গায়ের কম্বল না নিয়েই উপরের বাংকে উঠে গেছি। আগেতো মাথা গরম থাকায় ঠান্ডা টের পাইনি, কিন্তু মাথা ঠান্ডা হবার সাথে সাথে শীতটিকেও বেশ হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া শুরু করলাম।
কিন্তু তখন আমার করার নেই তেমন কিছু। নীচে বাবা ঘুমাচ্ছেন, নামতে গেলে তার গায়ের উপর পড়ে যেতে পারি এই ভয়ে নীচে নামতে পারছিনা। কিন্তু এদিকে দারুন শীতে আমার দাঁতকপাটি লাগার মত অবস্থা। গায়ে একটা পাতলা সোয়েটার ছিল বটে, কিন্তু সেটাকে গুটিশুটি করে বল বানিয়ে তখন বালিশ হিসেবে ব্যবহার করছি। ম্যাক্সিম গোর্কিকে বালিশ হিসেবে মাথার নীচে চালান করতে পারতাম, কিন্তু পাতলা সোয়েটারটি গায়ে দেওয়া আর না দেওয়া সমান ব্যাপারই ছিল। অগত্যা, দাঁতে দাঁত চেপে শুয়ে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা আমার হাতে।

তাইই করতে হোল। শুধু ভরসা ছিল একটা। বাবা ঘুম থেকে ওঠেন খুব সকালে। ফজরের নামাজ পড়ার জন্য। অতএব চোখ কান বুজে সূর্য্যোদয়ের প্রতীক্ষায় থাকলাম। রেলগাড়ীর দোলানীতে নাকি ঘুমের উদ্রেক হয় খুব সহজে, কিন্তু সে রাতে টের পেয়েছিলাম যে শীতের কষ্ট কাহাকে বলে। (অবশ্য এখানে বলে রাখা ভাল যে অনেক পরে একবার আমাকে শূন্যের পয়তাল্লিশ ডিগ্রি নীচে তাপমাত্রায় বাইরে থাকতে হয়েছিল। সে যাত্রায়ও বড় কষ্ট পেয়েছিলাম।)

এক সময় রাত পোহায়। বাবার ঘুম ভাংলো। উপরে আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে পড়ে আছি। প্ল্যান করছি যে বাবা বাথরুমে গেলেই আমি আমার ব্যাগ থেকে চাদর বের করবো। কিন্তু বাবা বিছানা থেকে নামলেন বটে কিন্তু ঘরের দরজা খুললেন না। চোখ বন্ধ করে আছি যেহেতু তাই ঠিক বুঝতেও পারছিনা যে তিনি কি করছেন।
এমন সময় হঠাৎ আমার গায়ে যেন কিসের স্পর্শ পেলাম। চমকে উঠে ভাবছি সাপ বা মাকড়সা জাতীয় কিছু নয়তো? চোখের কোণা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাবা তার নিজের গায়ের শালটি আমার গায়ে বিছিয়ে দিচ্ছেন। তিনি ভেবেছিলেন আমি হয়তো ঘুমিয়ে, তাই চুপিচুপি আলতো করে কাজটি সারলেন। যেন আমার ঘুম না ভাংগে, যেন আমি তার এই কোমল রূপটি না দেখি, যেন আমি জানতে না পারি তিনি আমাকে কতখানি ভালবাসেন।

শালটিতে তখনো বাবার গায়ের গন্ধ লেগে আছে, তার শরীরের ওম জড়ানো। নিদ্রাহীন আমার চোখের পাতায় ঘুম নেমে এলো মুহুর্তে। বাবার ভালবাসাটি আমিও খুব গোপনে নিজের মধ্যে ধারণ করলাম। এ জিনিস তো কাউকে বলবার নয়, এ জিনিসের কথা তো আর কারোর জানার কথা নয়। এ শুধুই আমার একার। সে রাতের কথা কেউ জানে না, এমনকি বাবাও না। সেদিন বাবা টের পাননি যে আমি মহামতি হিটলারের হূদয়টিকে গোপনে দেখে ফেলেছিলাম। আমিও আমার চোখের জলটিও তাকে দেখতে দেইনি।

এর অনেক দিন পরের কথা। আমার বিদেশ চলে আসার প্রাক্কালে মা বললেন, "তোকে একটা নতুন শাল-টাল কিনে দেই। শীতের জায়গায় যাচ্ছিস, মাঝেমাঝে গায়ে দিবি।" আমি গোপনে বাবার আলমারী খুলে সেই পুরনো শালটিকে আমার স্যুটকেসে ভরে নিয়ে চলে এসেছিলাম। ততদিনে শালটি জীর্ণ আকার ধারণ করেছে, গায়ে লেগেছে কিছু সময়ের দাগ, তৈরী হয়েছে পোকায় কাটা কয়েকটি ফুটো।
আজও শালটি আমার কাছে আছে। শীতকালে ঘরের ভিতরে সেটাকেই গায়ে দেই। বৌ আপত্তি করেছিল প্রথম প্রথম, ছেলেমেয়েরাও পছন্দ করেনি। কিন্তু শালটিকে আমি যখন গায়ে দেই, তখন আমি আমার বাবার গায়ে গা ঘেঁষিয়ে বসে থাকি যেন। যা বাস্তবে কোনদিন হয়নি। তাতে কি? এটাই এখন আমার বাস্তব। মহামতি হিটলার চিরটাকাল এমনিভাবে আমার কাছটিতেই থাকবেন।

মাস্টার্স পড়ার সময়ে আমি বাবার সাথে আর্থিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলাম। তারপর ছাত্র পড়িয়ে, স্কুলে এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারী করে যা পয়সা পেতাম, তাতে আমার বেশ ভালই চলে যাচ্ছিল। একা মানুষ, হোটেলে তিনবেলা খাওয়া খরচ বাদ দিলে আর থাকে বিড়ি-সিগ্রেটের খরচা আর মাঝেমাঝে রিকশা ভাড়া। আর বিপদে পড়লে আমার সদা প্রস্তুত বন্ধুরাতো রয়েছেই। বাবার কাছ থেকে পয়সা নেওয়া বন্ধ করার মূল কারণ ছিল যে তার উপরে আর আর্থিক বোঝা চাপাতে চাইনি আমি, এছাড়া খামাখা আমাদেরকে অহেতুক কৃচ্ছতার মধ্যে রাখার জন্যে তার প্রতি আমার এক ধরণের অভিমানও ছিল।

এমন করে ভালই চলছিল দিন। এরই মধ্যে খবর এলো যে আমেরিকার স্কলারশিপটি আমি পেয়ে গেছি। তিনমাস পর আমাকে যেতে হবে। বাবাকে খবরটি দিলাম ফোন করে। বাবা বললেন,"প্লেনভাড়ার জন্যে চিন্তা করিস না। আমি দিয়ে দেব।"
আমার পুরনো অভিমান মাথার মধ্যে নাড়াচাড়া করে উঠলো। একটু বাঁকা সুরে বললাম,"আমি চিন্তা করছি না বাবা, কেননা স্কলারশিপ যারা দিচ্ছে, তারা আমার প্লেন ভাড়াটাও দিয়ে দিচ্ছে।"
বাবা যেন একটু চুপসে গেলেন,"ও তাই নাকি? ভাল, বেশ ভাল। কিন্তূ তোর তো নতুন জামা কাপড় কিছু কিনতে হবে। আমি কালই মিনারের (ছোট ভাই) হাতে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি।"
"লাগবে না বাবা। আমার জমানো কিছু টাকা আছে, তাতে দু তিনটে জামা-প্যান্ট হয়ে যাবে।"
"স্যুটও তো বানাতে হবে একটা।"
"আমি স্যুট পরিনা বাবা। আমার স্যুট লাগবে না।"
"পথের খরচ তো লাগবে কিছু। আমার কাছে কিছু ডলার আছে। হজ্ব করার সময়ে কিনেছিলাম, সেগুলো তুই নিয়ে যা তাহলে।"
আমি কঠিন স্বরে বলি,"আমিতো বললামই তোমাকে বাবা যে আমার সমস্ত পথ খরচা ওরা দিয়ে দিচ্ছে। আমাকে একটা পয়সাও পকেট থেকে দিতে হবে না। আমি তোমাকে ফোন করেছি খবরটা দেওয়ার জন্য। তোমার কাছে আমি টাকা চাইতে ফোন করিনি। আমার কাছে টাকা আছে।"
বাবার স্বরটি কেমন যেন নরম হয়ে গেল।"তাহলেতো ভালই। যদি কিছু লাগে আমাকে অবশ্যই জানিও।"
"আমার কিছু লাগবে না বাবা।" আমি ফোনটি সশব্দে রেখে দেই। মনে মনে বলি, হিটলার সাহেব, আমি এখন স্বাধীন মানুষ।

আস্তে আস্তে আমার যাবার দিনটি এগিয়ে আসে। ঢাকাতে আমার ব্যস্ত সময় কাটে। ভিসার জোগাড়যন্তর, জিনিসপত্র কেনাকাটা, ব্যাংক এ্যাকাউন্ট বন্ধ করা ইত্যাদি। সবকিছু শেষ করার পর হাতে যা পয়সা বাকী ছিল, তা দিয়ে ডলার কিনে ফেলি। ব্যাস- আমার ঢাকার জীবন সমাপ্ত। হিসেব-কিতেব সব চুকিয়ে দিয়েছি, এবার আমার যাবার পালা।

যাবার দিন এয়ারপোর্টে সবাই এসেছে। বাবা, মা, ছোট ভাই বোনেরা। ছোট বোনটি জিজ্ঞেস করলো,"আবার কবে দেশে আসবে দাদা?"
আমার মা চুপচাপ মানুষ। তিনি বললেন,"বেশী মন খারাপ করোনা আমাদের জন্য।"
বাবা এদিক সেদিক পায়চারী করছেন। মাঝে মাঝে এসে আমাকে বার কয়েক শুধোলেন,"সব কিছু ঠিক আছে তো? কিছু লাগবে? লাগলে বল্‌। ডলারগুলো কিন্তু আমি নিয়ে এসেছি সাথে করে।"
আমি মনে মনে হাসি। নাহ্‌- কিচ্ছু লাগবে না আমার। আমি সব জানি। আমি স্বাধীন। আমার উপর তোমার আর কোন জারিজুরী খাটবে না মিস্টার হিটলার।

মাইক্রোফোনে ঘোষণা দিল। এবার আমাকে যেতে হয়। কাঁধে ব্যাগটি তুলে নেই। সবাই এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আস্তে আস্তে গেটের দিকে এগোই আমি। ওরা সবাই চোখে জল নিয়ে হাত নাড়ে।

গেটের সামনে একজন ভদ্রলোক বসে টিকিট, পাসপোর্ট ইত্যাদি পরীক্ষা করছেন। তাকে এগিয়ে দেই আমার কাগজ পত্র। সেগুলোতে চোখ বুলিয়ে ভদ্রলোক আমার দিকে তাকান।"এইবারই কি প্রথম দেশের বাইরে যাচ্ছেন?"
আমার মেজাজ খারাপ হয়। কেন আমাকে দেখতে কি ইডিয়েটের মতো লাগছে নাকি?
"হ্যাঁ-আমি স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় পড়তে যাচ্ছি (বেশ ডাঁট মেরে বলেছিলাম কথাগুলো)।"
ভদ্রলোক হাসেন।"এটাই যে আপনার প্রথম বিদেশ যাত্রা, সেটা বুঝতে আমার কোন অসুবিধা হয়নি।"
আমার মেজাজ চড়ে যায়। মুখ বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করি,"তা কি দেখে বুঝলেন, সেটা কি আমি জানতে পারি?"
"আপনি আপনার ট্র্যাভেল-ট্যাক্সটি দেননি। প্রথম যারা বিদেশ যায়, তাদের অনেকেই এই ভুলটি করে থাকে। যান-পাশের ব্যাংকের কাউন্টারে গিয়ে ট্যাক্সটি দিয়ে আসুন। ওরাই তখন আপনার বোর্ডিং পাসে একটা স্টিকার লাগিয়ে দেবে। ওটা এখানে এসে দেখালেই আপনি খালাস।"

রাগে গরগর করতে করতে আমি ফিরে আসি। আমাকে দেখে বাবা এগিয়ে আসেন আমার দিকে।
"কোন সমস্যা?"
"ট্র্যাভেল-ট্যাক্স দেওয়া হয়নি আমার। সেটা দিয়ে আসি।"
"ও-আচ্ছা।"
বাবা আর তেমন কোন কথা না বলে আমার পিছন পিছন ব্যাংক কাউন্টার অবধি আসেন।

কাউন্টারের ভদ্রলোককে বলি," ট্র্যাভেল-ট্যাক্স দিতে চাই।"
"কজন প্যাসেঞ্জার?"
"আমি একাই।"
"সাড়ে সাতশো টাকা দিন।"
"মানে?"
"সাড়ে সাতশো টাকা হচ্ছে একজনের ট্র্যাভেল-ট্যাক্স।"
আমার গা ঘামতে শুরু করে। বলে কি এই লোক? আমার পকেটে কুড়িয়ে-টুড়িয়ে বাংলাদেশী টাকা হয়তো দশ-বারো থাকতে পারে, তার বেশী নয়। সাড়ে সাতশো টাকা আমাকে তখন দশবার ঝাড়লেও বেরোবে না। আগেই বলেছি এয়ারপোর্টে আসবার আগেই বাংলাদেশের যাবতীয় হিসেব-কিতেব চুকিয়ে ফেলেছিলাম।
(এই প্রসংগে বলে রাখা ভাল, যে সেই সময়ে সাড়ে সাতশো অনেক টাকা। আমি ঢাকাতে তখন এক কামরা আর একটা বাথরুম নিয়ে থাকতাম শংকর এলাকায়, যার ভাড়া ছিল তিনশো টাকা।)

আমার পিছন থেকে একটি পরিচিত কাশি শুনতে পাই। একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করেন,"কি কোন সমস্যা?"
ভাবটা এমন যেন উনি আমাদের আলাপের কোন কিছুই শোনেননি।
"আমার ট্র্যাভেল-ট্যাক্স দেওয়া হয়নি। এখন তো দেখি বেশ অনেক টাকা।"
"কত লাগবে?"
"সাড়ে সাতশো টাকা।"
"আমি দিচ্ছি। কোন অসুবিধা নেই।"
পকেট থেকে বাবা দুটো পাঁচশো টাকার নোট বের করে আমার হাতে দেন। আমার মনের ভুলও হতে পারে, কিন্তু কেন জানিনে আমার মনে হোল বাবার মুখে একটি অতি সূক্ষ্ম হাসি দেখেছিলাম সেদিন আমি। বাবা যেন বলছেন,"আমি জিতলাম।"

সেদিন নিজের উপর রাগ হয়েছিল। টাকাটা আমার কাছে ছিলনা কেন? কেন এই ব্যাপারটি আগে থেকে চিন্তা করিনি?

আজ মনে হয়, বাবার সেদিন সেই হাসিটি জেতার হাসি ছিলনা। বাবা সেদিন খুশী হয়েছিলেন তার অকাটমূর্খ এই ছেলেটির পাশে দাঁড়াতে পেরে। বাবারা কোনদিনই জিততে চান না, তারা বরং দেখতে চান যে তার সন্তানেরা জিতেছে। এই ধ্রুব সত্যটি বোঝার জন্যে আমাকে আরো অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। যেদিন আমি আমার নবজাত শিশুকন্যাটিকে প্রথম কোলে নেই, সেদিন বিদ্যুৎচমকের মতো আমার চোখের সামনের মিথ্যে অহংকারের পর্দাটি চিরকালের জন্য মিলিয়ে যায়।

এজন্যেই কথায় বলে, গাধারা চিরকালই পানি ঘোলা করে তারপর খায়।

(বাকী অংশ পরের পর্বে)।


মন্তব্য

সাইফ এর ছবি

কিন্তু শালটিকে আমি যখন গায়ে দেই, তখন আমি আমার বাবার গায়ে গা ঘেঁষিয়ে বসে থাকি যেন
এখানটায় এসে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলাম


এজন্যেই কথায় বলে, গাধারা চিরকালই পানি ঘোলা করে তারপর খায়।

বড়ই সত্য কথা, আমি আপনার চির ভক্ত হয়ে গেলাম, ২য় পর্বের সাথে

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

এটাও পড়ে ফেললাম।
কী যে চমৎকার আর সাবলীল ভাষা !
দুর্দান্ত

রেনেট এর ছবি

অসাধারণ ২য় পর্ব। কিভাবে লিখেন এভাবে! পুরো লেখাটিই কোট করতে ইচ্ছা করছে!

আমাদের জীবনের সুখ বা দুঃখ আমরাই নির্ণয় করে থাকি। এবং সেটি নির্ণিত হয় আমাদের আশা দ্বারা। আশার অধিকই সুখ, আর আশার কমতিই দুঃখ।

এই অংশটুকু হৃদয়ে গেথে গেল।
---------------------------------------------------------------------------
No one can save me
The damage is done

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

অনিকেত এর ছবি

আমি জানিনা জাহিদ ভাই--ঠিক কী কারনে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আছে---আসলেই জানিনা---আপনি খুব খারাপ মানুষ--খুব খারাপ---

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- বস লেখা! চলুক

এখন তো মনেহয় ট্যাক্স টিকেটের সাথেই রেখে দেয়। কতো দিতে হয় এখন, একুশ'শ?
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

স্বপ্নাদিষ্ট এর ছবি

আমাদের জীবনের সুখ বা দুঃখ আমরাই নির্ণয় করে থাকি। এবং সেটি নির্ণিত হয় আমাদের আশা দ্বারা। আশার অধিকই সুখ, আর আশার কমতিই দুঃখ।

এই লাইনগুলো খুবই চমৎকার হয়েছে। চরমভাবে সহমত।

তানিম এহসান এর ছবি

কি অদ্ভূত সুন্দর! বাবা’র উপর রাগ মনে হয় সব সন্তানের থাকে, আমি যেমন এখনও জল ঘোলা করেই খাচ্ছি। তবে এইধরনের লেখা পড়লে, চোখের ভেতরও জল জমে এবং বাবার প্রতি যাবতীয় অন্যায়ের জন্য একটা অপরাধবোধ কাজ করে।

আপনি ভালো থাকবেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।