আমাদের ভাষা আমাদের সংস্কৃতি - পর্ব ২

আরশাদ রহমান এর ছবি
লিখেছেন আরশাদ রহমান (তারিখ: বুধ, ১০/১০/২০০৭ - ৯:০১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা রেখে জনগণ যদি ধর্মপরায়ণ হয় তাতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু ধর্মান্ধতা অশিক্ষা এবং অসচেতনতা আমাদেরকে অনেক সময় অনেক অমানবিক, অযৌক্তিক এবং বর্বরোচিত কাজে জড়াতে পারে। ১৯৪৭ এ ভারত ভেঙে বাঙালি পাকিস্তানী হওয়ার পেছনে যেমন ছিল ধর্ম, অশিক্ষা এবং অসচেতনতা, একাত্তরের স্বাধীনতার সময় রাজাকার-আলবদর হওয়ার পেছনেও ছিল তাই। তেমনি স্বাধীনতার এতদিন পরেও ধর্মান্ধতা অশিক্ষা এবং অসচেতনতা বাঙালির অস্তিত্বে আঘাত হানছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে বাংলাদেশ যেহেতু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ আর আমি যদি মনে করি জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ ধর্মান্ধ তাহলে হিন্দির আগ্রাসন নিয়ে এত দুশ্চিন্তার কি আছে? কেননা হিন্দিতো বিধর্মীদের ভাষা! কিন্তু আমাদেরকে আরো গভীর ভাবে চিন্তা করতে হবে। আজকের এই রাজনৈতিক অস্থিরতা, নেতৃত্বের শূন্যতা এবং জনগণের অসহায়তার কারণ আমাদের ধর্মান্ধতা অশিক্ষা এবং অসচেতনতা। হিন্দির প্রসারে বাংলার অস্তিত্ব যে হুমকির মুখে তার পেছনেও এই তিন কারণ মুখ্য ভূমিকা রাখছে। আমরা প্রশ্ন করতে পারি ধর্মান্ধতার সাথে ভাষার কি সম্পর্ক? আমি বাংলাদেশের অনেক ধর্মান্ধকে দেখেছি আরবি শব্দের অযথা প্রয়োগ করতে। একজন ধর্মান্ধ রাজনীতিবিদ কিংবা উচ্চ পর্যায়ের কোন সরকারী কর্মচারী রবীনদ্রনাথ কিংবা আমাদের জাতীয় সংগীত নিয়ে কটুক্তি করলেও পত্রিকায় দুকলম লেখা ছাড়া আর কিছুই হয়না। আজকের এই ধর্মীয় উগ্রবাদের কারণও আমদের ধর্মান্ধতা। একটি ধর্ষণের কিংবা অন্যায় অত্যাচারের খবর পড়ে একজন যুবকের চোখে যে ক্রোধের আগুন আমি দেখেছি তা কিছুটা হলেও নিসপ্রভ হয়ে যেতে দেখেছি শুধু এইটুকু জেনে যে সেই অত্যাচারিত তাঁর ধর্মের কেউ নয়।

বাংলাদেশের বর্তমান এই অবস্থা বাংলার অস্থিত্বের জন্য হুমকি সরুপ। একটি ফরাশি কিংবা জাপানি শিশুকে যদি নোয়াখালী কিংবা চিটাগাং এর আঞ্চলিক ভাষায় কথোপকথন করে এমন পরিবারে লালন পালন করা হয় তবে তাঁর দৈহিক গড়ন যাই হোকনা কেন সে কিন্তু নোয়াখালী কিংবা চিটাগাং এর ভাষাতেই কথা বলবে। যে শিশু প্রতিনিয়ত হিন্দি ছায়াছবি, নাচ-গান আর নাটকের মাঝে বড় হচ্ছে তাঁর ভাষা হবে ভবিষ্যত প্রজন্মের কোন এক ভাষা যা আমদের এই বাংলা নয় যে ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে রফিক সালমা বরকতেরা। বাংলাদেশের জনগণের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে হিন্দি কতটা প্রসার লাভ করেছে তা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা। যে শিশু বড় হচ্ছে এমন এক পরিবেশে তাঁর জীবনে হিন্দির প্রভাব পড়বেনা তা মনে করা চরম অসচেতনতা ছাড়া আর কি হতে পারে?

পাশ্চাত্যের অনুকরণে ভারতীয় অনুষ্ঠান গুলো যখন বাংলাদেশে প্রচার করা হচ্ছে তখন আমাদের বাংলাদেশের বাঙালিদের বুক যেন গর্বে ভরে ওঠে! আমার এই ধারণা অভিজ্ঞতা প্রসূত। আমি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি আমরা দিনে দিনে বাংলা শিল্প সংস্কৃতি থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছি। হিন্দির প্রভাব থেকে আমার কাছের লোকজনও মুক্ত নয়। আমাদের আড্ডার বিষয় চাল চলন সব কিছুতেই এর প্রভাব পড়ছে। জরিপ করলে দেখা যাবে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবে যে আমাদের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, সরকারী-বেসরকারী কর্মচারী এবং বিভিন্ন মহলের নীতি নির্ধারকদের সিংহভাগ দূর্নীতিপরায়ণ। সবাই বলবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যাচ্ছেতাই রকমের অরুচিকর। বলবে নাটকের মান আগের মত নেই। বলবে বাংলায় কিছু দেখা বা শোনার মত নেই বলেইতো হিন্দি দেখছি হিন্দি শুনছি। কিন্তু আমরা যে ভাবে হিন্দি চর্চা করছি তাতে তো মনে হয়না আমাদের উপর জোর করে এই হিন্দির বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। আমি স্বীকার করছি এর শুরুটা হয়েছে আমাদের অনিচ্ছায় কিন্তু আমরা কি কখনো কোন ভাবে প্রকাশ করেছি যে আমরা নিতান্তই বাধ্য হয়ে হিন্দি চর্চা করছি? বরং আমি দেখেছি এর মধ্যে এক ধরনের স্বতঃস্ফুর্ততা আছে। ইতিমধেই হিন্দিকে আমরা অনেক আপন করে নিয়েছি এবং আমাদের কথা বার্তা চালচলনে হিন্দির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। প্রতিদিনের স্বাভাবিক জীবনয যাত্রায় হিন্দির অবাধ বিচরণ। বিয়ে কিংবা জন্মদিনের অনুষ্ঠান হিন্দি গান ছাড়া হতে পারে এ যেন কল্পনাতীত। এমনকি একুশ কিংবা পহেলা বৈশাখ উৎযাপনও হিন্দি প্রভাব মুক্ত নয়।

(আগামী পর্বে শেষ হবে)


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

বাংলা ভাষা বহুভাষার আগ্রাসন মোকাবেলা করেই টিকে আছে এবং আজ এ পর্যায়ে । কারন এ অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা হলেও বাংলা কখনো,বংগের শাসকদের ভাষা ছিলোনা-৭১ এর আগে । আরবী-ফার্সী,উর্দুর সাথে কম্পিটিশন করেই বাংলাকে চলতে হয়েছে । এখনকার আগ্রাসন হিন্দী কারন এ উপমহাদেশের নতুন শাসকের ভাষা হিন্দী । হিন্দীওয়ালারাই এখন দক্ষিন এশিয়ার রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক,সাংস্কৃতিক শাসক । বাংলাকে তাই হিন্দীর সাথে কম্পিটিশন করতেই হবে ।
বাংলাভাষীদের নিজেদের প্রয়োজনেই সচেতন হওয়াটা জরুরী ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

আরশাদ রহমান এর ছবি

তা ঠিক হাসান মোরশেদ। সব ভাষাই বদলায় এবং এটাই নিয়ম। নদীর ধারা বদলাবে তার আপন গতিতে কিন্তু বাঁধ দিয়ে গতিপথ বদলানোর মতই মনে হয় বাংলাদেশের অবস্থা। সব ভাষাতেই নতুন শব্দ যোগ হয়, পরিবর্তন হয় কিন্তু গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ভাষা সংস্কৃতিতে পরিবর্তনটা বেশ চোখে পড়ে।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

সহমত । রাজনৈতিক আগ্রাসন যেমন যে কোনো সময়ের চেয়ে অস্বাভাবিক(প্রতিরোধহীনতা অর্থে),সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও ঠিক সেরকম এই সময়ে ।
আগ্রাসন সব সময়ই ছিলো তবে এতোটা অপ্রতিরোধ্য বোধ হয় ছিলো না কখনো ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

এতো দুশ্চিন্তার কিছু নেই। হিন্দি-আক্রান্তরা আমাদের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর একটি অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ এবং তারা বাংলা সংস্কৃতির নিয়ামক নয়।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

রাগিব এর ছবি

মুহম্মদ জুবায়ের লিখেছেন:
এতো দুশ্চিন্তার কিছু নেই। হিন্দি-আক্রান্তরা আমাদের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর একটি অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ এবং তারা বাংলা সংস্কৃতির নিয়ামক নয়।

জুবায়ের ভাইয়ের সাথে একমত। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ক্যাসেট কিন্তু মমতাজের খাঁটি বাংলা গানের ক্যাসেট, কোনো হিন্দি গান নয়। হিন্দিপ্রিয় মধ্যবিত্তদের চেয়ে বাংলাদেশের আমজনতা সংখ্যায় অনেক অনেক বেশি।

----------------
গণক মিস্তিরি
ভুট্টা ক্ষেত, আম্রিকা
http://www.ragibhasan.com[

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

আরশাদ রহমান এর ছবি

জুবায়ের ভাই, আওয়াজ শুনে ভালো লাগলো। [এতো দুশ্চিন্তার কিছু নেই। হিন্দি-আক্রান্তরা আমাদের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর একটি অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ এবং তারা বাংলা সংস্কৃতির নিয়ামক নয়। ] সংখ্যটা যদি কম হয় তাহলেতো ভাল কিন্তু সংখ্যাটা মনে হয়না যতটা ক্ষুদ্র মনে করেন ততটা ক্ষুদ্র। শহর ছাড়া গ্রামেও দেখা যায় হিন্দি বেশ জমজমাট।
ধন্যবাদ রাগীব। বাংলাকে অবহেলা করেনা এমন লোকের সংখ্যাটা যাতে বেশি থাকে সেই জন্যই সচেতনাতার প্রয়োজন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।