আমার রাস্‌তাফারী বন্ধু

ধ্রুব হাসান এর ছবি
লিখেছেন ধ্রুব হাসান (তারিখ: রবি, ১৭/০৮/২০০৮ - ৮:৩৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

Bob with his RastafariBob with his Rastafari

রাতের বেলা ছিলাম পুরা বেসামাল তাই মনে ছিলোনা যে বন্ধুকে কথা দিয়েছিলাম সকালে তাকে তার রাস্‌তা পরিস্কার করতে সাহায্য করবো। কিন্তু সকালে যখন সত্যি সত্যি সে সামনে এসে হাজির হলো হাতের তোয়ালে নিয়ে তার রাস্‌তার উকুন পরিস্কার করতে তখন রিয়্যালাইজ করলাম কি ভুল’টা করেছিলাম! এই সাহায্য আমারে শেষে যে পস্তাবে তা কি ভুল করেও ভেবেছিলাম! যাইহোক, বলে যখন ফেলেছি তবে তো সাহায্য করতেই হয়।

দেবী আমাকে একটা চেয়ারে নিয়ে বসালো, তারপর কোলের উপর তোয়ালে দিয়ে তার সদ্য যৌবন পাওয়া রাস্‌তাফারী’টা মুখের সামনে নামিয়ে আনলো। আমি চোখ বন্ধ করে একবার ঐটার দুর্গন্ধটা নিয়ে নিঃশ্বাসটা ক্ষনিকের জন্য বন্ধ করলাম। ও জানতে চাই, তুমি জানোতো কি করে পরিস্কার করতে হবে? আমি বললাম, হু জানি, শ্যাম্পু যেভাবে করে ওভাবে। ও চিতকার দিয়ে দাড়িঁয়ে গিয়ে বলে, না ওভাবে না। ওভাবে করলে তো আমার রাস্‌তাই খুলে যাবে! শোন, আমি যেভাবে বলি ওরকম করবা। (বিস্তারিত নীচে)

রাস্‌তা পরিস্কারের নিয়ম
প্রথমে গুনে দেখতে হবে মাথায় কয়’টা রাস্তা। তারপর প্রতিটার গোড়াতে দেখতে হবে কোন উকুন লুকিয়ে আছে কিনা। থাকলে ওগুলো ধরে এনে নখের উপর বা শক্ত কিছুর উপর রেখে মারতে হবে। এভাবে সবক’টা মারার পর শ্যাম্পুর মতো একটা লিক্যুয়িড ঢালতে হবে প্রতিটি রাস্‌তার গোড়ায়, পরিমাণ মতো। এভাবে যে’কটা রাস্‌তা আছে সবগুলোর গোড়ায় লিক্যুয়িড ঢালতে হবে। তারপর মাথাটাকে পাতলা প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে, টাওয়াল দিয়ে মুড়ে দিতে হবে।

প্রক্রিয়াটা বলা যত সহজ করাটা ততোই কঠিন। অন্তত আমি করতে পারিনি। একটা রাস্‌তার গোড়া কোনরকম দেখলাম। কিন্তু দ্বিতীয়টা দেখতে গিয়ে আরেকটুর জন্য বমি করে দিয়েছিলাম। আসলে দোষটা ওর মাথা বা রাস্‌তার না, দোষটা আমার চিন্তায়। উকুন শব্দটা আমার ঠিক চিন্তা করতেও সমস্যা হয়। কেমন যেন গা ঘেন ঘেন করে! ছোট বেলায় বাসায় মাঝে মাঝে দেখতাম বাড়ী’র বয়স্ক মহিলারা আর কাজ করতে আসা মহিলা’রা একে অন্যের মাথার উকুন তুলে দিচ্ছে। প্রায় আম্মাকে জিজ্ঞেস করতাম কেন এরা একে অন্যের মাথা চুলকায়! আম্মার খুব মেজাজ খারাপ হতো আমার প্রশ্ন শুনে, উনি উত্তর না দিয়ে নিজের কাজে মন দিতেন। সেই তখন থেকে আমার এই জিনিষের প্রতি একটা না জানা ভয় আর ঘেন্নাভাব কাজ করে। কিন্তু দেবোরা বা দেবীর রাস্‌তা পরিস্কারে নেমে উকুন খুজতে গিয়ে বুঝলাম কতটা অকর্মন্য আমি; আরেকজনের মাথাটাও ঠিকঠাক মতো পরিস্কার করে দিতে জানিনা! যাক, ওর গালা-গাল থেকে বাচঁতে গিয়ে তারে আমি গোটা কয়েক স্যামন, ডিম ভাজা করে খাওয়ালাম। কিন্তু বেটী খায় আর বলে, তুই আমার রাস্‌তাফারী’টা পরিস্কার করে দিলিনা। তার উপর আবার বমিও প্রায় করে দিয়েছিলি! ছি ধ্রুব, এতো প্রাকৃতিক একটা বিষয়ে কেউ এরকম রিয়্যাক্ট করে! আমার তখন বারে বারে দুঃখিত বলা ছাড়া কোন উপায় থাকেনা।

এইবার শোনা যাক তার রাস্‌তাফারী কাহিনী
ক’দিন আগে আমার মূল বন্ধুর সাথে দেবীর ৫ বছরের সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে সে একটু শান্তির খোজেঁ পাড়ী জমায় ল্যাটিন আমেরিকা। প্রায় দেড় মাস পর দেবী ফিরে আসে রাসতাফারী আর গলায় প্রচুর মালা নিয়ে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কি ব্যাপার ঘটনা কি? ও জানায় এই রাস্‌তা অনেক প্রবিত্র, আর জীবনে পাচামামা’র জন্য কিছু তো করতেই হয়! আমি তো উওর শুনে আকাশ থেকে পড়লাম, কি বলে এই মেয়ে এসব! তার কাছ থেকে আরো জানতে পারি, আর্জেন্টিনা গিয়ে সে সত্যিকারের মানুষের দেখা পেয়েছে। বৃটেনের মানুষ মরে গেছে, এরা যাষ্ট মানুষ নামের যন্ত্র/রবোট। কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকায় এখনো মানুষ বাস করে, প্রকৃত রক্ত-মাংষের মানুষ! ওখানে মানুষের সময়ের প্রচুর বিরতি আছে! ঐসব দেশের মানুষ আড্ডাবাজ, প্রাণভরে হাসে, নাচেঁ প্রাণ ভরে, হাটে প্রচুর! এককথায় আমাদের মানুষের ধারণার সাথে এরা যায়। আমি ওরে বুঝতে শুরু করলাম। ও যখন আর্জেন্টিনা আর আর্জেন্টাইন মানুষের গল্প করে তখন আমার কেবলি মনে পড়ে আমাদের ভারতবর্ষের মানুষের কথা, প্রাণ প্রাচুর্যময় মানুষগুলোর মুখ! ওরে আমার দেখা মানুষের সাথে ওর দেখা মানুষের মিলের কথা বললে ও ভীষন খুশি হয়ে লাফাতে থাকে। কিন্তু পরক্ষনেই চেহারা পাল্টিয়ে ভ্রু কুচঁকিয়ে আমাকে খোচাঁ দিয়ে বলে, তুমি কিন্তু একদম ওরকম না; এক্কেবারে কেপিটালিষ্ট শয়তানগুলার মতো তুমি! এদিকে আমার ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে মারা যাওয়া অবস্থা! হো হো হো হো হো হো

সো, আমার ল্যাটিন আমেরিকা ফেরত বন্ধু এখন Rastafari movement – এর একজন সদস্য বনে গেছে। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ হাস্যকর ঠেকলেও ওর লজিক’টা বুঝি। এরকম নিরবিচ্ছিন্ন প্রতিযোগীতায় মত্ত বিশ্বে আসলেই মানুষ নামক আইডিয়া নিয়ে বেচেঁ থাকাটা বেশ কষ্টকর! হতাশা আর নিঃসঙ্গতার ছায়া সবসময় কোন না কোনভাবে ঘীরে রাখে চারপাশ। এই হতাশা থেকে মুক্তি পেতে কেউ কেউ ছুটে যান রুগ্ন পুজিঁবাদী দেশগুলোতে, আশার খোঁজে। প্রথম কয়েক মাস বা বছর আশা আলো ছুয়ে দেখার প্রচুর সুযোগ মেলে। কিন্তু মাস বা বছর ঘুরতে ঘুরতে সেই আশার মুখ মলিন হতে শুরু করে এবং একসময় বোধদয় ঘটে যে, পৃথিবীর এমন কোন স্থান নেই যেখানে পুজিঁর পায়ের ছাপ পড়েনি! আপাত দৃষ্টিতে এই আছড় বেশ হালকা মনে হলেও ওসব রুগ্ন পুজিঁর দেশে পুজিঁর শক্তিটা অনেক নির্লজ্জরকম ভয়াবহ! তখন আরো দ্বি-গুন পরিমাণ হতাশা তাকে আবারো গ্রাস করতে শুরু করে এবং সে জীবনের যোগ-বিয়োগে বসে খাতা কলম নিয়ে! এবং যথারীতি একসময় আবারো সবল পুজিঁর দেশে অনেকের প্রত্যাবর্তন ঘটে। এরপরও কথা থেকে যায়......যে কোন প্রাণীই প্রাণের স্বাদ পেতে চাই আজীবন; অবসরে অন্যসব কাজের চিন্তা বাদ দিয়ে বৃষ্টি ছুতে চাই কেউ কেউ! যদিও জীবন হয়তো শূণ্য থেকে শুরু করে আবারও শূন্যতেই ফিরে আসা! বৃত্তের ব্যসের পরিবর্তন হয় কেবল, বৃত্ত ভাংগাই হয়তো অসম্ভব!

(নীচে ঝুরে দেওয়া হলো সেক্স পিস্তল নামে এক সংগীত দলের গান, যে তারুণ্যের ভরা যৌবনে আমাকে বৃত্তের ব্যাসার্ধে বাস করেও মুক্তির স্বাদ পেতে শিখিয়েছিলো।)


মন্তব্য

রণদীপম বসু এর ছবি

ওখানে মানুষের সময়ের প্রচুর বিরতি আছে! ঐসব দেশের মানুষ আড্ডাবাজ, প্রাণভরে হাসে, নাচেঁ প্রাণ ভরে, হাটে প্রচুর! এককথায় আমাদের মানুষের ধারণার সাথে এরা যায়। আমি ওরে বুঝতে শুরু করলাম। ও যখন আর্জেন্টিনা আর আর্জেন্টাইন মানুষের গল্প করে তখন আমার কেবলি মনে পড়ে আমাদের ভারতবর্ষের মানুষের কথা, প্রাণ প্রাচুর্যময় মানুষগুলোর মুখ! ওরে আমার দেখা মানুষের সাথে ওর দেখা মানুষের মিলের কথা বললে ও ভীষন খুশি হয়ে লাফাতে থাকে।

আসলে কি বিরতি আছে আমাদের ? কাজ নাই বলে বেকার থাকা ! বেকার আর বিরতি কি এক ?

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

ধ্রুব হাসান এর ছবি

আরে ভাইজান আমি কাজ র বিরতি কি বুঝেই লিখেছি। আমাদের ওদিকের মানুষজন এখনো হাড়ভাঙ্গা খাটুনি দিয়ে এসে এখনো আড্ডা দিতে ভালোবাসে, একে অন্যের কুশল জানতে ভালবাসে। আমি আসলে জীবনের এই দিকটি নিয়ে কথা বলছিলাম; এই কুশল বিনিময়, আড্ডাবাজী একভাবে এক প্রাণ আরেক প্রাণকে ছুতে চেষ্টা করে। অর্থনীতির সমস্যাকে মোটা দাগে টানিনি ঐখানে।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

বাইরে এসে টের পাই, এতো দুঃসময় সয়ে ও আমাদের মানুষেরা এখনো অনেক প্রানবন্ত ।
আমাদের সাথে ল্যাটিন এবং হিস্পানিজদের আসলেই বেশ মিল আছে ।
-------------------------------------
"এমন রীতি ও আছে নিষেধ,নির্দেশ ও আদেশের বেলায়-
যারা ভয় পায়না, তাদের প্রতি প্রযোজ্য নয় "

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

দেবোত্তম দাশ এর ছবি

একদম ঠিক, আমার মনে আছে দেশে থাকতে, রোজ হাড়ভাঙ্গা খাটুনি দিয়ে এসে যতই রাত হোক না কেন আড্ডা দিতে ঠিকই যেতাম । আর এখানে ? বলতে ইছে হছে না ।
------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।