একজন হিটলারের গল্প-৩।

জাহিদ হোসেন এর ছবি
লিখেছেন জাহিদ হোসেন (তারিখ: শুক্র, ১৯/০৬/২০০৯ - ৯:৪১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমেরিকায় চলে আসবার পর শুরু হোল নতুন জীবন। পরিচিত কেউ নেই। পরিবার-পরিজন নেই, আত্মীয়-স্বজন নেই, বন্ধু-বান্ধব নেই। তাহলে আছে কি? আছে শুধু পড়াশুনা, আছে পরীক্ষা, আছে টার্ম-পেপার। এককথায় হাবিয়া দোজখ।
আমেরিকার যে জায়গাটিতে আমি পড়তে গিয়েছিলাম, সে জায়গাটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের জন্য ভুবনবিখ্যাত। কি নেই সেখানে? নীল সমুদ্র আর আকাশছোঁয়া পর্বতরাজি দেখে টুরিস্টরা আহা-উহু করে। সেখানকার মানুষেরাও খুব ভাল। হাসিখুশি, বন্ধুবৎসল। বিশ্ববিদ্যালয়েও পরিচয় হোল আরো অনেকের সাথে। ভারতের মনজুনাথ, নেপালের নবরাজ, শ্রীলংকার টিসা, আমেরিকার ব্রুস, আরও কত জন।

তবুও মন ভরেনা আমার। ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কি যেন নেই। একা একা ঘরে বসে বাইরের দিকে উদাস তাকিয়ে থাকি। কি করবো তাহলে?

একজন বুদ্ধি দিল,"একটা প্রেম করে ফ্যাল্‌। প্রেমিকার পিছনে ঘুরতে ঘুরতে মন খারাপ করার সময় পাবিনে।"
প্রেম? আমি করবো? মনে পড়ে বহু বছর আগে করা হিটলার সাহেবের সতর্কবাণী। তিনি মাকে বলছেন,"মনে রেখো, আমি কিন্তু তোমার ছেলের কোন রকম বেয়াদবী সহ্য করবো না।"
নিজের অজান্তেই শিউরে উঠি। তার চেয়ে থার্মোডায়নামিক্স অনেক ভাল।
যেহেতু আমি স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গিয়েছিলাম, সে জন্য আমাকে পড়ার সাথে সাথে আর কোন কাজ করতে হয়নি। মাঝেমাঝে অন্যদের কাজ করার গল্প শুনে বড় খারাপ লাগে। আহা- কত কষ্ট করে লোকেরা পড়াশুনা করে। আর আমি কিনা খামাখা উলটো-পালটা চিন্তা করে সময় নষ্ট করছি। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।

দু’বছর পর সামারে দেশে গেলাম বেড়াতে। ভাই-বোনেরা সবসময় ঘিরে রাখে আমাকে। এদের ফেলে আবার কিভাবে ফিরে যাবো আমেরিকায়? এমনি সময় বাড়ীতে একটা ঢেউ উঠলো। দেশে এলিই যখন বিয়েটা করেই ফ্যাল। আবার কবে দেশে আসবি তার কি কোন ঠিক আছে? আমি মুখে কোন কিছু বলিনা।
একদিন মা এসে জিজ্ঞেস করলো,"তোর কি পছন্দের কোন মেয়ে আছে? তোর বাবা জিজ্ঞেস করছিল। থাকলে বল। আমরা কথা-টথা বলি।"
একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে? ভূতের মুখে রামনাম!
যে বাবা আমাকে পইপই করে করে দিল যে তিনি কোনরকম "বেয়াদবী" সহ্য করবেন না , আজি কিনা তিনি এসে জানতে চাইছেন আমার পছন্দের কোন মেয়ে আছে কিনা। রাগে আমার মুখে কথা আটকে যায়। শুধু মাথা নাড়ি। আমার কোন পছন্দ নেই। তোমরা যা ভাল মনে করো, তাকেই বিয়ে করবো।

তারপর একদিন হঠাৎ করেই বিয়েটা হয়েই গেল। নদীর নামের একটি মেয়ের সাথে। বিয়ের সাতদিন পর আমরা উড়াল দিলাম আমেরিকার উদ্দেশ্যে।

তারপর কাটলো আরো কয়েকটি বছর। একদিন আমাদের ঘরে এলো একটি শিশুকন্যা। তাকে নিয়ে পুতুল খেলি আমরা দুজন। শিশুটি আমাদের পাগলামো দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। বোধহয় ভাবে, আমাকে তুমি এ পাগলের ঘরে পাঠালে, খোদা?

এর মধ্যে একদিন দেশ থেকে খবর আসে। খবর শুনে আমার বুক শুকিয়ে যায়। মহামতি হিটলার আমাদেরকে দেখতে আমেরিকা আসছেন।

সর্বনাশ! যার নাগাল এর বাইরে যাবার জন্যে এই সাতসমদ্দুর তেরনদী পাড়ি দিলাম, তিনিই কিনা চলে আসছেন আমাদের কাছে। তাকে আমাদের এই ছোট্ট ঘরে কোথায় বসতে দেব? কি খাওয়াবো? কি কথা বলবো?
কিছুই করার নেই। তার ভিসা নেওয়া, টিকিট করা শেষ। এখন শুধু ফাঁসীর দড়ি ধরে টান দেওয়াটা বাকী। দুরুদুরু বক্ষে আমরা দিন গুনি শুধু।
বাবা যেদিন এলেন, সেদিন আমি একাই গেলাম এয়ারপোর্টে। ছাত্র মানুষ আমি। বৌকে বেবী সিটিং করতে হয়। তা না হলে সংসার চলেনা। অতএব তাকে বাসাতেই থাকতে হয়।
বাবার কপাল খারাপ যে তাকে ইমিগ্রেশনে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকতে হয়েছিল। এতটা দূরের পথ অতিক্রম করে এসে শেষের এই বিলম্বটুকু তাকে ভয়াবহ রকমের খেপিয়ে তুলেছিল। যাই হোক যখন তিনি ফাইন্যালি সে গেরো থেকে বেরোলেন, তখন আমিও একটু ঘাবড়ে গেছি।

বাইরে বেরিয়ে আদাব-সালামের পর্ব শেষ হলে বাবা বললেন,"একটা ব্যাপার এখনই পরিষ্কার করে ফেলা উচিৎ। আমি কিন্তু তোমাদেরকে দেখতে আসিনি।"
"তাহলে?"
"আমি আমার নাতনীকে দেখতে এসেছি। তোমাদের চেহারা আমি অনেক দেখেছি, আর না দেখলেও চলবে। কিন্তু আমার নাতনীটি কই?"
"ওরা তো বাসায়, বাবা।"
"তাহলে আর এই এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে থাকার দরকার কি? চলো- বাসায় যাই।"

আমরা তখন এক বেডরুমের একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকি। শুনশান এক রোদেলা দুপুরে বাসায় ফিরলাম আমরা দুজন। লিভিং রুমে তিনটে বেবী সিটিং এর বাচ্চা ঘুমাচ্ছে। তাদেরকে দেখেই বাবার তো চোখ চড়কগাছ।
"আমরাতো শুনেছি তোমার একটা মেয়ে হয়েছে। এখানে তিনটে বাচ্চা কেন?"
আমি মিনমিন করে বলি,"স্কলারশিপের পয়সায় সংসার চলেনা বলে ও বাসায় বসে বেবী সিটিং করে।"
বাবার ভুরুতে ভাঁজ পড়লো। "হুমম! ঐটাতো বলোনি কখনো। তার এর মধ্যে আমার নাতনী কোনটি?"
আমার দুরবস্থা দেখে স্ত্রী এগিয়ে আসে। "বাবা- আপনি বসুন তো। আপনার নাতনী এখানে নেই। সে শোবার ঘরে ঘুমুচ্ছে। আমি নিয়ে আসছি।"

ঘুমন্ত শিশুটিকে শোবার ঘরে থেকে এনে সে তাকে বাবার কোলে দেয়। কি আশ্চর্য্যের ব্যাপার। মুহুর্তের মধ্যে উধাও হয় বাবার কপালের ভাঁজ, ভুরুর কুঞ্চন এবং গলার বাজখাঁই আওয়াজ। তিনি অপার মমতায় শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তার হূদয়ের উষ্ণতায় শিশুটির ঘুম ভেংগে যায়। বাবাকে দেখে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন, তারপর খলখলিয়ে হেসে ওঠে। বাবাও হাসেন। "বাহ্‌-এতো দেখি আমাকে চিনে ফেলেছে। এইটুকু বাচ্চার এত বুদ্ধি! মাশাল্লাহ্‌!"

আমরা দুজন বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। বাবার মুখে হাসি? অমাবস্যায় পূর্ণিমা চাঁদ? এও কি সম্ভব?

রাতের খাবার খাওয়ার পর আমার স্ত্রী শোবার ঘরে মেয়েকে খাওয়াচ্ছে। বাবা আর আমি তখন একটু একলা। এই ফাঁকে বাবা তার স্বভাবসুলভ গম্ভীর গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,"এটা কি হচ্ছে?"
আমি সে কথা শুনে সাত হাত পানির নীচে। "কোনটা কি হচ্ছে?"
"তুমি যে বৌমাকে দিয়ে বেবী সিটিং এর কাজ করাচ্ছো, সেটা। আমিতো দেশে ফিরে গিয়ে বেয়াই সাহেবকে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবোনা। লোকে বিদেশ আসে ভাল থাকবার জন্যে, খারাপ থাকার জন্যে না। বৌমাদের বাড়ীর অবস্থা কি রকম তাতো তুমি জানোই। এ জাতীয় কাজ কোনদিন জীবনে সে করেছে?"
"তা আমি কি করবো? আমি ছাত্র মানুষ, আর আমার কাজ করার কোন পারমিশন নেই। সংসার চালাতে তো হবে। ও কাজ না করলে তাহলে তো আমাকে রাতের বেলা চুরি করতে যেতে হয়। তাই কি করবো?"
বাবা এ উত্তর শুনে গুম হয়ে গেলেন।
আমি আবার বলি,"তুমি এটা নিয়ে শুধু শুধু মন খারাপ করছো। আর তোমার বেয়াই সাহেবকে নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তিনি জানেন ব্যাপারটা।"
"ও-তোমার গুণের ব্যাপারটা অলরেডী জানিয়ে দিয়েছো। বেশ-বেশ।"

আমাদের ওখানে বাবা দুদিনেই হাঁপিয়ে উঠলেন। কারণটা আমার জানা। তিনি হচ্ছেন কাজের মধ্যে ডুবে থাকা স্বভাবের লোক। বিনা কাজে একটা দিন পার করা তার পক্ষে নরকযন্ত্রনা ভোগ করার মতো। একদিন খাবার সময় দেখলাম বলছেন,"আমিতো আর বিদেশ দেখতে আসিনি। আমি এসেছিলাম আমার নাতনীটিকে দেখতে। সে দেখা তো হয়েই গেছে, আর খামাখা এখানে থেকে লাভ কি?"

এমনি সময়ে হঠাৎ তিনি আমায় বললেন,"ভালো কথা-তুমি এখানে যার আন্ডারে কাজ করছো, সেই প্রফেসরের সাথে দেখা করা যাবে?"
আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। প্রফেসরের সাথে দেখা করার কারণটি কি? আমি কি এখনো সেই বাচ্চা আছি নাকি যে আমার টিচারের সাথে দেখা করতে হবে?
"আমি কালকে উনাকে জিজ্ঞেস করবো।"

আমার থিসিস গুরুটি ব্রিটিশ। বয়েস বেশী ছিলনা, স্বভাবও বেশী সুবিধার ছিলনা। আমাদের আশপাশের যাবতীয় প্রফেসরদের সাথে তার আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক ছিল। তাকে গিয়ে বললাম আমার পিতাজীর খায়েশের কথা। এবং সেই সাথে তাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য বারবার বললাম,"আমি জানি যে তুমি খুব ব্যস্ত মানুষ। সময় দিতে না পারলেও কোন সমস্যা নেই।"
কে শোনে কার কথা। সে ব্যাটা বলে,"তুমি তোমার বাবাকে অবশ্যই নিয়ে আসবে। পারলে আজকে বিকেলেই নিয়ে এসো। প্রথমে ল্যাব-ট্যাব গুলো ঘুরিয়ে দেখাও, তারপর তাকে আমার অফিসে নিয়ে এসো।"
মাথায় হইলো বজ্রাঘাত। এবার মান-সম্মান যেটুকু ছিল, সেটুকুও আর থাকবেনা মনে হয়। নেংটি ধরে টান দিলে আর কিছু কি অবশিষ্ট থাকে?

(বাকী অংশটুকু পরের পর্বে)


মন্তব্য

সাইফ এর ছবি

মাথায় হইলো বজ্রাঘাত। এবার মান-সম্মান যেটুকু ছিল, সেটুকুও আর থাকবেনা মনে হয়। নেংটি ধরে টান দিলে আর কিছু কি অবশিষ্ট থাকে?

কী অপূর্ব সাবলীল আপনার লেখনি, মুগ্ধ হয়ে এক নি:শ্বাসে পড়ে শেষ করলাম, আপনার ৪ টি পর্ব। এরকম আরো লেখা চাই

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

পড়ছি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে।

রেনেট এর ছবি

ছবির মত বর্ণনা! আপনার মার ইন্দ্রজিৎ কিভাবে আমাদের মুগ্ধ করে চলেছে, তা কি উনি জানেন?
---------------------------------------------------------------------------
No one can save me
The damage is done

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

তিথীডোর এর ছবি

এই ভদ্রলোককে ধরে (মাথায়, পিস্তল) সচলে ফেরানো যায় না? রেগে টং

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক চলুক চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।