শেয়ার বাজার নিয়ে একটি ‌'মূর্খ ভাবনা'

আরিফ জেবতিক এর ছবি
লিখেছেন আরিফ জেবতিক (তারিখ: শুক্র, ২১/০১/২০১১ - ৫:১৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গত কয়েকদিন ধরে দুপুর বেলা বাইরে বের হওয়া যাচ্ছে না। আমাদের দেশের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা রাস্তাঘাট অবরোধ করছেন, ইচ্ছেমতো গাড়ি ভাংচুর করছেন। দুপুর বেলা তাই এই রাজধানী শহরে লোক চলাচল কমে গেছে। আগামী রবিবার সিলেটবাসী হরতাল ডেকেছেন, দেশে যে কেউ হরতাল ডাকলেই সেটা পালিত হয় সুতরাং নিশ্চিত বলা যায় এই হরতালও পালিত হবে, হরতালের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে দেশের অন্যান্য স্থানে এমনকি সারাদেশে একটি হরতাল আহ্বান করা হলেও আশ্চর্যের কিছু থাকবে না।

বিরোধী দল বিএনপি ইতিমধ্যেই শেয়ার বাজারের ধ্বসকে পূঁজি করতে শুরু করেছে।
সরকারের দুইবছর পূর্তি উপলক্ষে দেওয়া খালেদা জিয়ার মূল্যায়ন বক্তৃতায় আলাদা ভাবে শেয়ার মার্কেটের ধ্বসের জন্য সরকারকে দায়ী করা হয়েছে। ৯৬ সালের ধ্বসের কারনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করা হয়, এ জন্য আওয়ামী লীগের মাঝে শেয়ার বাজার নিয়ে একধরনের ভীতি কাজ করে।

গত মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে যখন মার্কেট কমতে থাকে, তখন বিনিয়োগকারীদের চাইতেও বেশি অস্থির দেখা গেছে সরকারকে। মার্কেটকে স্থির রাখতে অনেকগুলো গোপন বৈঠক হয়েছে। এ বৈঠকের রেশ ধরে মার্কেটের জন্য যে সিদ্ধান্ত এসেছে সেগুলো আসলে মুমুর্ষ শেয়ার বাজারকে কফিনের দিকে ঠেলে দেয়াকে আটকাতে পারে নি। পড়ন্ত মার্কেটে ঋণের অনুপাত ১: ৩ করে দিয়ে যে লাভ হবে না, সেটি বুঝতে অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না।

নানা ধরনের নিয়ন্ত্রন চালু করার চেষ্টা করেও এই শেয়ার মার্কেটের পতন ঠেকানো আসলে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ এই নিম্নমুখীতাকে হয়তো ঠেকা দিয়ে কয়েকদিন আটকে রাখতে পারবে, কিন্তু আইসিইউতে ঢুকে পড়লে সে রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা যে কমে যায়, সেটা মেনে নেয়াই ভালো।

সবচাইতে বিরক্তিকর বিষয় হচ্ছে সরকার শেয়ার মার্কেটকে ৯৬ সালেও উৎসাহিত করতে গিয়ে ফটকা ব্যবসায়ীদেরকে সুযোগ করে দিয়েছে, এবারও এর ব্যতিক্রম হয় নি। বানিজ্যিক ব্যাংকগুলো শিল্পখাতে ঋণ না দিয়ে শেয়ার মার্কেটে ফটকা খেলতে এসেছে। এরা কোটি কোটি টাকার শেয়ার কিনে রেখেছিল। যখনই বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজারকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য ব্যাংকের ডিপোজিট বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে তখন তারা হুট করে একসঙ্গে সব শেয়ার বাজারে ছেড়ে দিয়ে বাজারকে ধ্বসিয়ে দিয়েছে। বুক বিল্ডিং পদ্ধতির নামে হাবিজাবি দুনিয়ার সবগুলো কোম্পানিকে সুযোগ দেয়া হয়েছে, তারা বাজারে অতিমূল্যায়িত হয়েই এসেছে এবং মার্কেট থেকে প্রচুর টাকা নিয়ে বেরিয়ে যেতে পেরেছে।

এখনকার সবচাইতে বড় বিপদ হচ্ছে তথাকথিত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের চাপ। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা রাস্তাঘাট অবরোধ করে, হরতাল করে এবং ভোটের বাজারে এই ৩০ লক্ষ বিও একাউন্টধারী এবং তাদের স্ত্রী/স্বামীর ভোট বড় একটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে। আমি কথা বলে দেখেছি, এদের ৮৫ শতাংশই ( আমার কথা বলা ২০ জনের মাঝে ১৭ জন) শেয়ার মার্কেটের পতনের জন্য সরকারকে দায়ী করে, যদিও ঠিক কিভাবে সরকার এই পতন ঘটিয়েছে সেটি নিয়ে এই ১৭ জনের কেউই আমাকে কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।

এই অবস্থায় শেয়ার মার্কেট নিয়ে বিকল্প ভাবনার সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয়।
আমরা উল্টো পথে ভাবতে পারি ব্যাপারটা।
আমি প্রস্তাব করছি, এই মার্কেট থেকে তথাকথিত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদেরকে দূরে সরিয়ে রাখা হোক। শেয়ার মার্কেটের ফুলে ফেপে উঠার কারন এই হুজুগে পাবলিক, যারা না বুঝেই নিজেদের টাকা এই বাজারে ঢুকিয়ে বসে থাকেন।

সমস্যা হচ্ছে এরা কোনো শেয়ার ভালো কোনটি খারাপ সেটি বুঝতে পারেন না। পুরো বাজার চলছে গুজবের উপর নির্ভর করে। সিএমসি কামাল নামের শেয়ারটি কোনো কোম্পানির এবং এরা কী উৎপাদন করে সে বিষয়ে কোনো ধরনের ধারনা ছাড়াই আমার পরিচিত অন্তত ১১ জন এই শেয়ারটি কিনেছেন। পিই রেশিও কি এ বিষয়ে আমার ট্রেড করা হাউসে কারো কোনো ধারনা আছে বলে আমি দেখি নি।

এরা যা করেন তা আসলে একটি দেশের স্টক এক্সচেঞ্জের জন্য সুস্থ কোনো বিষয় নয়।

আমার দৃষ্টিতে এই বাজারকে ঠিক করতে হলে নিচের প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনা হতে পারে।

১. মার্কেটকে কোনো ধরনের কৃত্রিম প্যাকেজ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা না করে নিজের মতো করে পড়তে দেওয়া। বাজার একটি নির্দিষ্ট স্তরে না আসা পর্যন্ত আবার ঘুরে দাঁড়াবে না। তাকে তার স্বাভাবিক গতিতেই পড়তে দিতে হবে। এতবড় মার্কেটকে বাঁচিয়ে তোলার মতো আর্থিক সামর্থ্য সরকারের নেই, সুতরাং কোনো বেইল আউট প্যাকেজের চিন্তা করাটা অবান্তর।

২. আগামী ৬ মাস বা ১ বছরের মেয়াদ দিয়ে সেকেন্ডারি মার্কেটের বিস্তারে নিয়ন্ত্রন আরোপ করতে হবে। পাড়ায় মহল্লায় এবং গ্রামে গ্রামে ব্রোকারেজ হাউজ চালু করা বন্ধ করা উচিত। বিশ্বনাথ কিংবা তাজপুর বাজারের অলস টাকা সরাসরি শেয়ার বাজারে চলে আসা অর্থনীতির জন্য ভালো কোনো খবর হতে পারে না। একেকটি ব্রোকারেজ হাউজের ২০ থেকে ৩০টি শাখা আছে, এগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

৩. অতি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য সেকেন্ডারি মার্কেটে প্রবেশ নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। নূন্যতম ২০ লক্ষ টাকা ছাড়া কারো সরাসরি মার্কেট এক্সেস বন্ধ করে দিতে হবে। এতে করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা কমে যাবে। অনূর্ধ ২০ লক্ষ টাকার বিনিয়োগকারীদের জন্য মিচুয়াল ফান্ড কিংবা অন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। বিনিয়োগকারীরা সেখানে টাকা দেবেন এবং প্রতিষ্ঠান এসব ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পক্ষে ফান্ড ম্যানেজ করবে। বছর শেষে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা লাভ ক্ষতির অংশীদার হবেন। এতে করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ারের শক্তি দেখে একেকটা শেয়ার কিনবেন, জেড ক্যাটাগরির শেয়ার কিনতে লাফিয়ে পড়বে না। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা তখন ফটকা মানসিকতা থেকে বেরিয়ে দীর্ঘস্থায়ী বিনিয়োগের ব্যাপারটা মাথায় রাখতে পারবেন।


মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

যখনই বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজারকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য ব্যাংকের ডিপোজিট বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে তখন তারা হুট করে একসঙ্গে সব শেয়ার বাজারে ছেড়ে দিয়ে বাজারকে ধ্বসিয়ে দিয়েছে।

অনেকে দেখি বাংলাদেশ ব্যাংককে দোষারোপে ব্যস্ত। অতিমূল্যায়িত বাজারে ফাটকা মুনাফার ধারা অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব হতে পারে না। বাণিজ্যিক ব্যাংকের অর্থ যাতে ফাটকা কারবারে না গিয়ে শিল্প বা সেবাখাতে যায় সেদিকটা আরো কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রন করা উচিৎ। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এই নিয়তে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা নেয় তাহলে আমি তাদের পদক্ষেপ সমর্থন করবো।

আমি প্রস্তাব করছি, এই মার্কেট থেকে তথাকথিত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদেরকে দূরে সরিয়ে রাখা হোক।

এটা বাস্তবসম্মত হবে না। হবে না এই কারণে যে ক্ষুদ্রদের চিহ্নিত করতে নীতিনির্ধারকেরা যেই ফ্লোর সেট করবেন সেটা কয়েকদিনের মধ্যেই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারিরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপ করে বাইপাস করে ফেলবেন। এরপর আগের অবস্থাই হবে।

মার্কেটকে কোনো ধরনের কৃত্রিম প্যাকেজ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা না করে নিজের মতো করে পড়তে দেওয়া।

বেইল আউটের প্রশ্নই ওঠে না। সবাই নিজ দায়িত্বে মুনাফা লুটতে গেছে। লস খেলে সেটাও প্রাথমিকভাবে নিজের দায়িত্ব।

আগামী ৬ মাস বা ১ বছরের মেয়াদ দিয়ে সেকেন্ডারি মার্কেটের বিস্তারে নিয়ন্ত্রন আরোপ করতে হবে। পাড়ায় মহল্লায় এবং গ্রামে গ্রামে ব্রোকারেজ হাউজ চালু করা বন্ধ করা উচিত।

এটা করে লাভ নেই। ব্রোকারেজ হাউজগুলো ব্যবসা করার জন্য টাকা অর্জন করতে পারছে বলেই এই সম্প্রসারণ। আজ হোক কাল হোক সবকিছু অনলাইন হবে এবং তখন এই বিস্তার কোনভাবেই ঠেকানো যাবে না।

অতি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য সেকেন্ডারি মার্কেটে প্রবেশ নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। নূন্যতম ২০ লক্ষ টাকা ছাড়া কারো সরাসরি মার্কেট এক্সেস বন্ধ করে দিতে হবে।

এই প্রস্তাব সম্পর্কে উপরে বলেছি। এই কাজ করলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারিরা ছোট ছোট গ্রুপে একজোট হয়ে ব্যবসা শুরু করবে।

অতিথি লেখক এর ছবি

বেইল আউটের প্রশ্নই ওঠে না। সবাই নিজ দায়িত্বে মুনাফা লুটতে গেছে। লস খেলে সেটাও প্রাথমিকভাবে নিজের দায়িত্ব।

ওবামা সরকার কত বেইল আউট দিল আমেরিকার অর্থনীতি বাঁচাতে! আর আমাদের সরকার একটা বেইল আউট না দিলে কী মান থাকে? আমি মোটামুটিভাবে অপেক্ষায় আছি বেইল আউটের ঘোষণার জন্য। -রু

হাসিব এর ছবি

ওবামা সরকারের বেইলআউট বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না। ওখানে কোম্পানি বাচাতে বেইল আউট দেয়া হয়েছিলো। শেয়ার মার্কেটে কে লস খেল সেই বিষয়ে না।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

১. বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ সঠিক আছে। আমি একমত। তবে ব্যাংকগুলো যাতে এই কাজে জড়িয়ে না পড়ে সেটা আরো আগে থেকে খেয়াল করা প্রয়োজন ছিল।

২. আমি সমবায় সমিতি বানিয়ে এই বাইপাসটাকে মাথায় রাখছি এবং এটার মাঝে শুভ ফল দেখছি। আমাদের একটা সিন্ডিকেট আছে, যেখান থেকে এভাবে গ্রুপ তৈরী করে মুলধন বড় করা হয়েছে। এই একাউন্টে লস হয় নি, কারন কয়েকজনের স্বার্থ জড়িত থাকে বলে বিনিয়োগে তুলনামুলক সচেতনতা ছিল। সব স্টেক হোল্ডারের একেক মতামত ছিল। ভালো শেয়ার কেনা হয়েছে।
কিন্তু ব্যক্তিগত একাউন্টে একক ভাবে ঝুঁকি নেওয়া যায়, সেই ঝুঁকির ফল সবসময় ভালো হয় না। মারি তো গন্ডার, আর হারালে যায় পুরো ভান্ডার। অধিকাংশই গুজব নির্ভর শেয়ার কেনা হয় ব্যক্তিগত একাউন্ট থেকে।

৩. নাহ্, অনলাইন হওয়া আর ব্রোকারেজ হাউসের শাখা নেওয়া এক জিনিস নয়। ব্রোকারেজ হাউসের শাখা যারা নেয়, তারা ব্যবসা করার জন্য পাগল থাকে। কারন তাদেরকে বাড়িভাড়া ও অন্যান্য খরচ দিতে হয়,কমিশনের একটা ক্ষুদ্র অংশ এরা পায়। সিলেটে এখন পানের দোকান থেকে ব্রোকারেজ হাউসের শাখা বেশি। প্রতি পাড়া মহল্লায় কয়েকটি করে আছে। এরা তখন ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে উৎসাহিত করে। আমার পরিচিত এক মহিলাকে গিয়ে ১ বছরে ৩ গুন লাভের কথা বলে উনার সঞ্চিত সাড়ে ৪ লাখ টাকা এরা এনেছে। এই মহিলা কি কিছু বুঝেন? এখন উনার সাড়ে ৪ লাখ টাকার অর্ধেকও ফেরত পাবেন কি না আমার সন্দেহ আছে। সবই জুয়ারি শেয়ার উনার কাছে। এই ব্রাঞ্চঅলারা ট্রেডিংয়ের জন্য পাগল থাকে, আপনি কিনেন আর বেচেন, দুটোতেই ওদের লাভ, তাই চেষ্টা থাকে আপনি যাতে প্রতি সপ্তাহে অন্তত ৩ বার কেনাবেচা করেন।

হাসিব এর ছবি

১. একমত।
২. এই জাতীয় যৌথ উদ্যোগের ফল তখনি ভালো হতে পারে যখন উদ্যোক্তারা একটু মাথা খাটানোর ক্ষমতা রাখেন। আমার নিজের ধারণা এই জাতীয় গ্রুপের সংখ্যা হুজুগে মাতা গ্রুপের সংখ্যার থেকে অনেক কম হবে।
৩. ভালো পয়েন্ট।

অতিথি লেখক এর ছবি

১. মার্কেট থেকে সাধারন বিনিয়োগ কারীদের সরানোর আইডিয়াটা হাস্যকর। আমাদের বাজার এফিসিয়েন্ট নয় সেটা বিনিয়োগ কারীদের দোষ নয় আওয়ামীলীগ সরকারেরও নয় বরং অর্থ ও সরকার ব্যাবস্থার। একটা মার্কেট এফিসিয়েন্ট করার দায়িত্বও সরকারের বিনিয়োগকারীদের নয়। এজন্য অবকাঠামো দরকার। শেয়ার মার্কেটকে আমাদের এখানে দেখা হয় টাকা কামানোর মেশিন হিসেবে কিন্ত এটা আসলে সাধারন মানুষের সঞ্চয়কে উত্‍পাদনমুখী খাতে প্রবাহিত করার চ্যানেল মাত্র। শেয়ার বাজার থেকে সাধারন উদ্যোক্তাদের সরালে এর সাধারন উদ্যেশ্য ব্যাহত হবে এবং রোগ না সারিয়ে উপসর্গ সারানোর মত ব্যাপার হবে।

২. বুক বিল্ডিং পদ্ধতির সমস্যা কী? এ পদ্ধতিতে এর বেইজ তো ইনিস্টিটিউশনাল ইনভেস্টররা ঠিক করে। অন্য পদ্ধতিতেও তো একশটাকার শেয়ার প্রথমদিনেই হাজার টাকা পেরোয়।

৩. আমাদের বিনিয়োগ কারীরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিয়ে কাদা ছুড়তেই বেশি অভ্যস্ত। এখনো পর্যন্ত আমি কাউকে নিজেকে দুষারোপ করতে দেখি নি। এটা কি আমাদের জাতিগত সমস্যা?

৪. সিকিউরিটি এবং একচেঞ্জ কমিশন এক্ট এর গুণগত পরিবর্তন সাধন করা দরকার। sec এর হাতে প্রায় ইশ্বরের সমান ক্ষমতা। অথচ এর কর্তা ব্যাক্তিরা প্রায় সবাইকেই সরকার নিয়োগ দেয় এবং মূলত আমলা। চেয়ারম্যান সহ বোর্ডের সদস্য সংখ্যা কমপক্ষে পাঁচজন এবং তিনজনে কোরাম হয়। কোরাম পুরণ হলেই (চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকলেও) যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে এরা। অথচ এদের যোগ্যতা কী হবে সেটার ব্যাপারে কড়া কোন আইন নেই। এরা কেউই এ ব্যাপারে প্রফেশনাল নয়। আমার সাজেশন হবে আগে কোন একচেঞ্জ এ কাজকরার অভিজ্ঞতা না থাকলে কাউকেই এখানে নিয়োগ দেয়া উচিত না। প্রয়োজনে আপাতত বিদেশ থেকে লোক হায়ার করে চালাতে হবে এবং দেশিগুলারে বাইরের একচেঞ্জগুলাতে কাজকরতে পাঠাতে হবে। শেয়ার একচেঞ্জ খুব হালকা কিছু না, অনেকখানি টেকনিক্যাল, এতগুলা মানুষের পুজির নিরাপত্তা এমন হালকা অবকাঠামোর উপর ছেড়ে দেয়া যায় না।

-রাখাল বালক

হাসিব এর ছবি

১. কী কী অবকাঠামোগত সংস্কার হলে মার্কেট এফিসিয়েন্ট হতে পারতো বলে মনে করেন?
৪.

প্রয়োজনে আপাতত বিদেশ থেকে লোক হায়ার করে চালাতে হবে এবং দেশিগুলারে বাইরের একচেঞ্জগুলাতে কাজকরতে পাঠাতে হবে।

এই প্রস্তাব নিঃসন্দেহে এসএইসির লোকজনেরা মাথায় নেবে। তবে বিদেশি লোকজন এখানে এসে কী সুবিধা করতে পারবে এটা নিশ্চিত না। বিদেশী লোকজন বাংলাদেশের মতো মার্কেট চালাতে কী অতিরিক্ত যোগ্যতা দেখাতে পারবে বলে মনে হয়?

গৌতম এর ছবি

শেয়ার মার্কেটের ব্যাপার-স্যাপার কিছু বুঝি না। কিন্তু বারবার কোনো এক কারসাজিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেটা সবার কাছেই পরিষ্কার, যদিও এই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য সরকারকে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।

তাও ভালো- আজকে অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, এই অবস্থান জন্য তাঁর কিংবা সরকারেরও কিছু ভুল রয়েছে। এখন দেখা যাক ভুল শোধরাতে সরকার কী করে।

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

সুচিন্তিত ব্লগ পড়ে ভালো লাগলো। চর্তুথ আরেকটা বিষয় হোলো একটা জনসচেতনতা তৈরী করা। ৯৬ এর শেয়ার ধ্বসের পরও কেনো যে মানুষ গুলো আবার লগ্নী করে কে জানে! অবশ্য সবাই চায় বিনা পরিশ্রমে অর্থ উপার্জন। এই ধরণের মানসিকতা থেকেই হয়ত এসেছে এই লোভ।

হাসিব এর ছবি

৯৬এর পরে কেন মানুষ আসলে একই কাজ করে এর কারণ হয়তো মানুষ আস্তে আস্তে তার পুরনো স্মৃতিগুলো ডিসকাউন্ট করতে থাকে এই ধারনা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। ৯৬ সাল ম্যালা বছর আগের কথা।

আর যেই মানসিকতার কথা বললেন সেইটা বিষয়ে আমিও একমত।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার মতে এ অবস্থার জন্য দায়ী বিনিয়োগকারীরাই... সবাই শেয়ার বাজারে অল্প সময়ে বেশি লাভের জন্য বুঝে না বুঝে টাকা ঢালে... ১০ টাকার শেয়ার ১০০০ টাকা তেও কিনে... এটা কখন বুঝে না যে কোম্পানি যদি সময়ের সাথে গ্রো না করে তাহলে ১০ টাকার মূল্য কখনই ১০০০ টাকাতে যাবে না... সবার ধারনা ১০০০টাকা তে কিনে দাম বাড়লেই বেচে দিবে... কিন্তু কখনও ভেবে দেখে না যে এই কোম্পানির এসেট এত হয় কিনা...আমাদের দেশে হাবিজাবি কোম্পানির শেয়ারও হুহু করে বাড়ে... সাধারন একটা উদাহরণ... কারও যদি এসেট হয় একটা ফ্যাক্টরি যার মুল্য ১ কোটি টাকা এবং লাভ এর হার ৩০%। বছর ঘুরে তার এসেট হবে ১ কোটি ৩০ লক্ষ... কোম্পানি নতুন করে এক্সপান্ড না করলে এসেট কিন্তু আর বাড়ে না... সুতরাং কোন ভাবেই তা ১০গুন বা ১০০গুন হয় না... সেকারনে স্বল্পসময়ে কেউ অনেক টাকা লাভ করা মানে এক সময় কেউ না কী ধরা খাবেই... সমস্যা হল অনেকে সেটা না বুঝেই বাজারে আসে...অথবা বুঝলেও ধরা খাওয়ার মেনে নিতে পারে না...
বিদেশে শেয়ার এর দাম বাড়ে কিন্তু সেই সাথে কোম্পানির এসেটও বাড়ে, যার ফলে বছর শেষে ডিভিডেন্ড দিলেও একটা সামঞ্জস্য থাকে...আমাদের দেশে খুব কম কোম্পানি আছে যারা বছর বছর এক্সপান্ড করে...

সরকার হস্তক্ষেপ করে অবশ্যই নিয়ন্ত্রন করতে পারে কিন্তু তা সাময়িক......

-
বঙ্গসন্তান

হাসিব এর ছবি

শেয়ারপ্রতি একটা ক্যাপ সেট করে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। দোষ দুই পক্ষেরই আছে। নীতিনির্ধারকদের উচিত ছিলো বিষয়টা আগে থেকে চিন্তা করা। বিনিয়োগকারিদেরও কিছু না বুঝে নোংরা লোভের পেছনে দৌড়ানো ঠিক হয় নি।

তাসনীম এর ছবি

এই মার্কেটের মূলমন্ত্র হচ্ছে মানুষের লোভ -- এটা নিয়ন্ত্রন না হলে এই রকম ঘটতেই থাকবে। কয়েক বছর আগে আমেরিকাতে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে শেয়ার মার্কেট কয়েক হাজার পয়েন্ট নেমে গিয়েছিল। যারা বিনিয়োগ করেন তাদের এই ঝুকিটা জানতে হবে এবং বিষয়গুলো ভালো মত বুঝতে হবে। অনির্দিষ্টকাল ধরে স্টক মার্কেটের অস্বাভাবিক উত্থান হলে এক সময় সেটা পড়তে বাধ্য।

ম্যানিউপুলেশন করে দাম বাড়ানো বিচিত্র নয়, এটা হওয়ার সম্ভবনা কম না। এই মার্কেটকে বেইল আউট করে লাভ নেই, এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো উপকার হবে না। স্টক বাড়লে উনারা আবার জমানো টাকা স্টকে ঢালবেন এবং স্টক কমলে গাড়ি ভাঙ্গবেন।

অতি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য সেকেন্ডারি মার্কেটে প্রবেশ নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। নূন্যতম ২০ লক্ষ টাকা ছাড়া কারো সরাসরি মার্কেট এক্সেস বন্ধ করে দিতে হবে। এতে করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা কমে যাবে। অনূর্ধ ২০ লক্ষ টাকার বিনিয়োগকারীদের জন্য মিচুয়াল ফান্ড কিংবা অন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। বিনিয়োগকারীরা সেখানে টাকা দেবেন এবং প্রতিষ্ঠান এসব ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পক্ষে ফান্ড ম্যানেজ করবে। বছর শেষে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা লাভ ক্ষতির অংশীদার হবেন। এতে করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ারের শক্তি দেখে একেকটা শেয়ার কিনবেন, জেড ক্যাটাগরির শেয়ার কিনতে লাফিয়ে পড়বে না। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা তখন ফটকা মানসিকতা থেকে বেরিয়ে দীর্ঘস্থায়ী বিনিয়োগের ব্যাপারটা মাথায় রাখতে পারবেন।

এই আইডিয়াটা মন্দ নয়...সমস্যা হচ্ছে এটা করাও দুষ্কর। মানুষ যদি দেখে শেয়ারে কেউ ৫০% লাভ করছে আর মিউচ্যুয়াল ফান্ডে লাভ ১০%...তখন এই আইনের বাইপাস তৈরি হবে। একটা বিও একাউন্টের পেছনে দেখবেন ২০ জন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী আছে।

লোভ যেই ব্যবসার চালিকাশক্তি সেটা রেগুলেট করা কঠিন।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

অমিত এর ছবি

"মানুষ যদি দেখে শেয়ারে কেউ ৫০% লাভ করছে আর মিউচ্যুয়াল ফান্ডে লাভ ১০%...তখন এই আইনের বাইপাস তৈরি হবে। "
দুইটার রিস্ক-ও সেরকম। এই ব্যাপারটাই অনেকে বোঝেন না।

নৈষাদ এর ছবি

মতিঝিলে যাবার জন্য এখন ‘পশ্চিমের ওয়েদার ফোরকাস্টের’ মত স্টক মার্কেটের উত্থান-পতন দেখতে হয়। তারপরও গত বৃহস্পতিবার ‘ধরা’ খেলাম। দু’টায় কাজ ছিল – একটায় রওয়ানা দিলাম, এর মধ্যেই পাচ মিনিটে মার্কেটের পতন - গিয়ে দেখি ‘প্রতিবাদ’ শুরু হয়েছে।

১। লিখেছেন - "এতবড় মার্কেটকে বাঁচিয়ে তোলার মতো আর্থিক সামর্থ্য সরকারের নেই, সুতরাং কোনো বেইল আউট প্যাকেজের চিন্তা করাটা অবান্তর।" - কিন্তু যতদূর জানি আইসিবির মাধ্যমে সরকার সেকেন্ডারি মার্কেটে টাকা ‘পাম্প’ করা শুরু করেছে। কী অদ্ভুত ব্যাপার। একটা ‘ইনফ্ল্যাটেড ফটকা মার্কেটকে’ সেই ‘ইনফ্ল্যাটেড’ অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার টাকা দিচ্ছে। ‘মার্কেটের স্ট্যাবিলিটির’ মানে হল বছরে ইন্ডেক্স মিনিম্যাম দ্বিগুন হওয়া।

এখনতো এটার আবার একটা পলিটিক্যাল/ভোট-সংশ্লিষ্ট ডাইমেনশন দাঁড়িয়েছে। সরকার তো মরিয়া হয়ে মার্কেটকে ‘স্ট্যাবিলাইজ’ করার চিন্তা করবে।

২। ব্রোকারেজ হাউজের ব্যাপারে অনেকটাই একমত। আরেকটা ব্যাপার হল ব্রোকারেজ হাউজ গুলি প্রান্তিক বিনিয়োগকারীদের ট্রেডিঙের ব্যাপারে উৎসাহ দেয়। খুবই সঙ্গত কারণে - যত কেনাবেচা হবে তাদের কমিশন বাড়বে। ব্রোকারেজ হাউজের গুলির কর্ণধাররা যখন স্টক-এক্সচেঞ্জের কর্ণধার হয় তখন ‘কনফ্লিক্ট অভ ইন্টারেস্ট’ ধারণাটার ব্যাপারে সরকারের চিন্তা ভাবনা নিয়ে মনে প্রশ্নের উদয় হয়। এই কর্ণধাররা ব্রোকারেজ হাউজের বিপক্ষে যায় এই সিদ্ধান্ত কীভাবে নিবে?

৩। দুঃখজনক হলেও এই মূল্যস্থিতি প্রকৃয়ার মাধ্যমে অতি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের একটা বড় অংশ এমনিতেই ‘ঝরে’ যাবে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

একটা প্রচলিত ধারনার কথা বলি। দুইটি রাজনৈতিক সরকারের মাঝখানের একটি অরাজনৈতিক সরকারের সময় রাজনীতিবিদ ও ধনী ব্যবসায়ীদের টাকার পরিমাণ, টাকার উৎস ইত্যাদি নিয়ে নানা রকম হয়রানী, জেল-জরিমানা, মামলা-মোকদ্দমা, রিমান্ড-স্বীকারোক্তি জাতীয় ঘটনাগুলো ঘটে বলে বুদ্ধিমান লোকেরা সাদা টাকা উপার্জনের নানা রাস্তা খোঁজে। ক্ষমতাবান বুদ্ধিমান লোকেদের জন্য শেয়ার বাজার অমন টাকা বানানোর একটা ভালো উপায়। ধরুন, আজ অমন উপায়ে কয়েক শ' কোটি টাকা বানানো গেলে আগামীতে পাঁচ-দশ জন মানুষকে এমপি/মন্ত্রী বানানো যাবে; একখানা ব্যাংক, একখানা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী, একখানা লিজিং কোম্পানী দেয়া যাবে; একটা এফএম রেডিও আর একটা টিভি চ্যানেল দেয়া যাবে; একটা দৈনিক পত্রিকা আর একটা পাক্ষিক ম্যাগাজিন বের করা যাবে; আগামী দিনের ব্যবসাগুলোতে (যেমন কার্বন, এনার্জি ইত্যাদি) খাটানোর জন্য সাদা পুঁজি পাওয়া যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন ক্ষমতাবান বুদ্ধিমানরা কালো কোটে থাকে, কালো চশমায় থাকে, বুট জুতায় থাকে, সাফারী স্যুটে থাকে, খদ্দরের পাঞ্জাবীতে থাকে, দাঁড়ি-টুপি-পৈতা-ক্রশে থাকে। তাই শেয়ার বাজার অযৌক্তিক কারণে পাগলা ঘোড়ার মতো উঠতে থাকে তারপর বোধগম্য কারণে অতলে তলাতে থাকে। আমি এখানে ইকনোমিক্স-ফিনান্সের তত্ত্বের সঠিক/ভুল প্রয়োগ, নিয়ম মানা/না মানা ইত্যাদির চেয়ে রাজনীতিটা বেশি দেখতে পাই।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।