কি লিখবো, কেন লিখবো, কতোটা লিখবো?

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি
লিখেছেন অছ্যুৎ বলাই (তারিখ: সোম, ৩০/০৫/২০১১ - ১২:২০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কবিতা লেখা সবচেয়ে সহজ। বেশি শব্দ খরচ করতে হয় না। অল্পশব্দে অধিক কথা প্রকাশ করা যায় বলে একটা ধারণা প্রচলিত, যদিও ধারণাটা ভুল হওয়ার সম্ভাবিলিটিও প্রচুর। কবিতা লেখার বিপদও আছে। শব্দভাণ্ডারের ক্যাচাল বিশাল ক্যাচাল। মাইকেলের মতো পাঁচজন পণ্ডিতের বন্দোবস্ত করা যেহেতু আম-পাবলিকের জন্য দূর-কল্পনার বিষয়, সেহেতু অভিধান মুখস্ত ভিন্ন উপায় নাই। তবে আম-পাবলিক অতো বোকা না, অভিধান যদি মুখস্ত করতেই হয়, তাহলে ইংরেজিটা দিয়ে শুরু। আগে জিআরই, পরে কবিগিরি। এরপরের ক্যাচাল হলো শব্দগুলো যায়গামতো বসানো। কবিতার আবার কি সব ছন্দ, রঙ, রস, গন্ধ, মিল-অন্ত্যমিলের ক্যাচাল আছে। এসব ক্যাচাল মিটিয়ে কবিতা লেখা কবির পক্ষে সম্ভব, আম-পাবলিকের পক্ষে সম্ভব না। তারপরেও যদি সাহস করে কয়েকলাইন লিখে ফেলা হয়, তাহলে সমালোচকের হাতে পড়লেই খবর আছে।

উদাহরণস্বরূপ,

"শিখা তোরে ভালোবাসি
তোর কালো চুলে নেবো ফাঁসি
তোর হাসিতে মুক্তো ঝরে
তোরে দেখলেই মন কেমন কেমন করে"

এই পিস কোনো ত্যাড়া সমালোচক পর্যন্তও যেতে হবে না, জীবনে কবিতা লিখতে কলম ধরে নাই এরকম পাবলিকের হাতে পড়লেও কবিতা লেখার সাধ বাপ বাপ করে পালাবে, নাস্তানাবুদ হওয়ার খবর অবধারিতভাবে শিখা পর্যন্ত পৌঁছাবে, ভালোবাসা জানালা দিয়ে উসাইন বোল্টের গতিতে পালাবে। এমন রিস্কে কেউ যাবে না, নজমুল আলবাবের কবিতা প্রকাশনায় আর কবিতাও পাঠানো হবে না।

কবিতা বাদ। তাহলে লিখবোটা কি? প্যাট আর চ্যাটের চিন্তায় ক্লান্ত মাথাও আবার হৃদয়ের রোল প্লে করে, আর হৃদয় হলো মহা বদমাশ সেনসিটিভ জিনিস। মহাবিশ্বের কোথাও জল পড়ে, পাতা নড়ে আর তার বোঝা এসে জমা হয় পোঁড়ার হৃদয়ে, হৃদয় বুক ফেটে মরে। সেই বুক ফাটা ঠেকাতেই মুখ ফোটাতে হয়, ভাষার দ্বারস্থ হতে হয়, কী-বোর্ডে হাত চালাতে হয়। মাথা থেকে হৃদয়ের দুয়ারকে গুঁতিয়ে ভাষার যুদ্ধ শেষ করে কী-বোর্ড চালানোর কাজটা অবশ্য কঠিন। যারা লেখক তারা হয় মাথা-টু-কীবোর্ড শর্টকাট মারেন, নাহয় আধুনিক রবীন্দ্রনাথ। আম-পাবলিক তো রবীন্দ্রনাথ না। তাদের প্রতিভা নাই, শর্টকাটের স্কিল নাই; কিন্তু কথা আছে। সোজাসাপটা হিসেবে লেখার বিষয় এই কথাই।

লেখার কারণ জিনিসটা অবশ্য এতো স্পষ্ট না। অসীম সৃষ্টিজগতের তুলনায় পৃথিবী কিছুই না আর পৃথিবীর তুলনায় মানুষ কিছুই না, মানুষের কথাও হয়তো কিছুই না। তবুও 'দাগ রেখে যাওয়ার বাসনা' কার না থাকে? আম পাবলিক সম্ভবত দাগ নিয়ে এতো মাথা ঘামায় না। নিত্যদিনের বাজারের ফর্দ, বউয়ের ঝাড়ি, জামাইয়ের মাতব্বরি, শিক্ষকের রক্ষচক্ষু, হোমওয়ার্কের হাসফাঁস ক্লান্তি আর অলসাকাঙ্ক্ষার ভিড়ে দাগটাগ তুচ্ছ হয়ে যায়। হয়তো এই নিত্যদিনের জীবনের ছলনাকেই একহাত দেখে নেয়ার সিক্সথসেন্সি ইচ্ছাই লেখার কারণ।

কতোটা লিখবোর হিসাব-কিতাব আমাকে সারাক্ষণই ঘামায়া ফেলে। হূমায়ুন আহমেদের মতো বাজারি হিসেবে লেখার সংখ্যা হিসেব করা পেশাদার লেখকের জন্য ঠিকাছে, আম-পাবলিকের জন্য ঠিক নাই। লেখার জন্য আম-পাবলিককে নির্ভর করতে হয় হৃদয়ের সেনসিটিভিটির ওপর, যেটা আবার লন্ডনী বৃষ্টির মতো এই আসে, এই যায়। শিখার ভালোবাসায় কাঁপা হৃদয়ের সরল দোলক থমকে পড়ে বীথির রিনিঝিনি হাসিতে কিংবা বাজারের ফর্দে অথবা বিসিএস পরীক্ষার জন্য সাধারণ জ্ঞান ফাইটে। যা লেখার এর মধ্যেই লিখে ফেলতে হয় আম-পাবলিককে। দেরি রকলেই লেট হয়ে যায়, দাগ না রেখেই হারায় কথার ফুলগুলো, মালা আর গাঁথা হয় না।

লেখা হয় না, লেখা আর হয় না লেখার কথা চিন্তা করে। লেখা হয় না গুছিয়ে লিখতে গিয়ে। লেখা হয় না রেফারেন্স খুঁজতে গিয়ে। রেফারেন্স খোঁজা তো আর জাকির নায়েকের মতো ব্যবসায় নয় আম-পাবলিকের। কতোটা লিখবো আমি? নাকি সেই হিসাবের গোঁজামিলে লিখবোই না আর?

আমার কথাগুলো একটানে বলে ফেললে কি তাকে আর লেখা বলা হবে না?

রুশ সাহিত্যিকের কোটেশন মুখস্ত না করে, আইরিশ বুদ্ধিজীবীর দর্শন না গিলে, আমেরিকান কোনো এক্স-প্রেসিডেন্টের বাণীর শানে নুযূলসহ ব্যাখ্যা না গিলে রুটিরুজির রিক্সায় প্যাডেল ঠেলার ফাঁকে আমি যদি বলি,

"লিমনকে পঙ্গু বানানোর জন্য সরকার তোমায় আমি ঘৃণা করি।

লাইসেন্সধারী সন্ত্রাসীবাহিনী সৃষ্টি করে তার আকামের সাফাই গাওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আমি তোমাকে ঘৃণা করি।

যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে গড়িমসি করে কোটিকোটি আমার সাথে প্রতারণা করার জন্য সরকার তোমার মায় রে বাপ!"

তাহলে কি সেটা আর ভদ্রসমাজে লেখার মর্যাদা পাবে না?

মর্যাদার খ্যাঁতা পুঁড়ি! আমার লেখক হওয়া লাগবে না। তোমার ছাঁচে ফেলে আমার লেখা লেখা হতে হবে না। আমার চিৎকারের ঘৃণাটা আমি দেবোই। আমার ভালোবাসার কবিতাটা আমি আমার শব্দে লিখবোই।


মন্তব্য

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

চলুক

আপনার সাথে আমিও ভদ্রসমাজের ছাঁচে পড়া মর্যাদার খ্যাতা পুড়ে বলিঃ

লিমনকে পঙ্গু বানানোর জন্য সরকার তোমায় আমি ঘৃণা করি।

লাইসেন্সধারী সন্ত্রাসীবাহিনী সৃষ্টি করে তার আকামের সাফাই গাওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আমি তোমাকে ঘৃণা করি।

যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে গড়িমসি করে কোটিকোটি আমার সাথে প্রতারণা করার জন্য সরকার তোমার মায় রে বাপ!

অপছন্দনীয় এর ছবি

চলুক

ফাহিম হাসান এর ছবি

খ্যাঁতা পুঁড়ি!

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কি লিখবো, কেন লিখবো, কতোটা লিখবো?

এর পরেও আবার জিগায়?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

জাস্টিসকে পপুলার জাস্টিস দিয়ে উৎখাত করার চেষ্টা সব সময়ই ছিলো। এটা বিচারব্যবস্থা নামক প্রতিষ্ঠান ও আইনের শাসন নামক ধারণাটিকে নির্মূল করার জন্য করা হয়। এতে ক্ষমতাবানদের পক্ষে ক্ষমতার ছড়ি ঘোরানো বা শোষণ সহজতর হয়। সাধারণ মানুষকে চট করে পপুলার জাস্টিসের পক্ষে আনা যায়, এর বিপদটা বোঝানো যায় না। এই জন্য রবিনহুড পাবলিকের হিরো হয়। কোন কোন দেশে সামরিক শাসন আসলে রাজনীতিবিদরাও বলে ওঠেন, "আই অ্যাম নট আনহ্যাপি"।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

ব্যাটম্যান, স্পাইডারম্যান এইসব সুপারহিরোরাও তো র‌্যাবের মতোই।

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

লিমনকে পঙ্গু বানানোর জন্য সরকার তোমায় আমি ঘৃণা করি

দ্রোহী এর ছবি

একদিন 'লিখে ফাটিয়ে ফেলব', 'সবার চোখ ট্যারা করে দেব' ভাবতে ভাবতে লেখা হয়ে ওঠে না আর আমার!

পা গেছে যাক, প্রাণে যে বেঁচে গেছে তার শুকরিয়া আদায় করতে করতে বাকি জীবন কেটে যাবে লিমনের।

তিথীডোর এর ছবি

চলুক

লিমনকে পঙ্গু বানানোর জন্য সরকার তোমায় আমি ঘৃণা করি।

শুধুই ঘৃণা।।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

ফ্রুলিক্স.. এর ছবি

লিমনের পা গিয়েছো। জ্বান তো বেঁচে গিয়েছিলো। রাষ্ট্র এখন ওর চৌদ্দগোষ্টি সন্ত্রাসী বানাইছে।

বিডিনিউজের খবরে প্রকাশ, আস্রাফ কইছেন উনি সব মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে। পাবলিক কেনো বিচারে কারো মৃত্যুদন্ড হলে প্রতিবাদ করে না। শুধু র‌্যাব মারলেই চিল্লায়। হাউ চেল্যুকাচ আমার দেশে রাজনীতিবিদ।

বসে বসে খবিতা লেখেন আর ভাবীরে পইড়া শুনান। একপিচ লাউ, মুরকা, তরকারীর ঝুল বেশী দিবো হাসি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

"লিমনকে পঙ্গু বানানোর জন্য সরকার তোমায় আমি ঘৃণা করি

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

স্পর্শ এর ছবি

লেখা হচ্ছে ঝরঝর করে লিখে যাবার বিষয়। নিজের লেখার উপর নিজের 'এক্সপেকটেশন' থাকা ঠিক আছে। কিন্তু সমস্যা হয় যখন কলমের উপর অন্যদের 'এক্সপেকটেশনের' চাপ এসে বসে। তাই সবকিছুকে গুল্লি মেরে লিখে চলাটাই আসল। নিজের জন্য লেখাই শুদ্ধতম লেখা... যতোটা পারা যায়।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

পড়লাম এর ছবি

প্রতি বছরই বুয়েটে কেউ না কেউ ফার্স্ট হয়, কিন্তু আমরা কয়েক দশকে একজনই রাগিব হাসান পাই। যারা দেশ চালাতে পারতো, সরকার চালাতে পারতো, রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে পারতো, তারা প্রায় সবাই দেশকে মধ্যযুগের অন্ধকারে রেখে বিদেশে বাংলাদেশের মুখ উজ্বল করছেন।

সারা বিশ্বেই এখন কর্পোরেটক্র্যাসি আর ধনীতন্ত্রের স্বর্ণযুগ যেভাবে চলছে বাংলাদেশও সেই হাওয়া পালে লাগিয়ে ডিজিটালি এগিয়ে যাচ্ছে।

শুধু আম জনতা দেখতে পাই যে নেতৃত্ব নিয়ে প্রতি পাঁচ বছর পরে শকুন আর হায়েনার নৃশংস কামড়া কামড়ি হয়, যে জিতে সেই আরেকদফা অস্থিমজ্জা চুষে নিজের ভূঁড়ি আরেকটু বাড়ায়।

F-word সর্বত্রই ব্যাবহারযোগ্য হয়ে গেছে এখন।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

লিমনকে পঙ্গু বানানোর জন্য সরকার তোমায় আমি ঘৃণা করি।
লিমনকে সন্ত্রাসী বানানোর অপচেষ্টার জন্য সরকার তোমায় আমি ঘৃণা করি।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

হ! ঘেন্না করি!

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

পাগল মন এর ছবি

কি সহজভাবে কঠিন সত্যি কথাটা বলে ফেললেন।

লিমনকে পঙ্গু বানানোর জন্য সরকার তোমায় আমি ঘৃণা করি

ঘৃণা, ঘৃণা আর শুধুই ঘৃণা।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

তোমার ছাঁচে ফেলে আমার লেখা লেখা হতে হবে না। আমার চিৎকারের ঘৃণাটা আমি দেবোই। আমার ভালোবাসার কবিতাটা আমি আমার শব্দে লিখবোই।

লেখার কোন ছাঁচ নাই, ধাঁচ নাই, তেল নাই, নুন নাই, কেবল ঝালটা থাকা চাই। বাটপাড়িটা সরকারের একচেটিয়া কারবার হয়ে যাচ্ছে যেন।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

আয়নামতি1 এর ছবি

চলুক ,,,,,,,

ওডিন এর ছবি

আমার চিৎকারের ঘৃণাটা আমি দেবোই।

খুব ভাল্লাগলো কথাটা! হাসি

পাঠক এর ছবি

ভাল লাগল।লেখার বিচার বিশ্লেষণ কি ভাবে করে সেই জাতে এখনও উঠি নাই,শুধু বলবো চালিয়ে যান । আপনার গতরে মাংস আছে।শুভ কামনা হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।