দাম্পত্য কিংবা কোলবালিশ জীবন

টিটো রহমান এর ছবি
লিখেছেন টিটো রহমান (তারিখ: বুধ, ০৫/০৩/২০০৮ - ১২:২৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
মুরাদ আজ সারাদিন তার ড্রয়িং রুমে টেলিফোনের পাশে বসে আছে একটা কল পাবার আশায়। কলটা তার বউ নাজমার। সে সম্প্রতি মুরাদকে অনেক দোষে দুষ্ট করে তার বাপের বাড়ি গিয়ে উঠেছে। তাদের চার বছরের বিবাহিত জীবনে এটাই তাদের বিচ্ছেদের প্রথম বিশেষ দিন। আজ তাদের চতুর্থ বিবাহবার্ষিকী। এবং মুরাদ নাজমাকে অসম্ভব ভালবাসে।

নাজমাও যে মুরাদকে ভালবাসে না এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যাবে না। কারণ না ভালবেসে পূর্ণ মনোযোগের সাথে চার বছর সংসার করা যায় না। অবশ্য খুব যে ভালবাসে এ কথাও জোড় গলায় কেউ বলতে পারবে না। মোদ্দাকথা নাজমাকে ঠিক মত চেনা যায়নি।
শুধু এইটুকু বলা যায়, সে আর সবার মত না।

এক একটি মেয়ের প্রবাল্য এক এক রকম। কেউ সাংসারিক, কেউ স্বাধীনচেতা, কেউ বন্ধুবৎসল, কেউ স্বামীকেন্দ্রিক। নাজমা মাতৃসুলভ। প্রবল তার মাতৃক্ষুধা। বিয়ের শুরু থেকেই তার সকল চিন্তা কাল্পনিক একটি ছোট্ট শিশুকে ঘিরে। স্বামী নয়, সংসার নয়, তার একটা সন্তান চাই।

কিন্তু প্রকৃতি এমন উপযুক্ত পরিবেশেই খেলতে ভালবাসে। তাদের পরিবারে তাই কোন শিশু নেই। মুরাদ এই দোষে দুষ্ট। আর তাই এই বিশেষ দিনেও নাজমা এখন তার বাপের বাড়ি। মুরাদ সারাদিন তার ফোনের আশায় ।
কারণ মুরাদ নাজমাকে অসম্ভব ভালবাসে।

কিন্তু নাজমার ফোন আর এলো না। এসেছে দূরের আত্মীয় স্বজনদের শুভেচ্ছা, যারা আনেক কিছুই জানে না। আত্মীয় স্বজনদের শুভেচ্ছা মুরাদকে কাঁটার মত বিঁধছে। স্বাভাবিক। দুর্বল সময়ে মানুষ কত কি না ভাবে! আজ মুরাদের নিজের দুর্বলতার কথা বারবার মনে হচ্ছে। আরও মনে হচ্ছে, আত্মীয় স্বজনরা সব জেনেশুনেই বোধ হয় তাকে খোঁচাচ্ছে।

রাতে, ঠিক বারোটায় সে টেলিফোনের লাইনটা ছিড়ে উঠে দাঁড়ায়। না খেয়ে যখন সে বিছানায়, ঠিক তখন নিজেকে তার ভিষণ নিসংগ, একাকী আর জড় মনে হয়। মনে হয় ঘড়িটাও তার চেয়ে প্রাণবন্ত। কেমন টিক টিক করে বাজতে পারে ওটা। সে ঘড়ির দিকে তাকায় এবং বলে- ঘড়ি, এই মুহূর্তে তুমি হয়ত আমার চেয়েও জীবন্ত। কিন্তু আমি জানি, তুমি কখনো উল্টা ঘুরতে পারবে না। আমি পারব। আমি নাজমার বাসরে হানা দেব।

মুরাদ ব্যস্ত হয় স্মৃতি রোমন্থনে। ঠিক মনে পড়ে তাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম রাত। নাজমার লাল শাড়ি। পার্লারে বেঁধে দেয়া চুল। তার ব্যস্ত হাত। গোলাপী অন্তর্বাস। নাভীর কাছের কালো তিল।
মুরাদের সর্বাঙ্গে জ্বলন শুরু হয়। আস্তে করে সে তার প্রিয় কোল বালিশটাকে টেনে নেয়। আর কি বা টানতে পারে সে? এই ঘরে একমাত্র কোলবালিশ ছাড়া আর কিই বা আছে মানুষের মত। এমনকি স্বয়ং সে ও না।

কোলবালিশটা আগে তার বিছানায়ই থাকত। যখন নাজমার সাথে তার বিয়ের কথা হচ্ছিল তখন এটাকে নাজমা বানিয়ে কত কথা বলত! কিন্তু নাজমা বাস্তবে তার জীবনে আসার পর কোলবালিশটা বাড়তি কিন্তু ফেলা যায় না এমন জঞ্জালের সাথে আশ্রয় নেয়, তাদের শয়ন কক্ষের কোনে। কারণ নাজমার কোল বালিশ পছন্দ নয়।
আজ ভিষণ নিসংগ, একাকী আর জড় সময়ে ওটাকে আবার সে তুলে আনে। তার পাশে, একই বিছানায়, ঠিক যে পাশটায় নাজমা ঘুমায়।
এরপর নাজমার বিকল্প সঙ্গি হিসেবে এটা স্থায়ি হয়ে যায় বেশ কিছুদিন।

২.
মাস খানেক পরে। একদিন নাজমা ফিরে আসে। মুরাদ খবরটা পায় দুপুর বেলা। ফোনে। কাজের ছেলেটিই জানায়। নাজমা এসেছে?নাজমা এসেছে!
কাজেই অর্ধবেলার অফিস কামাই করে মুরাদও ফিরে আসে।

নাজমা গেস্টরুম সাজিয়ে নিয়েছে তার থাকার জন্য। সারাদিন মুরাদ আনেকবার অর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু নাজমার ব্যাক্তিত্বের কাছে পাত্তা পায়নি। তা না পাক, নাজমা ফিরে এসেছে এই খুশিতেই সে আটখানা হয়ে যেতে পারে, চাঁদে যেতে পারে, পাহাড় থেকে লাফ দিতে পারে, এমনকি প্রতিদিন যেই কাকটা তার জানালার ধারে তাড়স্বরে চ্যাচায় তাকেও ক্ষমা করে দিতে পারে। মোদ্দা কথা ভিষণ খুশি সে।

কথা পর্ব রাতেই হল। খাবার টেবিলে। এবং নাজমাই শুরু করল। বলল, তুমি ভেব না আমি তোমার জন্য ফিরে এসেছি। আসলে ভাইয়া ছাড়া বাড়ির আর কেউ আমার সমস্যা বুঝতে চায় না। সে আমার আবার বিয়ে ঠিক করেছে। বাকিরা সবাই কোন এক বিচিত্র কারণে তোমাকে পছন্দ করে। তাই বাসায় আনেক বাজে বাজে কথা শুনতে হয় আমাকে। বাসার পরিবেশ সারাক্ষণই গুমোট হয়ে আছে। আমি আর বাসায় থাকতে পারছিলাম না। আত্মীয় স্বজনদের বাসায়ও একই কথা, আমি নাকি ভিষণ সেলফিস। যাই হোক that's my prob. i 've to solve. আপাতত তোমার বাসাটাই সবচেয়ে নিরাপদ মনে হল। আমি কয়েকদিন থেকেই চলে যাব। just পরিস্থিতিটা ঠান্ডা হোক।
মুরাদ আর কি করে? পূর্ণ সম্মতি না দিয়ে তার কোন উপায়ই যে নেই! সেই সঙ্গে বাড়তি যোগ করে নাজমার পরবর্তী বিয়ের অগ্রিম শুভেচ্ছা। এমন কি পরবর্তী স্বামীর সাথে ঝগড়া হলেও যে সে এখানে এসে সানন্দে থাকতে পারবে তার অগ্রীম নিমন্ত্রন ও নিশ্চয়তা।

নাজমা তার গেস্ট রুমে চলে গেল। মুরাদ তার রুমে। এবং কোলবালিশ নিয়ে যথাপূর্বম। একবারে হঠাৎই চিন্তাটা এল তার।
নাজমা তো পাশের রুমেই। তার বিয়ে করা বউ। একান্ত আপনজন। রক্তমাংসের হোমোসেফিয়েন্স, যাদের রাগ থাকে, দুঃখ থাকে, অভিমান থাকে আর থাকে ক্ষমা করার মহৎ প্রবনতা। তার কি একবার বুঝিয়ে বলা উচিৎনা, যে দোষে তার কোন হাত নেই তার জন্য তাকেই অপরাধী করা কতটা যৌক্তিক?

মুরাদ অনেক সাহস নিয়ে নাজমার ঘরে ঢোকে। বাইরের নীল আলোয় দেখা যায়, নাজমার চোখে জল। আদর করছে একিট কোলবালিশ।
মুরাদ চমকে ওঠে। যে নাজমা কোলবালিশ পছন্দ করে না
তারও তার মতই অবলম্বন তাহলে কোল বালিশ?!
তবে নাজমার কোলবালিশটা অনেক ছোট ।
(অনেকটা শিশুদের মত)।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আহারে... অসম্ভব সুন্দর একটা লেখা। মাতৃত্ব যে অন্য কিছুর চেয়েই বড় হতে পারে না। ধন্যবাদ।

--------
কুচ্ছিত হাঁসের ছানা

মাহবুব লীলেন এর ছবি

বালিশ দীর্ঘজীবী হউক

টিটো রহমান এর ছবি

@অতিথি লেখক |

অসম্ভব সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ

@মাহবুব লীলেন |
হুমমমমমমমমমমমম। বালিশ দীর্ঘজীবী হউক

ধুসর গোধূলি এর ছবি
স্বপ্নাহত এর ছবি

এর আগে আপনার লেখা "বউ কথা কউ" পড়েছিলাম।
ঐটা তো পুরা পাংখা...
এইটাও জোস লাগলো হাসি

=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=
বুকের মধ্যে আস্ত একটা নদী নিয়ে ঘুরি

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

টিটো রহমান এর ছবি

জেনে খুব খুশি লাগছে

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

হাসি
ভালো

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

টিটো রহমান এর ছবি

@ধুসর গোধূলি
- জয় বাবা কোলবালিশ!

সহমত

@লুৎফুল আরেফীন |
ধন্যবাদ, পড়ার জন্য

নজমুল আলবাব এর ছবি
টিটো রহমান এর ছবি

বেশ লাগল শুনে

অতিথি লেখক এর ছবি

কোলবালিশ...

টিটো রহমান এর ছবি

কোলবালিশ...কোলে থাকিস

অতিথি লেখক এর ছবি

এসব ক্ষেত্রে অভিমান ভেঙ্গে একজনকে না একজনকে এগিয়ে আসতে হয়
নাহলে দুজনেই পোড়ে

- ক্যামেলিয়া আলম

টিটো রহমান এর ছবি

ঠিক।

জাহিদ হোসেন এর ছবি

বালিশ না থাকলে হয়তো ওরা একে অন্যের কাছে ফিরে যেতো।
বালিশ নিপাত যাক!
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

টিটো রহমান এর ছবি

তাই কি?

রায়হান আবীর এর ছবি

ভাল লাগলো বস...

---------------------------------
এসো খেলি নতুন এক খেলা
দু'দলের হেরে যাবার প্রতিযোগিতা...

টিটো রহমান এর ছবি

ধন্যবাদ

হযবরল এর ছবি

দারূণ লাগলো।

কোলবালিশ দুভাবেই কাজে দেয় দেখা যাচ্ছেঃ
১। দুঃসময়ের সঙ্গী
২। এনার্কিস্ট ক্যাটালিস্ট, বালিশ না থাকলে তারা কাছাকাছি হতেও পারতো।

টিটো রহমান এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

সেইরকম, সে-ই র ক ম একটা গল্প।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।