ক্যান্সারের জার্নাল (পর্ব -৯)

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি
লিখেছেন জোহরা ফেরদৌসী (তারিখ: সোম, ৩১/০৫/২০১০ - ১০:১২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আগের পর্বগুলোঃ

।। পর্ব -১ ।। পর্ব - ২ ।। পর্ব - ৩ ।। পর্ব -৪ ।। পর্ব -৫ ।। পর্ব -৬ ।। পর্ব -৭ ।। পর্ব -৮ ।।

১১.

মিতি আর রাফাত বসে আছে সিভিক হাসপাতালের গ্রাইমস লজের পাঁচতলার ওয়েটিং এরিয়াতে । এখানেই ওম্যান্স ব্রেস্ট হেলথ সেন্টার । ডাক্তার হাবীব এখানেই ওদেরকে প্রথম পাঠিয়েছিল । এই মুহূর্তে ওরা অপেক্ষা করছে কখন ডাক্তার চ্যাডউইকের কাছ থেকে ডাক আসে ভেতরে । মিতির ম্যামোগ্রাম ও আল্ট্রা সাউন্ডের রিপোর্ট তার কাছ থেকেই জানা যাবে ।

গ্রাইমস লজ বিল্ডিংয়ের এটাই সব চেয়ে উপরের তলা । এলিভেটর থেকে বেড়িয়ে প্রথমেই চোখে পড়ে সামনের রিসেপশন । তারপর হাতের ডানদিকে এই ওয়েটিংয়ের জায়গাটা । ওয়েটিং এরিয়ার ঠিক ওপরের ছাদে কিছুটা জায়গাজুড়ে কাঁচ লাগানো । ছাদের ঐ অংশটা দিয়ে আকাশ দেখা যায় । এই মুহূর্তে আকাশ ধূসর হয়ে আছে । কাঁচের ছাদের জানালায় চোখ রাখলে আকাশটাকেও ঘসা কাঁচের মত ঘোলা লাগছে দেখতে । আকাশের গায়ে দলা দলা মেঘ উড়ে যাচ্ছে । উইন্টারে এই রকম মেঘেরাই দিনমান তুষারপাতের কারন । যখনই এই রকম মেঘেরা দখল নেয় আকাশের এপার ওপার, তখনই বোঝা যায় শো শো বাতাসের সঙ্গে তুষার ঝড় শুরু হতে খুব দেরী নেই । বাংলাদেশের মেঘগুলোর সঙ্গে এখানকার মেঘেদের বেশ তফাৎ । বাংলাদেশের মেঘের রং জলভরা কাজল কালো আর এই দেশের মেঘেরা বান কূড়ালী ঘূর্ণির মত ধূসর । তফাৎ হবে নাই বা কেন বাংলাদেশের মেঘেরা বৃষ্টি হয়ে ধারাজলে নামে পৃথিবীর কোলে । এদেশের মেঘেরা শুকনো তুষার হয়ে ঝরে পড়ে । কাঁচের ছাদের দেয়াল গলে আকাশের দিকে থেকে চোখ ফিরিয়ে মিতি ওর চারিদিকে ওয়েটিং এরিয়ায় দৃষ্টি দিল ।

মাঝারি আকারের ওয়েটিং এরিয়াটার চারিদিক ঘিরে চেয়ারগুলো সাজানো । মাঝখানে টেবিলের ওপর বেশ কিছু ম্যাগাজিন রাখা, রোগি ও তার সাথের লোকজনের জন্য । এক পাশের শেলফে রাখা আছে অনেকগুলো বই, বুকলেট, সবই ক্যান্সার বিষয়ক । কোনার টেবিলের ওপরে বড় একটা ফ্লাওয়ার ভাসে অনেকগুলো কৃত্রিম ফুল । নানান বয়সী বেশ কিছু রোগি অপেক্ষা করছে ভেতর থেকে ডাক আসার । কোনার দিকে একজন আরব দেশী মহিলা ছোট্ট একটি কোরান শরীফ পড়ছে নীরবে । কিছুক্ষণ আগে একটি কালো যুবতী সঙ্গী পুরুষটির হাত ধরে এলিভেটর থেকে বের হয়ে ওয়েটিংয়ে এসে বসল । তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে ভীষন নার্ভাস লাগছে তার । সঙ্গী যুবকটি তাকে বসিয়ে রেখে রিসেপশনে গিয়ে মেয়েটির হেলথ কার্ড দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে এল । তারপর, ফিরে এসে সঙ্গিনীর হাত ধরে বসে রইল । দু’জনের বসার ভঙ্গি বলে দিচ্ছে অনাকাংখিত কিন্তু অনিবার্য্য কোন দুঃসংবাদ শোনার আগে দু’জন দু’জনকে সাহস দেয়ার চেষ্টা করছে । যদিও সে চেষ্টা খুব ফলদায়ক হচ্ছে না ।

মিতির মুখোমুখি বসে আছে একজন মাঝ বয়সী সাদা মহিলা । মুখ দেখে মনে হচ্ছে পূর্ব ইউরোপের কোন দেশের হবে । সে নীরবে তার হাতের তসবিহর মত জপমালাটি ঘুরিয়ে মনে মনে কিছু বিড়বিড় করছে । তার চোখ দু’টো বন্ধ । একটুক্ষণ পরে একজন বয়স্ক সাদা মহিলা বের হয়ে এল ভেতর থেকে তার ওয়াকার ঠেলে ঠেলে । তার সারা মুখে অসংখ্য আঁকিবুকি, ওয়াকার ধরা হাত দু’টোও খেয়াল করে তাকালে দেখা যায় একটু একটু কাঁপছে । কিন্তু তার সারা মুখের নির্মল হাসিটি অবিশ্বাস্য রকমের উজ্বল । কুঁজো হয়ে আসা কাঁধের ওপর মাথাটা ঘুরিয়ে সে তার সঙ্গী তরুণীর দিকে তাকিয়ে কিছু বলছে । তার কথার প্রত্যত্তুরে তরুণীটিও হেসে কিছু বলল । বৃদ্ধা যখন রিসেপশনে কথা বলছে, তখনই ভেতর থেকে একজন নার্স বের হয়ে এসে ডেকে উঠল, “Mrs. Husain…..” মিতি আর রাফাত উঠে দাঁড়াল । বৃদ্ধাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় মিতির চোখ পড়ে গেল তার চোখের দিকে, অভ্যাসমত মিতি হেসে তাকালো । বৃদ্ধা একটু এগিয়ে এসে কাঁপা কাঁপা হাতে মিতির হাতটা একটু ছুঁয়ে দিয়ে বলে উঠল, “Don’t worry my child, everything will be okay. Someone is watching...”

মিতিও বৃদ্ধার হাতটা একটুক্ষণ ধরে রেখে ছেড়ে দিল । তারপর হালকা পায়ে নার্সকে অনুসরন করল । ওর মুখ দেখে বোঝার কোন উপায় ভেতরে ভেতরে ও কী ভাবছে । নার্স ওদেরকে হলওয়ে পার করে ভেতরের একটা রুমে নিয়ে এল । তারপরে নার্স হাতের কাগজপত্রের ফাইলটা দরজার পাশের হোল্ডারে রেখে “Dr. Chadwick will see you in few minutes.” বলে চলে গেল ।

মিতি আর রাফাত পাশাপাশি চেয়ারে বসে ডাক্তারের অপেক্ষা করতে লাগল চুপচাপ । খুব বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হ’ল না, দরজায় নক করে ডাক্তার চ্যাডউইক ঢুকল । দীর্ঘকায় মানুষটি সামনের দিকে একটু ঝুঁকে হাঁটে । পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সী ডাক্তার চ্যাডউইকের চোখদু’টো চশমার আড়াল থেকেও বেশ কৌতুহলোদ্দীপক । ঢুকেই ডাক্তার হাত বাড়িয়ে দিল ওদের দিকে, তারপর চেয়ারে বসে মিতির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “How did you first find the tumor?”

মিতির জবাব শুনতে শুনতেই ডাক্তার মিতির রিপোর্টে চোখ বুলাতে লাগল । আরো কিছু প্রশ্ন করে জেনে নিল মিতির ফ্যামিলি হিস্ট্রি, গত দু’এক বছরে মিতির সার্বিক স্বাস্থ্যের খুঁটিনাটি । এক পর্যায়ে কাগজপত্র থেকে চোখ তুলে বলল, “I see you have a five years old son. Did you breastfed him? If yes, then for how long?”

মিতি জবাব দিল, “I breastfed him for more than two years.”

চশমার ওপাশে ডাক্তারের চোখ দু’টো একটু যেন ছায়াচ্ছন্ন মনে হ’ল মিতির, “You did everything you could do. Yet I have to give you a bad news. Your mammogram image is showing evidences of micro calcification.” বলেই ডাক্তার এক্স-রে প্লেট হাতে নিয়ে দেয়ালের কাছে গেল । দেয়ালে লাগানো পাশাপাশি দু’টো এক্স-রে ভিউং বক্সের গায়ে দু’টো প্লেট খটাস করে লাগাল । তারপর ডানদিকের প্লেটটির দিকে হাত রেখে বলল, “This one is your right breast. The whole image is showing same level of darkness.” তারপরেই বামদিকেরটায় হাত রেখে বলল, “This one is your left breast. You can see it is not same level of darkness everywhere. Particularly here it is lighter, which is basically evidence of calcification.”

ডাক্তারের কথামত এক্স-রে প্লেটের দিকে তাকিয়ে মিতি দেখল, বাদিকের ইমেজের একটা অংশ কিছুটা কম অন্ধকার অন্য অংশের চেয়ে । ডানদিকের ইমেজে সবটাই একই রকম অন্ধকার । এইবার রাফাত কথা বলে উঠল, “What do you mean by calcification? Does that mean that the tumor is malignant?”

ডাক্তার রাফাতের দিকে তাকিয়ে বলল, “Calcification means cluster of specks of calcium. When there is calcification, there is a good chance that the tumor is malignant.”

ডাক্তারের কথা শেষ হওয়ার পরে ঘরে হঠাৎ করেই শীতল নীরবতা নেমে এল কয়েক মুহূর্তের জন্য । নীরবতা ভেঙ্গে ডাক্তারই আবার বলে উঠল, “I cannot be absolutely sure about it without core biopsy. I am writing requisition for a core biopsy on emergency basis. So, that we get the final diagnosis fast. Also, I will ask for some more diagnostic tests such as MRI, bone scanning and abdominal ultrasound to see if the cancer has already spread or not.”

অনেকক্ষণ ধরেই মিতি কিছু বলছে না । ডাক্তারের কথাগুলো একের পর এক তীরের মত এসে বিধঁছে ওর বুকের মধ্যে । মনে হচ্ছে একের পর এক ঢেউ এসে আঘাত করছে নদীর পাড়ে । অসহায়ের মত ও দাঁড়িয়ে দেখছে উত্তাল ঢেউয়ের আঘাতে কেমন করে ফাটল ধরছে ওর স্বপ্নের ঘর-দোরের চারিপাশের মাটিতে । ক্রমশঃই মাটি আলগা হচ্ছে…

আত্মনিমগ্ন মিতির ভাবনার সুতো ছিড়ে গেল রাফাতের প্রশ্নে, “What is the probability of her getting breast cancer at this age? And why are you saying that if it is cancer, it might have been spreaded already?” রাফাতের কথাগুলো আর্তনাদের মত শোনাল । রাফাত জানে না, এখানে আসার আগে মিতি ব্রেস্ট ক্যান্সারের স্ট্যাটিসটিক্স ঘেটে এসেছে অনলাইনে । অর্থনীতির ছাত্রী মিতি নিজেই এখন “উপাত্ত” । কানাডিয়ান ক্যান্সার সোসাইটির ওয়েবপেইজে বলা আছে, প্রতি দশজন নারীর মধ্যে একজন নারী তার জীবদ্দশায় ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় । কানাডায় প্রতি বছর বাইশ হাজার নতুন রোগি ডায়াগনোসড হয়, মারা যায় পাঁচ হাজার জন । বয়সের সাথে সাথে এই রোগের সম্ভাবনা বাড়ে, পঞ্চাশের আগে ঝুঁকি কম থাকে । মিতির বয়সী এক হাজার জনের মধ্যে দুই দশমিক ছয় জন আক্রান্ত হয় । যদিও কম বয়সী নারীদের মধ্যে এর প্রকোপ তুলনামূলক কম, কিন্তু রোগের তীব্রতা তাদের মধ্যেই বেশী ।

ডাক্তার চ্যাডউইক রাফাতের প্রশ্নের জবাবে বলল, “Mr Husain, I can give you whole lot of statistics about breast cancer that might not mean anything to you. So far, the statistics supports that the incidence rate is low before fifty. But, for your wife, I guess it is simply a matter of whether she has it or not. Now come on to your last question, let me explain how the cancer cells work.” বলেই সে তার প্যাডের ওপর ছবি আঁকতে শুরু করল । মেয়েদের স্তনের এনাটমিক্যাল ছবি এঁকে ব্যাখ্যা শুরু করল ডাকটাল কারসিনোমা ইন সিটু, সংক্ষেপে ডিসিআইএস কোথায় কিভাবে হয় । স্তন ক্যান্সারের আরো একটি ধরণ থাকলেও ডিসিআইসি-এর হারই বেশী, মিতির ক্ষেত্রেও টিউমারটি হয়েছে ডাক্টের মধ্যেই । স্তনের ভেতরের দুধের গ্ল্যান্ডগুলোকে বলা হয় “ডাক্ট”। সেখানেই ইনভেসিভ ক্যান্সার কোষ বিভাজিত হয়ে হয়ে টিউমারের পরিনত হয় । তারপর কোন এক সময় গ্ল্যান্ডের দেয়াল ভেদ করে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে দেহের অন্য অর্গানগুলোতে । মানবদেহে তরল পদার্থ প্রবাহের জন্য ছড়িয়ে আছে জালের মত অসংখ্য সরু নালিকা, যাদেরকে বলা হয় “লিম্ফনোড” । ইনভেসিভ ক্যান্সার মূলতঃ এই লিম্ফনোডের মাধ্যমেই অন্য অর্গানে সংক্রমিত হয় । ডাক্তারের ব্যাখ্যা শেষ হলে রাফাত একগুঁয়ে গোয়ারের মত শেষ চেষ্টা করল, “I understand how breast cancer can spread. But, she does not have any symptom other than this tumor. And she just found it two weeks ago. Why would you think that it might have gone to that extent?”

ডাক্তার এবারে রাফাতের দিকে প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর মিতির রিপোর্টের দিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে মিতিকে জিজ্ঞেস করল, “You never felt this tumor before that very evening?”

মিতি বিষন্ন কন্ঠে জবাব দিল, “Perhaps not. I don’t remember. Sometimes, I might have felt something occasionally. But you know women in my age do feel some kind of thickness in their breast, which is normal.”

“Exactly, young women like you do feel this kind of thickness before or during their regular cycle. That is the danger about young women. Often they simply ignore it. By the time they go to doctor it is not in early stage anymore. Considering the size of your tumor, which is already three point five centimeter, I can tell this has been with you at least one year, if not more than that. Therefore, I need to check your whole body in order to see what exactly I am dealing with before taking further steps.”

কথা শেষ করে ডাক্তার রিকুইজিশন ফর্মের ওপর মিতির নাম লিখে একে একে এম.আর.আই., বোন স্ক্যান, আল্ট্রা সাউন্ড টেস্টের জন্য অর্ডার লিখতে লাগল । ফর্মের মাথায় বড় বড় অক্ষরে “এমারজেন্সী” লিখে দিল । টেবিলের অন্য পাশে ওরা দু’জন নির্বাক বসে থাকল…….

চলবে…

………………………………………………………………………
আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রানে……… রবীন্দ্রনাথ


মন্তব্য

শিশিরকণা [অতিথি] এর ছবি

লেখা খুব সুন্দর হচ্ছে। নিয়মিত পড়ছি।

বইখাতা এর ছবি

পড়ছি এই সিরিজটা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।